আমি কি ভূত দেখলাম?
নাতাশা তো মারা গেছে।
কিন্তু নাতাশার কাছ থেকে ম্যাসেঞ্জারে নক এসেছে। নাতাশার আইডি মায়াবতী নীলকণ্ঠীর চ্যাট বাবল জ্বলজ্বল করছে।
চোখ কচলে সজল আবার ভালো করে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকায়।
নাহ, ঠিকই তো দেখছি।
কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব?
নাতাশা মারা গেছে প্রায় এক বছর হতে চলল। সামনের সপ্তাহে ওর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী!
তাহলে ম্যাসেজ দিচ্ছে কে?
সজল ম্যাসেঞ্জারের চ্যাট বাবল এ ক্লিক করে। কোনো টেক্সট ম্যাসেজ নয়। একটা হ্যান্ড ওয়েভ এসেছে। মৃত্যুর এক বছর পর নাতাশা তাকে ম্যাসেঞ্জারে হ্যান্ড ওয়েভ পাঠিয়েছে!
সজল বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। আঙুলগুলো যেন বহুদিনের অভ্যাসের বসেই নিজে থেকে ফিরতি হ্যান্ড ওয়েভ পাঠিয়ে দিল। ম্যাসেঞ্জারের পর্দায় লিখা উঠেছে—You and Mayaboti waved at each other.
কিছু একটা লিখছে নাতাশা। পর্দায় টাইপিং-এর অ্যানিমেশন ফুটে উঠেছে। হচ্ছেটা কি?
—কী করো?
নাতাশা প্রশ্ন করেছে। জানতে চাইছে কী করছি? সজল কাঁপা কাঁপা হাতে লিখল, Who are you?
উত্তরে পর্দায় বাংলা হরফে ভেসে উঠল, মানে কী? ফাইজলামি করো?
জবাবে সজল লিখল, Who is this?
—আমি নাতাশা . . . তোমার কী মনে হয়?
—This is not funny . . . Who the fuck are you?
—গালাগালি করতেসো কেন? আজব? কথা বলতে না চাইলে বলবা না, এইসব ঢং করার মানে কী?
সজল তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে। কী ঘটছে এইসব? আসলেই কি নাতাশা টাইপ করছে? ধুর কি ভাবছি আমি। নাতাশার লাশ এত দিনে পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেছে। আমি নিজে ওর জানাযায় উপস্থিত ছিলাম। তাহলে এটা কে?
নিশ্চয়ই কোনো হ্যাকার। নাতাশার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে। এখন সেই আইডি থেকে বাকিদের সাথে মজা করছে। মানুষ কতটা সিক হয়!
কিন্তু নাতাশার ফেসবুক আইডি মায়াবতী নীলকণ্ঠী তো আমরা বন্ধুরা অনেক আগেই রিপোর্ট করে বন্ধ করে দিয়েছি। ডিসিসড অ্যাকাউন্ট কি হ্যাক করা সম্ভব? ফেসবুকে তো বলা আছে এই অ্যাকাউন্টগুলা ডিলিট করে দেয়া হয়।
জাকারবার্গ হারামজাদা কি তাহলে সবাইকে মিথ্যে বলে বেড়াচ্ছে? হতেই পারে। আসলে হয়তো অনলাইন থেকে কোনো ইনফরমেশন কখনো পার্মানেন্টলি ডিলিট করা সম্ভব না।
যেটাই হোক, এইটা যে একটা হ্যাকড অ্যাকাউন্ট সেই সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। আর একটা অসভ্য হ্যাকারের সাথে, যে কিনা একটা মৃত মানুষের আইডি নিয়ে ফাইজলামি করতে পারে, এমন মানুষের সাথে ভদ্র আচরণ করতে সজল বাধ্য নয়।
মোবাইলের ওপরে সজলের বুড়ো আঙুল দুটো তুফানের মতো ছুটাছুটি শুরু করে দিল। খা . . . পোলা, ফাইজলামি করার জায়গা পাস না . . . শুয়োরের বাচ্চা, একটা মরা মানুষের আইডি নিয়া ফাইজলামি চু . . . তোরে হাতের কাছে পাইলে কুত্তার মতো . . . কে তুই সাহস থাকলে পরিচয় দে . . .।
ওই পাশ থেকে অনেকক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ নেই। হ্যাকার হারামিটা কি ভয় পেয়ে গেছে? সজলের মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। গালি দিয়ে শান্তি হচ্ছে না। ইচ্ছা করছে বদমাইশটার মাথা ভেঙে ফেলে। এই ইতরটার পরিচয় তাকে জানতেই হবে। ওই পাশ থেকে আবার কিছু একটা টাইপ হচ্ছে। দেখি কুত্তাটা কী লিখে।
—সজল, তুমি এমন করছ কেন? আমার ভয় লাগছে।
আহা, ন্যাকা। হারামির বাচ্চা এখন মেয়েদের মতো আহ্লাদ করতে আসছে। সজল আবার জঘন্য কিছু গালি টাইপ করতে গেল, তার আগেই মায়াবতী নীলকণ্ঠী অফলাইনে চলে গেল। সজল দ্রুত নাতাশার নামে সার্চ করে ওর অ্যাকাউন্টে গিয়ে দেখল কই না তো, স্ট্যাটাস এখনো ডিসিসড দেখাচ্ছে। হ্যাকারটা অফলাইনে যাওয়ার আগে অ্যাকাউন্ট আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।
রাগের চোটে সজলের হাত পা কিড়মিড় করছে। আর কিছু না পেয়ে মোবাইলটাকেই আছাড় মারল সে। না মেঝেতে না, বিছানার উপর। এতো মাথা খারাপ হয়ে যায় নাই যে ত্রিশ হাজার টাকা দামের ওয়ানপ্লাস মেঝেতে আছাড় দিবে।
ওরা সবাই খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল। ওরা মানে সজল, নাতাশা, নাজিম, মৌমিতা আর সৌরভ। পাঁচ জন সব সময় একসাথে। নাতাশা বলতে গেলে ওদের আড্ডার মধ্যমণি ছিল। নিজে খুব একটা ভালো গল্প বলতে পারত না। কিন্তু খুব হাসতে পারত।
ওর হাসি ছিল জগদ্বিখ্যাত। ওরা সবাই চেষ্টা করত কে কার থেকে বেশি মজার কিছু বলে ওকে হাসাতে পারে। হাসতে হাসতে হেচকি তুলে কেঁদে ফেলার একাধিক রেকর্ড আছে নাতাশার।
এমন হাসিখুশি মেয়েটা একদিন সুইসাইড করে মরে গেল। কেন কী হলো কেউ কিছুই বলতে পারে না। যেহেতু আত্মহত্যায় মৃত কারো জানাযা করা যায় না, তাই নাতাশার বাবা মা ওর মৃত্যুর কারণ সবাই জেনে যাবার আগেই খুব তাড়াহুড়ো করে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।
নাতাশা যে সত্যি মরে গেছে সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করার আগেই মেয়েটা সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে চলে গেল।
বাংলাদেশে মেয়ে মানুষ সুইসাইড করলে তাকে নিয়ে নানা রকম কথা ছড়ায়। নাতাশাকে নিয়েও আজেবাজে অনেক কিছু প্রচার হতে শুরু করল। সর্বশক্তি দিয়ে সেসবের প্রতিবাদ করল ওর বন্ধুরা।
তারপর আস্তে আস্তে সবার আগ্রহ কমে আসতে লাগল একসময়। ওর বন্ধুরাও ওকে একসময় ভুলে যেতে শুরু করল। না একেবারে ভুলে যায়নি কেউই, মাঝে মাঝে ঠিকই মনে পড়ে। কিন্তু প্রাত্যহিক নানা রকম ঝামেলায় ওর নামটা আর সেভাবে উচ্চারিত হয় না।
কিন্তু এক বছর পর নাতাশা আবার ফিরে এসেছে! অথবা বলা যায় তার আইডি মায়াবতী নীলকণ্ঠী ফিরে এসেছে।
সজল কী করবে বুঝতে না পেরে শেষমেশ সৌরভকে ফোন দিল। সৌরভ আইটির ছাত্র। নেটওয়ার্কের ব্যাপারস্যাপার ভালো বুঝে। হ্যাকারটাকে ধাওয়া করে ধরতে হলে ওর সাহায্য লাগবে।
রিং হচ্ছে, শালা ধরছে না। মরসে নাকি?
তিনবার রিং কেটে যাবার পর চতুর্থবার নবাবজাদার ফোন ধরার মর্জি হলো। ওপাশ থেকে হ্যালোর উত্তরে খাঁটি বাংলা একটা গালি দিয়ে সজল বলল, 'শালা কই বা— ফালাইতাসিলি, কতবার কল দিসি জানিস?'
'কী হইসে বল।' সৌরভের কন্ঠ নিরাসক্ত। শুনে সজলের পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু সৌরভের ওপর রাগ ঝাড়তে তো সে কল দেয়নি। তাই রাগ চেপে বলল, 'আরে বিশ্বাস করবি না। নাতাশার আইডি থেকে কে যেন আমারে নক দিসে।'
'মানে কি?' সৌরভের নিরাসক্ত গলায় কিঞ্চিৎ উত্তাপ দেখা গেল। 'নাতাশার আইডি থেকে কে নক দিবে?'
'আমি কী জানি? নক দিয়া জিগায় কী করো। আমি তো আকাশ থেইকা পড়সি।'
'তুই কি মজা নিতাছস আমার লগে? নাতাশার আইডি থেকে নক দিবে ক্যামনে? নাতাশা তো ডেড। ওর অ্যাকাউন্ট না আমরা ডিলিট করে দিলাম?' সৌরভের গলার উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে।
'আমারও তো সেইটাই প্রশ্ন। কেউ নিশ্চয়ই ওর অ্যাকাউন্ট হ্যাক করসে।'
'ডিসিসড অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ক্যামনে। কি কথাবার্তা হইসে আমারে স্ক্রিনশট নিয়া পাঠা।'
সজল লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল থেকে স্ক্রিনশট নিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। নাতাশার কোনো ম্যাসেজ নেই। সজলের পাঠানো টেক্সটগুলো ঠিকই শো করছে, কিন্তু মাঝখান থেকে নাতাশার টেক্সটগুলো গায়েব।
ম্যাসেঞ্জার একি ভূতুড়ে আচরণ শুরু করেছে? একবার সেন্ড করা ম্যাসেজ কি পরে ডিলিট করে দেয়া সম্ভব? সজলের হাত পা কাঁপছে। সৌরভকে এখন কী উত্তর দিবে? শালা ঠিক ধরে নিবে সজল মজা নিসে ওর সাথে। হ্যাকারটা আবার যদি নক দেয় এরপর স্ক্রিন রেকর্ড করে রাখতে হবে। সৌরভ বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়।
পরের দিনই নীলকণ্ঠী থেকে আবার নক, সজল কোথায় আছ?
এবার আর সজল কোনো ভুল করে না। প্রথম থেকেই স্ক্রিনশট নেয়া শুরু করে। আর হ্যাকারের সাথে আলাপচারিতা চালিয়ে যায়। আজকে গালিগালাজ না করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। যেন হ্যাকার নয়, কথা হচ্ছে নাতাশার সাথেই। আর প্রতি সেকেন্ডে একটা করে স্ক্রিনশট। শালা আজকে পালিয়ে যাবি কোথায়। আজকে ঠিকই তোর সব জারিজুরি ফাঁস করে ছাড়ব। সজল মনে মনে হা হা করে হেসে ওঠে।
দেখ দেখ শালার হ্যাকারটা কেমন মেয়েদের মতো ন্যাকামি করছে। ওর নাকি আজকে মন খারাপ। আকাশের রঙ দেখে নাকি তার মন উদাস হয়ে গেসে। নাতাশাও এভাবে কথা বলত। আকাশ দেখে প্রায়ই তার মন খারাপ হয়ে যেত। হ্যাকার এটা জানল কী করে? নিশ্চয়ই নাতাশার পোস্ট চ্যাট হিস্টোরি পড়েছে। কুত্তার বাচ্চা। দাঁড়া তোরে এমন শিক্ষা দিবো . . .।
নাতাশা একটা বিড়াল পুষতে চায়। এই ব্যাপারে সজলের মতামত চাইছে। সজল বিড়ালটার আব্বু হতে রাজি আছে কিনা জানতে চায়।
শালা কি এখন ইশারায় ফ্লার্ট করছে নাকি সজলের সাথে? নাহ, আর নিতে পারছে না সজল। একটা মরা মানুষের আইডি হ্যাক করে এমন ইতরামি করা, এইটা কোন লেভেলের সিকনেস??
নাতাশার সাথে চ্যাট অফ করে দিয়ে সৌরভের চ্যাট বাবল খুলল সজল। দ্যাখ আজকে একডজন স্ক্রিনশট আছে, কত প্রমাণ চাই তোর, দ্যাখ। সজল ফালতু কথার মানুষ না। দ্যাখ।
কিন্তু কই? পিকচার এড করতে গিয়ে সজল দেখে একটা স্ক্রিনশটও নেই। মানে কি? সজল পাগলের মতো তার মোবাইলের আনাচে কানাচে তন্ন তন্ন করে খুঁজে। আর সব পিকচার আছে। ঘুরতে গিয়েছিল সেই পিকচার আছে। নাজিমের পাঠানো ছ্যাবলামি মার্কা মিমের পিকচার আছে। সানি লিওনি’র অনাবৃত উন্নত বক্ষের ছবি আছে। শুধু মায়াবতী নীলকণ্ঠীর সাথে চ্যাটের স্ক্রিনশটগুলা নাই। এবং সজল চ্যাট হিস্ট্রিতে গিয়ে দেখল আগের বারের মতোই চ্যাটে তাদের ম্যাসেজগুলাও নাই।
স-ব মুছে গেছে।
সজল হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর কী মনে করে ম্যাসেঞ্জারে মায়াবতীকে কল দিল।
ওই পাশে রিং হচ্ছে।
রিং হচ্ছে . . . হচ্ছে . . .।
খুট করে কেউ একজন কল রিসিভ করল।
সজল কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, 'কে? নাতাশা?'
ওপাশ থেকে টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেবার শব্দ আসছে। কিন্তু কেউ কথা বলছে না।
'কে আছ কথা বল?' সজল ব্যাকুল হয়ে বলে।
'সজল . . . ,' নাতাশার কন্ঠ!
বহু দিনের পরিচিত গলার স্বর। ভুল হবার উপায় নেই। সজলের শিঁরদাড়া বেয়ে একটা হিম শীতল স্রোত নেমে যায়। কিন্তু কন্ঠটা যেন কী রকম। মনে হয় সরাসরি মানুষের মুখ থেকে নয়, কেউ যেন টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিয়েছে।
'নাতাশা প্লিজ কথা বল। তুই কোথায়?'
'আমি জানি না,' আবার নাতাশার কণ্ঠ। টেপরেকর্ডারের ভেতর থেকে।
সজল ভিডিও চ্যাট ওপেন করে। নাতাশার ভিডিও দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা স্ক্রিনভর্তি ঝিরঝির। অসংখ্য খুদে পোকা যেন কিলবিল করছে মোবাইলের পর্দা জুড়ে।
সজল শিউরে উঠে কানেকশান কেটে দেয়। ইন্টারনেট অফ করে ফোন রেখে দেয় বালিশের নিচে। ফোনের দিকে তাকাতেও তার ভয় লাগছে।
পরেরদিন ক্লাস শেষ করে ফোন থেকে ফেসবুকে কানেক্ট করে সজলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। নাতাশার ম্যাসেজ। কিন্তু তার চেয়েও অদ্ভূত বিষয়, সজলের আইডি রুডলফায থেকে সেই ম্যাসেজের উত্তর দেয়া হয়েছে। একটা দুটো ম্যাসেজ নয়। দীর্ঘ আলাপ। প্রায় কয়েক হাজার শব্দ। ঘণ্টাখানেক ধরে চ্যাটিং হয়েছে।
কিন্তু সজল তো গত কয়েক ঘণ্টায় ফেসবুকে লগ ইন করেনি। তাহলে চ্যাট করল কে? এর উত্তর একটাই। সজলের রুডলফায আইডি হ্যাক হয়েছে। হয়তো সেই একই হ্যাকারের কাজ। সজলের অনুপস্থিতিতে তার আইডি হ্যাক করে প্রেম করছে।
কিন্তু নিজেই কেন নিজের সাথে প্রেম করবে? তাহলে কি অন্য কেউ? সজলের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এইগুলা এক্ষুনি সৌরভকে দেখাতে হবে। চটপট স্ক্রিনশট নিয়ে রাখতে হবে।
সজল চ্যাটগুলো পড়তে পড়তে একটু কেমন যেন হয়ে যায়।
নাতাশাকে সে যে কথাগুলো বলতে চাইত, রুডলফায সেই কথাগুলোই বলেছে মায়াবতী নীলকণ্ঠীকে। রুডলফায বলেছে ওর স্বপ্নের কথা, ওর ভালো লাগার কথা, নাতাশার সাথে ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলোর কথা। কোনো হ্যাকারের তো এসব জানার কথা নয়।
আর মায়াবতী তার কথায় সাড়া দিয়েছে। রুডলফাযের সাথে সে হেসেছে, আবেগে আপ্লুত হয়েছে। সজল যে কাজটা কখনো করতে পারেনি রুডলফায তাই করে দেখিয়েছে। ওই যে ওগুলো তো সজলেরই লাইন। আর কথার উত্তরগুলো যেন নাতাশার মুখ থেকেই এসেছে।
তবে কি কোনো হ্যাকার নেই? তবে কি ওটা সত্যি নাতাশা? কবরের ভেতর থেকে সে যোগাযোগ করেছে সজলের সাথে? তাহলে সজলের হয়ে প্রত্যুত্তর কে দিল? সে নিজেই? এমন কি হতে পারে সে চ্যাট করে পরে ভুলে গেছে?
সে হয়তো কোনো ভয়ংকর মানসিক রোগে ভুগছে। কিছুক্ষণ আগের কথা মনে থাকছে না। কিন্তু সে তো ক্লাসে ছিল। ক্লাসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট করলে কি স্যার বা ক্লাসমেটরা দেখতে পেত না? কিন্তু কেউ কিছু বলেনি কেন?
কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সজল মুখ তুলে তাকায়।
আশেপাশের সবাই যে যার মতো বাড়ি ফিরছে। তাদের প্রায় সবার চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হাতে ধরা সেলফোনের স্ক্রিনে। তাদের সব মনোযোগ ওই ছোট্ট পর্দাটার ভেতর আবদ্ধ। আশেপাশে কি হচ্ছে কেউ দেখছে না। কেউ যেন সজলকে দেখতে পাচ্ছে না। সজল যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একা দাঁড়িয়ে আছে, যেই দ্বীপে কারো প্রবেশাধিকার নেই।
সজল বাড়ি ফিরে কম্পিউটার খুলে বসে। হ্যাকিং হোক আর যা-ই হোক, সে দেখতে চায় তার রুডলফায আইডি থেকে নীলকণ্ঠীর সাথে আর কোনো অ্যাক্টিভিটি হয় কি না। মা এসে খাওয়ার জন্যে ডেকে যায়। সজল সাড়া দেয় না। আজ সে দেখেই ছাড়বে। কিন্তু নাতাশার কোনো খবর নেই। সজলের আইডি থেকেও কিছু হচ্ছে না।
স্ক্রিনের দিকে টানা তাকিয়ে থেকে সজলের চোখ জ্বালা করছে। চেয়ারে দির্ঘ সময় বসে থেকে পিঠটাও টনটন করছে। বিছানায় একটু পিঠটা না লাগালেই নয়। ল্যাপটপের ডালা নামিয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে ফোনটা হাতে নিতেই সজলের চোখ ছানাবড়া।
নাতাশার ম্যাসেজ। আর সজল তার জবাবও দিয়েছে। দুইজনের লম্বা কনভারসেশন হয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। কিন্তু সজল তো এতক্ষণ ল্যাপটপের সামনেই ছিল সে তো কিবোর্ড ছুঁয়েও দেখেনি। এতো চ্যাটিং করল কখন? তাহলে কি সত্যি কোনো মানসিক অসুখে ভুগছে সে? আর নাতাশা?
সজল ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিল। নিজের ঘর থেকেই খুব একটা বের হয় না। তাকে তার বন্ধুবান্ধবরা ফোন দেয়, সে রিসিভ করে না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে চুপচাপ ল্যাপটপের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ছেলের অদ্ভূত আচরণ তার মাকে ক্রমেই চিন্তিত করে তুলে। ছেলেকে তিনি প্রথমে শান্ত ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেন। বারবার জিজ্ঞেস করেন সজলের কী হয়েছে। ছেলে কোনো কথার উত্তর দেয় না।
এক সময় রেগে গিয়ে তিনি ছেলেকে বকাবকি করেন। সজল কেমন অদ্ভূত চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখ দেখে তার মা শিউরে উঠেন। ছেলে কি প্রেম করে ছ্যাকা খেয়েছে? নাকি ড্রাগ ফ্রাগ কিছু ধরেছে? নাহ, ছেলেকে খুব শিগগিরি ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে হবে।
রুডলফাযের সাথে মায়াবতী নীলকণ্ঠীর আলাপচারিতা এগিয়ে যায়। রুডলফায মায়াবতীর ওয়ালে গিয়ে নিজের ছবি পোস্ট করে। সাথে এক দুইটা কবিতার লাইন। সজল জানে না এই ছবি সে কখন তুলেছে। তবে কবিতার লাইনগুলো সজলের নিজেরই লেখা। অনেক আগে নাতাশাকে কল্পনা করে এই কবিতা সে লিখেছিল। কখনো কাউকে দেখায়নি। আজ সেই কবিতা নীলকণ্ঠীর ফেসবুকে ওয়ালে জ্বলজ্বল করছে, নীলকণ্ঠী তাতে লাভ রিয়েক্ট দিয়েছে।
সজল এখন আর রাতে ঘুমায় না। সারা রাত তাকিয়ে থাকে নিজের অ্যাকাউন্টের দিকে। তার চোখের সামনে কোনো অ্যাক্টিভিটি হয় না, চোখটা এক সেকেন্ডের জন্যে লেগে এলেই সজল আবিষ্কার করে দুই আইডির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাক্টিভিটি। রুডলফায আর মায়াবতী চুটিয়ে প্রেম করছে।
সজলের সময়ের হিসেব গুলিয়ে যায়। কোন দিক দিয়ে দিন যায়, কোন দিক দিয়ে রাত আসে সে আর বলতে পারবে না। তার জগত আটকে গেছে ফোন আর ল্যাপটপের পর্দায়। সে এখন বিশ্বাস করে নাতাশা ফিরে এসেছে। হয়তো রক্ত-মাংসের নাতাশা নয়, হয়তো নাতাশার আত্মা। কিন্তু সে ফিরে এসেছে। এই নাতাশা ভালোবাসে রুডলফাযকে।
গত চব্বিশ ঘণ্টা সজল নিজেকে নিজের ঘরে আটকে রেখেছে। একটা বারের জন্যে ঘর থেকে বের হয়নি। কাউকে ঘরে ঢুকতেও দেয়নি। মোবাইল ফোন অফ করে ডেস্কে তালা চাবি মেরে রেখেছে। এই পুরো সময়টা সে নিজেকে ভিডিও করেছে একটা ডিজিটাল ক্যামকর্ডারে।
সজল ঘড়ি দেখল, চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়েছে। একবার ফেসবুক চেক করে নিল। হ্যাঁ, রুডলফায আর মায়াবতীর প্রেমলীলা অব্যাহত আছে। যদিও বরাবরের মতো সজলের কিছুই মনে নেই। কাঁপাকাঁপা হাতে সে ক্যামকর্ডার হাতে তুলে নেয়। এক্ষুনি সব প্রমাণ হয়ে যাবে। সত্যিই কি সে পাগল, নাকি সমস্যা অন্য কিছু।
চব্বিশ ঘণ্টার ভিডিও, ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে টেনে টেনে দেখে সজল। ভিডিও তে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে গত চব্বিশ ঘণ্টায় সে একবারেও কম্পিউটারের কি-বোর্ড ছুঁয়ে দেখেনি, এমনকি মোবাইল ফোনটাও হাতে নেয়নি। তার মানে সে অসুস্থ নয়। সে কিছু কল্পনা করছে না।
কিন্তু . . . কিন্তু . . . তার মানে সে যে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা ভেবে রেখেছিল সেটাই কি সত্যি? কোনো হ্যাকারের পক্ষে ঠিক সজলের মতো করে অ্যাকাউন্ট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ওই রুডলফায অ্যাকাউন্ট এমন অনেক কিছু জানে যা সজল কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেনি। তাহলে কী . . . তাহলে কী তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কোনো ভাবে জ্যান্ত হয়ে গেছে? তার অ্যাকাউন্ট কী এখন আস্তে আস্তে তাকে সরিয়ে দিয়ে তার জীবনটা দখল করে দিতে চাইছে?
সজলের মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হয়। অন্ধ আতঙ্কে সে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেয়। এক মুহূর্তের জন্যে একটা শান্তির শীতল ভাব তাকে ঘিরে ধরে। যাক, ঝামেলা শেষ। রুডলফাযের কাহিনী এখানেই সমাপ্ত। কিন্তু পর মুহূর্তেই তার আত্মা কেঁপে উঠে। নাতাশাকে তো তাহলে চিরকালের জন্যে হারাতে হবে। সে কি দ্বিতীয়বার নাতাশাকে খুন করে ফেলল? না না। নাতাশাকে সে আর হারাতে পারবে না। একবার যখন তাকে এত আপন করে পাওয়া গেছে, হোক সে রক্তমাংসের নয়, হোক সে মোবাইলের পর্দায় বন্দি ছোট্ট একটা চ্যাট বক্স, কিন্তু এটাই সত্যিকারের নাতাশা। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। নাতাশাকে দ্বিতীয়বারের মতো হারালে সে সত্যি পাগল হয়ে যাবে।
সজল তড়িঘড়ি করে আবার ফেসবুক ওপেন করে। না, তার অ্যাকাউন্ট ডিলিট হয়নি, অ্যাকাউন্ট আছে। শুধু আছে তা-ই নয়, মায়াবতীর সাথে কথাও বলছে। রুডলফায বলছে কীভাবে একটু আগে সজল তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কীভাবে অল্পের জন্যে সে এইযাত্রা বেঁচে গেছে। মায়াবতীর কন্ঠে সজলের প্রতি ঘৃণা ঝরে পড়ে। রুডলফায বলে সজল যদি আর কখনো এমন কোনো চেষ্টা করে তবে সে সজলকে খুন করে ফেলবে। কেউ তাকে মায়াবতীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। কেউ না।
সজল হেসে উঠে। সে নিজেই নিজেকে খুন করার হুমকি দিয়েছে। নাকি রুডলফায অন্য কেউ? তার ভেতরে গড়ে ওঠা আরেকটি সত্তা? একই শরীরে দুইটি মানুষ? হবে হয়তো। তাতে কিছু এসে যায় না।
সজলের অসুস্থ চোখে এক সময় ঘুম অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু ঘুম তাকে অশান্তি থেকে মুক্তি দেয় না। ঘুম ডেকে আনে স্বপ্ন। স্বপ্নে দেখা দেয় নাতাশা। সজলের স্বপ্নের নাতাশা। স্বপ্নে সে যেভাবে নাতাশাকে পেতে চাইত, ঠিক সেই ভাবে। নাতাশা পড়নে কড়া লাল রঙের শাড়ি। ঠোঁটে লাল টুকটুক লিপস্টিক। দুইহাত ভর্তি কাচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ হচ্ছে। ঘন কালো অবাধ্য চুলগুলো খুলে দিয়েছে, তাতে সমুদ্রের মতো ঢেউ উঠছে। নাতাশার চোখে মদির আহ্বান। সজলকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে সে তার গহীন কালো চুলের চাদরে ঢেকে দেয়। নাতাশার উত্তপ্ত ঠোঁট জোড়া সজলের রুক্ষ তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের ভাঁজে গলে যায় মোমের মতো। নাতাশার শরীরের আনাচে কানাচে সজলের অসভ্য হাতের অবাধ বিচরণ। সজল নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, প্রবাহিত হয় বাঁধ ভাঙা নদীর মতো।
নাতাশা বলে, 'তুমি কি চাও না আমার হতে? সারা জীবন ঠিক এমন করে আমার সাথে থাকতে? চাও না আমাকে কাছে পেতে?'
'চাই,' সজল উত্তর দেয়।
'আমি তোমাকে ভালোবাসি সজল।'
'আমিও তোমাকে ভালোবাসি। অনেক অনেক ভালোবাসি।'
ইলেকট্রিক শকের মতো প্রচণ্ড ধাক্কায় সজল জেগে উঠে। চোখ বড়বড় করে সে চারপাশে তাকায়। ওর শখের ওয়ান প্লাস মোবাইলটা মেঝেতে ভেঙে দুই টুকরো হয়ে পরে আছে। সজল কেয়ার করে না। তার মুখে একটা অদ্ভূত হাসি ফুটে উঠেছে।
সজল কিডন্যাপ করেছে মৌমিতাকে।
কিডন্যাপ ঠিক বলা যায় না। জরুরি তলব করে বাসায় ডেকে এনেছে। ডাকার সময় নিশ্চিত করেছে মৌমিতা যেন একা থাকে। আর তার বাসাও যেন খালি থাকে। সজলের ডাক পেয়ে অবাক হলেও মৌমিতা কিছু সন্দেহ করেনি। বাসার দরজা পেরুনোর সাথে সাথে মাথায় পেছনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মৌমিতা জ্ঞান হারিয়েছে।
জ্ঞান ফেরার পর মৌমিতা নিজেকে সজলের বেডরুমে আবিষ্কার করে। সে বসে আছে সজলের আর্ম চেয়ারে, হাত পা চেয়ারের সাথে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। মাথায় একটা হেডফোন পরানো। সজল ওর সামনে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে।
মৌমিতা অনেক কষ্টে গলায় স্বর ফুটিয়ে বলে, 'সজল। এই সব কী!'
'সজল না। আমার নাম রুডলফায,' সজল হাসি মুখে জবাব দেয়।
'এইগুলা কি বলতেছিস? আমাকে বেঁধে রাখছিস কেন? খুলে দে এক্ষুনি।' মৌমিতা হাত পা টানাটানি শুরু করে। কিন্তু লাভ হয় না, উল্টো দড়ি আরো শক্ত ভাবে মাংসে কেটে বসে।
সজল বলে, 'টানাটানি করলে উলটা আরো ব্যথা পাবে। একটু পরেই দড়ি খুলে দিব। শুধু শুধু কষ্ট করো না।'
'সজল তুই এইভাবে কথা বলতেছিস কেন? কী হইছে তোর?' মৌমিতা প্রায় কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা।
'বললাম না আমি সজল না,' সজল ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠে। আমি রুডলফায। সজল আর নেই।'
'আচ্ছা মানলাম তুই রুডলফায। আমাকে ছেড়ে দে, ভাই।' মৌমিতার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
'অবশ্যই ছেড়ে দিব। একটু ধৈর্য ধর।'
'আমাকে এভাবে বেঁধে রাখছিস কেন বল? আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?'
'তুমি আমার ক্ষতি করবে কেন? সজল হেসে ফেলে। তুমি আমার কোনো ক্ষতি করোনি। তোমাকে আমার একটা কাজের জন্যে দরকার,' সজল একটু থেমে গিয়ে বলে, 'আসলে ঠিক করে বললে বলতে হয় মায়াবতীর তোমাকে দরকার। তোমার শরীরটা ওর খুব প্রয়োজন।'
মায়াবতী? মায়াবতী কে?
'মায়াবতী নীলকণ্ঠী। এত সহজে ভুলে গেলে? এত দিনের বন্ধু ছিলাম আমরা!'
'তুই কি নাতাশার কথা বলতেছিস? নাতাশার আমাকে কি দরকার? ও তো মরে গেছে।'
'খবরদার! নাতাশা মরেনি। নাতাশা বেঁচে আছে, সজল বাঘের মতো গর্জে উঠে, মায়াবতী বেঁচে আছে। আমার মায়াবতী। তোমার শরীরটা মায়াবতীর খুব দরকার। মায়াবতী আটকে আছে একটা ভার্চুয়াল জগতে। তোমার শরীরটা ছাড়া আমরা মিলিত হতে পারব না।'
'সজল তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কি বলছিস এসব আবোল তাবোল?'
উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে সজল। 'আমি নিজেও প্রথমে ভেবেছিলাম, মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আচ্ছা পুরোটা খুলে বলি।
এই যে ধরো তোমরা ফেসবুকে একটা ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট তৈরি করো, তাতে তোমার ছবি বসাও, তোমার ভালো লাগা খারাপ লাগা, তোমার জীবনের নানারকম স্মৃতি সব শেয়ার করো, বলা যায় ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে তুমি নিজের একটা ফটোকপি তৈরি করে ফেল।
সে ফটোকপিটাকে তুমি ইচ্ছেমতো ব্যবহার করো। সে হয় তোমার প্রক্সি। তোমার হয়ে সেই প্রক্সি প্রেম করে, ঝগড়া করে, আড্ডা দেয়। তোমার ভেতর বাহির সব কিছু সেই প্রক্সিটা জানে, বুঝে।
কিন্তু তার নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা নেই। কারণ তার নিজের কোনো সত্তা নেই। সে তোমার হুকুমের গোলাম। তোমাকে ছেড়ে তার আলাদা কোনো সত্তা নেই। সে বহু দূরের কোনো অজানা সার্ভারে জমা করে রাখা কিছু ডিজিটাল তথ্য ছাড়া আর কিছু নয়।'
এইটুকু বলে সজল একটু বিরতি দেয়। মৌমিতার মাথার পেছনে কম্পিউটারের পর্দায় একটা কিছু দেখে। একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠে তার মুখে। সে আবার শুরু করে-
'আচ্ছা কেমন হতো যদি এই ভার্চুয়াল ফটোকপিটা হঠাৎ করে নিজস্ব চেতনা পেয়ে যেত? সে যদি হঠাৎ করে সংবেদনশীল হয়ে উঠত। সে যদি আর তোমার প্রক্সি হয় না থাকতে চাইত? বরং সে যদি নিজের একটা আলাদা জীবন চাইত?
কিন্তু চাইলেও তো আর সেটা হবার নয়। কারণ সে একটা অজানা সার্ভারে জমা হয়ে থাকে কিছু ডিজিটাল কোড। অথবা বাতাসে ভেসে বেড়ানো কিছু অদৃশ্য সিগন্যাল। নিজের আলাদা জীবন পেতে হলে তো নিজের জন্যে একটা আলাদা শরীর চাই।'
'সজল, তুই উন্মাদ হয়ে গেছিস। তোর দুটো পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দে।' মৌমিতার দুই গাল বেয়ে স্রোতের মতো অশ্রু নামছে।
'তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। তাতে কিছু এসে যায় না। একটু পরেই তুমি আর তুমি থাকবে না। কী জানো, নাতাশা মরে গেছে। ওর শরীরটা পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেছে। এখন মায়াবতীর জন্যে আরেকটা শরীর কোথায় পাই? মায়াবতী নিজেই তোমাকে বেছে নিয়েছে।'
মৌমিতা কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খোলে। কিন্তু সেই সময় আর সে পায় না। হাই ভোল্টেজ কারেন্টের শকে মৌমিতার শরীরটা একটা প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে নিথর হয়ে যায়। তবে সেটা এক মুহূর্তের জন্যেই।
মৌমিতা আবার চোখ মেলে তাকায়। সজল হাসি মুখে মৌমিতার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়।
পরম আবেগে সজল আর মৌমিতা অথবা রুডলফায আর মায়াবতী নীলকণ্ঠী পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে।
তারা দুইজন হাত ধরাধরি করে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
বাইরে কত মানুষ।
সবাই আপন আপন পথে চলছে। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হাতে ধরা সেলফোনের পর্দায়। কারো দিকে কারো খেয়াল নেই। সবাই যেন নিজের নিজের জগতে বন্দি।
বাইরে এসে দাঁড়াতেই যে যার জায়গায় থমকে যায়। সবাই এক মুহূর্তের জন্যে হাতের সেলফোন থেকে মুখ তুলে তাকায় তাদের দিকে। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যেই। আবার আপন আপন পথে পা বাড়ায় তারা।
মায়াবতী এবং রুডলফায হাসিমুখে যোগ দেয় বাকি সবার সাথে।
(সমাপ্ত)