‘স্যার, লাঠিটা একটু দিবেন?’
‘পিঠটা বড় চুলকোচ্ছে’
‘তো আমার লাঠি চাইছেন কেন?’
‘অপারগ হয়েই বললাম স্যার। লাঠি দিয়ে পিঠটা একটু চুলকবো। এমন জায়গায় চুলকোচ্ছে, যেখানে হাতটা ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না।’
‘সরকারী লাঠি পিঠ চুলকোনোর জন্য তো নয়, আপনি হাত দিয়ে কাজ চালান’
‘এতক্ষণ ধরে সেই চেষ্টাই করছিলাম, জুত মতো হচ্ছে না। বড্ড চুলকোচ্ছে অথচ চুলকোতে পারছি না। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে স্যার।’
‘ডান পাশের পিঠ ডান হাত দিয়ে চুলকোলে তো হবে না, আপনি আপনার বাম হাত ব্যবহার করুন।’
‘সেটাই করতাম কিন্তু সমস্যা হলো স্যার আমার বাম হাতটা বেশ দুর্বল। ছোটবেলা থেকে হাতটাতে জোর পাই না।’
‘পোলিও টোলিও হয়েছিল নাকি?’
‘সেসব কিছু না। রোগ বালাই আমার হয় না। শুনলে অবাক হবেন স্যার, গত প্রায় পৌনে তিন দশক ধরে আমার ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস জ্বর হয়নি’
‘বাহ, আপনার বডি তাহলে সাংঘাতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নিয়েছে’
‘তাই হবে হয়তো। অবশ্য একদম ছোট থাকতে বাড়াবাড়ি রকমের জ্বরে ভুগতাম। একবার হলো কি, সুপারি গাছ থেকে পড়ে গেলাম। প্রাইমারিতে পড়ি তখন। দাদীজানের ছিল কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার অভ্যাস। স্কুল থেকে সবে ফিরেছি, দাদীজান ডেকে বললেন, ‘ওরে বন্ধু পান আছে, সুপারি নাই। দিবি কয়েকটা সুপারি পেড়ে?’
আমি ভালোই গাছ বাইতে পারতাম। করে উঠে গেলাম পুকুর পাড়ের সুপারি গাছে। কিন্তু নিচে নামার সময়ই ফ্যাকড়াটা বাধল। মনে হলো কে যেন আমার পা ধরে টানছে, ছাড়াতে চাই, ছাড়েই না। কোথাকার কোন হ্যাঁচকা টানে গেলাম পড়ে। জানে বেঁচে গেলাম সেবার কিন্তু বাম হাতখানা অকেজো হয়ে গেল। সেই থেকে স্যার, জ্বরটর একদম হাওয়া।’
‘একে সৌভাগ্য, নাকি দুর্ভাগ্য—কোনটা বলব?’
‘দুর্ভাগ্যই বলুন। আমার দাদীজানটা মরে গেল।’
‘হুট করেই মরে গেল!’
‘অনেকটা তাই। আমার অকেজো হাতের জন্য দাদীজান নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করলেন বোধহয়। উনার কাঁচা সুপারির জন্যই তো আমি গাছে চড়েছিলাম। আমি পড়ে যাওয়ার দুঃখে তিনি কাঁচা সুপারি ছাড়লেন কিছুদিন পর ছাড়লেন পৈতৃক দমখানাও।
অবশ্য গায়ের দুষ্ট লোকেরা বলে কাঁচা সুপারি না খেয়ে খেয়ে দাদীজান মারা গেছেন। সে যাই হোক, সুপারি গাছ থেকে পড়ার মাস তিনেক পর মধ্যে ঘুমের ভিতরই দাদীজান মারা যান। আমায় খুব আদর করতেন তিনি। আদর করে ডাকতেন মনু।’
‘দুঃখজনক।’
‘দুর্ভাগ্য এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও পারত।’
‘থামেনি?’
‘না, পরপর বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সে সময় ঘটেছিল।’
‘যেমন আপনার বাবার মৃত্যু?’
‘জী স্যার। দাদীজান মারা যাওয়ার মাস দু’এক বাদে বাবা হার্টঅ্যাটাক করেন। এশার নামায আদায় করতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ হাতে পুকুরের পাড় ঘেঁষে তিনি মসজিদের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। যেতে আর পারেননি, পথেই মারা যান। বাবার দেহটা উল্টে পুকুরে পড়ে ছিল। সকালে গোসল করতে গিয়ে একজন দেখতে পায় উল্টানো মৃত দেহটা। অনেকের মতে বাবা ভয় পেয়েছিলেন। ভয়ের কারণে তার মৃত্যু ঘটে’
‘ভয়টা কিসের?’
‘দাদীজান মারা যাওয়ার পর থেকেই গাঁয়ের সবাই বলাবলি করত, উনাকে নাকি পুকুর পাড়ের সুপারি বাগানের আশেপাশে কাঁদতে দেখা যায়। কাঁচা সুপারি খাওয়ার নেশাতেই তিনি সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। এরপর যা হয় আর কি, সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল দাদীজানের আত্মা গ্রামে ভর করেছে। আমার বাবা আগে নামায কালাম তেমন পড়তেন না। দাদীজানের মৃত্যুর পর তিনি বেশ ধর্মভীরু হয়ে যান। নিয়মিত নামায পড়া শুরু করেন। নামায পড়তে গিয়েই হার্টঅ্যাটাকে উনার মৃত্যু হয়।’
‘আসলেই কি আপনার বাবা কিছু দেখেছিলেন?’
‘কি করে বলি স্যার! আমি কখনও কিছু দেখিনি। তবে আমার মা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে তিনি আর গ্রামের বাড়িতে রাখতে চাননি। ঢাকায় মামার কাছে পাঠিয়ে দেন।’
‘আপনার মামা মানে সৈয়দ ইয়াকুব হকের কাছে?’
‘হুম, বাইরের সবাই মামাকে সৈয়দ ইয়াকুব হক নামেই চিনত। বাড়িতে আমরা ডাকতাম পিন্টু মামা।’
‘ইয়াকুব হক সাহেব ব্যাংকে চাকরি করতেন, লোন সেকশনে। অর্থ কেলেঙ্কারিতে তাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়, তাই না?’
‘পিন্টু মামাকে ফাঁসানো হয়েছিল স্যার। তিনি ভীষণ সহজ সরল মানুষ ছিলেন। খুব গরুর মাংস খেতে পছন্দ করতেন। মামীর হাতের গরুর মাংস ছাড়া উনার আর কোনো দাবি-দাওয়া ছিল না।’
‘শুনেছি আপনার মামার দারুণ জুয়ার নেশা ছিল?’
‘নেশা ছিল তবে ওইটাকে জুয়া বলা ঠিক হবে না স্যার। পিন্টু মামা দুর্দান্ত তাস পেটাতেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে খেলতেন না, তার কাছে খেলাটাই ছিল মুখ্য।
পিন্টু মামাকে টুয়েনটি নাইনের সম্রাট বলা হতো। মামাই আমাকে তাস খেলাটা শেখান। তিনি এমন কিছু ট্রিকস জানতেন, কার্ড ফেলার আগেই বলে দিতে পারতেন সামনের চালগুলো কার কী হবে।’
‘আপনার মামার তো কোনো সন্তানাদি ছিল না।’
‘মামীর খুব ইচ্ছে ছিল একটা সন্তানের। ডাক্তার, কবিরাজ, মাজার, দরগা কম ছুটাছুটি করেননি তিনি, কিন্তু লাভ হয়নি।’
‘আপনার মামা ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করলেন কেন? আপনার কী ধারণা?’
‘অর্থ কেলেঙ্কারির পর ব্যাংক থেকে মামার নামে পুলিশ কেইস হয়। জোরেশোরেই শুরু হয় তদন্ত। মামাকে ধরে নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন তিনি জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান। অপমানটা খুব গায়ে লেগেছিল। এক সন্ধ্যায় পিন্টু মামা ছাদ থেকে লাফ দেন।’
‘আপনার মামী কোথায় ছিলেন?’
‘বাসাতেই ছিলেন, ঘুমাচ্ছিলেন। বিকেলে মামীর ঘুমানোর অভ্যাস ছিল। মামাও সাথে শুয়ে ছিলেন। কোন সময় উঠে ছাদে গেলেন আর লাফ দিলেন মামী বলতে পারেন না। আমিই ডেকে তুলে মামীকে প্রথম খবরটা দেই।’
‘আত্মহত্যার?’
‘আত্মহত্যার সময় আপনি ছিলেন কোথায়?’
‘গাছ থেকে পড়ে বাম হাত অকেজো হয়ে যাওয়ায় আমি কারো সাথে আর মিশতে পারিনি। এক হাতে কোনোদিন খেলতে নেমেছেন স্যার? খুব টাফ। কিছুতেই কিছু হয় না। ওরা মাঝে মধ্যে দয়া দেখিয়ে খেলায় নিতো কিন্তু দূরে বসিয়ে রাখত, মাঠে নামতে দিতে চাইত না। লজ্জা লাগত খুব। তখন আমার পড়ার নেশা পেয়ে বসল। প্রচুর বই পড়তাম। গ্রামে থাকতে স্কুল লাইব্রেরী, শহরে মামার কাছে আসার পর ঢাকার বিশাল লাইব্রেরী। মামার আত্মহত্যার সময় আমি লাইব্রেরীতেই ছিলাম। রাস্তার ওপাশেই ছিল পাবলিক লাইব্রেরীটা। ওখানটাতেই আমি থাকতাম অধিকাংশ সময়।
‘খবরটা কীভাবে পেলেন?’
‘এলাকার একজন পরিচিতা আমাকে খবর দেয় মামা রাস্তায় পড়ে আছে। আমি দৌড়ে যাই ঘটনাস্থলে। দেখি পিন্টু মামার মাথা ফেটে চৌচির, রক্তে ফুটপাত ভিজে গেছে।’
‘আর আপনি উপরে গিয়ে আপনার মামীকে খবর দেন?
‘জী, আমি ঘুম থেকে ডেকে তুলি আর মামার আত্মহত্যার খবরটা জানাই। স্যার, লাঠিটা কি কয়েক মিনিটের জন্য দেয়া যায় না?’
‘এখনও চুলকোনো কমেনি?’
‘না স্যার, জ্বালাচ্ছে খুব। আচ্ছামতো না চুলকোতে পারলে শান্তি পাচ্ছি না। এই এক পিঠ চুলকোনোতেই আমার একটু সুখ। এ ছাড়া কোনো নেশা-টেশা নেই। অনেকের থাকে না, পান বিড়ি তাসের নেশা। আমার নেশা পিঠ চুলকানো।’
‘এলার্জি নেই তো? ফুসুরি টুসুরি? ট্যালকম পাউডারে তো এসব ভালো হয়ে যায়।’
‘ওসব কিছু না। আমার এমনিতেই চুলকোয়। বাবার থেকে পেয়েছি। আমি বাবার পিঠ চুলকে দিতাম। বাবা বলত, পিঠের মাংসের নখের অনুপাত মেপে ঠিকঠাক চুলকে দিতে পারাটাও কিন্তু একটা আর্ট।’
‘আর্ট! সামান্য পিঠ চুলকোনোকে এক্কেবারে আর্টের মর্যাদা!’
‘আলবৎ আর্ট, যে কোনো কাজ মন লাগিয়ে ঠিকমতো করতে পারলে তার মধ্য থেকে একটা সৌন্দর্য বেরিয়ে আসে স্যার’
‘কিন্তু মনোয়ার সাহেব, আমি যে লাঠিটা আপনাকে পিঠ চুলকোনোর জন্য দিতে পারছি না, মাফ করবেন।’
‘তাহলে স্যার আমার একটা উপকার করুন, প্লিজ? আমার মেয়ের শোবার ঘরের ওয়্যারড্রোবের দ্বিতীয় তাকে সবুজ রঙের প্ল্যাস্টিকের একটা হাতল আছে। পিঠ চুলকোনোর হাতল।
আমার স্ত্রী কিনে এনেছিল আমার জন্য। আমরা বাপ মেয়ে দুজনেই ব্যবহার করি। বাইরে দাঁড়ানো আপনার কনস্টেবলকে বলে হাতলটা একটু এনে দিতে পারবেন?’
‘আপনার মেয়ের শোবার ঘর? করিডর ধরে এগোলে হাতের ডান পাশের দ্বিতীয় ঘরটিই তো?
‘একদম ঠিক। সেখানেই সবুজ রঙের পিঠ চুলকোনোর হাতলটা আছে। একটু এনে দিন না স্যার। একটু শান্তি মতো পিঠটা চুলকে নেই। আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিলে আর তো পাবো না।’
‘আপনার নামে এখনও ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়নি। এক্ষুনি আপনাকে হয়তো জেলে যেতে হবে না। তবে তদন্তের প্রয়োজনে থানায় আসতে হতে পারে।’
‘উফ বাঁচালেন স্যার। জেল হাজত বড় নোংরা। সর্বত্র পেশাবের গন্ধ’
‘এইবার আমাকে বলুন তো, আপনার শ্বশুরের কোম্পানি ছেড়ে আমি চলে এলেন কেন?’
‘চলে আসিনি, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তারা অবশ্য উচিৎ কাজটিই করেছেন। আমার হাত অবশ, কাজটাজও পারতাম না। অফিসের লোকজন হাসাহাসি করত।
শুধু শুধু জামাই কোটায় বড় পদে বসে আমি কোম্পানির ক্ষতিই করছিলাম। তারা বরং ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে দেরিতে সরিয়েছে। আরও আগেই আমাকে ছাঁটাই করা উচিৎ ছিল।’
‘কোম্পানি থেকে ছাঁটাইয়ের পর আপনি কী করলেন?’
‘কিছুই না। পুরোপুরি বাসায় বসে গেলাম। কিছুই না করতে পারাটা আমি বেশ ভালো পারি।’
‘পারুল ইসলামের সাথে আপনার প্রেমের বিয়ে ছিল, তাই না?’
‘পারুলের মতো এমন স্মার্ট সুন্দরী মেয়েরা আমার মতো গর্দভদের প্রেমেই বেশি মজে। হুট করেই পারুল আমার প্রেমে পড়ে গেল। কেন পড়ল আমি জানি না। পুরোটাই আমার কপাল আর পারুলের নিয়তি’
‘আর নিয়তির ম্যারপ্যাচে আপনার শাশুড়ি মিসেস শরিফা ইসলামের মৃত্যু ঘটল’
‘কী যে একটা বাজে দুর্ঘটনা স্যার, কী বলব! তা না হলে এভাবে গলায় ভাত আটকে কেউ মারা যায়, বলুন তো!’
‘আপনার শ্বশুর বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব দেলোয়ার ইসলাম, তিনিও তো গলায় ভাত আটকেই মারা গিয়েছিলেন’
‘আপনি স্যার সব খোঁজ খবর নিয়েই এসেছেন দেখা যাচ্ছে। জী, তিনি গাজর খেতে গিয়ে মারা যান। ওসব বহু বছর আগের কথা। আমাদের বিয়েরও প্রায় সাত আট বছর আগে হবে। পারুলের তখন ষোল সতেরো বছর বয়স।
শ্বশুর সাহেবের অবশ্য নানান অসুখ বিসুখ ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। উনার সাথে সবসময় একজন লোক থাকত সেবা করবার জন্য। খাইয়ে দিতে হতো। সেদিন বাসায় কেউ ছিল না, তিনি নিজে নিজে গাজর খেতে গিয়ে মারা যান।’
‘কিন্তু আপনার শাশুড়ি তো সুস্থ ছিলেন। শরিফা ইসলামের বয়স সাতান্ন চলছিল, মেডিক্যাল রিপোর্টে তার কোনো শারীরিক অসুস্থতার বিবরণ পাওয়া যায়নি। তিনি শক্ত সামর্থ্য মহিলা ছিলেন। তার এভাবে গলায় ভাত আটকে মারা যাওয়াটা কী অস্বাভাবিক নয়?’
‘অস্বাভাবিক তো বটেই। শ্বশুর সাহেবকে আমি দেখিনি, উনার কথা বলতে পারবো না, তবে আমার শাশুড়ি আম্মার সবকিছুতেই অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো ছিল।
তিনি স্থিরভাবে কোনো কাজ করতে পারতেন না। সবসময় একটা ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন। আসলে আমার শ্বশুরসাহেব অসুস্থ হবার পর কোম্পানিটা তিনি নিজ হাতেই টিকিয়ে রেখেছিলেন। ভীষণ কাজ পাগল মহিলা ছিলেন আমার শাশুড়ি।’
‘আপনাকে ছাঁটাই করলেও উনার মেয়ে আইমিন আপনার স্ত্রী পারুল ইসলাম কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই উনার মাকে সাহায্য করতেন।’
‘পারুল নামে মাত্র পদে ছিল। আমার মেয়ে বকুল ছাড়া আমার শাশুড়ি কাউকে তেমন বিশ্বাস করতেন না। যেদিন তিনি মারা গেলেন সেদিন সকালে উনার একটা মিটিং ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাত খাচ্ছিলেন।
দ্রুত গিলতে গিয়েই ঝামেলাটা হলো। গলায় ভাত আটকে গেল। আশেপাশে কেউ ছিল না, ডাকও দিতে পারছিলেন না। গ্লাসে অবশ্য পানি ভরেছিলেন। খেতে আর পারেননি। দম আটকে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। ট্র্যাজিডি, নিদারুণ ট্রাজিডি।’
‘আপনার শাশুড়ি যখন মারা যান আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’
‘আমি বারান্দায় ছিলাম। নতুন কিছু পুঁইশাকের বীজ বুনেছিলাম, বারান্দাতেই। সদ্য পাতা ছেড়েছে। গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলাম। গাছ আমার ভীষণ প্রিয়।’
‘আর আপনার স্ত্রী পারুল ইসলাম?
‘পারুল বাথরুমে ছিল—গোসলে। তার সকাল সকাল হালকা কুসুম গরম পানিতে গোসলের অভ্যাস।’
‘শরিফা ইসলাম মারা গেছেন, খবরটা আপনি প্রথম কার কাছে থেকে জানতে পারলেন?’
‘আমার মেয়ে, বকুল। ও ছুটে এসে আমায় জানায়।’
‘সময়টা মনে আছে?’
‘সকাল আনুমানিক দশটা কি সোয়া দশটা।’
‘বকুল সেদিন স্কুলে যায়নি কেন? ওর তো সকাল আটটা থেকে ক্লাশ শুরু’
‘সেদিন ওর শরীর খারাপ ছিল। মেয়েদের যা হয় আর কি’
‘বকুল তো এবছর চৌদ্দতে পড়ল’
‘জী স্যার। গতমাসে আমার মেয়েটার জন্মদিন ছিল। ওর নানুমণি বকুলের জন্য চৌদ্দ পাউন্ডের বিশাল এক কেক নিয়ে আসে। খুব আদর করত নাতনীকে। ঐ যে বললাম না নাতনী ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস পর্যন্ত করতেন না।
বকুলও নানুমণি বলতে অজ্ঞান ছিল। মায়ের চেয়ে ও ওর নানুমণির কাছেই বেশি থাকত। আমার শাশুড়ির অফিস রুমে বকুলের জন্য আলাদা একটা ডেস্কও রাখা ছিল। বকুল যখন তখন সেখানে গিয়ে বসে বসে ছবি আঁকত। ওর নানুমণি মারা যাওয়ার পর বকুলটা খুব ভেঙ্গে পড়েছে।’
‘আর আপনি?’
‘আমি একজন অপদার্থ মানুষ। আমার অনুভূতির মূল্য কী স্যার?’
‘মনোয়ার সাহেব, শুনুন, আমার সামনে এখন অনেকগুলো ছেঁড়া গল্প পড়ে আছে। ছেঁড়া হলেও সবগুলো গল্পে একটা হারমোনি আছে। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তবে ছেঁড়া গল্পগুলো আমি জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে পারি’
‘লজ্জা দিচ্ছেন স্যার, আপনি পুলিশের কতবড় লোক। আপনাকে আমি আর কীইবা সাহায্য করতে পারি! প্রশ্ন করলে যতটুকু জানি উত্তর দিতে চেষ্টা করব।’
‘অতটুকুই দরকার। বলে রাখি আমার সব ধারণার শক্ত প্রমাণ এই মুহূর্তে হাতে এসে পৌঁছায়নি, অনেক কিছুই হবে আমার অনুমান নির্ভর। তবুও আমি একটি সারমর্ম দাঁড় করাচ্ছি, তো শুরু থেকেই শুরু করি?’
‘প্লিজ স্যার . . .।’
‘মিসেস শরিফা ইসলামের মৃত্যুর গুরুত্ব অনুধাবন করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন দপ্তরে আপনার শাশুড়ির কেইসটা আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং কেইসটির দায়িত্ব পাই আমি।’
‘আমাদের পরিবারের জন্য আনন্দের সংবাদ যে কেইসটা আপনি ডিল করছেন। আমার কাছে আপনাকে অত্যন্ত পারদর্শী একজন তদন্তকারী বলেই মনে হচ্ছে।’
‘লোকাল ডাক্তারের মাধ্যমে যে মেডিক্যাল রিপোর্ট আমরা হাতে পাই সেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণের কথা উল্লেখ থাকলেও ঘটনার মোড় ঘোরাতে শুরু করে পারুল ইসলামের মেইলে আসা কয়েকটি ছবি। এর জন্য সর্বপ্রথম ধন্যবাদ প্রাপ্য আপনার শ্বশুরবাড়ির অদ্ভুত খেয়াল, স্বর্ণের প্রতি উনাদের পরিবারের আসক্তি।’
‘বুঝলাম না।’
‘মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক বাদে শরিফা ইসলামের লাশের ছবিগুলো তোলা হয়। ছবিগুলো ঠিক কে তুলেছে পারুল ইসলাম বলতে পারছেন না। বাসায় তখন অনেক মানুষ। খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই চলে এসেছে। ছবিটা যে কেউ তুলতে পারে, তবে যেই তুলেছে সে পারুল ইসলামকে একটা মেসেজ দিতে চায়।
‘কী মেসেজ?’
‘মায়ের মৃত্যুর দিন পারুল ইসলাম স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না বলেই হয়তো খেয়াল করেননি কিন্তু তিনদিন পর মেইলে আসা ছবিগুলোতে তার প্রথমেই নজর পড়ে শরিফা ইসলামের মুঠিতে ধরা রাখা একটা সোনার চেইনের প্রতি।
ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় শরিফা ইসলামের গলায় ও হাতের মুঠিতে একটা করে মোট দুইটা সোনার চেইন। এর একটি ব্যাখ্যাই হতে পারে, মৃত্যুর আগে শরিফা ইসলাম তার সামনে থাকা হত্যাকারীর গলা থেকে চেইন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। পারুল ইসলামের ধারণা হত্যাকারী এ বাসারই কেউ, কারণ এ বাসার সবাই একই রকম সোনার চেইন পরে।’
‘পারুলই আপনাদের অভিযোগ করে, ঠিক না?’
‘তিনি গোপনে আমাদেরকে জানান। উনার অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত শুরু করি।’
‘অভিযোগ পারুলই করেছে অনুমান করেছিলাম, আজ নিশ্চিত হলাম। ভালোই হয়েছে মনে সন্দেহ জন্ম নিলে, সেটি দূর করাই শ্রেয়। সন্দেহ সাপের চেয়েও ভয়ংকর।’
‘পারুল ইসলামের অনুমতি সাপেক্ষে শরিফা ইসলামের লাশ কবর থেকে উঠিয়ে পুনরায় ময়নাতদন্তের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কী হলো, অবাক হচ্ছেন যে?
‘লাশ কবর থেকে উঠানো হলো অথচ আমি তার কিছুই জানতে পারলাম না! পারুল আমাকে এতটা অবিশ্বাস কবে থেকে করা শুরু করল! আমি তো পালিয়ে যেতাম না। তার মাকে আমি নিজের মায়ের মতোই দেখতাম’
‘যাই হোক, আপনাকে প্রধান সাস্পেক্ট ধরে সেই অনুযায়ী আমরা আপনার সম্বন্ধে বিস্তারিত খোঁজ নেয়া শুরু করি।’
‘আমার সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার কীইবা আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হতো।’
‘আপনি এতক্ষণ ধরে যা বললেন তার প্রায় সবই মিথ্যে। সুকৌশলে আপনি সত্য এড়িয়ে গেছেন।’
‘আমি কোনো মিথ্যে বলিনি’
‘মনোয়ার সাহেব, আপনার মা এখন কোথায় আছেন?’
‘দুঃখিত স্যার, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চাইছি না। আমার বৃদ্ধ মাকে এখানে অযথা টেনে আনছেন কেন?’
‘তিনি শুরু থেকেই এই কেইসের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। মনোয়ার সাহেব, আপনার মা লতিফুন্নেসা বেগম কোথায় আছেন?’
‘তিনি এখন কাশিমপুর কারাগারে। ডাবল মার্ডারের আসামী হয়ে আমার মা যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন।’
‘সেই খুন হওয়া ব্যাক্তি দুজন কারা?’
‘আমার দাদীজান আর আমার বাবা।’
‘এই তথ্য আপনি আমাদের কেন দেননি।’
‘কারণ আমি বিশ্বাস করি না, মা এমন কিছু করতে পারে।’
‘কিন্তু আমি যদি বলি আপনি ভালোমতোই জানেন, আপনার মা একজন খুনি?’
‘সে আপনি বলতেই পারেন কিন্তু আমি স্বীকার করছি না।’
‘আপনি কি তবে এইটাও অস্বীকার করবেন যে আপনার মেয়ে বকুল মিসেস শরিফা ইসলামের হত্যাকারী না?’
‘স্যার আপনি কিন্তু খুবই গুরুতর অভিযোগ করছেন। কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?’
‘আমি শুরুতেই বলেছি, সব এভিডেন্স এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কিন্তু ঘটনার পারস্পারিকতায় আমি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাচ্ছি। আর সেজন্যই আপনার সাহায্য আমার একান্ত কাম্য।’
‘আমার মেয়ের নামে এত বড় একটা অপবাদ দিয়েও আপনি আশা করছেন আমি আপনাকে সাহায্য করবো?’
‘করছি, কারণ ইতিমধ্যে আপনি সাহায্য করেছেন।’
‘আমি কীভাবে কখন আপনাকে সাহায্য করলাম!’
‘আপনার কি শরিফা ইসলামের লাশ দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের রেজাল্ট জানতে ইচ্ছে করছে না?’
‘তিনি দ্রুত ভাত খেতে গিয়ে গলায় ভাত আটকে . . .।’
‘আপনার শাশুড়িকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে আর শুরু থেকেই আপনি কথাটা জানতেন। অল্প কিছুক্ষণ আগে আমার মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে আপনার মেয়ে বকুলের ঘরের ওয়্যারড্রোবের ভিতর থেকে সবুজ রঙের প্ল্যাস্টিকের পিঠ চুলকানো হাতলের পাশাপাশি একটি বিষের শিশি উদ্ধার করা হয়েছে।
আপনি শুরু থেকে এই জন্যই পিঠ চুলকানোর কথা বলছিলেন, বকুলের রুমের দিকে আমাদের ইঙ্গিত করছিলেন।’
‘মোটেই না। আর আপনি সোনার চেইনেই ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছেন।’
‘কোথায় ভুল করছি, বলুন তো শুনি!’
‘লাশ গোসলের শেষে পারুলের হাতে দুটা নয়, একটাই চেইন তুলে দেয়া হয়েছিল আর ওইটা ছিল আমার শ্বাশুড়ির গলার সোনার চেইনটাই’
‘না। যে চেইন দেয়া হয়েছিল সেটি শরিফা ইসলামের হাতে থাকা চেইন, উনার গলার চেইন নয়। যে দুজন মাদ্রাসার ছাত্রী সেদিন শরিফা ইসলামকে গোসল করিয়েছিল তাদের সাথে কথা বলে আমরা এ সত্যতা নিশ্চিত করেছি যে ওইদিন তারা শরিফা ইসলামের গলায় কোনো সোনার চেইন দেখেনি’
‘কিন্তু ছবিতে পারুল দুইটা চেইন দেখেছে। আরেকটা চেইন তবে কোথায়?’
‘মোচড়টা তো সেখানেই মনোয়ার সাহেব!’
‘স্যার, আপনি ভীষণ হেঁয়ালি করছেন। একবার বলছেন ছবিতে দুইটা চেইন দেখা গেছে, আবার বলছেন মাদ্রাসার মেয়েরা পারুলকে একটাই চেইন দিয়েছে আমার শাশুড়ি মায়ের হাতের মুঠি খুলে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যেমনটা বুঝতে পারছি না, এসবের সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক কোথায়? তিনি এই আলোচনায় কেন?’
‘ভালোবাসার মানুষগুলোকেই নিজ হাতে খুন করে ফেলা। অতি অদ্ভুত এক সাইকোপ্যাথ পেশেন্ট ছিলেন আপনার মা লতিফুন্নেসা বেগম। আপনার দাদীজানের কোনো মেয়ে ছিল না, নিজের একমাত্র ছেলের বউকে তিনি নিজের মেয়েই ভাবতেন।
সেই মা-রূপী শাশুড়িকে আপনার মা খুন করেন। পর্যায়ক্রমে খুন হয় আপনার বাবা। আপনার মা বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ভিতরকার অসুস্থতার কথা। অতঃপর তিনি নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করে বিস্তারিত জানান। উনার ভয় ছিল তার কাছে থাকলে হয়তো আপনিও খুন হতে পারেন।’
‘আমার মা খুনি ছিলেন, সেই সাজা তিনি পাচ্ছেন। কিন্তু কেন বকুলকে জড়াচ্ছেন স্যার?’
‘বকুল জড়িয়ে গেছে। সেদিন বকুলের মুখে শরিফা ইসলামের মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে লাশের কাছে গিয়ে আপনি দেখতে পান উনার মুঠিতে ধরা একটা চেইন, আর বকুলের গলা খালি।
দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়। আপনি বুঝতে পেরেছিলেন বকুল আপনার মায়ের পথে হাঁটছে। ভালোবাসার মানুষকে খুনের নেশা পেয়েছে তার।
কিন্তু শত হলেও বকুল আপনার মেয়ে। আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। ইতিমধ্যে দাফনের সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। শেষ মুহূর্তে আপনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বকুলকে থামানো প্রয়োজন। কিন্তু আপনার স্ত্রীকে বললে তিনি কোনোদিন বিশ্বাস করতেন না।
আপনি তাই নিজের জীবনের ওপর জুয়াটা খেললেন। নিজেই অপরাধী সাজেন। মেয়েকে সন্দেহ না করলেও স্বামীকে সন্দেহ করাই যায়। এছাড়াও শরিফা ইসলামকে হত্যার পেছনে আপনার যথেষ্ট কারণও আছে, তিনি আপনাকে কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।’
‘শাশুড়ি মায়ের গলার চেইন কোথায় গেল?’
‘বকুলের কাছে। শরিফা ইসলামের মুঠি থেকে সে চেইনটা ছুটাতে পারছিল না। আবার সে বুঝতে পারছিল খালি গলা দেখলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন লাশ উপলক্ষে বাসা ভর্তি মানুষ, বকুল একফাঁকে শরিফা ইসলামের গলা থেকে চেইন খুলে নিজের গলায় পড়ে নেয়। ঐদিকে লাশ গোসলে নিলে সাবান পানিতে পিচ্ছিল হয়ে মুঠি থেকে চেইন খসে পড়ে, সেই চেইন মাদ্রাসার মেয়েরা পারুল ইসলামকে জমা দেয়। কিন্তু এর আগেই আপনি শরিফা ইসলামের কিছু ছবি তুলে রাখেন। সেই ছবিগুলো পারুল ইসলামের কাছ পাঠান।’
‘এতটা কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন ছবিগুলো আমিই পাঠিয়েছি?’
‘যে আইডি থেকে মেইল পাঠানো হয়, তার সূত্র ধরে আইপি অ্যাড্রেস ট্রেস করা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। দক্ষিণ নাখালপাড়ার যে সাইবার ক্যাফে থেকে আপনি মেইল পাঠিয়েছেন সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি। আপনাকে চিনতে আমার ভুল হওয়ার কথা নয়। কী হলো চুপ করে আছেন যে?’
‘এইসব কথা পারুল জানে? ওকে জানাবেন না। ও সহ্য করতে পারবে না।’
‘এখনও কিছু জানানো হয়নি।’
‘বকুলের চোখটা অবিকল আমার মায়ের মতো শীতল আর খুনে। আমি আর কী বা করতে পারতাম স্যার, বলুন তো? বকুলের হাত থেকে নিরপরাধ মানুষগুলোকে বাঁচাতে হলে ওকে আইনের হাতে তুলে দেয়া ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ খোলা ছিল না। এতে তো বকুলটাও বেঁচে গেল। ওর গায়ে আর খুনের রক্ত লাগবে না।’
‘বকুল? বকুল কোথায়? আমার মেয়েটা কোথায় স্যার? আমার সোনামানিকটাকে আমি এক নজর দেখতে চাই।’
‘পাশের রুমে আছে। তাকে মনিটরিং-এ রাখা হয়েছে।’
‘স্যার, বকুল কিন্তু এখনও মাইনর, বাচ্চা একটা মেয়ে। প্লিজ দেখবেন স্যার ওর শাস্তিটা যেন কম হয়, আমার মেয়েটা যেন কষ্ট না পায়’
‘বকুলের শাস্তি হবে না’
‘মাইনর বলে?’
‘না। কারণ খুনটা বকুল করেনি বলে।’
‘কী বলছেন? আপনিই তো বললেন বকুল খুন করেছে!’
‘বকুল খুন করেনি। তাকে খুনি সাজানো হয়েছে।’
‘তাহলে খুন কে করেছে?’
‘খুন করেছেন আপনি।’
‘একজন বাবার কষ্ট নিয়ে হেঁয়ালি করছেন স্যার?’
‘মনোয়ার সাহেব আপনি খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি নিজের বুদ্ধির ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠে তার চেয়ে ভয়ংকর শক্তিশালী আর কেউ হয় না।’
‘আমাকে বলছেন? বাহ, ভালো তো! আমি নিজেকে সারাটা জীবন একজন অপদার্থ ভেবে এসেছি। মজার করেই না হোক, এই প্রথম কেউ আমাকে বুদ্ধিমান বলল। কৃতজ্ঞতা স্যার।’
‘এখন পর্যন্ত আমি আপনার দেখানো পথেই পথ চলছিলাম, আপনি যেভাবে আমাকে পরিচালিত করেছেন ঠিক ঠিক সেভাবেই আমি বলে গেছি।
হয়তো এভাবেই আমি সব মেনে নিয়ে মাত্র চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে খুনের আসামী হিসেবে ঘোষণাও করে দিতাম। কিন্তু বাধ সাধল আপনার মামা সৈয়দ ইয়াকুব হকের আত্মহত্যা!’
‘স্যার আপনি এবার বাজে বকছেন! আপনার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে আমি উঠব।’
‘আহা, বসুন বসুন, পিঠ চুলকোলে আমার লাঠিটা এখন নিতে পারেন। নিবেন?’
‘ঠিক আছে, আমাকে শুধু বলুন, ইয়াকুব হক যে বছর আত্মহত্যা করেন ঠিক একই বছর মারা যান দেলোয়ার ইসলাম। ব্যাপারটা কি একেবারেই কাকতালীয়?’
‘অবশ্যই কাকতালীয়। পিন্টু মামা যে বছর খুন হয় আরও অনেক মানুষ সে বছর মারা গেছে, এর মাধ্যমে কী প্রমাণ হয়?’
‘কী বললেন? ইয়াকুব হক খুন হয়েছেন?’
‘খুনই তো। নিজেকে নিজে খুন করেছে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা, এইটাও কি খুন নয়?’
‘অথবা তাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে’
‘কে হত্যা করেছে? কে?’
‘হত্যা করেছে আপনার স্ত্রী পারুল ইসলাম’
‘আমি উঠব। এখানে আর এক সেকেন্ড আমি বসব না।’
‘পারুল ইসলামের সাথে আপনার প্রথম পরিচয় কিশোর বয়সে, লাইব্রেরীতে। লাইব্রেরীর সদস্য বইয়ে সেই সময়ে আপনাদের নাম খুঁজে পাওয়া গেছে।
‘ঘটনাচক্রে দুই কিশোর কিশোরী একে অপরের কাছাকাছি এসে বুঝতে পারে উভয়ই খুনের নেশায় মত্ত। আপনি ইতিমধ্যে দাদী আর বাবাকে খুন করে ঢাকায় এসেছেন। পারুল হত্যা করেছে তার বাবাকে। আর পরবর্তীতে আপনারা দুজন একসাথে হত্যা করেন ইয়াকুব হককে।
আপনারা ভেবেছিলেন বকুলও আপনাদের মতোই ফ্যামিলিসাইডে যুক্ত হবে। কিন্তু যখন বুঝলেন সে আপনাদের মতো নয়, তখন নিজের চৌদ্দ বছরের মেয়েকে ফাঁসাতেও আপনাদের বুক কাঁপেনি। আপনারা দুজন ভয়ংকর সাইকোপ্যাথেটিক সিরিয়াল কিলার।’
‘আমি খুনি, এ কথা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?’
‘আপনার মায়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনাদের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে। মামলার রাজসাক্ষী হতে যাচ্ছেন আপনার মা।’
‘মা এমনটা করতে পারেন না।’
‘পুত্রস্নেহে পাগল মা আর কত সহ্য করবে? এতগুলো বছর ধরে তিনি আপনার খুনের বোঝা টানছেন, আপনার মা মুক্তি চান।’
ওসি চঞ্চল ফিরোজ উঠে দরজার কাছে এগোন। আজ তার দ্রুত বাড়ি ফেরার কথা। তার মেয়ে রুমকির আজ জন্মদিন। পিছনে থেকে তিনি শুনতে পান মনোয়ার কিছু বলছে। গুরুত্ব না দিয়ে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।
মনোয়ার চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে মা ফিরে আসছে, এবার তাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।’
(সমাপ্ত)