একটা চিঠি সবকিছু কেমন ওলট পালট করে দিল। আতঙ্ক তৈরি করে দিল আমার ম্যাডামের মনের ভেতর।
তবে কি সত্যিই ম্যাডামের জীবনাবসান হতে যাচ্ছে? তাও আবার কোনো এক আততায়ীর হাতে? বাঁচার কি কোনো উপায়ই নেই?
ভনিতা না করে মূল গল্পে চলে যাই। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সহকারী। আমার ম্যাডাম দেশের স্বনামধন্য পত্রিকা দৈনিক মেঘনা পত্রিকার সাথে জড়িত। এই পত্রিকার সাপ্তাহিক একটি সাময়িকীর নাম মনের ক্যানভাস; প্রকাশিত হয় প্রতি শুক্রবার। সারা দেশের যে সমস্ত লোকজন মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্থ বা বিভিন্ন ডিপ্রেশনে ভুগছে, কিন্তু কারও সাথে শেয়ার করতে পারছে না, তারা চিঠি লেখেন এই সাময়িকীতে। আর সেইসব চিঠির উত্তর আমার ম্যাডাম অর্পা হক সেখানেই দিয়ে দেন।
সারাদেশের মানুষ মনের ক্যানভাস-এর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। পুরো সপ্তাহ ভরে যে চিঠিগুলো আসে সেগুলো আমিই পড়ি। পড়ে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিগুলো ম্যাডামকে দেই। ম্যাডাম কেবল সেগুলোর উত্তর দেন। মাত্র দুই পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকে মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা মানুষদের প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য।
একবার অদ্ভুত একটা চিঠি আসল। চিঠিটা হচ্ছে এরকম—
শ্রদ্ধেয় অর্পা ম্যাম,
আমার নাম শিমু। আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ছি। শুরুতেই বলে নিই যে, আমি আপনার অনেক বড় একজন ভক্ত। আমি সানটিভিতে আপনার প্রতিদিনের প্রোগ্রাম দেখি, কখনও মিস করি না। দৈনিক মেঘনা পত্রিকার সাপ্তাহিক সাময়িকী মনের ক্যানভাস-এর জন্য আমি মুখিয়ে থাকি পুরো সপ্তাহ। এই পর্যন্ত আপনি হয়তো অনেকের অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন। কিন্তু আজ আমি আপনাকে এমন একটি সমস্যার কথা বলবো, যেটি শুনে আপনি ভয় পেয়ে যাবেন।
আমি নিজেও ব্যাপারটা নিয়ে খুবই ভীত৷ আমি একটি নতুন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল কিনেছি কিছুদিন হলো। কিন্তু এই মোবাইলটা কেনার পর থেকে আমার জীবন বিষিয়ে উঠেছে। জিনিসটা কেনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইউটিউব দেখা। আমাদের বাসায় ওয়াইফাই আছে। আমি আমার মোবাইল থেকে প্রথম যেদিন ইউটিউবে ঢুকি, সেদিন নানান জিনিস দেখতে দেখতে একটা ফানি ভিডিওর চ্যানেল আমার খুব ভালো লেগে যায়। চ্যানেলটির নাম বনসাই। আমি চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করি। এরপর থেকেই মাঝেমাঝে আশ্চর্যজনকভাবে আমি ওয়াইফাই কানেক্ট করতেই আমার সামনে অদ্ভুত কিছু ভিডিও চলে আসে। ভিডিওগুলোতে আমি এমন অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পাই যা শুনে আপনি আঁতকে উঠবেন হয়তো। বেশিরভাগ সময়ই আমি শুক্র-শনিবারে ভিডিওগুলো পেয়ে থাকি। প্রতিবার ভিডিওতে আমি কাউকে খুন হতে দেখি, কিন্তু আমি ভিকটিম বা খুনী কাউকে চিনি না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যে, আমার কাছে যখন ভিডিওগুলো আসে তার কয়েকদিন পরে আমি সেই ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ পত্রিকায়, না হয় টিভিতে দেখি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে খুনগুলো হয় আমি ভিডিও পাওয়ার পাঁচ কি ছয়দিন পরে । এর মানে কি আপনি বুঝতে পারছেন তো? মানে মানুষগুলো খুন হওয়ার আগেই সেই ভিডিওগুলো আমার কাছে চলে আসে। আবার বনসাই নামক এই ইউটিউব চ্যানেলটি আমি ছাড়া ইউটিউবে আর কেউ খুঁজে পায় না।
আমি আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে শেয়ার করেছি ব্যাপারটা। কিন্তু কেউ ইউটিউবে চ্যানেলটা খুঁজে না পেয়ে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। আমি একটা ভিডিও দেখে যদি কাউকে বলি যে এ সপ্তাহের মধ্যেই একজন বয়স্ক লোককে কুপিয়ে হত্যা করা হবে, তখন তারা আমাকে লোকের নাম ঠিকানা বলতে বলে। কিন্তু ভিকটিমদের কেউই তো আমার পরিচিত না। আমি নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারি না । কয়েকদিনের মধ্যেই যখন সত্যি সত্যি খুনটা হয় আর আমি পত্রিকা নিয়ে সবাইকে দেখাই, তারা বলে এরকম তো এখন হরহামেশাই হচ্ছে। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু গত সপ্তাহে আমি বনসাই চ্যানেলে যে ভিডিওটি দেখতে পাই, সেই ভিকটিম আমার পরিচিত। সেই খুনটি দেখে আমি পুরোই চমকে যাই। এই ভিকটিম আমার অপরিচিত কেউ না। যাকে আমি অসংখ্যবার দেখেছি টিভিতে। আমি যার মস্ত বড় ফ্যান।
সে আর কেউ নয়, স্বয়ং আপনি ম্যাম। হ্যাঁ ম্যাম, আপনি। দেশের অনেকেরই পরিচিত মুখ ড. অর্পা হক। কিন্তু খুনীকে আমি চিনতে পারিনি। আমি যদি এই কথাটি সরাসরি কাউকে বলি, তবে কেউ বিশ্বাস করবে না। ম্যাম, আপনি নিজেকে বাঁচান প্লিজ৷ আপনার মতো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট অকালে মারা গেলে দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
আপনার অধম ভক্ত শিমু মির্জা।
ম্যাডাম চিঠিটা পড়ে আঁতকে উঠলেন। গত সাত বছর ধরে তার সাথে আছি, কিন্তু কখনও ম্যাডামকে এতটা ঘাবড়াতে দেখিনি। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এত সহজে ঘাবড়ায় না। কিন্তু নিজের মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়। ম্যাডামও তার ব্যতিক্রম নন।
মেয়েটা চিঠিতে যে ঠিকানা দিয়েছে সেটিও ভুয়া ঠিকানা। ওই ঠিকানায় গিয়ে শিমু নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। আমি ম্যাডামকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু তিনি শান্ত হলেন না। পরিচিত গণ্ডির ভেতর কোনো শত্রু আছে কিনা খুঁজে দেখার চেষ্টা করলেন। জিডি করার কথাও ভাবলেন একবার। আমি তাতে বাধা দিলাম। একটা অপরিচিত মেয়ের চিঠিতে একজন প্রতিষ্ঠিত সাইকিয়াট্রিস্টের ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা লোকে ভালো চোখে দেখবে না। লোকজনের হাসির পাত্রী হয়ে যাবেন ম্যাডাম।
ম্যাডাম নিজ থেকে কাউকে জানালেন না ব্যাপারটা। কেবল কাছের কয়েকজন আত্মীয় জানল। তবুও কী করে যেন ভাইরাল হয়ে গেল খবরটা। অবশ্য কেউই বিশ্বাস করল না। অনেকে তো বলেই বসল, মানসিক রোগীদের কাউন্সেলিং করতে করতে আর মানসিক রোগীদের সাথে থাকতে থাকতে ড. অর্পা হক নিজেও একজন মানসিক রোগী হয়ে গেছেন।
সত্যি বলতে, আমারও ইদানীং তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ম্যাডামের সহকারী হওয়াতে ব্যাপারটা প্রকাশ করতে পারছি না। দেশের স্বনামধন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্টের একটা অচেনা মেয়ের অতিপ্রাকৃত গল্পে বিশ্বাস করে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেওয়াটা হাস্যকর মনে হচ্ছে আমার কাছে।
ম্যাডাম আমাকে খুবই বিশ্বাস করেন। মেয়েটার চিঠি পাওয়া গিয়েছে শনিবারে। আজ বৃহস্পতিবার। চিঠির ভাষ্যমতে আজকের মধ্যেই ম্যাডামের মৃত্যু হবে। আজকের দিনটা কোনো রকমে পার হয়ে গেলে ম্যাডাম পুরো শঙ্কামুক্ত৷ এই পুরো সপ্তাহটা ম্যাডাম খুব টেনশনে কাটিয়েছেন। আজ রাতটা তার কাছে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যাডাম আমাকে রাতটা তার সাথে কাটাতে অনুরোধ করলেন।
আমি আর ম্যাডাম ছাদে বসে গল্প করছি। এই ছাদে তিনি হরেকরকম ফুলের গাছ লাগিয়েছেন টবের মধ্যে। রাত হলে রজনীগন্ধার গন্ধে ছাদের পরিবেশটা মুখরিত হয়ে যায়। কারও মন খারাপ থাকলে, এখানে এলে মন ভালো হয়ে যাবে; সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যাডামের যখন খুব দুঃশ্চিন্তা হয়, তখন ম্যাডাম এই ছাদে এসে বসেন মন ভালো করার জন্য।
আমাকে ছাড়া ম্যাডাম কোথাও যান না। উনি এমনিতে কথা খুব কম বলেন। আমি উনার সহকারী হওয়াতে আমার সাথেই দিনের বেলা সবচেয়ে বেশি কথা বলেন ম্যাডাম। বয়সে আমার আট-নয় বছরের বড় হবেন। উনার স্বামী মারা গেছেন বছরখানেক আগে। হার্টের রোগী ছিল বেচারা, কার্ডিয়াক ফেইলিউরেই মারা গেছেন। হঠাৎ করেই এক সকালে ড্রয়িংরুমের সাথে অ্যাটাচ বাথরুমের সামনে স্যারের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই ম্যাডাম কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন।
রাতের আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে ম্যাডাম আমাকে বললেন,
‘সায়মা, আমার মৃত্যুটা কীভাবে যেন হবে বলেছিল মেয়েটা?’
আমি একটা ঢোক গিলে ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, ‘জ্বি, বলেছে প্রথমে আপনাকে অন্ধ করে দেওয়া হবে। আপনি যখন চোখের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকবেন, তখন . . .।’
‘হুম, তখন কী সায়মা? বলো কী—?’
‘থাক ম্যাডাম। এসব গুজব। এরকম হয় নাকি কখনও? মেয়েটা কি জ্যোতিষী? এসব আজব কথায় কান দিবেন না।‘
ম্যাডাম আবারো চুপ হয়ে গেলেন। চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লেন। ম্যাডামের খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। চিকনমতন দেখতে ম্যাডামের দিকে তাকালে কখনও বোঝা যায় না যে, উনার বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে। বিশ-বাইশ হলে হয়তো ঠিক মানাত এই শরীরে। ঠিক সেই মুহূর্তে ম্যাডামের মোবাইল বেজে উঠল আবার।
আননোন নাম্বার। ম্যাডাম কলটা রিসিভ করতে বললেন আমাকে। রাত তখন বারোটা এক মিনিট। আমি ম্যাডামের নির্দেশে লাউড স্পিকার অন করে ফোন রিসিভ করলাম। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে একটা মেয়ে বলে উঠল—
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, অর্পা ম্যাম, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। ম্যাম, আমি শিমু বলছি। কেমন চমকে দিলাম বলুন তো? আমি দীর্ঘদিন ধরেই আপনার ফ্যান। মনের ক্যানভাস-এ আপনি যেভাবে অদ্ভুত অদ্ভুত মানসিক সমস্যার সমাধান দেন লোকজনকে সেটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি প্রতি শুক্রবার ওটার জন্য অপেক্ষা করে থাকি শুধু আপনার প্রশ্নোত্তর পর্ব পড়ব বলে। আমি জানি এই কয়দিন আপনি অনেক ডিপ্রেশনে ছিলেন। আমি সবকিছুর জন্য খুবই দুঃখিত৷ তবুও এই অধমকে যেন আপনার প্রতি জন্মদিন এলেই অন্তত একবার হলেও মনে পড়ে, সেজন্যই পুরো সপ্তাহ আপনাকে চিন্তিত রেখে এই অভিনব পদ্ধতিটি অবলম্বন করে আপনাকে উইশ করলাম।’
একটানা কথা বলে গেলো মেয়েটা। এদিকে ম্যাডাম তো বিস্ময়ে হতবাক! কি বলবে বুঝতে পারছে না বোধ হয়। আশ্চর্য আমিও কম হইনি। একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ের মাথায় এই চিন্তাটা আসলো কী করে? মেয়েটার অর্পা হকের মতো মহিলাকে এরকম দুঃশ্চিন্তায় ফেলার জন্য একটু ভয়ও হলো না? ম্যাডাম যদি এখন তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়?
ম্যাডাম রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন৷ ওপাশ থেকে মোবাইলে বলা হচ্ছে, ‘ম্যাম, আপনি কী রাগ করেছেন? আমি খুবই দুঃখিত।’
দেখতে পেলাম, ম্যাডাম দাঁড়িয়ে দাঁত কটমট করছেন।
চট করে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ছাদের এক কোণায় একটা ছোট্ট হাতুড়ি পড়ে ছিল। কিছুক্ষণ আগেই আমার শ্রদ্ধেয় ম্যাডাম সেই জিনিসটা দিয়ে টবের মাটির একপাশ খুঁচিয়ে কী যেন একটা বোঝাচ্ছিলেন আমাকে!
ফোনালাপে ব্যস্ত থাকায় এদিকে খেয়াল করেননি তিনি। খুব সতর্কভাবে হাতুড়িটা মেঝে থেকে তুলে নিয়েছি আমি। এক ঝটকায় ম্যাডামের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘দেখি দেখি, ম্যাডাম আপনার চশমায় ওটা কি লেগে আছে!’
ম্যাডাম নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে রইলেন মূর্তির মতো। এই সুযোগে গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে হাতুড়িটা বসিয়ে দিলাম চশমার বাম কাঁচ বরাবর। তারপর, এক মুহূর্ত বিরতি না দিয়েই ডান কাঁচ।
চশমার কাঁচ ভেঙ্গেচুরে চোখের ভিতর ঢুকে গেল একেবারে। চোখ বেয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে। থেঁতলে গেছে নাকের ওপরের একাংশ।
আর দেরি করা যাবে না। অর্পা হকের মুখ চেপে ধরে তার পাতলা শরীরটা গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঠেলে নিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলাম আমি।
আজ থেকে দেড় বছর আগের কথা। অর্পা হক তখন একটা সেমিনারের কাজে দেশের বাইরে ছিলেন। জরুরি কাগজপত্র আনা-নেয়ার কাজ থাকতে পারে বলে ম্যাডাম আমাকে তার বাড়ির চাবি দিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বস্ত সহকারী বলে কথা! সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফাঁকা বাড়িতে একটা জরুরি কাগজ নেয়ার নাম করে ঢুকেছিলাম আমি। বেডরুমের ক্লজিটের ওপরে একটা স্মার্টল্যাম্প রেখে এসেছিলাম। শাওমি ব্র্যান্ডের চাইনিজ জিনিস। মোবাইল দিয়ে খুব সহজেই আলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ল্যাম্পটার ঠিক সামনে রেখে এসেছিলাম একটা রাবারের সাপ। মাত্র দশ মিনিটের কাজ। সন্ধ্যা হবার আগেই বেরিয়ে এসেছিলাম আমি।
তারপর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলাম বাড়ির পেছনের সরু গলিতে। ঠিক রাত বারোটায় আমার মোবাইলের সাহায্যে ঘরের ভেতর রেখে আসা ল্যাম্পটা চালু করে দেই। নিজ চোখে দেখিনি, তবে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। হঠাৎ অন্ধকার ঘরে আলোর ঝলকানি, উল্টোদিকের দেয়ালে ফণা তোলা সাপ। আলো জ্বলছে, আর নিভছে। দুর্বল হৃদপিণ্ডের মানুষকে কুপোকাত করতে এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে!
সকাল সকাল ম্যাডামের ফোন পেয়েছিলাম সেদিন। বিদেশে বসে স্বামীকে বারবার ফোন করছিলেন, না পেয়ে স্মরণ করেছিলেন আমাকে। কোনো বিপদ হয়নি তো? এক দৌড়ে বেরিয়ে ম্যাডামের বাড়িতে এসেছিলাম আমি। দারোয়ানকে সাথে নিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকি। দেশবরেন্য সাইকিয়াট্রিস্টের স্বামী মরে কাঠ হয়ে বিছানার একপাশে পড়ে আছেন। মুখের এক পাশ থেকে গড়িয়ে পড়া লালা শুকিয়ে আঠালো হয়ে আছে। চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত।
দারোয়ানকে বলেছিলাম, পুলিশকে জানাতে। সে ঘর থেকে বেরোতেই এক মুহূর্তে ক্লোজেটের ওপর থেকে আমার ল্যাম্প আর ছোট্ট সাপটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম। এক মিনিটের মামলা!
বেচারা! সবাই সেটাকে হার্ট অ্যাটাক বলে মেনে নিয়েছিল। অন্যের অসুখ যে কারও সুখের কারণ হতে পারে, সেবারই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমি!
তারপর আজকের কথা। ম্যাডামকে মারার এমন একটা মোক্ষম কৌশল, আমি শিমুর চিঠির কল্যাণে পেয়েছি। আর সুযোগ হাতছাড়া করতে ইচ্ছা হলো না।
হ্যাঁ, সে অনেক আগের কথা। অর্পা হকের স্বামীর কোম্পানিতে চাকুরি করতে গিয়ে ওই দুশ্চরিত্রের লোকটার কাছে ধর্ষিত হয়েছিল আমার বড় বোন। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রমহিলা নিজের খ্যাতি আর পয়সার জোরে বাঁচিয়ে এনেছিল স্বামীকে।
আমার বোন সুইসাইড করার আগে একটা ছোট চিরকুটে ছোট করে লিখে গিয়েছিল, ‘উকিলের জেরা।’
হ্যাঁ, ধর্ষণের শোকটা চাপা দিতে পারলেও বিচার চাইতে গিয়ে উকিলের যে বিশ্রী জেরার মুখে তাকে পড়তে হয়েছিল, সেটা সহ্য করতে পারেনি আমার বোন।
(সমাপ্ত)