সায়েন্স সেন্টার, সেন্ট্রাল সিটি।
জায়গাটা ইউনাইটেড আর্থের রাজধানী সেন্ট্রাল সিটির উত্তরে। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন। এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখলে মনে হতে পারে এটি কোনো উচ্চ-পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বাসভবন। স্ব-নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ভবনের ভেতর-বাইরের প্রত্যেকটা জীব ও জড়বস্তুর ওপর নজর রাখা হচ্ছে। প্রধান প্রবেশ পথের দুপাশে আধুনিক অস্ত্র হাতে চারজন গার্ড সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের ওপর অবস্থান করছে একশ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক দেয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন কাঁটাতারের বেড়া। আর, পাঁচিলের ভেতরে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে পাঁচটি ভয়ংকরদর্শন অ্যালসেশিয়ান কুকুর। ছাদের ওপর থেকে ছয়টা স্পটলাইট আশেপাশের সমস্ত গ্রাউন্ড কভার করছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোথাও কোনো ফাঁক ফোকর নেই।
চারতলা বিশিষ্ট ভবনের প্রত্যেক ফ্লোরে আধুনিক অস্ত্র হাতে অবস্থান করছে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভাড়াটে যোদ্ধারা, যারা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। এছাড়াও ভবনের প্রায় প্রত্যেক কোনায় রয়েছে এক বা একাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, ছয়জন অপারেটর একটা নির্দিষ্ট কামরায় বসে সারাক্ষণ নজর রাখছে মনিটরের ফুটেজে। অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে রয়েছে হিট সেন্সর, মোশন সেন্সর ও লেজার সেন্সর সিস্টেম। সহজ কথায় বলা চলে, নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের চোখ এড়িয়ে একটা পিঁপড়াও ভেতরে ঢুকতে বা ভেতর থেকে বেরোতে পারবে না।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলেও সত্যি, এই ভবনটি মূলত একটি বিজ্ঞানাগার। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার বাসভবন না হলেও যে মানুষটি এ গবেষণাগার গড়ে তুলেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। ড. অ্যালেক্স আরভিন, বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। দীর্ঘদিনের সাধনায় একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন তিনি এই বিজ্ঞান গবেষণার প্রাণকেন্দ্র। নাম দিয়েছেন— দ্য সায়েন্স সেন্টার। এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক গবেষণা সহায়ক সামগ্রীসমূহ বিদ্যমান। বর্তমান পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীরা যেমন এখানে তাদের নানামুখী গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছেন, ঠিক তেমনি তরুণ প্রজন্মের শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীরা লাভ করছে বিজ্ঞান বিষয়ে অফুরন্ত জ্ঞান। গোটা পৃথিবী যখন ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, তখন বিজ্ঞানী অ্যালেক্স দেখছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। প্রাকৃতিক আর মানবিক বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবীর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পিছিয়ে গেছে অনেকখানি। যে কয়জন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ পৃথিবীকে আগের রূপ ফিরিয়ে দিতে একনিষ্ঠ পরিশ্রম করে চলেছেন, বিজ্ঞানী অ্যালেক্স আরভিন তাদেরই একজন।
সারাদিন লোক গমগম করলেও রাতের বেলা ভবনটি খালি হয়ে যায়। বাইরে দিনের আলো কমার সাথে সাথেই ভবনের ভেতর বেড়ে যায় কৃত্রিম আলোর তীব্রতা। রাত বাড়ার পর এখানে অল্প যে ক’জন মানুষ জেগে থাকে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ড. অ্যালেক্স আরভিন নিজে, এছাড়াও সজাগ থাকে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী। নির্বিঘ্নে গবেষণা সংক্রান্ত কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন রাতের নিস্তব্ধতাকে। আঁধার-নির্জনতা-মনঃসংযোগ, এই তিনের মাঝে অদ্ভুত এক মেলবন্ধন রয়েছে। ড. অ্যালেক্স মনে করেন এই তিন উপাদান যখন এক সাথে পাওয়া যায় তখন কোনো কাজই আর অসম্ভব থাকে না। আর, এর সাথে যদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা যোগ হয়, তাহলে তো কথাই থাকে না। যতক্ষণ খুশি—যেভাবে খুশি কাজ করা যায়, কারও দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ব্যক্তিগত গবেষণা সংক্রান্ত কাজের জন্য ভবনের একটা অংশ আলাদা করে নিয়েছেন অ্যালেক্স আরভিন। এই অংশটি ভবনের টপ ফ্লোরে। সেখানে অন্যদের আনাগোনা কম। দু-তিনজন সিকিউরিটি গার্ড আর কয়েকজন সেক্রেটারি ব্যতিত এদিকটাতে আর কারও প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এদের কাছে বিশেষ ধরনের আইডেন্টিটি পাস রয়েছে যা ছাড়া ল্যাবের বাইরের করিডোরের দরজা খোলা সম্ভব নয়। তাছাড়া চোখের রেটিনা স্ক্যান ও বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষার ব্যাপার তো রয়েছেই।
কিন্তু ড. অ্যালেক্স জানেন একজন মানুষ আছে যাকে আটকে রাখার জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়। সে উল্কার বেগে এসে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে দাবানলের মত সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিতে পারে। ক্ষিপ্রতা-গতি-দক্ষতা গুণগুলোর সাথে যোগ হয়েছে অনন্য উপস্থিত বুদ্ধি। বিজ্ঞানী অ্যালেক্স তাকে বলেন, “দ্য আনস্টপেবল ম্যান”!
এই মুহূর্তে বিজ্ঞানী অ্যালেক্স তার ব্যাক্তিগত ল্যাবের ভেতর খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন, অথচ তিনি জানেন না তার সাথে এখন সেই আনস্টপেবল ম্যানের দূরত্ব মাত্র কয়েকশ গজ!
লোকটি লম্বা একটা শ্বাস নিল। তারপর হাতে ধরা ডিভাইসের একটা বিশেষ বাটন চাপল। ভবনের গায়ে চড়ার আগে লোকটি গ্রাউন্ড ফ্লোরের ইলেকট্রিক ট্রান্সমিটারটা খুঁজে বের করেছে। তারপর সেটার গায়ে ছোট্ট একটা রিমোট কন্ট্রোলড এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে এসেছে। কঠিন কিছু নয়, তার কাছে থাকা বিশেষ ধরনের কাস্টোমাইজড এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গায়ে প্রজেক্টাইল এনহ্যান্সমেন্ট বসানো। শুধু বিদ্যুতের পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সুযোগ বুঝে একটা গুলি করতে হয়েছে ট্রান্সমিটারের গায়ে, বাকি কাজটা ছিল খুব সহজ। ডিভাইসের বোতাম চাপতেই ভয়ঙ্কর শব্দ করে ট্রান্সমিটারটা বিস্ফোরিত হলো। সাথে সাথে প্রথম দুইটা ফ্লোরের সবগুলো বৈদ্যুতিক বাতি দপ করে নিভে গেল, পুরো ফ্লোর ঢেকে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে।
প্রধান গেটের নিরাপত্তায় থাকা চারজন গার্ড আর অ্যালসেশিয়ান কুকুরগুলোকে কাবু করতে খুব একটা বেগ বেতে হয়নি। আনআর্ম কমব্যাটে দারুণ দক্ষ সে। পাইপ বেয়ে খানিকটা উঠে ফার্স্ট ফ্লোরের জানালার কাঁচ খুলে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করল। ছোট্ট একটা অফিস রুম মনে হচ্ছে, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আগন্তুক তার কপালে বসানো মাল্টিভিউ গগলসটা টেনে নামালো চোখের ওপর। এটা একটা ফোর্থ জেনারেশন আলফা ডুয়্যাল টিউব গগলস। থারমাল ভিশন আর নাইট ভিশন দুই মোডেই কাজ করে। নাইট ভিশন অন করতেই এক ঝটকায় ঘরের সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল। হাতে নষ্ট করার সময় একদমই নেই। ভবনের ভেতরের নিরাপত্তা কর্মীরা সবাই দক্ষ ভাড়াটে যোদ্ধা, এদের হাতে মারা পড়ার আগেই বিজ্ঞানী অ্যালেক্সকে খুঁজে বের করতে হবে। লোকটি হোলস্টার থেকে বের করল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। যদিও একান্ত দরকার না হলে ওটা ব্যবহার করে না। অফিস রুমের দরজা ঠেলে করিডোরে বের হয়ে এল আগন্তুক।
এদিকে বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়ার পর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যরা অন্ধকারে দিশেহারার মতো ছুটোছুটি করছে। সিঁড়িতে ডজন খানেক বুটের শব্দ পাওয়া গেল। হঠাৎ করে মেশিনগানের প্রলম্বিত গর্জন আর মানুষের কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠল বাতাস। মনে হচ্ছে কেউ একজন আতঙ্কে এলোপাথাড়ি গুলি করা শুরু করেছে! আগন্তুক সিঁড়ির দিকে খানিকটা এগিয়ে আসতেই দেখল নিচ থেকে দুইটা মোটা আলোকরশ্মি উঁকি দিল। সম্ভবত নিরাপত্তা কর্মীদের টর্চের আলো। দুই-তিন জন ওপরে উঠে আসছে! স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে লোকটি ডেস্কের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ভারি হেলমেট, গগলস আর আর্মার পড়া নিরাপত্তা সদস্যদের দেখে মনে হচ্ছে সায়েন্স ফিকশনের পাতা থেকে উঠে আসা সাইবর্গদের মতো। নিজেদের কাজে অত্যন্ত চৌকস তারা। ফ্লোরের প্রতিটি ঘরের সামনে দুজন করে সদস্য দাঁড়িয়ে গেল। একজন লাথি দিয়ে দরজা খুলে ফেলছে আরেকজন টর্চের আলো ফেলে ভেতরটা চেক করছে। এদের এই ধরনের আচরণের কারণ কী? এরা আসলেই নিরাপত্তাকর্মী নাকি অন্য কিছু? সামান্য আলো চলে যাওয়াতে এত সতর্কতা কেন? প্রধান গেটের গার্ডদের মৃত্যুর খবর এত দ্রুত পেয়ে গেছে?
খানিক বাদেই আগন্তুক লোকটা বুঝতে পারল এরা আসলে নিরাপত্তা কর্মী নয়, এরাও তার মতো অন্য কাউকে খুঁজছে! তাদের কমব্যাট দক্ষতা দেখে মনে হচ্ছে সংগঠিত কোনো দল। একজনের পরনের ইউনিফর্মের ওপর একটা বিশেষ ধরনের লোগো দেখতে পেল আগন্তুক। লোগোর ভেতর প্রাচীন কোনো ফন্ট স্টাইল এর আদলে ইংরেজি বর্ণমালার দুটো অক্ষর ‘আই’ ও ‘এফ’ লেখা আছে। সম্ভবত সুযোগ বুঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী ইনডিপেন্ডেন্ট ফাইটারস গ্রুপের একটা উইং এই ভবনে হামলা চালিয়েছে। ইদানীং রাজধানীর ভেতর তারা বেশ কিছু সফল অপারেশন চালিয়েছে। কিন্তু এদের উদ্দেশ্য কী তা এই মুহূর্তে বোঝা সম্ভব নয়। ড. অ্যালেক্সকে খুঁজছে? কিন্তু কেন? ড. অ্যালেক্সকে মেরে ফেলে এদের কী লাভ? তার মানে কিডন্যাপ করতে চাচ্ছে। সম্ভবত গভীর কোনো চক্রান্ত করে বসে আছে এরা, যেখানে ড. অ্যালেক্স এর সাহায্য প্রয়োজন।
ইনডিপেন্ডেন্ট ফাইটারস গ্রুপের দু’জন সদস্য ডানপাশের একটা দরজা খুলতেই ভেতর থেকে ভারি রাইফেলের গুলির শব্দ ভেসে এল। একজন হেলমেট পড়া সদস্য ছিটকে এসে দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়ল। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরেছে। জায়গাটা দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। বাকিরা দ্রুত দরজার দুই পাশে পজিশন নিল। এদের মধ্যে একজনকে দেখা গেল পিন খুলে ঘরের ভেতরে একটা গ্যাস বম্ব ছুঁড়ে ফেলল। চাপা শব্দ করে সাদা ধোঁয়ার একটা মেঘে ডুবে গেল ঘরটা। একটু পর ঘর থেকে অন্ধের মত টলতে টলতে বের হয়ে এল একটা মানুষ, সম্ভবত এই ফ্লোরের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মী। ঘর থেকে বের হয়ে তিন পা এগুতেই আক্রমণকারীদের মেশিনগানের প্রায় একডজন গুলি তাকে ঝাঁঝরা করে দিল। মানুষটার শরীর মেঝে স্পর্শ করার আগেই প্রাণ হারিয়েছে।
ডেস্কের আড়ালে থাকাটা আর নিরাপদ নয়, চট করে উঠে দাঁড়িয়ে করিডোরের পাশের একটা ঘরে লুকিয়ে পড়ল আগন্তুক। অবশ্য কয়েক সেকেন্ড পরেই বুঝল সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। কয়েক জোড়া বুটের আওয়াজ এসে থামল দরজার সামনে। তারা সজোরে লাথি দিতে দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেল। ঘরের ভেতরের অন্ধকার চিরে দিল মোটা দুটো আলোক রশ্মি। টর্চের আলো দুটো ঘরের ভেতর মিনিট খানেক ঘুরে বেড়াল, ভেতরে কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে তারা দুজন এগিয়ে গেল পাশের ঘরটির দিকে।
লুকিয়ে থাকা আগন্তুক তখন ঘরের কোনায় মেঝে থেকে ছয় ফুট উপরে শূন্যে ঝুলছে। দুই পা দেহের দুই পাশে পারফেক্ট স্লিপ্ট করে দুইপাশের দেয়ালের গায়ে চেপে বসে থেকে তার শরীরটাকে শূন্যে সাপোর্ট দিচ্ছে। আক্রমণকারীরা টর্চের আলোতে ঘরটা সার্চ করলেও অন্ধকারের কারণে ছাদের দিকে তাদের দৃষ্টি যায়নি। সার্চকারীরা দরজার সামনে থেকে সরে যেতেই দেয়াল থেকে পা সরিয়ে এনে ধুপ করে মাটিতে নেমে এল সে। পকেট থেকে একটা চিকন কর্ড ক্যাম বের করে দরজার নিচ দিয়ে ওপাশে পাঠিয়ে দিল কর্ডটাকে। কর্ডের মাথায় বসানো ক্যামেরা দরজার ওপাশের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছে তার হাতের ডিভাইসের পর্দায়। আরও দুই মিনিট সময় দিল সে হামলাকারী সদস্যদের যথেষ্ট দূরত্বে সরে যাবার জন্য। তারপর দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। করিডোরের এক কোণে গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া লাশটা পড়ে আছে। লাশ ডিঙিয়ে সামনে পা বাড়াল আগন্তুক। করিডোরের মধ্য দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে, শেষ মাথায় সিঁড়ি। হামলাকারীদের আগেই তাকে ড. অ্যালেক্স আরভিনের কাছে পৌঁছাতে হবে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, হামলাকারীরা জানে না ড. আলেক্স এই মুহূর্তে কোথায় আছে, কিন্তু আগন্তুক তা জানে!
ড. অ্যালেক্স আরভিনের ব্যক্তিগত গবেষণার জন্য আলাদাকৃত ভবনের এই অংশটুকুর অস্তিত্ব বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সঠিক অবস্থান না জানলে কারও পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ভবনটির এই অংশ সম্পূর্ণভাবে সাউন্ডপ্রুফ করা হয়েছে। ফলে বাইরে ছোট-খাটো একটা যুদ্ধ শুরু হলেও ভেতরে একটুও আওয়াজ প্রবেশ করতে পারবে না। ল্যাবের সামনে একটা লম্বা করিডোরের শেষ মাথায় যে দরজা আছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সাদা দেয়ালের গায়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে হাত রাখলে দেয়ালের গায়ে সেট করা একটা স্ক্যানিং মেশিন এর অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়। সেখানে অথোরাইজড ব্যক্তির চোখের রেটিনা আর হাতের ছাপ স্ক্যান করার পর দরজাটি আপনা আপনি খুলে যায়। প্রবেশ করার জন্য মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ড সময় পাওয়া যায়। তারপর যেমন শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক তেমনি দরজাটা আবার দেয়ালের গায়েই মিলিয়ে যায়।
ল্যাবের ভেতর কিছু একটা কাজ করছেন ড. অ্যালেক্স। ঝুঁকে পড়েছেন খুব অদ্ভুতদর্শন একটা যন্ত্রের সামনে। এই সময়টাতে তিনি পিন-পতন নিরবতা পছন্দ করেন। খুব সামান্য শব্দও বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। কিন্তু আগন্তুক সম্ভবত বিষয়টি জানে না। পেছনে খুট করে একটা শব্দ হওয়াতে চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে ঘুরে তাকালেন বিজ্ঞানী। আগন্তুকের আপাদমস্তক বিশেষ ধরনের ব্ল্যাক ইউনিফর্মে আবৃত, পায়ে কমব্যাট শু, মুখে সিনথেটিক মাস্ক। মাস্কের উপরিভাগে অদ্ভুত ধরনের মোটা গগলস যা যেকোনো ধরনের সেন্সরের অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম। তবে সবচেয়ে ভীতিকর বিষয়টি হলো, আগন্তুকের হাতের ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র, ট্রিগারে সামান্য আঙুল ছোঁয়াতেই বর্ষণ করবে মৃত্যুবীজ যা চোখের পলক ফেলার আগেই লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম। অথচ আগন্তুককে দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার বদলে খুশি হয়ে উঠলেন বিজ্ঞানী অ্যালেক্স। মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান হল!
“এরিস এক্স! তুমি এসেছ তাহলে!” ড. অ্যালেক্সের কণ্ঠে ভয় নয়, তৃপ্তির সুর। “আমি জানতাম তুমি আসবে।”
আগন্তুক মনে হচ্ছে না তার কথা শুনছে। গগলস এর আড়ালে ঢাকা না থাকলে দেখা যেত চোখ দুটোতে জ্বলজ্বল করছে সুস্পষ্ট খুনের নেশা, চোয়ালে দৃঢ়তার ছাপ, ট্রিগার টিপে দিতে নিশপিশ করছে আঙ্গুল।
“জানি আমাকে খুন করার নির্দেশ আছে তোমার ওপর।” হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ড. অ্যালেক্স। “কিন্তু তুমি কি আমাকে খুন করতে পারবে এরিস এক্স? তোমাকে নিজ হাতে গড়েছি আমি, সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়?”
এরিস এক্স সম্পূর্ণ নির্বিকার। নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে সে একটা রোবট ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
“ঠিক আছে এরিস।” হতাশ ভঙ্গিতে কাধ ঝাঁকালেন ড. অ্যালেক্স, অমোঘ নিয়তিকে মেনে নেয়ার লক্ষণ। “যদি তোমার হাতেই আমার মৃত্যু লেখা থাকে, তবে তাই হোক। মৃত্যুর আগে শুধু একটা কথা বলতে চাই আমি...”
এরিস আবার ট্রিগার চাপতে গিয়েও চাপল না। দ্বিধায় ভুগছে সে। প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিকের সরাসরি নির্দেশ, বিজ্ঞানী অ্যালেক্সকে দেখা মাত্রই খুন করতে হবে। এই নির্দেশ অমান্য করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এটাও সত্যি যে তার গড়ে ওঠার পিছনে বিজ্ঞানী অ্যালেক্স আরভিনের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
এরিসের নিজের মধ্যকার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ফাঁকে বিজ্ঞানী অ্যালেক্স নিজের অ্যাপ্রোনের নিচে হাত গলিয়ে দিলেন। ব্যাপারটা লক্ষ করে আর থেমে থাকতে পারল না এরিস এক্স। তার রিফ্লেক্স দুনিয়ার সবচেয়ে ট্রেইন্ড অ্যাসাসিনের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। এক সেকেন্ডের একশভাগের এক ভাগ সময়ে ট্রিগারে চেপে বসল আঙ্গুল। গুলি বেরিয়ে গেল তার চেয়েও দ্বিগুণ দ্রুততা নিয়ে। বুকে ভারী বুলেটের ধাক্কা খেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন বিজ্ঞানী। দেহটা মাটিতে পড়ার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সাদা রঙের অ্যাপ্রোন। তবে ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। অ্যাপ্রোনের ভেতর পোশাকের বোতামের সাথে সাঁটা একটা ফলস বোতাম টিপে দিয়েছেন তিনি।
Episode-1, Chapter-1 of Incarnation, a science fiction thriller novel by Nazim Ud Daula.
Feature Image: gettyimages.com