পরিচ্ছেদ দশ
কাগমারী সম্মেলন
এই পরিচ্ছেদে দু’টি বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক আলোচনা করা হবে।
এক. কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল। ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রæয়ারি।
দুই. কাগমারী আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন। ১৯৫৭ সালের ৯ ও ১০ ফেব্রæয়ারি।
পরপর দুই দিন করে মোট চার দিনে এই দুইটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী নামক স্থানে। দুইটি সম্মেলনেরই ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
এক
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল, ৭-৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭
আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় যখন কেন্দ্র এবং প্রদেশ উভয় ক্ষেত্রেই দলটি সরকারে ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (যদিও কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮০ জনের মধ্যে মাত্র ১৩ জন)। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবং আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। ইতিপূর্বেই পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অন্তর্বিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছিল এবং এই কাউন্সিলে সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর দুই বিপরীতমুখী বক্তব্য শোনা গেল। সোহরাওয়ার্দী পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো-সেন্টো (বাগদাদ প্যাক্ট) সমর্থন করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ৯৮ শতাংশ পাওয়া গেছে বলে আবারো দাবি করলেন। যদিও ইতিপূর্বে সংবিধান সংক্রান্ত বিতর্কের সময় সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলের নেতা হিসাবে পার্লামেন্টে বলেছিলেন যে, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোন স্বায়ত্তশাসনই পাওয়া যায় নি। প্রধানমন্ত্রী হয়ে এবার তিনি ভোল পাল্টালেন, উল্টো কথাটি বললেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সংখ্যা সাম্য নীতি (প্যারিটি) সমর্থন দিয়েছিলেন।
এখানে উল্লেখ্য যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। সেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সঙ্গে একটি যুক্ত ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই ইশতেহারে উভয় নেতা বলেন যে, “স্বাধীন বিশ্বের নিরাপত্তার পথে আন্তর্জাতিক কমিউনিজম এক বিরাট হুমকি হিসাবে অবস্থান করছে”। সেই সময় সিবিএসকে এক সাক্ষাৎকারে সোহরাওয়ার্দী বলেন যে, “ইজরায়েলকে আজ একটি রাজনৈতিক সত্য হিসাবে স্বীকার করতে হবে”। অর্থাৎ ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে তিনি একভাবে বিরোধীতা করেছিলেন। সুয়েজখাল নিয়ে যখন মিশরের সঙ্গে ফ্রান্স বৃটেনের যুদ্ধ হয়েছিল তখনো তিনি মিশরের নাসেরের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বৃটিশ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করেছিলেন। যেকোন জাতীয়তাবাদী নেতার জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হতে পারে না।
সেই সময় আমেরিকায় যাওয়ার পথে স্পেন সফরকালে সোহরাওয়ার্দী পরোক্ষভাবে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, রয়টার, এপি ও এএফপি একই রকম বক্তব্য দিয়েছে। সোহরাওয়ার্দী বলেছেন, “আগের কালের সাম্রাজ্যবাদ অপেক্ষাও ভয়ঙ্কর এক নতুন ধরণের সাম্রাজ্যবাদের অভ্যুদয় আমরা দেখতে পাচ্ছি। এমনকি আজ এশিয়ার কোন কোন দেশও সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠেছে এবং ‘প্রতিবেশী রাজ্যখণ্ড গ্রাস করছে’।” স্পষ্টতই তিনি ভারতকে ইঙ্গিত করেছিলেন।
এই কাউন্সিলে ভাসানী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি পুনর্বার উচ্চারণ করলেন। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নীতি হল পার্লামেন্টারি শাসন ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি”। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে ১৯৫৬ সালের ২০শে মে এই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেই সিয়াটো-সেন্টোসহ সকল সামরিক জোট ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি করা হয়েছিল সর্বসম্মতভাবে। এর জবাবে অবশ্য সোহরাওয়ার্দী বলেন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের নীতি ও কৌশলও পরিবর্তন হতে পারে। ভাসানী অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দুইটি সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। (এক) দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বর্জন, (দুই) প্রাদেশিক পরিষদে যুক্ত নির্বাচন পাশ করানো (ইতিপূর্বে ধর্ম ও সম্প্রদায় ভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের প্রথা চলে আসছিল বৃটিশ আমল থেকেই)।
স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মওলানা ভাসানীই প্রথম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি যে দুইটি পৃথক তা উল্লেখ করেছিলেন। যদিও তাঁর বলার ভঙ্গি ও ভাষা পেশাদার অর্থনীতিবিদদের মত নয়- একজন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতার মতোই।
তিনি স্বায়ত্তশাসনের কথা বলতে গিয়ে সামরিক বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানী যুবকদের সমান দাবি উত্থাপন করেন। ‘বাঙ্গালীরা নাকি সৈনিক হবার উপযোগী নয়’ পাকিস্তানের সামরিক নেতাদের সেই অভিযোগকে তিনি খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, “জাপানী ও চীনাদের মত খর্বকায় ব্যক্তিরা যুদ্ধের উপযোগী হতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানী যুবকরা সামরিক বিভাগের জন্য উপযোগী হবে না কেন তা বুঝে ওঠা কঠিন”। তিনি বলেন দেশ রক্ষার জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করা হয়। তার ১৫ আনাই যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি আরো বলেন, “সংবিধানে যখন সংখ্যা সাম্য নীতি মেনে নেওয়া হয়েছে তখন সকল ব্যাপারেই সংখ্যা সাম্য ভোগ করার অধিকার পূর্ব পাকিস্তানের আছে”। সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন বক্তব্য ছিল অত্যন্ত সাহসীকতাপূর্ণ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা তুলে তিনি বলেছিলেন যে এমন চলতে থাকলে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাতে বাধ্য থাকব। অর্থাৎ পৃথক ও বিচ্ছিন্ন হবার হুমকি তিনি দিয়েছিলেন। তাঁর এই বিখ্যাত আসসালামু আলাইকুম উক্তিটি তিনি প্রকাশ্যে দুইবার উচ্চারণ করেন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এবং পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে। অনেক পরে ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, ভাসানী কাগমারীতেই তাঁকে (তারাশঙ্কর) বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে। বড়জোর ১২ বছর সময় লাগবে। এরপর তারাশঙ্কর মন্তব্য করেন, “১২ বছর নয়, ১৪ বছর পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, দুই বছর দেরিতে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময়ই পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি যে স্বাধীনতার কথা ভাবতেন তারও অনেক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর প্রতি তার অসীম ভক্তির কারণে তিনি সেদিন মুখ খোলেননি। এটা দুঃখজনক। তাই দশ বছর পরে রংপুরে অনুষ্ঠিত ন্যাপের বিশেষ অধিবেশনে ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে শেখ মুজিব কর্তৃক প্রণীত ছয় দফার প্রশ্ন উত্থাপন করে ভাসানী অতীতকে স্মরণ করে কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় বলেছিলেন, “সোহরাওয়ার্দীর ৯৮ শতাংশ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন যদি অর্জিতই হয়ে থাকে তবে আজ ছয় দফা কেন?” তাই বলে ছয় দফাকে তিনি বিরোধীতা করেন নাই। কিন্তু এ ধরণের একটি অপপ্রচার আছে। পরবর্তীতে যথাস্থানে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
ভাসানীর বক্তব্যকে খÐন করার প্রচেষ্টায় সোহরাওয়ার্দী আবারো বলেন যে, ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পাওয়া গেছে। তিনি দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তান এখন কেন্দ্র থেকে প্রচুর অর্থ পাচ্ছে। পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে তিনি আবারও ভাসানীর বক্তব্যের বিরোধীতা করে বলেন যে, সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসলে পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পররাষ্ট্রনীতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল।
আওয়ামী লীগের আরেক নেতা পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান মওলানা ভাসানীকে একজন ‘মহামানব’ ঘোষণা করেও বলেন যে তিনি (ভাসানী) নাকি মারাত্মক ভুল করছেন। আতাউর রহমানের মতে তিনি নাকি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আতাউর রহমান আরো বলেন, বর্তমান দুনিয়ার বাস্তবতায় চীন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়।
দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি খুব পরিষ্কার। তবু স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে কোন ভোটাভুটি হয়নি। মোহাম্মদ তোয়াহার মতে সেদিন বেশিরভাগ কাউন্সিলর ভাসানীর ভূমিকাকে যথাযথ মনে করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমাদের বিজয় হয়েছিল নৈতিক, কিন্তু বাস্তবিক নয়” (মোহাম্মদ তোয়াহার স্মৃতিকথা)।
তবে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের নৈতিক পরাজয় যে ঘটেছিল এটা মানতে হবে। এই পরাজয়ের শোধ তিনি তুললেন অন্যভাবে। প্রথমে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল প্রাঙ্গনে হেলিকপ্টার যোগে নেমে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির স্বপক্ষে সেই কুখ্যাত জিরো থিয়োরি বিবৃত করলেন। এর অর্থ এই যে, তাঁর মতে পৃথিবীর বিভিন্ন ছোট ছোট দেশগুলো প্রত্যেকেই শক্তি হিসেবে শূন্য। এইসকল শূন্য যোগ করলে যোগফল শূন্য ছাড়া কিছুই হতে পারে না। অন্যদিকে আমেরিকা একটি বিরাট শক্তিশালী দেশ। তার শক্তির অঙ্কটিও বিরাট। সেই অঙ্কের সঙ্গে আমরা যুক্ত হলে সেই শক্তির কিছুটা ভাগ পাব। জনগণকে প্রতারিত করার কী ধরণের বুর্জোয়া কৌশল। তিনি অবশ্য বললেন, আরেকটি বিকল্প আছে, তা হল রুশ চীন ও ভারতের সঙ্গে যাওয়া। কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে যাওয়া পাকিস্তানের নীতিবিরুদ্ধ। আর কাশ্মীরে ভারতের দখলদারিত্ব যতদিন থাকবে ততদিন পাক-ভারত বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গেও তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন যার প্রায় সবটাই বানোয়াট।
কাগমারীর নৈতিক পরাজয়ের আসল শোধ তিনি তুলেছিলেন পরবর্তীতে একটি ভুয়া আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের মাধ্যমে। সে সম্পর্কে আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে আলোচনা করব।
দুই
কাগমারী আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন
১৯৫৭ সালের ৯-১০ তারিখে কাগমারীর মত একটি অজো গ্রামে মওলানা ভাসানী এক আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ১. বাঙ্গালীর নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি তুলে ধরা ২. আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ও সম্পর্ক স্থাপন করা।
দুইদিন ব্যাপী এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যা যা হয়েছিল তা হলো:
১. দেশী বিদেশী আমন্ত্রিত মনিষীদের বক্তৃতা ও প্রবন্ধ পাঠ।
২. ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতির কিছু দিকের প্রদর্শনী, যথা কবি গান (রমেশ শীলের কবিগান তার মধ্যে অন্যতম), দেশাত্মবোধক গান (কণ্ঠশিল্পী আবদুল লতিফ প্রধানত গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গান গাইতেন), রংপুর দলের ভাওয়াইয়া গান, শেরপুর সম্প্রদায়ের জারি গান, তসের আলী ও সম্প্রদায়ের জারি গান, চট্টগ্রাম পার্টির নবজীবনের গান ইত্যাদি। বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও তিনি গান গাননি, তবে তাঁর বড় ছেলে মোস্তফা জামান আব্বাসী গান গেয়েছিলেন। এছাড়াও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের লোকনৃত্য দল, রংপুর থেকে আগত লাঠিয়ালদের লাঠি খেলা এবং তরবারি ও রামদা’র খেলা। আরো ছিলেন লালন শাহ্র গ্রুপ। মাদাম আজুলির সঙ্গে আসা পশ্চিম পাকিস্তানের একটি নৃত্যশিল্পীর দল নৃত্য পরিবেশন করেন। সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের কয়েকজন লোকসংগীতশিল্পী কাগমারী সম্মেলনে ছিলেন। তারাও গান গেয়েছিলেন।
৩. বিখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও কামরুল হাসানের আঁকা কিছু চিত্র প্রদর্শনীও ছিল এই সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়।
৪. শিল্পী কামরুল হাসান তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের দিয়ে ব্রতচারীর নৃত্যের প্রদর্শনী করেছিলেন।
গোটা সম্মেলনটির দেখাশোনা প্রধানত ভাসানী নিজেই করতেন। তবু বিশেষভাবে যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। মিডিয়ার দিকটি দেখতেন দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস। তরুণ জহির রায়হান তখন ছিলেন সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। তিনিও তাঁর দলবল নিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন।
এই সবকিছু দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে তিনি বলেন, “এমন মানুষ, এমন মাটির মানুষ আমি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। অন্য ধরনের মানুষ। মানুষটি সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা ছিল। সব মানুষকে ভালোবাসতে তাঁর মত আমি আর কাউকে দেখিনি।”
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা ও বিখ্যাত কবি গোলাম কুদ্দুস (যাঁর ‘ইলা মিত্র’ শীর্ষক কবিতাটি বিখ্যাত) ভাসানী সম্পর্কে বলেন যে, কৃষক শ্রমিকের প্রতি এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা উপমহাদেশের আর কোনো নেতার রয়েছে কি না তা তাঁর জানা নাই।
আমন্ত্রিত দেশী বিদেশীদের মধ্যে যারা লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেছেন অথবা বক্তৃতা দিয়েছেন অথবা উপস্থিত থেকেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (ভারত), কাজী আবদুল ওদুদ (ভারত), অধ্যাপক হুমায়ুন কবির (ভারত, তিনি তখন ভারতের মন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে আসেননি), কবি নরেন্দ্র দেব (ভারত), রাধারানী দেবী (ভারত), প্রবোধ কুমার সান্যাল (ভারত), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (পূর্ব পাকিস্তান), ড. মুহম্মদ এনামুল হক (পূর্ব পাকিস্তান), শওকত ওসমান (পূর্ব পাকিস্তান), কবি জসীম উদ্দীন (পূর্ব পাকিস্তান), চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন (পূর্ব পাকিস্তান), চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান (পূর্ব পাকিস্তান), আব্বাস উদ্দীন আহমেদ (পূর্ব পাকিস্তান), জহির রায়হান (পূর্ব পাকিস্তান), অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ইঞ্জিনিয়ার বি এম আব্বাস (পূর্ব পাকিস্তান), চিকিৎসক এম এন নন্দী (পূর্ব পাকিস্তান), অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান (পূর্ব পাকিস্তান) প্রমুখ। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট বৃটেন, কানাডা, মিশর (ড. হাসান হাবাশী) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন।
ভারতের কয়েকজন আমন্ত্রিত হয়েও বিভিন্ন কারণে সৌজন্যের সঙ্গে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম লেখক মুলক রাজ আনান্দ এবং বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিখ্যাত বামপন্থী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেননি বলে জানিয়েছিলেন। সোভিয়েত ও চীনের দূতাবাস সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বাণী পাঠিয়েছিল।
আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজনই ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসু। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আসেননি। হুমায়ুন কবিরও তাঁকে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেন যে, “কমিউনিস্টদের আয়োজিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি অস্বস্তিবোধ করেন”। তিনি সবিনয়ে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।
মওলানা ভাসানী নিজ হাতে চিঠি দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নেহেরু তাঁর একান্ত সচিবের মাধ্যমে এবং ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে জানান যে, যেহেতু তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দ্বারা আমন্ত্রিত নন সেই হেতু প্রটোকলগত কারণে তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। বিধান রায়ও একই প্রটোকলগত কারণে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বিদেশী আমন্ত্রিতদের জন্য বিশেষ হোটেল ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণ যোগদানকারীদের জন্য প্রচুর সংখ্যক তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মহিলাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নারীদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন আজিজা ইদ্রিস। মওলানা ভাসানী তাকে মেয়ের মত স্নেহ করতেন। তখন ঢাকা টাঙ্গাইলের রাস্তায় চলাচল ছিল খুবই কষ্টকর। বিদেশী আমন্ত্রিতদের জন্য বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
এত হাজার হাজার লোকের খাবারের ব্যবস্থা কিভাবে হল সেটাও একটা দেখার বিষয়। প্রধানত ভাসানীর মুরিদ ও ভক্তগণ চাল ডাল তরি-তরকারি মাছ মুরগী ছাগল ইত্যাদি সরবরাহ করেছিলেন। রান্না হত বড় বড় ডেচকিতে আর রান্নার পর খিচুড়ি রাখা হতো শত শত নৌকায়। এই লেখকের (রনো) এই রকম বড় সম্মেলনে নৌকায় খিচুড়ি রাখার ব্যবস্থা দেখার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত ভাসানীর সন্তোষ সম্মেলনে। ভক্তরা যে যা পেরেছে অর্থকড়ি সাহায্য করেছে। তাদের টাকায় ভাসানীর পাঞ্জাবীর দুই পকেট ভরে উঠত। কিন্তু শুধু ভক্তদের টাকা এবং তাদের আনা সামগ্রী দ্বারা এত বড় সম্মেলন সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। কয়েকজন ধনী ব্যক্তিও ভাসানীকে টাকা দিয়েছিলেন। ইস্পাহানী দিয়েছিলেন পাঁচ হাজার টাকা। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের মালিক সূর্য বসু এবং রনদা সাহা বড় অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মওলানা ভাসানী এবং তাঁর সঙ্গী সংগঠকরা (যথা আবু জাফর শামসুদ্দীন) টাকা পয়সার নিখুঁত হিসাব রাখতেন। সোহরাওয়ার্দী সরকারের পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাসানী গ্রহণ করেননি।
টাঙ্গাইল থেকে কাগমারী পর্যন্ত রাস্তাটিতে প্রায় পঞ্চাশটির মত তোরণ করা হয়েছিল বিভিন্ন দেশী বিদেশী মনিষীদের নামে। প্রথমটি ছিল কায়েদে আজমের নামে। এছাড়াও আর যাদের নামে তোরণ হয়েছিল তারা হলেন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি ও সাহিত্যিক। বিশেষ করে ইংরেজ, জার্মান, রুশ, ফার্সি ও তুর্কির বিখ্যাত ক্লাসিকাল কবি সাহিত্যিকদের নাম চোখে পড়ার মত। বাঙ্গালী কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে পড়েন রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, শরৎচন্দ্র, লালন শাহ প্রমুখ। উর্দু কবিদের মধ্যে ছিল ইকবাল ও মির্জা গালিবের নামে তোরণ। এছাড়াও বাংলা ও ভারতের কয়েকজন বিপ্লবী ও রাজনীতিবিদদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁরা হচ্ছেন গান্ধী, সুভাষ বোস, চিত্তরঞ্জন দাশ, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, হাজী শরিয়তউল্লাহ, মজনু শাহ (কৃষক বিদ্রোহের নেতা), মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী প্রমুখ। আরো ছিল স্বামী বিবেকানন্দ, হাসরাত মোহানী, নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী সি ভি রমন প্রমুখের নামে তোরণ। সবচেয়ে তাক লাগানো বিষয়টি হল মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সে তুং ও চৌ এন লাই- বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই মহান নেতা ও শিক্ষকদের নামেও তোরণ ছিল।
পৃথিবীর বহু মনিষীদের নামে তোরণ প্রশংসিতই হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতাদের পাশে কায়েদে আজম এবং অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও বৃটিশ ভক্ত নবাব আবদুল লতিফের নামে তোরণ বেশ বেমানান দেখায়। সম্ভবত কায়েদে আজমের নামটি এক নাম্বারে থাকার পেছনে রাজনৈতিক কৌশল ছিল। তবু প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিদের নাম একত্রিত করে তিনি হচপচ করেছিলেন বলে এই লেখকের মনে হয়। এর দ্বারা প্রগতিশীল মতাদর্শকে গুলিয়ে ফেলা হয় এবং বিভ্রান্ত করা হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন প্রতিক্রিয়াশীল নেতা গান্ধী সুভাষের নামে তোরণের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং ভাসানীকে ভারতের চর বলতেও তাদের বাধেনি। ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার উপসম্পাদকীয় লেখায় এই তোরণ নিয়ে বেশ ঠাট্টা তামাশা করেছিলেন এবং সম্মেলনের সংগঠকদের লালমিয়া বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। তার এক লেখায় তিনি বলেন, সুভাষ বোসের নামে তোরণ দেখে তিনি নাকি চমকে উঠেছিলেন। অর্থাৎ তার মতে পাকিস্তানে সুভাষ বোস সম্ভবত একজন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। এখানে উল্লেখ্য যে সেই সময় পাকিস্তানের বড় কর্মকর্তাদের এবং এমনকি হাইকোর্টের বিচারপতিদের অনেকেই বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, ক্ষুদিরাম সূর্যসেনের মত বিপ্লবীদের ভালো চোখে দেখতেন না। প্রসঙ্গক্রমে সেই আমলের হাই কোর্টের একটি রায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খন্দকার ইলিয়াসের লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে রিট করা হয়। হাইকোর্টের রায়ে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখা হয়। ‘মহামান্য’ হাইকোর্টের রায়ে এক জায়গায় বলা হয়েছে যে লেখক খন্দকার ইলিয়াস সূর্যসেনের প্রসংসা করেছেন। হাইকোর্ট বলেন, সূর্যসেন হল একজন ‘ডাকাত, খুনী ও রাষ্ট্রদ্রোহী’। তাই হাইকোর্টের মতে যে বইয়ে এমন ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়েছে তা নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
মওলানা ভাসানী সেদিন পাকিস্তানী মন মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চেতনা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলেন।