পরিচ্ছেদ ছয়
পাকিস্তানের প্রথম যুগের রাজনৈতিক দল
কংগ্রেস
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে অবিভক্ত ভারতের প্রাচীনতম দল কংগ্রেসের প্রভাবও দ্রুত হ্রাস পায় এবং মুসলিম লীগ কেবল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতই হয় নি তখন তাদের জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা হারাতে বেশিদিন লাগেনি। অবশ্য পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানে কংগ্রেস কখনোই একটি উল্লেখযোগ্য দল হিসেবে আসতে পারেনি। যদিও ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে অমুসলিম আসনগুলোতে তারা জয়লাভ করেছিলেন। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মনোরঞ্জন ধর। ১৯৭১ সালে ধীরেন দত্ত পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। আর মনোরঞ্জন ধর ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন, যে উপদেষ্টা কমিটির প্রধান ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা (ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি) করার জন্য যে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন তা মুসলিম লীগের সদস্যদের ভোটে বাতিল হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং পূর্ববঙ্গীয় সদস্য নুরুল আমিন, তমিজুদ্দীন খান প্রমুখ মুসলিম লীগ সদস্যরা এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার মর্মার্থ হল ‘মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এবং দেশের সংহতি রক্ষার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে মাত্র একটি এবং তা হবে উর্দু’। তবে ধীরেন্দ্রনাথের যুক্তিসঙ্গত এবং সাহসী বক্তব্য ঢাকার ছাত্রসমাজের মধ্যে প্রশংসা লাভ করেছিল। সেই সময় ২৮শে ফেব্রুয়ারি কোলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ পূর্ব এশিয় যুব সম্মেলনে যোগদানকারী পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিগণ ধীরেন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অন্যদিকে কোলকাতায় থেকেই এই সম্পর্কে প্রচারিত সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতিটি ছিল অস্পষ্ট, ঘোলাটে ও নির্দিষ্ট বক্তব্যহীন (সূত্র- দৈনিক আজাদ, ২৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮)। আরো উল্লেখ্য যে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন শহীদ হলে শহীদ ও আহতদের মেডিকেল কলেজে গিয়ে একবার দেখে আসার জন্য কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ, এমনকি সরকার দলীয় কয়েকজন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন। কিন্তু নুরুল আমিন রাজি হননি। প্রতিবাদে সেদিন যেসব সদস্য অধিবেশন বর্জন করে ঘটনাস্থল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আসেন তাদের মধ্যে কংগ্রেস দলীয় সদস্য মনোরঞ্জন ধর ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও ছিলেন। এদিকে সরকার দলীয় মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, শামসুদ্দিন আহমেদ, আনোয়রা খাতুন প্রমুখ একইভাবে অধিবেশন বর্জন করেন।
অন্যান্য ছোট দল
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে এবং তার অল্পদিনের মধ্যে কয়েকটি ছোট দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণআজাদী লীগ। কামরুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঠিক আগে আগে ’৪৭-এর জুন মাসে এই দলটি গঠন করেন। এছাড়াও নিখিল বঙ্গ কংগ্রেসের এককালীন সম্পাদক কুমিল্লার আশরাফুদ্দীন চৌধুরী গঠন করেছিলেন নেজাম-এ-ইসলাম। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে একেবারে বিপরীত দিকে তিনি অবস্থান নিলেন। এছাড়াও ছিল জামায়াতে ইসলাম। পূর্ববঙ্গে তার প্রভাব কোনদিনই খুব বেশি ছিল না। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে জামায়াতের প্রভাব তখন ছিল। ১৯৫০ সালে জামায়াত প্রধান মওদুদী পাঞ্জাবে কাদিয়ানি বিরোধী দাঙ্গা পরিচালনা করেন যেকারণে তার ফাঁসির আদেশ পর্যন্ত হয়েছিল, যদিও পরে তা কার্যকরি হয়নি এবং তিনি মুক্তিলাভ করেন। এই ছোট ছোট দলগুলোর সবকটাই প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু সেই সময় প্রগতিশীল দল গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন গণতান্ত্রিক পার্টি। কিন্তু সেটাও বিশেষ জনসমর্থন অর্জন করতে পারেনি। বরং নেপথ্যে থেকে কমিউনিস্ট পার্টি প্রগতিশীল যুবকদেরকে সংগঠিত করে গঠন করেছিল যে যুবলীগ তা ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং তার বিস্তৃতিও ঘটেছিল দ্রুত। বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের উপর যে বই লিখেছেন তাতে তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন, “সাংগঠনিকভাবে যুবলীগই তখন বিরোধী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবথেকে সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালি ছিল”। তিনি আরো বলেছেন, “মুসলিম ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্র সংগঠন হলেও যুবলীগের তুলনায় তার সাংগঠনিক শক্তি এবং উদ্যোগও কম ছিল। ভাষা আন্দোলনকে পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ১৯৫২’র ২১শে ফেব্রæয়ারির পরবর্তীকালে গণআন্দোলন সৃষ্টি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে যুবলীগের প্রধান ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নাই” [সূত্র- লেখক ও গবেষক ভাষা সৈনিক ডা. আহমেদ রফিকের (আমরা ইতিপূর্বেই এই নামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম ইলা মিত্র প্রসঙ্গে আলোচনার সময়) লেখা গ্রন্থ ‘ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতিঃ তমদ্দুন মজলিস ও কমিউনিস্ট পার্টি, পৃষ্ঠা-৭১]। যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আব্দুস সামাদ, মোহাম্মদ সুলতান (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি)। লেখক ও গবেষক বশির আল হেলাল ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে যে মূল্যবান গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত) সেখানে তিনি অলি আহাদের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেন (পৃষ্ঠা-৫৮-৫৯)। যুবলীগ নেতা অলি আহাদ বলছেন, “১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভংগের প্রশ্নে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস ও আওয়ামী লীগ প্রভাবান্বিত গণসংগঠনের নেতারা আপোষকামিতার ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। এতদবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২১শে ফেব্রুয়ারি ও তদপরবর্তী দিনগুলোতে নির্ভীক, সংগ্রামী ও সচেতন নেতৃত্ব না দিলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করিত না...”। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে যুবলীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, পরে আর পুনর্জীবিত করার আর কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
১৯৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারির পরপরই ২৬ শে এপ্রিল গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র ইউনিয়ন কেবল ভাষার আন্দোলন করে নাই, ছাত্র ইউনিয়ন এই দেশে সবচেয়ে প্রথম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিল। তবে উল্লেখ্য যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুসলিম লীগ করা সত্ত্বেও আন্তরিকভাবে অসাম্প্রদায়িক এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদবিরোধী ছিলেন। তিনিই প্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
মুসলিম লীগ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ যে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল সেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্তত ১৯৫০ পর্যন্ত মুসলিম লীগই সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল। তবে মুসলিম লীগের অন্তর্দ্ব›দ্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগের থেকেই ছিল যদিও তার একক নেতা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্না। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তবে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও কূটকৌশলের কারণে নেতৃত্বের লড়াইয়ে তিনি পরাজিত হন এবং নাজিমউদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এমনকি সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে থাকাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। তিনি বাধ্য হয়ে কোলকাতায় ফিরে যান। এদিকে কোলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা তাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য দায়ী করত। তাই কোলকাতাও তার জন্য নিরাপদ ছিল না। তখন দাঙ্গাপীড়িত কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন মহাত্মা গান্ধী। মহাত্মা সোহরাওয়ার্দীকে আশ্রয় দেন। এদিকে কিছুদিন পর গান্ধীও নিহত হলেন। তখন সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ভারত ত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানে করাচিতে চলে যান। সেখানে তিনি জিন্না মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ভাসানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং ঢাকায় ফিরে আসেন।
করাচিতে থাকা অবস্থায় তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হোক বলে বিবৃতিও প্রদান করেছিলেন। তিনি যে বিবৃতিটি প্রদান করেন তা দৈনিক আজাদে ১৯৫২ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়েছিল (ইতিপূর্বেই ২১শে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে গেছে)। সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতির অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত হল:
“ঘটনা বর্তমানে ঘটিলেও বহুপূর্বেই ভাষা সম্পর্কে পূর্ববঙ্গে বিতর্ক দেখা দিয়াছে। আমি সেই সময় বলিয়াছিলাম, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তদনুসারে উর্দুই হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলা পাকিস্তানের জনসাধারণের একটি বিরাট অংশের মাতৃভাষা। ... বাংলার বুকে উর্দুকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইবে না, তবে বিদ্যালয়ে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষা রূপে ইহা পড়ান হইবে এবং যথাসময়ে এই প্রদেশবাসীগণ এই ভাষার সহিত পরিচিত হইয়া উঠিলে পূর্ব পাকিস্তানীরাও দুই ভাষাভাষী হইবে। ইহাই সমস্যা সমাধানের বাস্তব উপায়”।
সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্যের লিখিত প্রতিবাদ মাত্র একজনই করেছিলেন। তিনি হলেন সদ্য গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সিলেট জেলার সভাপতি নুরুর রহমান। তার বক্তব্যটি সিলেটের নওবেলাল পত্রিকায় ২৮ শে ফেব্রুয়ারিতে ১৯৫২ প্রকাশিত হয়েছিল। তা নিম্নরূপ:
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ওকালতি করিয়া জনাব সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব যে বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিয়াছেন তাহা পাঠ করিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। ... যে সময় পশ্চিম পাকিস্তান হইতেও আমাদের দাবির পক্ষে জোরালো সমর্থন আসিতেছে তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের এইরূপ উদ্দেশ্যমূলক দম্ভোক্তি শুধু অবাঞ্ছিতই নয়, উপরন্তু ঘৃণার্হ।... আমরা স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করিতেছি, এইরূপ জনস্বার্থবিরোধী বিবৃতি ঝাড়িবার জন্য সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে জাগ্রত জনমতের নিকট অবশ্যই জবাবদিহি করিতে হইবে।
এদিকে মুসলিম লীগের অন্তর্দ্বদ্ব এবং অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ফলে ঐ দলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যেও ক্রমাগত ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে জোরেসোরে কোন নেতা মুখ খোলেননি। একদিকে ক্ষোভ, আরেকদিকে আপোষ। এই প্রসঙ্গে ডা. আহমদ রফিক (পূর্বে উল্লিখিত গ্রন্থে) যে মন্তব্য করেছেন তা নিচে উদ্ধৃত হল:
তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের মাত্র দুজন ব্যক্তিই ব্যতিক্রম ধারার অর্থাৎ আপোষরফার বিরোধী হিসেবে পারিচিত ছিলেন যারা যেকোনো প্রকার গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নির্ভয়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই। এদের একজন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অন্যজন শেখ মুজিবুর রহমান। শেষোক্তজন ১৯৫২ সালে আন্দোলনের শুরু থেইে কারাগারে বন্দী। আর প্রথমোক্ত জন আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থন জুগিয়ে পরে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘসময় ধরে কারাগারে থাকেন।
মুসলিম লীগের অত্যাচার ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন মওলানা ভাসানী। তিনি বিক্ষুদ্ধ মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীদেরকে সংগঠিত করে গঠন করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন)। সে সম্পর্কে আমরা একটু পরেই আলোচনা করব। তবে একথা উল্লেখ করা দরকার যে যাদেরকে তিনি সংগঠিত করেছিলেন তাদের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শের লোক ছিলেন; প্রগতিবাদী, গণতান্ত্রিক এমনকি দক্ষিণপন্থী ও ইসলামপন্থীরাও ছিলেন। সেই সময় অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন। ডা. আহমদ রফিক মন্তব্য করেছিলেন যে “ভাসানী, শেখ মুজিব প্রমুখ নেতাদের কারাবন্দী হওয়াটা ছিল নিয়মিত ঘটনা” (পূর্বে উল্লিখিত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-৬৮)।
শ্রমিক কৃষক পার্টি ও শেরে বাংলা ফজলুল হক
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শেরে বাংলা ফজলুল হক কিছুদিন একেবারে নিঃসঙ্গ ছিলেন। পরে তিনি নুরুল আমিনের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের এ্যাডভোকেট জেনারেল হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন করেন। যুক্তফ্রন্টের ইহাই ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি (বৃহত্তম পার্টি ছিল আওয়ামী লীগ)। সেই দল থেকে আবু হোসেন সরকার কিছুদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন।
শেরে বাংলা ফজলুল হক ইতিপূর্বে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে দুই মাসের মধ্যেই তাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্বের অধীনে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। আরো পরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরও হয়েছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক কখনোই নীতিনিষ্ঠ ছিলেন না। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তার বিশেষ কোন আদর্শ ছিল না। তবে উদারপন্থী ও প্রজাদরদী ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন মওলানা ভাসানী কর্তৃক আহুত কর্মী সম্মেলনে (যেখান থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম) কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রেখেছিলেন। একথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৪৮ সালে জিন্না সাহেব যখন ঢাকায় জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ তখন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্য থেকে একমাত্র শেরে বাংলা ফজলুল হকই প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছিলেন, আর কেউ নন। অবশ্য জিন্না সাহেবের সামনেই কয়েকজন ছাত্র ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করেছিলেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই মুসলিম লীগ দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের বিক্ষুদ্ধ কর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ই জুন নতুন দল গঠন করার আহবান জানিয়ে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহবান করেন। ২৩শে জুন সেই কর্মী সম্মেলন হয়। ১৫ই জুনের বিবৃতিতে তিনি বলেন, “মুসলিম লীগ পূর্বের ন্যায় আর গণপ্রতিষ্ঠান নেই। ... রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনায় এবং স্বার্থবাজদের কবল হতে কওমী প্রতিষ্ঠান উদ্ধারের উপায় নির্ধারণের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহবান করা হয়েছে। ২৩শে জুন টিটাটুলির রোজ গার্ডেন নামক এক বাড়িতে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের বিদ্রোহী কর্মীদের এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেইখানেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাহী পরিষদও গঠিত হয়। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক যিনি টাঙ্গাইল আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পন্নীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন (এই প্রসঙ্গটি পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে)। সহ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মুশতাক আহমেদ (বঙ্গবন্ধুর খুনি)। উল্লেখ্য যে সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দী ছিলেন। এই সম্মেলনে শামসুল হক ‘মূল দাবি’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেন এবং তারই ভিত্তিতে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচী গৃহীত হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে তখনো পর্যন্ত মুসলিম লীগ নামটি বাদ দেওয়া হয় নাই। মওলানা ভাসানী বললেন মুসলিম লীগকে জনগণের মুসলিম লীগে পরিণত করতে হবে। আওয়ামী শব্দের অর্থ জনগণ এবং ইহাও একটি উর্দু শব্দ। এই সম্মেলনে যে কর্মসূচী তুলে ধরা হয় তাতে সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। তাদের ভাষায় সেই রাষ্ট্ররূপ ছিল নিম্নরূপ:
১. পাকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক্স বৃটিশ কমনওয়েলথের বাহিরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে।
২. পাকিস্তানের ইউনিটগুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে।
৩. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লার প্রতিভূ হিসাবে জনগণের উপর ন্যস্ত থাকিবে।
৪. গঠনতন্ত্র (সংবিধান) হইবে নীতিতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।
আওয়ামী মুসলিম লীগের মূলনীতিতে আরো বলা হয়েছিলো যে, মুসলিম লীগের সঙ্গে এর নীতিগত ব্যবধান নেই, বরং ইসলামের সত্যিকারের আদর্শের ভিত্তিতেই এই দল গঠিত হয়েছে। এ দলের ‘জেহাদ’ স্বৈরাচারী ও শোষক মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে।
তবে সেই সময় কিছু প্রগতিশীল দাবিও এই সম্মেলনে উত্থাপিত হয় প্রধানত ভাসানীর উদ্যোগে। যথা বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, দেশের বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, সরকারি উদ্যোগে শিল্প কল কারখানা গড়ে তোলা, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, চা ও পাট শিল্পের জাতীয়করণ এবং পাটচাষীদের ন্যায্য মূল্য প্রদান। এই ধরণের দাবি মুসলিম লীগের কোন নেতা ইতিপূর্বে করেননি।
বোঝাই যাচ্ছে মওলানা ভাসানীর চিন্তার মধ্যে বেশ কিছু বিভ্রান্তি সত্ত্বেও তিনি গরীবের পক্ষে ছিলেন। এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে আমরা দেখেছি যে মওলানা ভাসানী আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কৃষকের স্বার্থে নিজস্ব দল মুসলিম লীগের মন্ত্রীসভার পতন ঘটিয়েছিলেন। তার ভিতরে এক ধরণের ইসলামী সাম্যবাদের চিন্তা ছিল তবে পরবর্তীতে তার চিন্তারও অনেক পরিবর্তন ঘটে। চীন রাশিয়া ধরণের সমাজতন্ত্রের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন যদিও মার্কসবাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। তিনি সারা জীবন গরীব কৃষকের মত কুড়েঘরে বাস করেছেন। তার কোন সম্পত্তি ও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ছিল না। গাড়ি ও দালানবাড়িও ছিল না। তিনি কমিউনিস্টদের খুব ভালোবাসতেন এবং নিজ দলে অধিকতর হারে কমিউনিস্টদের উচ্চতর পদে বসাতেন। শোনা যায় আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা কিছু লিখে পাঠালে তিনি যথাযথ মর্যাদা দিতেন। বলাই বাহুল্য মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কমিউনিস্টদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে ষাটের দশকে এক পর্যায়ে মাওবাদী কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন গাড়তর হয়েছিল তেমনি সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার বিরোধও দেখা দিয়েছিল। এটা মধ্য ষাটের দশকের কথা যখন চীন সোভিয়েত মহা বিতর্ক দেশে দেশে কমিউনিস্টদের মধ্যে বিভক্তি এনেছিল।
১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই সময় সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় চলে আসেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে এটিকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করা হয়।
ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী এই দলের দুই প্রধান নেতা ছিলেন। আরো পরে ১৯৫৭ সালে রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিরোধের কারণে (সে প্রসঙ্গ যথাস্থানে আলোচনা হবে) মওলানা ভাসানী নিজ হাতে গড়া আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নতুন প্রগতিশীল দল গঠন করেন- ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ।
কমিউনিস্ট পার্টি
পাকিস্তানের তথা ভারতের সবচেয়ে সংগ্রামী এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে নিপীড়িত রাজনৈতিক দল হল কমিউনিস্ট পার্টি। পকিস্তানের পুরো সময়টাই প্রায় এই পার্টিকে আন্ডারগ্রাউন্ড থাকতে হয়েছে যদিও প্রথম দিকে পার্টি আইনত নিষিদ্ধ ছিল না (সেই সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল)। এত নির্যাতনের মধ্যে থেকেও এই পার্টি শ্রমিক কৃষক ও নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। বহু শহীদের রক্তের মধ্য দিয়ে পার্টি খুবই ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকে অগ্রসর করে নিয়েছে। বহু কমরেডকে পাকিস্তান আমলের প্রায় পুরো সময়টাই জেলে কাটাতে হয়েছে। জেল হত্যা, ইলা মিত্র ও অপর্ণা পালের উপর বর্বর অত্যাচার, নারী কমরেডদের ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে হাজার হাজার কমরেড ও তাদের সমর্থকদের দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
এত অত্যাচার সত্তে¡ও কমিউনিস্ট পার্টি কয়েকটি অঞ্চলে (গারো পাহাড়, সিলেট, নাচোল ইত্যাদি) কীভাবে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছে তা ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে। এই সকল আন্দোলনের কারণেই মুসলিম লীগ সরকার ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা আইনত উচ্ছেদ করতে বাধ্য হয়। এছাড়াও শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান বিশাল। একেবারে শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তানে কল কারখানা খুবই কম ছিল। বৃটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে যারা শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রওশন আলী (কুষ্টিয়ার মোহিনি মিলের শ্রমিক), অনীল মুখার্জী, নেপাল নাগ প্রমুখ। তারপর একটা পর্যায়ে আফতাব আলী ও ফয়েজ আহমেদ এই দুই ব্যক্তি সংস্কারবাদী ট্রেড ইউনিয়ন শুরু করেন এবং সরকার ও মালিকদের সঙ্গে আপোষে ট্রেড ইউনিয়ন করেন। তারা দু’জনই ছিলেন চরমভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী।
ষাটের দশকে এই আপোষকামী ও দালাল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদেরকে উচ্ছেদ করে নতুন ধারায় সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলেন কিছু তরুণ ও মাঝ বয়সী কমিউনিস্ট কর্মী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী জাফর আহমদ, আবুল বাশার, দেবেন শিকদার, চৌধুরী হারুন-অর-রশীদ, মঞ্জুরুল আহসান খান, মফিজ আলী (চা বাগান), প্রতাপ উদ্দীন আহমেদ (নৌ পরিবহন), হায়দার আকবর খান রনো (প্রধানত টঙ্গী অঞ্চলে)। এছাড়াও রেলওয়ে শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক ও সাদা কলার কর্মচারীদের মধ্যেও কমিউনিস্টরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। কমিউনিস্টদের ত্যাগ ও সাহসীকতা অপরিসীম। এখানে উল্লেখ্য যে, এই গ্রন্থের লেখক (রনো) টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে টানা চার বছর ছিলেন সেই এলাকায় লাল ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা উল্লেখ করতে চাই, যদিও ঘটনাটি আরেকটু পরের স্বাধীন বাংলাদেশ আমলের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপন রেখে মেধাবী ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী তাজুল ইসলাম আদমজী জুটমিলে সাধারণ বদলী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন শ্রমিকদেরকে সংগঠিত ও কমিউনিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে। তিনি ছিলেন সিপিবির সভ্য। এরশাদ সরকারের গুণ্ডাদের হাতে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত দ্বিতীয়টি আর নেই। তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে কমিউনিস্টরা আদমজীর শ্রমিকদের মধ্যে কখনোই দৃঢ় ঘাঁটি গাড়তে পারেনি।
ভাষা আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টি শুরু না করলেও প্রায় প্রথম থেকেই তারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং একটা পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি প্রধানত পেছন থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে যখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ উগ্ররূপে উপস্থিত ছিল তখন নারী প্রগতির পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টিই প্রথম এগিয়ে আসে। ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মাঝামাঝির দিকে যখন ইসলামী মোল্লাতন্ত্র বেশ প্রবল তখনই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব পেছনে থেকে মেয়েদের দিয়ে একটি জনসভার আয়োজন করেছিল। পুলিশ ও গুণ্ডারা মেয়েদের উপর হামলা করে সভাটি পণ্ড করে। সেই সভা থেকে নিবেদিতা নাগসহ এগারোজন নারী কমরেড গ্রেফতার হন। নারী আন্দোলন ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল। বহু কমিউনিস্ট নারী কর্মী সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক লড়াই করেছেন, শ্রেণী সংগ্রাম করেছেন, ছাত্র আন্দোলন করেছেন, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করেছেন। এরকম নারীর সংখ্যা শতাধিক। এখানে মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। তারা হচ্ছেন নিবেদিতা নাগ, অনিমা সিংহ, হেনা দাস, অপর্ণা পাল, ইলা মিত্র, কল্পনা দত্ত, আরতি দত্ত, প্রণতি দস্তিদার প্রমুখ।
কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫১ সালে গঠন করে যুব লীগ। পুলিশের বাধা অতিক্রম করার জন্য বুড়িগঙ্গায় নৌকার মধ্যেই এই সংগ্রামী সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এই সংগঠনের ভূমিকা বিশাল। এই সংগঠনের প্রধান নেতারা ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, ইমাদুল্লাহ (খুব কম বয়সে ১৯৫৬ সালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন) প্রমুখ। ১৯৫২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি পেছনে থেকেই গঠন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, সেই সময় যার নেতারা ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন (যিনি ভাষা মতিন নামে পরিচিত), এস এ বারি এটি প্রমুখ। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং পরবর্তীকালে আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে (বিশেষ করে ১৯৬২ সালে) ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকেই কমিউনিস্ট পার্টির উপর যে অত্যাচার নেমে এসেছিল সেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবং কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতৃত্বকে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে হয়েছিল। তবে সেই সময় পার্টি বা অন্য কোন দল-সংগঠনের উদ্যোগ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কয়েকটি ঘটনা ঘটে যার মধ্যে বাঙ্গালী জনগণের সংগ্রামী চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে পুলিশরা ধর্মঘট করেন, ঢাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, কারণ তারা দেড় মাস ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না। সরকার সামরিক বাহিনী দিয়ে ধর্মঘটী পুলিশদের দমন করার চেষ্টা করে। দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। তাতে দুইজন পুলিশ কন্সটেবল নিহত হন। এই ঘটনার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কোন সংশ্রব ছিল না। ১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদের কর্মচারীরা কতিপয় দাবির ভিত্তিতে ধর্মঘট শুরু করেন। সেই সময় ছাত্ররা এই ধর্মঘটের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে। প্রায় একই সময় বৃটিশ আমল থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক পরিচালিত ছাত্র ফেডারেশন বিক্ষোভ মিছিল করে এবং তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফ চাই না’ ইত্যাদি শ্লোগান দেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ছাত্র ফেডারেশনের অনেক কর্মী গ্রেফতার হন। এত উৎপীড়নের পরও ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা আবার মিছিল বের করে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেন। তারা শ্লোগান দেন, ‘হাজার লোকের ভাত মারা চলবে না’, ‘কৃষক, মজুর, ছাত্র ভাই ভাই’। মুসলিম ছাত্রলীগ ও অন্যান্য বুর্জোয়া দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলো এই ধরণের শ্রেণীভিত্তিক শ্লোগান কখনোই দেয়নি।
প্রায় একই সময় বৃটিশ সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের কন্যা এলিজাবেথের পুত্রসন্তানের জন্ম উপলক্ষে অন্যান্য সরকারি ভবনের সঙ্গে রাজশাহী কলেজেও পাকিস্তানের পতাকার সঙ্গে বৃটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা তোলা হয়। এর ফলে ছাত্ররা ভীষণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘কমনওয়েলথ ছাড়তে হবে’ ইত্যাদি শ্লোগান দেন। জোর করে বৃটেনের পতাকা নিচে নামিয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম ও বিকাশ বৃটিশ আমলে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে। মণি সিংহের বক্তব্য অনুসারে “১৯২৮ সালে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন মাত্র চারজন। কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, কমরেড আবদুল হালিম, কমরেড আব্দুর রেজ্জাক ও কমরেড শামসুল হুদা। ১৯৩৫ সালে সিলেটে, ১৯৩৭ সালে ঢাকায় এবং ১৯৩৮ সালে পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়”। সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং তা চলে ৭দিন ধরে। ইতিপূর্বেই দেশভাগ হয়ে গেছে। তবে ভারত ও পাকিস্তান উভয় জায়গা থেকেই প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ৯১৯। উপস্থিত ছিলেন ৬৩২ জন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ডেলিগেটের সংখ্যা ১২৫ জন এবং তখন পূর্ব পাকিস্তানে পার্টির সভ্য সংখ্যা ছিল ১২,০০০। সারা ভারতে পার্টির সভ্য সংখ্যা ছিল ৯০,০০০। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন মাত্র ৫ জন। এই কংগ্রেসে সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কমরেড বিটি রণদীভে যিনি শ্লোগান তুলেছিলেন “ইয়া আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, সাচ আজাদী ছিনকে লো”। যেহেতু দেশভাগ হয়ে গেছে তাই ভারত ও পাকিস্তানের জন্য আলাদা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যদিও উভয় পার্টি রণদীভের লাইন গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের পার্টির জন্য স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় যার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন সাজ্জাদ জহির (তিনি লক্ষ্ণৌর মানুষ)। অবশ্য পার্টি করার জন্য তিনি পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তানের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা হলেন- সাজ্জাদ জহির (সাধারণ সম্পাদক), আতা মোহাম্মদ, জামাল উদ্দীন বুখারি, ইব্রাহিম (শ্রমিক নেতা), খোকা রায়, নেপাল নাগ, কৃষ্ণ বিনোদ রায়, মনসুর হাবিব ও মণি সিংহ। শেষের পাঁচজন বাঙ্গালী। তবে মনসুর হাবিব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের বাসিন্দা। পার্টি করার জন্যই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫০ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং রাজশাহী জেলে খাপড়াওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরে তিনি ভারতে চলে যান। আরো পরে তিনি CPI(M) -এর নেতা হয়েছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকার ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। কৃষ্ণবিনোদ রায়ও পূর্ব পাকিস্তানে গ্রেফতার হন, পরে তিনিও পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। ১৯৬০ সালে মস্কোতে ৮১টি দেশের (বস্তুতঃ তা ছিল ৮৬টি দেশের, ৫টি দেশের নাম গোপন রাখা হয়। তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি অন্যতম) কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টির যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন কমরেড নেপাল নাগ। পরে ভারত হয়ে গোপনে ফিরে আসার কথা। কিন্তু দারুণ অসুস্থতার জন্য তিনি ভারতে থেকে যান। তিনি সেখানে CPI(M) এর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সক্রিয় থাকতে পারেন নি।
পাকিস্তানের এই কেন্দ্রীয় কমিটি কোনদিনই একত্রে বসতে পারেনি। কারণ তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াত করা অসম্ভব ছিল এবং সারা পাকিস্তান জুড়ে কমিউনিস্টদের উপর চরম নিপীড়ন চলছিল। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রাদেশিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল যা কার্যত স্বাধীনভাবেই কাজ করছিল। সেই সময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন খোকা রায়।
ইতিপূর্বে এই গ্রন্থেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে জিন্নার মৃত্যুর পরপর একটি সামরিক ক্যু’র প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ তোলা হয় যা রাওয়ালপিণ্ডি ‘Conspiracy Tribunal Ordinance’ নামে পরিচিত। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদানীন্তন সামরিক প্রধান জেনারেল আকবরকে বরখাস্ত করা হয় এবং বন্দী করা হয়। এটাকে কমিউনিস্ট ক্যু বলে অভিযোগ আনা হয় যদিও ঘটনাটি সত্য নয়। এই অভিযোগে কমরেড সাজ্জাদ জহিরকেও বন্দী করা হয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট এই অর্ডিন্যান্স বাতিল করে দেয় এবং অভিযুক্ত আসামীরা সকলেই মুক্তি পান। কমরেড সাজ্জাদ জহিরও এই সঙ্গে মুক্তি লাভ করেন। সাজ্জাদ জহিরকে একটি ‘পারমিট’ দিয়ে পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে যাবার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরপরই সরকার কৌশলের সঙ্গে পারমিট প্রত্যাহার করে নিলে সাজ্জাদ জহির ভারতে থেকে যেতে বাধ্য হন, আর পাকিস্তানের ফিরে আসতে পারেননি। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির মতই স্বাধীনভাবে কাজ করছিল। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তানের কমরেডরা অত্যন্ত গোপনে কোলকাতায় এক সম্মেলনে মিলিত হন এবং সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে তেরটি জেলা ও অন্যান্য ইউনিট থেকে মোট ২৮জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে একটি নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় যার সম্পাদক নির্বাচিত হন মণি সিংহ। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ছিলেন
১. মণি সিংহ
২. নেপাল নাগ
৩. সুখেন্দু দস্তিদার
৪. আমজাদ হোসেন
৫. মোহাম্মদ তোয়াহা
৬. শহীদুল্লাহ কায়সার
৭. অনীল মুখার্জী
৮. মোজাফ্ফর আহমদ (পরবর্তীকালে ন্যাপ নেতা)
৯. চৌধুরী হারুন অর রশীদ
১০. খোকা রায়
১১. আব্দুস সালাম
১২. আলতাব আলী
পরে সরদার ফজলুল করিমকেও কেন্দ্রীয় কমিটিকে কো-অপ্ট করা হয়। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।
এখানে লক্ষণীয় যে প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আগের তুলনায় মুসলিম পরিবার থেকে আগত কমরেডদের সংখ্যা বেশি। এর ব্যাখ্যা কমরেড মণি সিংহ নিজেই দিয়েছেন, “তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থাৎ মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে আসা সৎ-উদ্যোগী পার্টি কর্মী-নেতাদের আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অংশগ্রহণ বা অন্তর্ভুক্ত আশু প্রয়োজন হয়ে পড়েছে”। (মণি সিংহ- জীবন সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২০৬)
এই সম্মেলন বা কংগ্রেসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, পার্টিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে কাজ করার কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও তর্ক বিতর্কও হয়েছিল। অবশ্য এর আগেই বেশ কয়েকজন কমরেড আওয়ামী লীগের মধ্যে কাজ শুরু করেছিলেন, এমনকি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিতও হয়েছিলেন।
শুরুতে পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টদের উপর চরম নির্যাতন চালানো হলেও পার্টি কিন্তু নিষিদ্ধ ছিল না। পার্টি এই অবস্থায় কিছু প্রকাশ্য কাজের সুযোগ গ্রহণ করে, যদিও মূল নেতারা আত্মগোপনেই থেকে যান। পার্টি একটি প্রকাশ্য অফিসও নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ১৩ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের গুণ্ডারা ঐ অফিস আক্রমণ করে। তার আগেই ১০ই মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে ১৫ই মার্চ তাদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়। একই বছর জুন মাসের মাঝামাঝি যে নারীদের জনসভা এবং পুলিশি আক্রমণ করা হয়েছিল সেকথা ইতিপূর্বে এই গ্রন্থেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই বছর ৩০শে জুন পার্টি আরেকটি প্রকাশ্য সভা করে যেখানে সভাপতিত্ব করেন মুনির চৌধুরী (’৭১-এর শহীদ)। সভায় সরদার ফজলুল করিম ও রণেশ দাশগুপ্ত বক্তৃতা করেন। জনসভায় হাজার খানেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। যারা প্রকাশ্যে পার্টির কাজ করতেন তাদের মধ্যে অন্যতম নুরুন্নবী, আলী আকসাদ, সরদার ফজলুল করিম, মির্জা আব্দুস সামাদ প্রমুখ। মির্জা সামাদ ও সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ যে মন্তব্য তাঁর লেখা বইয়ে (জীবন সংগ্রাম) করেছেন তা এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৫৫ সালে তিনি (মির্জা সামাদ) “আমাদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে বলেন, কিছু পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তিনি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন”। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সরদার ফজলুল করিম জেলে বসেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ মন্তব্য করেন, “গণপরিষদের ভেতরে তাঁর পরিচালিত কর্মকাণ্ডে আমরা সবসময় সন্তুষ্ট হতে পারিনি। গণপরিষদের কার্যকালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিপরিষদ গণবিরোধী ‘সেফটি অ্যাক্ট’ বহাল রাখার জন্য ভোট দিয়ে পাশ করিয়ে নেয়। সরদার ফজলুল করিমও তার পক্ষে ভোট দেন। আমরা ওই ‘সেফ্টি অ্যাক্ট’-এর ঘোরতর বিরোধী ছিলাম। যাই হোক, সরদার ফজলুল করিম পরবর্তীকালে পার্টির কাজকর্মের সঙ্গে তাঁর সংস্রব রক্ষার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করায় তাঁকে সসম্মানে পার্টি সভ্যপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়”। (সূত্র- জীবন সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২০০)
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে ৯২(ক) ধারায় পূর্ব পাকিস্তান শাসন করার সময় গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা কমিউনিস্ট ও গণতন্ত্রমনা রাজনীতিবিদদের উপর চরম নির্যাতন চালিয়েছিল। সেই সময় মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি পরিষদে যোগদান করতে গিয়ে বিদেশে ছিলেন। ইস্কান্দার মির্জা ঘোষণা করেছিলেন যে ভাসানী দেশে ফিরে আসলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। শেরে বাংলা ফজলুল হককে গৃহবন্দী করা হয়। এক পর্যায়ে গভর্নরের শাসন উঠে গেলে ১৯৫৫ সালে আবু হোসেন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি এককালে কংগ্রেস পার্টি করতেন। তখন তিনি ফজলুল হকের দল করেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই সেপ্টেম্বর মাসের দিকে (১৯৫৫) কমিউনিস্টদের কাছে খবর পাঠান যে, কমিউনিস্টদের আর গোপনে থাকার দরকার নাই। কারণ তিনি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এই অবস্থায় খুব স্বল্পকালের জন্য কমরেড মণি সিংহসহ পার্টির মূল নেতারা বেরিয়ে আসেন এবং পল্টন ময়দানে জনসভা করেন। গণতন্ত্রী দল তাঁদেরকে সম্বর্ধনার আয়োজনও করেছিল। কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ একটি সংবাদ সম্মেলনও করেন। পাকিস্তানের জন্মের পর এটাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সংবাদ সম্মেলন। মণি সিংহ তাঁর লেখা ‘জীবন সংগ্রাম’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “অবশ্য ওই সংবাদ সম্মেলনে, তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমরা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য বলে উল্লেখ না করে, কমিউনিস্ট মতবাদে বিশ্বাসী, এইভাবে আমাদের পরিচিতিসহ বক্তব্য পেশ করেছিলাম”। (পৃষ্ঠা ১৯৭)
ইতিমধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১শে নভেম্বর হঠাৎ জানা গেল পুলিশ ধর্মঘট শুরু হয়েছে। পুলিশ ধর্মঘট সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির কোনকিছুই জানা ছিল না। তবু কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধেই উস্কানীদাতা হিসাবে অভিযোগ তোলা হল। ২২শে নভেম্বর তারিখ থেকে আবার শুরু হল কমিউনিস্টদের ব্যাপক ধরপাকড়। পার্টির মূল নেতারা আবার আত্মগোপনে গেলেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হলেন।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে মতাদর্শগত বিষয়ে চীন ও সোভিয়েত পার্টির মধ্যে বিতর্ক শুরু হলে প্রায় সকল দেশের পার্টির মধ্যেই বিভক্তি এসেছিল। ভারতের পার্টিতে বিভক্তি এসেছিল ১৯৬৪ সালে। পূর্ব পাকিস্তানের পার্টির মধ্যেও বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে উঠেছিল এবং আনুষ্ঠানিক বিভক্তি হয় ১৯৬৬ সালে।
একে অপরকে বিদ্বেষমূলক ভাষায় আক্রমণও করে। পিকিংপন্থী পার্টিও ও গ্রুপগুলো মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিকে সংশোধনবাদী বলে অভিযুক্ত করে, অন্যদিকে সোভিয়েতপন্থীরা চীনপন্থী পার্টিকে হঠকারী ও বিভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যাবে যে এই দেশের পার্টিসহ পৃথিবীর প্রায় সকল পার্টিকেই একদিকে সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদ এবং অপরদিকে হঠকারীতা ও সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। রণদীভের লাইন যে হঠকারী ছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। নকশাল নামে যে পার্টি গঠিত হয়েছিল তা ছিল চরম নৈরাজ্যবাদী ও মার্কসবাদ বিরোধী অবৈজ্ঞানিক পার্টি। তথাকথিত চীনপন্থী পার্টি যে মাত্র দুই তিন বৎসরের মধ্যে কয়েক টুকরা হয়ে গেল, তার কারণও এক ধরণের সুবিধাবাদ। বাম সুবিধাবাদ, বুলিবাগীশতা এবং সংকীর্ণতা তথাকথিত চীনপন্থী পার্টি ও গ্রুপগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছিল। তথাকথিত মস্কোপন্থী পার্টির মধ্যেও যে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ ছিল না এমন কথা বলা যাবে না। কারণ সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর দেখা গেল সিপিবির মূল নেতৃত্ব মার্কসবাদকেই অস্বীকার করে বিলোপবাদের লাইন তুলে ধরেছিলেন। এই প্রসঙ্গে সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিজেদের ভ্রান্তি সম্পর্কে যে আত্মসমালোচনা করেছেন তা পাওয়া যাবে ‘জীবন সংগ্রাম’ নামে মণি সিংহের লেখা বইয়ের ভূমিকায় (পৃষ্ঠা-১১)। কমরেড মণি সিংহের চিন্তার সঠিকতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কমরেড সেলিম উক্ত ভূমিকায় যা বলেছেন সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃত করা যেতে পারে,
“পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসের আগে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় পার্টির নাম পরিবর্তন করে কার্যত একটা ঢিলেঢালা ধরনের পার্টি করার কথা উঠলে, তিনি (মণি সিংহ) দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘... নাম বদলালেই মানুষ আসতে থাকবে, একথা ঠিক না। এখন যাঁরা নাম বদলানোর প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাঁরা আস্তে আস্তে দাবি করবেন ডেমোক্র্যাটিক সেন্ট্রালিজম কেটে দিতে হবে, ডিক্টেটরশিপ অব প্রলেতারিয়েত কেটে দিতে হবে, ইন্টারন্যাশনালিজম কেটে দিতে হবে, মার্কসিজম-লেনিনিজম কেটে দিতে হবে ফরাসি পার্টির মতো। তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির কনটেন্টই নষ্ট করে দেবেন’।”
মণি সিংহ সম্পর্কে কমরেড সেলিম আরো বলেছেন, “তিনি বাকশালের বিরোধিতা করেছেন। জিয়ার খাল কাটা কর্মসূচি এবং ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। বিদ্যমান অবস্থাকে বাস্তবতা বলে অজুহাত দাঁড় করিয়ে প্রকারান্তরে চলতি হাওয়ায় আত্মসমর্পণের ঘোর বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি”।
তার মানে পার্টির মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রবণতা ছিল যা পরবর্তীকালে বিশেষ করে সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর বেশি করে চোখে পড়ল। কিন্তু এত বিভ্রান্তি ও কিছু সুবিধাবাদ সত্তে¡ও কমিউনিস্টরাই (সোভিয়েত ও চীন উভয়পন্থী) চরম নিপীড়ন সহ্য করে বহু জীবনদান করে মেহনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।
তমদ্দুন মজলিস
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ২রা সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস নামে একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম। প্রথম দিকে এই সংগঠনটি ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল এবং সংগঠনটিও থানা পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ই নভেম্বর সৈনিক নামে একটি সাপ্তাহিক মুখপত্রও প্রকাশ করে। তার কিছু কিছু লেখায় বেশ প্রগতিশীল কথাও পাওয়া যায়। যেমন সৈনিকের একটি সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “সাধারণ মানুষের সামনে পাকিস্তান সম্বন্ধে একদিন এক রঙীন স্বপ্ন তুলিয়া ধরা হইয়াছিলÑ কিন্তু কোনো মজবুত আদর্শের বুনিয়াদ তাদের মধ্যে খাড়া করা হয় নাই। ... ক্ষমতা হাতে পাইয়া নেতারা নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন আর দরিদ্র জনসাধারণ, ছাত্র, শিক্ষক, কিষাণ, শ্রমিক, যাদের ঐতিহাসিক কোরবানীর ফলে পাকিস্তান হাসিল হইয়াছে নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া আজ তারা শংকিত ও সন্ত্রস্ত। ... তাদের ভাত-কাপড়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দাবি এতটুকু মিটে নাই”। আবার একই লেখায় কিছু উদ্ভট ও বিভ্রান্তিকর কথা শোনা যায়। যেমন, “আমরা কায়েদে আজমের বিপ্লবী আদর্শের উত্তরাধিকার বহন করিতেছি। এদেশের পুঁজপতি ও জমিদারদিগকে কায়েদে আজম কী বলিয়াছিলেন, বড়ো বড়ো শিল্প জাতীয়করণ সম্বন্ধে তাঁর কী ধারণা ছিল, সর্বোপরি কোন ন্যায়-নীতির উপর পাকিস্তানের বুনিয়াদ তিনি খাড়া করিতে চাহিয়াছিলেন, সৈনিক তাহা ভুলিতে পারে না”।
কায়েদে আজম কবে কোন সময় পুঁজিবাদ ও জমিদারবিরোধী ছিলেন তা আমাদের জানা নাই। কায়েদে আজমের অনুসারী তমদ্দুন মজলিস এখানে একটি বানোয়াট কথা তুলে ধরেছে।
তবু ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তমদ্দুন মজলিসের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। যেমন, তাদের গঠনতন্ত্রে ও বক্তব্যে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করা হয়। একই উদ্দেশ্যে তমদ্দুন মজসিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ এই শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। সেখানে তিনটি প্রবন্ধে তথ্য ও যুক্তি সহকারে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি তুলে ধরা হয়। প্রবন্ধ তিনটি লিখেছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেনের মত প্রগতিবাদী পণ্ডিত ব্যক্তি, আবুল মনসুর আহমেদের মত সুলেখক ও রাজনীতিবিদ এবং তমদ্দুনের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং আবুল কাশেম। আবুল কাশেমের লেখায় অবশ্য কিছু বিভ্রান্তিকর বক্তব্য পাওয়া যায়। যেমন, বাংলা ভাষার অধিকার সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যের পর তিনি লাহোর প্রস্তাবের সূত্র ধরে পূর্ব বাংলায় বাংলা প্রচলনের দাবি করেন; কারণ তার মতে ‘কায়েদে আজম জিন্না প্রত্যেক প্রদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন’। জিন্না প্রসঙ্গে এই বক্তব্যটি একেবারেই সত্য নয়। বরং জিন্না পাকিস্তানের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের যে ইতিবাচক ভূমিকা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এইভাবে যে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক হয়েছিলেন নুরুল হক ভূঁইয়া যিনি তমদ্দুন মজলিসের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ আবার যে ভাষা আন্দোলনের আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়েছিলেন তারও আহবায়ক ছিলেন আরেকজন তমদ্দুন মজলিসের নেতা শামসুল আলম। তবে এক পর্যায়ে আন্দোলনের চরিত্র বামমুখী ও সংগ্রামমুখী হয়ে উঠলে পরিষদের আহবায়ক শামসুল আলম বিব্রত বোধ করে আহবায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরিষদের কাগজপত্র তোয়াহাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজে আন্দোলন থেকে সরে আসেন। এর থেকে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিক্রিয়াশীল ও কমিউনিস্ট বিদ্বেষী চরিত্রটি অনুধাবন করা যেতে পারে।
তারপরও তমদ্দুন মজলিসের যতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা ছিল তা অস্বীকার করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর তমদ্দুনের প্রধান নেতা অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে মুনির চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম আহসান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভায় রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গ ছাড়াও ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘উর্দুর জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি শ্লোগান উঠেছিল।
শুধু উর্দু নয়, রোমান হরফে অথবা আরবি হরফে বাংলা লেখারও উদ্যোগ নিয়েছিল মুসলিম লীগ সরকারের কিছু কিছু লোক। ১৯৫১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারিতে করাচিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের অধিবেশনে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের নেতা আগা খান দাবি করেন আরবিই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কবি গোলাম মোস্তফা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে আরবির দাবিকে আশীর্বাদরূপে স্বাগত জানাতে হবে। বাংলায় আরবি হরফ প্রবর্তনেরও উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল তমদ্দুন মজলিস ও তার মুখপত্র ‘সৈনিক’।
তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ২৩শে ডিসেম্বরের সৈনিক পত্রিকায় স্পষ্ট করেই লেখা হয়েছিল, “অর্থাভাবের দোহাই দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানে যখন প্রাইমারি স্কুলে তালা দেওয়া হচ্ছে, তখন ২৫,০০০ টাকা ব্যয় করে আরবি হরফ প্রবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তানের তামদ্দুনিক প্রগতিকে ধ্বংস করা কি জাতিদ্রোহিতা তথা রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়?”। আরবি হরফের প্রস্তাবক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান সম্পর্কে ঐ ‘সৈনিক’ পত্রিকায় আরো লেখা হয়েছিল, “...লিপির আবরণে আপনি পাকিস্তানের দুই-তৃতীয় অংশ অধিবাসীর (যারা অধিকাংশ মুসলমান) মাতৃভাষাকেই হত্যা করবার ব্যাপক যজ্ঞে মেতে আছেন। ... ইসলামী সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাকে আরবি হরফে লেখার দরকার নেই।”
এখানে দুঃখজনক যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপণ্ডিত ও আদর্শবাদী অধ্যাপক ড. মু. শহীদুল্লাহ বাংলা রাষ্ট্রভাষা ও বাংলা লিপির প্রধান সমর্থক হওয়া সত্তে¡ও তিনিও আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, “মাতৃভাষার পরেই স্থান ধর্মভাষার, অন্ততঃ মুসলমানের দৃষ্টিতে। অনুবাদ কখনোই মূলের স্থান অধিকার করিতে পারে না। আমরা প্রত্যেক দিন কমপক্ষে ৩২ বার আলহামদু সুরাঃ আরবি ভাষায় নামাযে পড়ি। কিন্তু তাহার অর্থবোধ করে কজন? তারপর মুসলমানের সমস্ত কৃষ্টি ও ভাবধারার আদি উৎস আরবি পুস্তকেই। ...সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে, যেদিন আরবি সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হইবে” (‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধ, ১৯৪৯ সাল, ঢাকা; বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বশীর আল হেলালের লেখা গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ থেকে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা: ৭২৮-৭২৯)।
বেশ কিছু ইতিবাচক ভূমিকা সত্তে¡ও তমদ্দুন মজলিস একপর্যায়ে ভাষা আন্দোলন থেকে সরে আসে। ১৯৪৮ সালে জিন্না সাহেবের ঢাকা আগমন উপলক্ষে তমদ্দুন মজলিস জিন্না সাহেব যে কয়দিন ঢাকায় থাকবেন সে কয়দিন আন্দোলন স্থগিত রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল।
তমদ্দুন মজলিস কোন রাজনৈতিক দল নয় এবং ইসলামি সমাজব্যবস্থা কায়েম করাই তাদের মতাদর্শগত লক্ষ্য বলে তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন। তাই ভাষার চেয়েও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্না সাহেবের ভাবমূর্তি তুলে ধরা। তারা আরো মনে করতেন যে আন্দোলন তীব্রতর হলে বামপন্থীরাই লাভবান হবেন। সেজন্য এক পর্যায়ে তারা আন্দোলন থেকে সরে আসেন।
মজলিসের ইসলামি আদর্শের সমর্থক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলা একাডেমিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভাষা-আন্দোলনে মজলিসের পিছিয়ে পড়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট কারণ নির্দেশ করেছেন। তার মতে “ভাষা-আন্দোলন ক্রমে বামপন্থী প্রগতিবাদী সমাজতন্ত্রী কর্মী, নেতা ও দলসমূহের হাতে চলে যায়। এইসব দল নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে সমর্থন যুগিয়ে সমাজতন্ত্রের স্বার্থকে পোষণ বা সাহায্য করা তাদের আদর্শবিরোধী ছিল, তারা বিশ্বাস করতেন ইসলামের বিপ্লবী সম্ভানায়” (সূত্র- বশীর আল হেলালের লেখা গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ পৃষ্ঠা- ১৮৩)
‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য’ শীর্ষক গ্রন্থে (আহমেদ রফিকের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা) ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা আবদুল মতিন তমদ্দুন মজলিসের পিছিয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন (পৃষ্ঠা-৪৭)
“এই নেতৃত্বের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত দুর্বলতা এবং দোদুল্যমানতার কারণে ছাত্র বুদ্ধিজীবী ও জনগণের সমর্থন সত্তে¡ও ভাষা-আন্দোলনকে তারা বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। এদের একাংশ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাগত পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে এসময় নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিসের প্রাধান্য আন্দোলন বিকাশের অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে থাকে। কারণ তমদ্দুন মজলিসের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে একটি ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্দেশ্য সামনে থাকার কারণে ভাষার মত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে এরা তাদের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ধ্যান ধারণার বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি।"