পরিচ্ছেদ সাত
ভাষা আন্দোলন
১
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর অন্যতম। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে কলোনি করার লক্ষ্যে বাঙ্গালীর সংস্কৃতির উপর সর্বপ্রথম আঘাত হেনেছিল। পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ৫৬ শতাংশ হওয়া সত্তে¡ও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে মর্যাদা দিতে চায়নি। এবং তারা বাংলা ভাষার বদলে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালাতে চেয়েছিল। এমনকি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আরবি ও রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করার উদ্ধত্য দেখিয়েছিল। পাকিস্তানের জন্মের প্রায় পরপরই এই প্রশ্নটি নিয়ে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য লড়াই ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম জনপ্রিয় ও ব্যাপকতম গণআন্দোলন।
বাংলাকে দমন করার শয়তানি মুসলিম লীগের নেতৃত্বের ’৪৭ পূর্বকাল থেকেই ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে, অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষণা করেছিলেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা”। সেই সময়ই বেশ কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবী এর বিরোধীতা করেন, প্রতিবাদ জানান যদিও তাদের অধিকাংশই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন। দেশভাগের আগেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছিল এবং তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। তখনই ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় আবদুল হক নামক একজন লেখক ও সাংবাদিক ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। ১৯৪৭ সালের ৩০শে জুন অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই তিনি ‘আজাদ’ পত্রিকায় আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সেখানে তিনি বলেন, “যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার দাবি সবচেয়ে বেশি”। প্রায় একই সময় ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধতে বলা হয়, “মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না”। ভবিষ্যতের মুক্তি সংগ্রামের ইঙ্গিত এই প্রবন্ধে পাওয়া যায়। তবে ‘মিল্লাত’ প্রমুখ পত্রিকা পাকিস্তান দাবির পক্ষে জোরালোভাবে ছিল। ‘মাসিক কৃষ্টি’ নামক পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (১৩৫৪) ড. মুহম্মদ এনামুল হক উর্দু রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলেছেন, “ উর্দু বহিয়া আনবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণÑ রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু”। ‘সওগাত’ পত্রিকায় ১৩৫৪ বাংলা সনের অগ্রহায়ন সংখ্যায় প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ড. কাজী মোতাহার হোসেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে লেখেন, “যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চেষ্টা করা হয় তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হইবে”। তাঁর মতে বাংলা ও উর্দু উভয়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ। আরেকজন পণ্ডিত ব্যক্তি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তবে ইতিপূর্বেই আমরা লক্ষ্য করেছি, এই শহীদুল্লাহ সাহেবও কোন এক সময় আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার মত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
তবে স্বল্প সংখ্যক মুসলমান লেখক ও বুদ্ধিজীবী সেই সময় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলেও পাকিস্তানপন্থী অধিকাংশ তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম লীগের নেতারা উর্দুর পক্ষেই ছিলেন খুব জোরের সঙ্গে। যেমন কবি গোলাম মুস্তফা, ‘আজাদ’-এর সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ, মুজিবর রহমান খাঁ, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন (একাত্তর সালে যিনি পাকিস্তানীদের পক্ষে দালালী করেছিলেন), খাজা নাজিমউদ্দীন, তমিজুদ্দীন খান ও নুরুল আমিন প্রমুখ। মুসলিম লীগের এই নেতারা একজোট হয়ে পাকিস্তানের গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ভোট দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের গণপরিষদ বা সংবিধান পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন (১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি) কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে ইংরেজী ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। ধীরেন দত্তকে ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী বর্বরভাবে হত্যা করেছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদেও বাংলায় কথা বলা হত না। ইংরেজীতে বক্তৃতা করা হত। সেই নিয়ম ভঙ্গ করে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (স্বল্পকালের জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন, মুসলিম লীগ সরকার কৌশলের সঙ্গে তাকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করে, এরপর তিনি আর কখনো নির্বাচনে অংশ নেননি)।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তমদ্দুন মজলিস নামে যে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কে ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি একটি পুস্তিকা লেখেন যেখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। প্রবন্ধগুলোতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যুক্তি স্থাপন করা হয়। ঐ তিনটি প্রবন্ধের লেখকরা হচ্ছেন, অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন, রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমেদ এবং স্বয়ং অধ্যাপক আবুল কাশেম।
২
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অভিমত তৈরি হচ্ছিল, যদিও পুরনো ঢাকার আদিবাসীদের মধ্যে এবং বিহার থেকে আসা মহাজেরদের মধ্যে বাংলার বিরুদ্ধে মতই ছিল প্রধান। পাকিস্তানের শুরুতেই ভাষার প্রশ্নে বিক্ষোভ দেখা দেয় যখন দেখা গেল যে, সদ্য প্রকাশিত চিঠির এনভেলাপ, পোস্টকার্ড ও ডাকটিকিটে শুধু ইংরেজী ও উর্দু রয়েছে, বাংলা নাই। সরকারি কর্মচারীদের এক অংশ সঙ্ঘবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মনে রাখতে হবে তখন পাকিস্তানের বয়স কয়েক মাসও হয়নি। ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরাও একইভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ‘পোস্টকার্ড- ডাকটিকিটে বাংলা নাই কেন’ এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যেই জেগে ওঠে। এই ঘটনার প্রতিবাদে প্রথম সভা ও মিছিল করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন নীলক্ষেত ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীরা। কোন কোন ছাত্রও তার সঙ্গে যোগ দেন। তারা দাবি তোলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দুর সঙ্গে বিরোধ নাই’। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে।
এদিকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা চলছে রাজধানী করাচিতে। ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করেন ও সভা আহŸান করেন অধ্যাপক আবুল কাশেম। যদিও আবুল কাশেম তমদ্দুন মজলিসের নেতা তবু তার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে অনেক প্রগতিপন্থী ব্যক্তি, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সরকারি কর্মচারীরা এই সভায় যোগদান করেন। শহীদ মুনির চৌধুরী তাদের অন্যতম।
ঘটনা আরো গড়াতে থাকে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, তমদ্দুন মজলিস, মুসলিম ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রমুখ একত্রিত হয়ে গঠন করেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (ডিসেম্বর, ১৯৪৭)। এর আহবায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের সদস্য নুরুল হক ভূঁইয়া। এই পরিষদে বিভিন্ন মতবাদের মানুষ ছিলেন। কমিউনিস্টরাও ছিলেন যদিও তারা কৌশলগত কারণেই তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করেননি। মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখ এই কমিটিতে ছিলেন। আমরা পরবর্তীতে দেখব, ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এই দুই নেতা এবং আবদুল মতিন। ভাষা আন্দোলন সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে সাড়া জাগালেও বস্তুত প্রত্যক্ষ আন্দোলনে ছিলেন ছাত্র ও কিছু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী। শ্রমিক শ্রেণীর কোন বিশেষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। তবে ঢাকা শহর রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ সেলিম বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সক্রিয়ভাবে ন্যাপ (ভাসানী) করতেন এবং ১৯৬৮-৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
ঘটনা আরো এগুতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঘনঘন প্রতিবাদী সভা মিছিল ইত্যাদি চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় যে এই দাবিতে ১১ই মার্চ (১৯৪৮) দেশব্যাপী হরতাল পালন করতে হবে। এবং সেজন্য নতুন করে আরো বড় আকারে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এবার আহবায়ক করা হয় শামসুল আমলকে। তিনিও তমদ্দুন মজলিসের সদস্য।
১১ই মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। পুলিশ বেধড়ক লাঠি চার্জ করে। সরকারের গুণ্ডাবাহিনী আক্রমণ করে। সচিবালয়ের বিভিন্ন গেটে দাঁড়িয়ে যারা সরাসরি পিকেটিং করেছিলেন এবং সেদিনের আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু), তাজউদ্দীন আহমেদ (১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী), শামসুল হক (যিনি পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন), মোহাম্মদ তোয়াহা (কমিউনিস্ট), অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব (যিনি এক পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদের আহবায়কও হয়েছিলেন) এবং ডা. করিম (আত্মপরিচয় গোপনকারী কমিউনিস্ট)। ঘটনা আরো অগ্রসর হলে বিশেষ করে জিন্না সাহেবের ঢাকা সফর ও উর্দুর পক্ষে ওকালতি করার পর তমদ্দুন নেতা ও সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক শামসুল আলম বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন এবং মোহাম্মদ তোয়াহাকে পরিষদের কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে তিনি আহবায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের দিকে বিশেষ করে ১১ই মার্চের হরতালের পর প্রাদেশিক সরকার শঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের কাছে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব পাঠান। ১৫ই মার্চ পরিষদের নেতারা মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেন এবং ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। এই আলোচনায় কারাগারের বাইরের নেতারা যেমন ছিলেন তেমনই কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব তারাও একভাবে অংশগ্রহণ করেন, অর্থাৎ তারা চুক্তিতে সম্মতি প্রদান করেছিলেন। ৮ দফা চুক্তির একটি বিশেষ দিক হল এই যে মুখ্যমন্ত্রী অঙ্গীকার করেছিলেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তিনি সুপারিশ করবেন এবং গণপরিষদে পাশ করানোর জন্য চেষ্টা করবেন। বলাই বাহুল্য মুখ্যমন্ত্রী সে অঙ্গীকার রাখেন নি। অন্যদিকে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কথা দেওয়া হয় যে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নার আসন্ন পূর্ব বাংলার সফর নিরুপদ্রূপ এবং তার ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হবে। স্থগিত রাখার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল তমদ্দুন মজলিস ও অন্যান্য জিন্নাভক্ত নেতারা। তমদ্দুন মজলিস এটাকে একটা বড় বিজয় বলে ঘোষণা করে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে আন্দোলন যতই বাড়তে থাকে তমদ্দুন মজলিস ততই পিছু হঠতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ৮ দফা চুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল ছাত্রবন্দীদের মুক্তি। এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরপরই ছাত্র নেতারা মুক্তিলাভ করেন।
৩
১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ জিন্না সাহেব ঢাকায় আসেন। ২১শে মার্চ রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। শ্রোতাদের অনেকে বিচলিত, বিভ্রান্ত হলেও মুখ বন্ধ রেখেছিল। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্না বক্তৃতা দেন ২৪শে মার্চ। তিনি সেখানে আরো জোরের সঙ্গে বলেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তিনি আরো বলেন যারা আন্দোলনকারী তারা হচ্ছে কমিউনিস্ট ও বিদেশী চর। জিন্না মনে করেছিলেন তার বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ আসবে না। কিন্তু জিন্নার এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রদের একাংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ‘নো নো’ বলে চিৎকার করে ওঠে। প্রথম ‘নো’ বলেছিলেন ছাত্রনেতা আবদুল মতিন যিনি পরবর্তীকালে ভাষা মতিন নামে পরিচিত হন। জিন্নার উপস্থিতিতেই সারা হল কাঁপিয়ে ছাত্ররা শ্লোগান দিতে থাকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অবশ্য একই সঙ্গে তারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’ শ্লোগানও দিয়েছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে জিন্না দ্রæত পুলিশ পাহারায় হল ত্যাগ করেন। জিন্নার এই অন্যায়, অযৌক্তিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন যে একমাত্র রাজনৈতিক নেতা, তিনি হলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। এমনকি ভাসানীও নিরব ছিলেন। কারণ তখনও পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের সদস্য। আর সোহরাওয়ার্দী যে সরাসরি উর্দুর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেকথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪
জিন্না চলে যাওয়ার পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং কিছুটা স্থবিরতাও লক্ষ্য করা যায়। সেই সময় ১৯৫০ সালে ১১ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আবদুল মতিনকে আহবায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হয়েছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন ক্রমাগত গতি লাভ করতে থাকে। এই সময় পাকিস্তানের গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটিতে আবারো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সুপারিশ করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এর বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক মহল আবার বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সালের নভেম্বরের ৪-৫ তারিখে প্রতিবাদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১২ই নভেম্বর ব্যাপক বিক্ষোভ ও মিছিল সারা দেশকে নাড়া দিয়েছিল। ইতিপূর্বে জিন্না মৃত্যুবরণ করেছেন। মুসলিম লীগের মধ্যে তাঁর মত একনায়কসুলভ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আর ছিল না। কেন্দ্রের সরকার ঢাকার অবস্থা দেখে কিছুটা ভীত হয়ে ওঠে। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে মূলনীতি কমিটির সুপারিশ স্থগিত করে সরকার।
১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মতিন গণপরিষদের সদস্যদের কাছে ইংরেজিতে লেখা একটি স্বারকলিপি প্রেরণ করেন। সেখানে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার পক্ষে যুক্তি স্থাপন করা হয়। ঐ স্বারকলিপি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছিল। সেই সময় লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষ উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেন। আবদুল মতিনের নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম কমিটি ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। তা সারাদেশে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। এমনকি কোথাও কোথাও যেমন নারায়ণগঞ্জে হরতাল পর্যন্ত হয়েছিল। সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ঢাকায় ৫ই এপ্রিল পতাকা দিবস পালন করা হয় যার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থদান করেন। আন্দোলন আবার জেগে উঠছে।
এর কিছুদিন পর ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন আবার রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। ইতিপূর্বেই ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চের অঙ্গীকার তিনি সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন এবং ঘোষণা দিলেন যে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুই হতে যাচ্ছে, আর পাকিস্তান হবে একটি ইসলামি রাষ্ট্র।”
তার বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সেই সময় ৩১শে জানুয়ারি (১৯৫২) বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল কর্মীসভা। তাতে যোগদান করেন বাংলা ভাষার পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতাকর্মীরা। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। প্রতিটি সংগঠন ও ছাত্রাবাস থেকে প্রতিনিধি নিয়ে ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আহŸায়ক কাজী গোলাম মাহবুব। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে প্রায় ১০-১২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিলেন। তারা মিছিল করে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’। ঐদিনের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে পরবর্তী ২১ তারিখ (২১শে ফেব্রæয়ারি) দেশব্যাপী হরতাল, সভা সমাবেশ ও প্রতিবাদী মিছিল করা হবে। উল্লেখ্য যে, ঐ ২১ তারিখে পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সফল করার জন্য মওলানা ভাসানী তার নিজস্ব তেজস্বী ভাষায় আহবান রেখেছিলেন, বিশেষ করে ছাত্রদের প্রতি।
৫
২১শে ফেব্রুয়ারিকে সফল করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি খুবই উদ্যোগী ছিল। পার্টির তরফ থেকে গোপনে খোকা রায়, জ্ঞান চক্রবর্তী প্রমুখ নিয়মিত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। তাছাড়া গোপনে যারা পার্টির পক্ষ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তারা হলেন লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯৫৬ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন), সাদেক খান (রাশেদ খান মেননের বড় ভাই, তিনি তখন কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন) এবং তকিউল্লাহ (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র)। সমগ্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন যারা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, গাজীউল হক এবং রণেশ দাশগুপ্ত (তিনি যদিও ছাত্র ছিলেন না কিন্তু প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতেন এবং বারবার গ্রেফতার হয়েছেন)।
২১শে ফেব্রুয়ারিকে সফল করার জন্য পার্টি তার কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি সার্কুলার জারি করে (১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২)। সার্কুলারের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত হলো:
আন্দোলন এখনও পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের ব্যাপক অংশের মধ্যে প্রসার লাভ করে নাই। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন এখনও প্রধানত শহরে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিয়া যাইতেছে। ...পাকিস্তানের মজুর ও কৃষকশ্রেণী যাহাতে এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে এবং আন্দোলনকে সঠিক পথে নিয়া যাওয়ার জন্য আগাইয়া আসিতে পারে, তার জন্য আমাদের পার্টির তরফ হইতে বিশেষ প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পারিচালনার জন্য বিভিন্ন দল, প্রতিষ্ঠান ও শ্রেণীর প্রতিনিধি লইয়া জেলায় জেলায় স্থায়ীভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করুন। সর্বদলীয় কমিটির নেতৃত্বে ও উদ্যোগে ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রচার, সাধারণ ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্র করার ব্যবস্থা করুন। ২১শে ফেব্রুয়ারি গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলিতেও যাহাতে হরতাল পালিত হয় তার জন্য বিশেষ চেষ্টা নেওয়া প্রয়োজন। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির উস্কানি সত্ত্বেও ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ সভা ও শোভাযাত্রা যাহাতে শান্তিপূর্ণভাবে চলে, সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন।
৬
২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার মিছিল বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এমনটি যে করতে পারবে এবং সরকার যে গুলিবর্ষণ পর্যন্ত করতে যাবে এটা তখন অনেকেরই ভাবনার মধ্যে ছিল না। মওলানা ভাসানীও তার এক পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে সফরে ছিলেন। অথচ ২১শে ফেব্রæয়ারির আগে এবং পরে তাঁর ঢাকায় থাকা জরুরি ছিল বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আতাউর রহমান খানও ২০ এবং ২১ তারিখে ঢাকায় ছিলেন না। মামলা পরিচালনার জন্য ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন। কোর্টের ঐ মামলার তারিখ পরিবর্তন করা সহজ ছিল বলেই মনে হয়। কিন্তু তিনি তা করেন নি। ২১শে ফেব্রæয়ারির গুরুত্বকে তিনিও বুঝতে পারেননি। অথবা মামলার নাম করে ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন।
যাই হোক, ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই এই পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ আলোচনায় বসে। ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা বেলায় আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে এই বৈঠকটি হয়েছিল। সেখানে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না এই নিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্ক হয়। মাত্র তিনজন সংগ্রামী নেতা- আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মাওলা (কারো কারো মতে চারজন, কিন্তু চতুর্থ নামটি পাওয়া যায় নি) জোরের সঙ্গে বলেন যে, ‘আমরা ১৪৪ ধারা অবশ্যই ভঙ্গ করব’। কিন্তু বাকি সকলেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেন। তাদের মতে শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক পথেই এগুনো উচিৎ এবং আইন অমান্য করা সঠিক হবে না। এইরকম কাপুরুষোচিত বক্তব্যই রাখেন সংগ্রাম পরিষদের তিনজন বাদে বাকি সকলেই। সেই সভায় সভপতিত্ব করছিলেন আবুল হাশিম সাহেব যিনি একদা নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুসলিম লীগারদের মধ্যে তাকে প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী বলে প্রচারিত আছে। তিনিও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরুদ্ধে। সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক কাজী গোলাম মাহবুবও একইভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরুদ্ধে। এই ধরণের মনোভাবকে কী বলব, সুবিধাবাদ না ভীরুতা? মাত্র দুই বছর আগে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল তার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক (তখনও পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক, পরে এই পদে অধিষ্ঠিত হন ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান), তিনিও ১৪৪ ধারা মান্য করার পক্ষে। আরেকজন রাজনৈতিক নেতা কামরুদ্দিন আহমেদও ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। যাই হোক সেদিন ঐ সভায় পক্ষে বিপক্ষে ভোটাভুটি হয়। মাত্র তিনটি ভোট ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিল। আবদুল মতিনের প্রস্তাব ১১/৩ ভোটে পরাজিত হয়।
এখানে লক্ষণীয় যে মোহাম্মদ তোয়াহা কোন পক্ষেই ভোট দেন নি। তিনি ভোটদানে বিরত ছিলেন। কিন্তু তোয়াহার মত সংগ্রামী মানুষের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। কী কারণে তিনি বিরত ছিলেন? কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহার নিজস্ব লিখিত স্মৃতিচারণ থেকে আমরা যা পাই তা নিম্নরূপ।
সেদিন কার কি ভূমিকা ছিল এই নিয়ে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে।... সেখানে বেশ জোর দিয়েই সেদিন আমি বলেছিলাম যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করলে আর এক কদমও এগুনো যাবে না; কিন্তু আমি ভোটাভুটিতে যেতে রাজি নই।... আমি অপেক্ষা করছিলাম আমাদের পার্টির কোন নির্দেশ আমার কাছে আসে কিনা। কিন্তু কোন... নির্দেশ আমার কাছে আসেনি। কেউ কেউ বলেছিল যে, কম্যুনিস্ট পার্টি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরোধিতা করেছিল কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
পাশাপাশি আমরা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য খোকা রায়ের বক্তব্য মিলিয়ে দেখতে পারি:
“২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর পার্টির কয়েকজন আন্ডারগ্রাউন্ড প্রাদেশিক নেতা ও পার্টির যুব-ছাত্র নেতাদের এক বৈঠক হয়েছিল। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ২১ তারিখ ছাত্র মিছিল করার জন্য একটি প্রস্তাব পার্টির ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে পরের দিন ছাত্র সমাবেশে উত্থাপন করা হবে। সে প্রস্তাব সম্পর্কে ঐ ছাত্র সমাবেশ যে রায় দেবে পার্টির সব সভ্য ও কর্মী তা মেনে চলবে”। [সূত্র: ‘ভাষা আন্দোলনের দলিল সংকলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’, (১৯৮৯)] ।
২০শে ফেব্রুয়ারির রাতের সভায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে পরদিন আমতলায় যে ছাত্রসভা হবে সেখানে দুই পক্ষ তাদের বক্তব্য রাখবে। ছাত্রদের অধিকাংশ যা বলবে সেটাই করা হবে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে তথাকথিত বিরাট মাপের নেতারা ধারণা করেছিলেন যে ছাত্ররা পুলিশের গুলির মোকবেলা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে সাহসী হবে না। তাদের ধারণা যে ভুল ছিল তা পরবর্তী ঘটনাবলী প্রমাণ করে। যথারীতি পরদিন আমতলায় ছাত্রসভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। তিনি অবশ্য সংগ্রাম পরিষদের কোন সদস্য ছিলেন না এবং সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বক্তব্য রাখেন নি। ছাত্রদের যে মত সে মতই তিনি মান্য করবেন বলে ঘোষণা দেন। আহবায়ক গোলাম মাহবুবসহ অধিকাংশই শান্তিপূর্ণ থাকা এবং ১৪৪ ধারা মান্য করার পক্ষে বক্তব্য রাখলেও আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে যুক্তি তর্ক সহকারে খুব উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। অলি আহাদও ছাত্রদেরকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে উদ্দীপ্ত করেন। অন্যদিকে শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব এবং তমদ্দুন মজলিসের নেতারা অনেক যুক্তি তর্ক সাজিয়ে ১৪৪ ধারা অমান্য করার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে এইধরণের সুবিধাবাদী নেতারা তাদের বক্তব্য শেষ করতে পারেন নি। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিল ১৪৪ ধারা তারা ভাঙ্গবেই।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হল। নির্ধারিত কর্মসূচী অনুসারে ছাত্ররা আইন পরিষদের ভবনের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ চরম মারমুখী হয়ে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকে। তবু ছাত্ররা পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙ্গতেও যেমন পারেননি, তেমনি পুলিশও ছাত্রদেরকে পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। যাই হোক, পরিস্থিতি এমন ছিল না যে গুলি করতে হবে। পুলিশ বিনা প্ররোচনায়, কোন রকম হুঁশিয়ারি ঘোষণা না করেই মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাস্তায় জমায়েত ছাত্রদের দিকে তাক করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। সরকারি হিসাব মতে তখন সময় ছিল বেলা ৩টা বেজে ২০ মিনিট। এবং পুলিশ গুলি করেছে ২৭ রাউন্ড। হতাহতের সঠিক হিসাব দেওয়া বেশ কঠিন। ২১শের প্রথম শহীদ হলেন রফিক উদ্দীন। এছাড়াও শহীদ হলেন আবদুল জব্বার, আবুল বরকত, আবদুস সালাম প্রমুখ। রফিক উদ্দীন ছিলেন ছাত্র, আবদুল জব্বার ছিলেন লুঙ্গি পরা শ্রমজীবী, আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আবদুস সালাম ছিলেন সরকারি কর্মচারী। গুলির প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র দেশবাসী স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠল। গুলির খবর শুনে প্রতিবাদে প্রাদেশিক আইন পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন ত্যাগ করে আহত ও নিহতদের দেখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে চলে আসেন। তারা হলেন, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, শামসুদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারা খাতুন, মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। এদিকে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলকে আন্দোলনের কন্ট্রোল রুম বানিয়ে মাইকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে থাকেন। সারা শহরে, এমনকি সারা দেশে গুলির প্রতিবাদে সভা, মিছিল চলতে থাকে। এইরকম পরিস্থিতিতে আগের সংগ্রাম পরিষদ ও তার আহবায়ককে বাতিল করে গোলাম মাওলাকে নতুন আহবায়ক করা হয়। অলি আহাদ, আবদুল মতিন, ইমাদুল্লাহ এখন আন্দোলনের হাল ধরে আন্দোলনকে আরো অগ্রসর করে নিতে থাকেন। ঠিক হয়েছিল পরদিন জানাজা ও শোকসভার আয়োজন করা হবে। শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন যুব নেতা ইমাদুল্লাহ (তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন)। ২২ ফেব্রæয়ারি, পরদিন হরতাল ডাকা হয়। এমন সফল হরতাল খুব কমই হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। দোকানপাট, বাজার-হাট পুরোপুরি বন্ধ ছিল। অফিস-আদালতে কোন কাজ হয়নি। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে কোন ট্রেন ছাড়েনি। কিন্তু সরকার সেদিনও নিরীহ মানুষ ও পথচারীদের উপর গুলি চালায়। তাতে শহীদ হন হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, রিকশা চালক আবদুল আওয়াল, কিশোর ওহিউল্লাহ, যুবক সিরাজ উদ্দীন এবং আরো অনেকে। মসজিদে মসজিদে শহীদদের জন্য মোনাজাত পড়া হয়। বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উড়তে থাকে। ক্রুদ্ধ জনতা সরকারি মুখপত্র ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘সংবাদ’ পত্রিকা (তখন সংবাদ মুসলিম লীগের মুখপত্র ছিল) আক্রমণ করে। ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার ছাপাখানা জনতার ক্রদ্ধ রোষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ছিল এক অভ্যুত্থান। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা ভয়ে সামরিক ক্যান্টনম্যান্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। সারা দেশে টানা ৫দিন ধরে হরতাল চলে। তারপর সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সংগ্রাম কমিটি ৬ষ্ঠ দিবসে হরতাল স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু শিক্ষায়তনে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। এমতাবস্থায় আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য ২৭শে এপ্রিল, ১৯৫২, ঢাকা বার লাইব্রেরিতে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত করা হয় এবং নতুন করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় যেখানে আতাউর রহমান খানকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক করা হয়। এরমধ্যে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। ইতিপূর্বে ৫ই মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির গোপন উদ্যোগে একটি গোপন স্থানে পার্টির সক্রিয় কর্মী ও আন্দোলনের কয়েকজন অকমিউনিস্ট নেতাদের একটি গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কারোর বিশ্বাসঘাতকতা অথবা কোন প্রকার ভুলত্রুটির কারণে খবরটি পুলিশের কাছেও চলে গিয়েছিল। পুলিশ মিটিংয়ের স্থানটি ঘেরাও করে সেই স্থান থেকে ৮জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন:
১. মোহাম্মদ তোয়াহা
২. অলি আহাদ
৩. আবদুল মতিন
৪. সাদেক খান
৫. আবদুল লতিফ চৌধুরী
৬. হেদায়েত হোসেন চৌধুরী
৭. মজিবুল হক
অষ্টম নামটি এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। পরে কাজী গোলাম মাহবুব (যিনি ইতিপূর্বে সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ছিলেন), এবং খন্দকার মুশতাক আহমেদ (বঙ্গবন্ধুর খুনী) নিজেরাই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফেব্রুয়ারির এই অভ্যুত্থানের পরপরই সরকার মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান আগের থেকেই কারারুদ্ধ ছিলেন।
২০ নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এবং ৫ ডিসেম্বর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আরমানীটোলা ময়দানে পরপর দুইটি জনসভা ডাকা হয়। সেদিনের ঢাকার জনসংখ্যা অনুসারে এই জনসভা দুইটি ছিল বিশাল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ছাড়াও সভা থেকে রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয় এবং ৫ ডিসেম্বর দেশব্যাপী বন্দী মু্িক্ত দিবস পালিত হয়। তখন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের অধিকাংশই জেলে।
অবশ্য তাদের বেশিদিন জেলে থাকতে হয়নি। দেশের পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকে। নুরুল আমিনের মুসলিম লীগও ভেঙ্গে পড়ে। সরকার নির্বাচন ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এবং একই সঙ্গে রাজবন্দীদের অধিকাংশ (মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ) মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু ও কমিউনিস্ট পরিচিতির বন্দীরা জেলেই থাকেন। কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও অব্যাহত থাকে।
এখানে দেখার বিষয় এই যে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের উপর গুলি সারা দেশব্যাপী যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা কিন্তু হাজং বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ অথবা নাচোলের সাঁওতাল বিদ্রোহ তেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে নি। ইলা মিত্র, অপর্ণা পাল ও অন্যান্য কৃষক নেতা ও কমিউনিস্টদের উপর যে বর্বর অত্যাচার, জেলের অভ্যন্তরে গুলি, শত শত মানুষকে হত্যা ও নারী ধর্ষণ করা হয়েছিল, যা অন্তত ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তাও সংবাদপত্রে প্রকাশ পায় নি, অথবা পেলেও কোন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জনমনেও একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে এই কমিউনিস্ট বিদ্রোহীরা পাকিস্তান ভাঙ্গতে চায়। পাকিস্তান ভাঙ্গুক এমনটি তখনো জনগণ চায়নি। তবে ভাষা আন্দোলনের পর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটা গুণগত পরিবর্তন এসেছিল। সাধারণ মানুষ এবার অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে এবং ইসলাম, পাকিস্তানী তমদ্দুন ইত্যাদি ভাষা আর তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি একটি প্রগতিমুখী দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে আমরা সে সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনা করব।