৩: নিউক্লীয় ফিউশন
প্রাকৃতিক তেজষ্ক্রিয়তা এবং নিউক্লিয় ফিশন উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চ ভরসংখ্যা বিশিষ্ট নিউক্লিয়াসগুলো প্রভাবিত হয়। যার ফলে নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটে এবং মাঝারি আকৃতির এবং অনেক বেশি স্থিতিশীল নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় ভর হ্রাস পায় এবং শক্তি উৎপন্ন হয় ও ছড়িয়ে যায়। এর বিপরীতে, ছোট ভর সংখ্যা বিশিষ্ট পরমাণু পরস্পরের সাথে একীভূত হওয়া বা গলে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াসেও পরিণত হওয়া সম্ভব। এই ক্ষেত্রেও নিউক্লিয়াস মাঝারী আকৃতির এবং অনেক বেশি স্থিতিশীল নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এই ক্ষেত্রেও ভর হ্রাস পায় এবং শক্তি উৎপন্ন হয় ও ছড়িয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে, উচ্চ ভরসংখ্যা থেকে মাঝারি মানে নামতে সন্নিবেশ ভগ্নাংশ যেখানে মৃদু ভাবে বৃদ্ধি পায়, সেখানে নিম্ন ভরসংখ্যা থেকে মাঝারি মানে উঠতে সন্নিবেশ ভগ্নাংশ খাড়া ভাবে বৃদ্ধি পায়। এ থেকে বোঝা যায়, নিউক্লিয় ফিউশন প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট ভরের জন্য নিউক্লীয় ফিশনের তুলনায় আরো বেশি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।
চলুন একটি উদাহরণের সাহায্যে দেখা যাক এটি কীভাবে কাজ করে। হাইড্রোজেন-২-এর একটি নিউক্লিয়াস (১ টি প্রোটন ও ১ টি নিউট্রন) অন্য আরেকটি হাইড্রোজেন-২ এর নিউক্লিয়াসের সাথে একীভূত হয়ে হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস (২ টি প্রোটন ও ২ টি নিউট্রন) গঠন করে। হাইড্রোজেন-২ এর ভর সংখ্যা ২.০১৪০ এবং দুইয়ের মিলে মোট হয় ৪.০২৮০। তবে হিলিয়াম-৪ এর ক্ষেত্রে এর আকারের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ সন্নিবেশ ভগ্নাংশ দেখা যায়। এর ভর সংখ্যা ৪.০০২৬। তাহলে হাইড্রোজেন-২ থেকে হিলিয়াম-৪ এর পরিণত হওয়ার সময় হারানো ভরের পরিমাণ ৪.০২৮০-৪.০২২৬ = ০.০২৫৪। এই হারানো ভর ০.০২৫৪ হচ্ছে মূল ভর ৪.০২৮০ এর ০.৬৩ শতাংশ।
এই পরিমাণটুকু শুনতে খুব বেশি মনে হয় না। হাইড্রোজেন-২ থেকে হিলিয়াম-৪ এর ফিউশন প্রক্রিয়ায় এর ভরের এক শতাংশের ৫/৮ অংশ কেবল শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু বাস্তবে এই পরিমাণটুকু আসলে প্রকাণ্ড। প্রাকৃতিক তেজষ্ক্রিয় পরিবর্তনের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম-২৩৮ থেকে লেড-২০৬ এ পরিণত হতে প্রাথমিক ভরের মাত্র ০.০২৬ শতাংশ আর ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ক্ষেত্রে মাত্র ০.০৫৬ শতাংশ ভর হ্রাস পায়। একই পরিমাণ ভরের জন্য হাইড্রোজেনের ফিউশন, প্রাকৃতিক তেজষ্ক্রিয়তার চেয়ে ২৪ গুণ এবং ইউরেনিয়াম ফিশনের চেয়ে ১১ গুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।
নিউক্লিয় ফিউশনের ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা এই মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই এই বিষয়টি শক্তির অন্যান্য উৎস যেমন নিউক্লিয় ফিশনের আগে থেকেই জানা ছিল। এর গল্পটি হচ্ছে এমন:
১৮৪৭ সালের শক্তির সংরক্ষণশীলতা সূত্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা সূর্যের বিকিরিত শক্তির উৎস সম্বন্ধে চিন্তিত ছিলেন। এই বিকিরণ সমগ্র মানব ইতিহাস জুড়ে বিরাজমান আছে এবং ভূ-তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, মানবজাতির উদ্ভবের অনেক আগে থেকেই এই বিকিরণ চলছে।
ঊনিশ শতকে এমন কোনো শক্তির উৎস জানা ছিল না, যা সূর্যকে শতকোটি বছর কিংবা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রজ্জ্বলিত করে রাখতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন শিলাখণ্ড, উল্কা প্রভৃতির তেজষ্ক্রিয় উপাদানের পরিমাণের নির্ণয়ের মাধ্যমে এগুলোর বয়স নির্ধারণ করতে শুরু করেন। এসব থেকে শীঘ্রই জানা গেল, আমাদের সৌরজগত আসলে কয়েকশো কোটি বছর পুরোনো। বর্তমানে এর বয়সের সবচেয়ে যথার্থ অংকটি হচ্ছে ৪,৫৫০,০০০,০০০ বছর।
১৯১০ সালের মধ্যে জানা হয়ে গিয়েছিল যে, অন্য যে কোন উৎসের বিবেচনায় নিউক্লিয় শক্তি অনেক বেশি তীব্র। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন (১৮৮২-১৯৪৪) প্রস্তাব দিয়েছিলেন সূর্যের শক্তি হয়তোবা হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের ফিউশনে উৎপন্ন হতে পারে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে তাঁর এই প্রস্তাব আরো যথার্থ মনে হতে লাগল। যখন অ্যাস্টন সন্নিবেশ ভগ্নাংশের বিষয়টি নির্ণয় করেন তখন পরিষ্কার হয়ে এলো, হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের ফিউশনই সূর্যের শক্তির সম্ভাব্য সবচেয়ে সহজ এবং পর্যাপ্ত উৎস।
তারপর, ১৯২৯ সালে, আমেরিকান জ্যোতির্বিদ হেনফর নোরিস রাসেল (১৮৭৭-১৯৫৭) সতর্কতার সাথে সূর্যের আলোক বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেন এবং আবিষ্কার করেন যে সূর্যের অধিকাংশই হলো হাইড্রোজেন। সূর্যের প্রায় ৯০ ভাগ পরমাণুই হাইড্রোজেন আর ৯ ভাগ হলো হিলিয়াম। বাকি সকল মৌলের পরমাণু মিলে অবশিষ্ট ১ শতাংশ গঠন করে। এ থেকে বোঝা যায়, হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের ফিউশন শুধু যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি উৎপাদনের সবচেয়ে সরল নিউক্লীয় বিক্রিয়া নয়, বরং এটিই একমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ নিউক্লিয় বিক্রিয়া যা সংঘটিত হতে পারে।
সূর্যের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেনের ফিউশনে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস উৎপাদন প্রক্রিয়া। চিত্রে নিউট্রিনো এবং পজিট্রনের নিঃসরণ দেখা যাচ্ছে যেগুলো সম্বন্ধে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
১৯৩৮ সালে, জার্মান-আমেরিকান পদার্থবিদ হ্যান্স আলব্রেখট বেথে (জন্ম ১৯০৬) গবেষণাগারের অভ্যন্তরে সংঘটিত বিভিন্ন নিউক্লীয় বিক্রিয়া এবং মহাজাগতিক ইন্টারফেরেন্স থেকে সূর্যের কেন্দ্রের ঘটতে-বাধ্য ঘটনাবলী নির্ণয় করেন। এই কাজের জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
বর্তমানে ধারণা করা হয়, অধিকাংশ স্বাভাবিক নক্ষত্রই নিরবচ্ছিন্নভাবে হাইড্রোজেনের ফিউশন চালিয়ে যাচ্ছে যা তাদের কয়েকশো কোটি বছরের শক্তির যোগান দিয়ে যেতে পারে। ক্রমান্বয়ে, বিশেষ করে আরো ভারী নক্ষত্রের ক্ষেত্রে, কেন্দ্রের পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে হিলিয়াম আবারো ফিউশন প্রক্রিয়ায় আরো ভারী নিউক্লিয়াস যেমন: কার্বন, অক্সিজেন, নিয়ন, সিলিকন থেকে আয়রন পর্যন্ত উৎপন্ন করতে পারে এই পর্যায়ে এসে প্রক্রিয়াটি থেমে যায় কেননা আয়রনের ক্ষেত্রে সন্নিবেশ ভগ্নাংশ সর্বোচ্চ হয়।
অত্যাধিক ভারী নক্ষত্রগুলো যতদূর সম্ভব ফিউশন চালিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তাদের শক্তির উৎস ফুরিয়ে আসতে থাকে এবং তাদের বাইরের স্তরগুলোকে তারা আর ধরে রাখতে পারে না। ফলে নক্ষত্র গুটিয়ে যেতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়ায় বাইরের দিকের স্তরে থাকা হাইড্রোজেনকে একত্রে আকস্মিকভাবে ফিউশনে যায়। ফলাফল হিসেবে প্রলয়ঙ্কারী শক্তির উদগীরণ পাওয়া যায়। একটি প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে যাকে বলা হয় সুপারনোভা। বিস্ফোরণের ফলে বিস্ফোরনোন্মুখ নক্ষত্রটির ভরের বিরাট অংশ চতুর্দিকের মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হয় একই সময়ে ভিতরের দিকের অবশিষ্ট ভরটুকু গুটিয়ে সংকুচিত হয়ে গিয়ে নিউট্রন তারকা নামে অত্যন্ত ক্ষুদ্র বস্তুতে কিংবা তার চেয়েও ক্ষুদ্র, কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয়।
বর্তমানে ধারণা করা হয, মহাবিশ্ব সৃষ্টির সূচনালগ্নে শুধু হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এর চেয়ে ভারী নিউক্লিয়াসগুলো শুধু প্রকাণ্ড নক্ষত্রগুলোর কেন্দ্রেই উৎপন্ন হয় এবং শুধুমাত্র এই প্রকান্ড নক্ষত্রগুলোর বিস্ফোরণের মাধ্যমেই এই ভারী নিউক্লিয়াসগুলো ধূলি, গ্যাস কিংবা জঞ্জালের মতো বস্তু হিসেবে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তুত সুপারনোভা বিস্ফোরণে এত বিপুল শক্তি সহজপ্রাপ্য হয় যে, আয়রনের নিউক্লিয়াস ইউরেনিয়াম বা তারচেয়েও আরো ভারী নিউক্লিয়াসে পরিণত হতে বাধ্য হয় এবং এসব কিছুও চারপাশের মহাশূন্যে ছড়িয়ে যায়।
এক পর্যায়ে, আন্তনাক্ষত্রিক ধূলো-বালি ও গ্যাস থেকে নতুন নক্ষত্র গঠিত হয় যাদের মধ্যে সুপারনোভায় ছিটকে পড়া ভারী নিউক্লিয়াসগুলোও থাকে। এই নতুন নক্ষত্রগুলো দ্বিতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র। এরা এবং এদের গ্রহগুলোতে বিপুল পরিমাণ ভারী নিউক্লিয়াস বিদ্যমান থাকে।
সূর্য এ ধরনেরই একটি দ্বিতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র। এই পৃথিবী এবং আমরা, আমাদের সবাই প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভারী নিউক্লিয়াস দিয়ে গঠিত হয়েছি যা কোনো এক সময় কোনো প্রকান্ড নক্ষত্রের কেন্দ্রে তৈরি হয়েছিল এবং প্রকান্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু যদি হাইড্রোজেনের ফিউশনে প্রাকৃতিক তেজষ্ক্রিতার চেয়ে এতই বিপুল পরিমাণ শক্তি উন্মুক্ত হয় তাহলে কেন তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং প্রাকৃতিক তেজষ্ক্রিয়তার চেয়ে আরো দ্রুততার সাথে ঘটে না? পৃথিবীতে, ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম ধীরে ধীরে বিয়োজিত হয়ে অপেক্ষাকৃত হালকা নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়, এমনকি খুবই বিরল ক্ষেত্রে, স্বতঃস্ফূর্ত ফিশনের মধ্য দিয়ে যায়, কিন্তু হাইড্রোজেন স্থিতিশীল থাকে এবং কোনো ধরনের ফিউশনের লক্ষণ দেখায় না।
এর কারণটি বের করা তেমন কষ্টসাধ্য কিছু নয়। ভারী নিউক্লিয়াস যেমন, ইউরেনিয়াম বা থোরিয়ামের নিউক্লিয়াসসমূহের যাবতীয় প্রোটন এবং নিউট্রনগুলো একটি স্থানে গোটানো অবস্থায় থাকে। তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটার থাকলে তা ঘটে যায়। তবে, হাইড্রোজেনের ফিউশনের ক্ষেত্রে দুটি হাইড্রোজেন-২ নিউক্লিয়াস অথবা চারটি হাইড্রোজেন-১ নিউক্লিয়াস, যারা পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক অবস্থায় থাকে তাদের ইলেক্ট্রনের বাধা অতিক্রম করার জন্য যথেষ্ট শক্তির প্রয়োজন হবে। যার ফলে তারা পারস্পরিক বিকর্ষণ অতিক্রম করে যথেষ্ট বলে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে ফিউশনের সূচনা করতে পারবে। সাধারণ তাপমাত্রায় তাদের গতি প্রয়োজনীয় শক্তির খুব সামান্যও সরবরাহ করতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে, প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করার জন্য, তাপমাত্রা হতে হয় অতি উচ্চ কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি। এই অবস্থাতেই কেবল হাইড্রোজেন পরমাণু অল্প ঘনত্বের মধ্যে সংকুচিত হয়ে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের মধ্যে স্পন্দনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সংঘর্ষ ঘটিয়ে তাদের পৃথক করে রাখা অস্বাভাবিক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে।
এই ধরনের অবস্থা তৈরি হতে পারে নক্ষত্রের কেন্দ্রে। ১৯২৬ সালে এডিংটন একটি সন্তোষজনক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্যের সর্বত্র গ্যাসীয় অবস্থা বিরাজমান। সূর্যের একেবারে কেন্দ্রে তাপমাত্রা এবং চাপ এতো বেশি যে, সেই অবস্থায় পরমাণু ভেঙে যেতে পারে। ইলেক্ট্রনগুলো একে অপরের উপর ঢলে পড়তে পারে এবং নিউক্লিয়াসগুলো একে অপরের কাছাকাছি চলে আসতে পারে।
আমরা বর্তমানে বিশ্বাস করি, সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ১৫,০০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ঘনত্ব ১৬০ গ্রাম/কিউবিক সে.মি. যা সোনার ঘনত্বের চেয়ে ৮ গুণ বেশি। তারপরেও কেন্দ্রটি গ্যাসীয়। কারণ পরমাণু ভেঙে নিউক্লিয়াসগুলো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। যেমন সাধারণ গ্যাসীয় বস্তুগুলো অবিকৃত পরমাণুগুলোও করে থাকে। ফলশ্রুতিতে, কেন্দ্রের ছোট একটি হিলিয়াম কোরের পৃষ্ঠে নিউক্লীয় ফিউশন সংঘটিত হয়। সেই হিলিয়ামটুকু প্রাথমিকভাবেই সূর্যের ছিল এবং পাশাপাশি ৪.৫৫ বিলিয়ন বছর ধরে হাইড্রোজেনের ফিউশনের মাধ্যমেও যোগ হচ্ছে।
তাহলে, আমরা যদি পৃথিবীর বুকে একটি ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে চাই তাহলে কীভাবে তা করতে পারি? কেমন করে আমরা এতো বেশি তাপমাত্রা ও চাপের ব্যবস্থা করতে পারি?
ফিশন বোমা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর এটিকেই এই উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপ তৈরির একটি পদ্ধতি হিসেবে দেখা হলো। যদি ফিশন বোমার মধ্যে কিছু পরিমাণ হাইড্রোজেন কোনো ভাবে যুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে ফিশন বিক্রিয়ার প্রথম কয়েকটি মুহূর্তে হাইড্রোজেনের তাপমাত্রা এবং চাপ হয়তো এদের ফিউশন প্রক্রিয়ার সূচনার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই সফলতার সাথে একটি নিউক্লীয় ফিউশন বোমা তৈরি করেছিল। সেটি হাইড্রোজেন বোমা বা ঐ-বোমা নামে অধিকতর জনপ্রিয় হয়েছিল। এটিকে অনেকসময় তাপ-নিউক্লীয় বোমা বলা হয়। কেননা নিউট্রন বিস্ফোরণের বদলে ফিউশন বোমার বিস্ফোরণের সূচনা করা হয় মাত্রাতিরিক্ত তাপের মাধ্যমে।
ফিউশন বোমার প্রবল শক্তির কারণে এটি বিস্ফোরিত হয় চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির মাধ্যমে। এই বিস্ফোরণ এতোই শক্তিশালী যে, কোনো যুদ্ধে যদি এটি মুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সভ্যতা প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তোবা সার্বিকভাবে মানবজাতি এবং চরম ক্ষেত্রে অধিকাংশ জীবই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সূর্য নিজে অবশ্য কার্যত একটি প্রকান্ড ফিউশন বোমা, কিন্তু এটি ফেটে যায় না। পৃথিবীর চেয়ে ৩৩৩,০০০ গুণ ভারী সূর্যের মহাকর্ষ ক্ষেত্র প্রবল হওয়ায় তা এর অভ্যন্তরীণ ফিউশনের নৈরাজ্যের বিপরীতে এর বস্তুসমূহকে টেনে ধরে রাখে। তাই আমরা এই মহাজাগতিক বোমার স্বাগত কিরণে বসে রোদ পোহাই। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা এর কাছ থেকে ৯৩,০০০,০০০ মাইল নিরাপদ দূরত্বে আছি।
নিউক্লিয় ফিউশনের সূচনা করে একে নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিমায় চালানো সম্ভব কি? এটিকে কি ধীর গতির শক্তি উৎপাদনে কাজে লাগানো সম্ভব, যাতে সেই শক্তি ব্যবহার করা যায় এবং তা ধ্বংসাত্মক না হয়? যদি ব্যবহারিক প্রেক্ষিতে একে কাজে লাগানো যায় তাহলে আমরা এমন এক ধরনের নিউক্লীয় শক্তি পাব যা পাওয়াও সহজ আর নাড়াচাড়া করাও সহজ। শিলা থেকে লঘু অবস্থায় প্রাপ্ত ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম সংগ্রহ না করে আমরা তখন সমুদ্র থেকে হাইড্রোজেন-২ সংগ্রহ করতে পারব। হাইড্রোজেন-২, হাইড্রোজেন-১ এর চেয়ে অনেক বিরল, কিন্তু হাইড্রোজেন-২ অনেক সহজে ফিউশন বিক্রিয়ায় যায়, এবং বিরল হলেও সমুদ্রে তা যে পরিমাণে পাওয়া যাবে তা দিয়ে আমরা কয়েকশ কোটি বছর টিকতে পারব।
তবে, এর বাইরেও, ফিশনের ক্ষেত্রে একটি ন্যূনতম পরিমাণ ফিশনযোগ্য বস্তুর সরবরাহ দিতে হয়, যার ফলে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে যায়। ফিউশনের ক্ষেত্রে খুব সামান্য জ্বালানী নিয়ে কাজ করা যায়, যার ফলে বড় কোনো ধরনের দুর্ঘটনা কেবল যাদুঘরের বিষয়ে পরিণত হবে। সবশেষে, ফিউশনশক্তি কোনো ধরনের তেজষ্ক্রিয় বস্তু উৎপন্ন করবে না যা ফিশনের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়।
তবে, নিয়ন্ত্রিত নিউক্লীয় ফিউশন ঘটানোর জন্য আমাদের হাইড্রোজেন-২ কে উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপের মধ্য আনতে হবে। আমারা এখনো এই পরিমাণ চাপের ব্যবস্থা করতে পারি না। আমাদের এখনকার পর্যায়ে উৎপাদন সম্ভব তাপমাত্রাকেও আরো বৃদ্ধি করতে হবে, এবং একই সময়ে হাইড্রোজেনকে চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আবদ্ধ করতে হবে।