অধ্যায় ১১
কোয়ার্কসমূহ
১: হেড্রন চিড়িয়াখানা
এখন পর্যন্ত আমরা যেসব সাব-অ্যাটমিক কণিকা নিয়ে আলোচনা করেছি, চলুন সেগুলো একবার পর্যালোচনা করা যাক। প্রথমত, আমরা লেপটন নিয়ে আলোচনা করেছি যারা দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া দেখায় এবং যদি এদের বৈদ্যুতিক চার্জ থাকে তাহলে তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়া দেখায় তবে এরা সবল মিথষ্ক্রিয়া দেখায় না। এদেরকে মৌলিক কণিকা বলেই মনে হয় যাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোনো গঠন নেই। এদের তিন ধরনের ফ্লেভারে পাওয়া যায়, ইলেক্ট্রন ও এর নিউট্রিনো, মিউয়ন ও এর নিউট্রিনো এবং টাউয়ন ও এর নিউট্রিনো। এই তিনটির আবার প্রতিকণিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা মোট ১২ ধরনের লেপটন পেতে পারি। বিজ্ঞানী এর বাইরে আর কোন লেপটন পাওয়ার আশা করেন না।
দ্বিতীয়ত আলোচনা করা যায় বিনিময়যোগ্য কণিকা নিয়ে, যারা চার ধরনের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যস্থতা করে মহাকর্ষীয় মিথষ্ক্রিয়ার জন্য গ্রাভিটন, তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়ার জন্য ফোটন, দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার জন্য ড কণিকা এবং সবল মিথষ্ক্রিয়ার জন্য ইউকাওয়ার বিনিময় যোগ্য কণিকা পাইয়ন। গ্র্যাভিটন এবং ফোটন একক কণিকা, কিন্তু ড কণিকা এবং পাইয়ন উভয়ে ধনাত্মক, ঋনাত্মক ও নিরপেক্ষ এই তিন ধরনের হয়ে থাকে। এর মানে হলো, মোট বিনিময়যোগ্য কণিকার সংখ্যা ৮। বিজ্ঞানীরা এগুলোর বাইরে আর কোনোটি খুঁজে পাওয়ার আশা করেন না।
এগুলো বাদ দিলে আর বাকি থাকে সবল মিথষ্ক্রিয়া যেসব কণিকার উপর ক্রিয়াশীল থাকে সেই ব্যারিয়নসমূহ। অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রন। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে এদের অন্তর্ভূক্ত থাকার কারণেই সবল-মিথষ্ক্রিয়া তত্ত্বের উদ্ভব হয়। পাশাপাশি আছে পাইয়ন, যারা মেসন শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত এবং সবল মিথষ্ক্রিয়া দেখায়।
যেসব কণিকা সবল মিথষ্ক্রিয়া দেখায় অর্থাৎ ব্যারিয়ন এবং মেসন শ্রেণির কণিকাগুলোকে একত্রে বলা হয় হেড্রন (ঐধফৎড়হ), গ্রিকভাষায় যার অর্থ “মোটা” বা শক্তিশালী। হেড্রনগুলো তাই লেপটনের বেশ ভালো রকমের বিপরীত যেখানে লেপটনের অর্থ “দুর্বল”, যা আমি পরের দিকে ব্যাখ্যা করেছি।
যদি প্রোটন, নিউট্রন, তাদের প্রতিকণিকাসমূহ, সেই সাথে তিনটি পাইয়নই হতো বিদ্যমান সব ধরনের হেড্রন তাহলে তাদের সংখ্যা হতো মোট ৭, একটি যুক্তিযুক্ত সংখ্যা। কেননা, তিনটি পাইয়নকে বিনিময়যোগ্য কণিকা হিসেবে ধরে বাকি লেপটন, হেড্রন, তাদের সবার প্রতিকণিকা সব মিলিয়ে মোট কণিকার সংখ্যা হয় মাত্র ২৪ টি, যা বিজ্ঞানীদের একটি সরল মহাবিশ্বের বর্ণনা দেওয়ার জন্য বেশ চমৎকার।
তবে কণিকা ত্বরণ যন্ত্র যত বড় করে তৈরি হতে লাগল এবং যত কার্যকরী হতে লাগল। ততোই সেগুলো আরো শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম হলো। বিজ্ঞানীরা দেখলেন বিপুল পরিমাণ শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে এমন সব কণিকা পাওয়া যাচ্ছে যাদের উচ্চশক্তি অবস্থা ছাড়া কখনো দেখা যায় না। এই কণিকাগুলোর প্রতিটিই মাত্রাতিরিক্ত ধরনের অস্থিতিশীল, সর্বোচ্চ এক সেকেন্ডের মিলিয়ন ভাগ পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়িত্ব আরো কম।
এই নতুন আবিষ্কৃত কণিকাগুলোর মধ্যে লেপটন হিসেবে রয়েছে টাউয়ন এবং এর নিউট্রিনো, বিনিময়যোগ্য কণিকার মধ্যে ড কণিকা এবং হেড্রনের মধ্যে আরো প্রচুর কণিকা।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৪ সালে একটি নতুন কণিকা আবিষ্কৃত হয়, যাকে মেসন হিসেবে সনাক্ত করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ক মেসন, কিংবা ক্যায়ন (কধড়হ)। এর ভর একটি পাইয়নের সাড়ে তিন গুণ এবং একটি প্রোটনের ভরের প্রায় অর্ধেক।
১৯৪৭ সালে, প্রথমবারের মত প্রোটন বা নিউট্রনের চেয়ে ভারী কণিকার একটি শ্রেণি আবিষ্কৃত হলো। গ্রিক ভাষা হতে আগত একটি শব্দ অনুযায়ী এদের নাম দেওয়া হলো হাইপেরন, যার অর্থ “ছাড়িয়ে” কেননা এদের ভর তখন পর্যন্ত আবিস্কৃত সবচেয়ে ভারী কণিকা প্রোটন ও নিউট্রনকে ছাড়িয়ে যায়।
এই ধরনের ঘটনা অব্যহত থাকল এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধরনের শতাধিক হেড্রন আবিষ্কৃত হলো, যা আরো শতাধিক প্রতি হেড্রনের উপস্থিতি ঘোষণা করে। যদিও এদের মধ্যে কোনো কোনোটি সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের মধ্যে ভেঙে নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তারপরেও তাদেরকে কণিকাই বলতে হবে।
বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুনলেন। এর আগে প্রতিটি নমুণাই একটি সরল মহাবিশ্বের বর্ণনা দিয়েছে, কিন্তু এখন এই “হেড্রন চিড়িয়াখানা” বিষয়গুলোকে আবারো অর্থহীন জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, এই হেড্রন গুলোকে শৃঙ্খলায়িত করে এদের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হলো এবং অর্থপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো। যদি এটি করা যায়, তাহলো কাউকে একক ভাবে প্রতিটি কণিকা নিয়ে চর্চা করতে হবে না, কয়েকটি শ্রেণি নিয়ে গবেষণা করলেই চলবে।
১৯৩২ সালে হাইজেনবার্গ দেখিয়েছেন, যদি বৈদ্যুতিক চার্জের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে প্রোটন এবং নিউট্রনকে একই কণিকা হিসেবে দেখা যেতে পারে যারা ভিন্ন দশায় থাকে। এই দশার ভিন্নতাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা একটি দশাকে ধনাত্মক এবং অপরটিকে ঋনাত্মক আখ্যা দিতে পারি।
১৯৩৭ সালে হাঙ্গেরিয়-আমেরিকান পদার্থবিদ ইউজিন পল উইগনার (ঊঁমবহব চধঁষ ডরমহবৎ, জন্ম: ১৯০২) প্রস্তাব করেন, পর্যায় সারণির এক মৌলের কোনো আইসোটোপের কাছে প্রোটন এবং নিউট্রন একই রকম, এবং এই দুটির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র দশার পার্থক্য থাকে যা ব্যাখ্যা করা যায় কোন একধরনের ঘূর্ণনের মাধ্যমে। ঘূর্ণনের ভিন্নতার কারণে দশার ভিন্নতা তৈরি হয়। তিনি হাইজেনবার্গের ধারণাকৃত দশার এই পার্থক্যকে বলেন আইসোটোপীয় ঘূর্ণন, একে বর্তমানে সংক্ষেপে বলা হয় আইসোস্পিন। ১৯৩৮ সালে রাশিয়ান পদার্থবিদ এন. কেমার (ঘ. কবসসবৎ) বললেন, ধনাত্মক, ঋনাত্মক এবং নিরপেক্ষ এই তিন ধরনের পাইয়নকে একই কণিকার তিনটি ভিন্ন দশা বলা যেতে পারে যাদের আইসোস্পিন দশা ভিন্ন।
আইসোস্পিনের ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ প্রথমত, এটি কিছু কণিকাকে শ্রেণিবদ্ধ করার মাধ্যমে হেড্রন চিড়িয়াখানার জটিলতা হ্রাস করে এবং দ্বিতীয়ত, এটি হেড্রন সমূহের মধ্যে সংরক্ষণশীলতা আরোপ করে। এই দ্বিতীয় বিষয়টি হেড্রন চিড়িয়াখানার কিছুটা যৌক্তিকতা দান করে। এই কণিকাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে পরিবর্তিত হয় না বা মিথষ্ক্রিয়ায় যায় না, তাই তাদের মধ্যে কিছু ধর্মের সংরক্ষণশীলতা থাকাই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে পরিবর্তনের সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়। যত বেশি ধরনের সংরক্ষণশীলতা আরোপ করা যাবে ততোই কণিকা সমূহের ধর্মগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে, তার ফলে প্রকৃত ঘটনা বিশ্লেষণ করা আরো সহজ হবে।
উদাহরণস্বরূপ, কেয়ন এবং হাইপেরনসমূহ অদ্ভুতভাবে বেশ দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়। কেয়নের ক্ষেত্রে বিভাজিত হতে সময় লাগে এক সেকেন্ডের মিলিয়নভাগের একভাগ এবং হাইপেরনের ক্ষেত্রে এক সেকেন্ডের বিলিয়নভাগের এক ভাগ। এদের উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, এরা সবল মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যস্থতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং তাই এদের বিভাজনের ধরন একই রকম-এক সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ভাগেরও ক্ষুদ্রাংশ।
কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না; তাদের যে পরিমাণ স্থায়ী হওয়ার কথা তার চেয়ে হাজার গুণ বা মিলিয়ন গুণ স্থায়ী হতে দেখা যায়, যা বেশ অদ্ভুত মনে হয়। বাস্তবিকই, তাদের নামই হয়ে গেল স্ট্রেঞ্জ।
১৯৫৩ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ মারে গেল-ম্যান (জন্ম ১৯২৯) প্রস্তাব দিলেন, স্ট্রেঞ্জ কণিকাগুলোর এমন কোনো বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্য হেড্রনগুলোর নেই। যথেষ্ট স্বাভাবিকতার সাথে তিনি এই বৈশিষ্ট্যের নাম দিলেন স্ট্রেঞ্জনেস।
প্রোটন, নিউট্রন এবং বিভিন্ন ধরনের পাইয়ন সবারই স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যা ০, কিন্তু কেয়ন এবং হাইপেরনসমূহের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যা দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার সাথে জড়িতদের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত। সবল মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে কেয়ন এবং হাইপেরনসমূহকে ভাঙা যায় না। কারণ তাতে পাইয়ন এবং প্রোটনের উদ্ভব হবে যাদের স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যা ০, যার ফলে স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যা কমে যায় এবং সংরক্ষণশীলতা ভঙ্গ হয়। এই কারণে কেয়ন এবং হাইপেরনসমূহকে অবশ্যই দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে ভাঙতে হবে যার ফলে স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যার সংরক্ষণশীলতা নীতি মেনে চলতে হবে না। এর মাধ্যমেই স্ট্রেঞ্জ কণিকাগুলো এত দীর্ঘস্থায়ী হয়।
হেড্রনের গবেষণায় সংরক্ষণশীলতা সূত্রগুলো রক্ষায় সবসময় সফল হওয়া যায়নি। একটি ক্ষেত্রে তাই বিজ্ঞানীদের সংরক্ষণশীলতা সূত্র পরিমার্জিত করতে হলো।
১৯২৭ সালের দিকে, উইগনার সমতার সংরক্ষণশীলতা সূত্রের উন্নতি ঘটালেন। সমতা আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু আমরা এখানে জোড় এবং বিজোড় সংখ্যার মাধ্যমে একটি তুলনামূলক চিত্র দেখাতে পারি। দুটি জোড় সংখ্যা যোগ করলে সর্বদাই একটি জোড় সংখ্যা পাওয়া যায় এবং দুটি বিজোড় সংখ্যা যোগ করলেও সর্বদা একটি জোড় সংখ্যা পাওয়া যায়। তবে একটি জোড় সংখ্যা এবং একটি বিজোড় সংখ্যার যোগফল সর্বদাই বিজোড় সংখ্যা হয়। এখন, আমরা যদি কিছু কণিকাকে জোড় এবং কিছু কণিকাকে বিজোড় বলি তাহলে অনুমোদিত পরিবর্তনের ফলাফল একই নিয়ম মেনে চলবে: জোড় + জোড় = বিজোড় + বিজোড় = জোড়; এবং, জোড় + বিজোড় = বিজোড় + জোড় = বিজোড়।
কিন্তু পরবর্তীতে, ১৯৫০ এর দশকের শুরুতে দেখা গেল একটি নির্দিষ্ট ধরনের কেয়ন বেশ কিম্ভুতাকারভাবে ক্ষয় হচ্ছে। কখনো কখনো এটি দুটি পাইয়নে ভেঙে যাচ্ছে; আবার কখনো কখনো তিনটিতে। দুটি পাইয়ন একত্রে জোড় সমতা তৈরি করে, কিন্তু তিনটি পাইয়ন একত্রে বিজোড় সমতা তৈরি করে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে: কেয়ন একই সাথে কীভাবে জোড় এবং বিজোড় হতে পারে?
সবচেয়ে সহজে এই সমস্যার মোকাবেলা যেভাবে করা যায় তা হচ্ছে দুটি পুরোপুরি একই ধরনের কণিকা ধরে নেওয়া, যাদের একটি হচ্ছে জোড় সমতা এবং অপরটি বিজোড় সমতা। গ্রিক বর্ণমালা অনুযায়ী এদের নাম দেওয়া হলো টাউ মেসন এবং থিটা মেসন। টাউ মেসন এবং থিটা মেসনের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না, এই বিষয়টি ছাড়া এর মাধ্যমে সমস্যাটির মোকাবেলা করা সম্ভব।
তবে এটি খুব ভীতিকর পরিস্থিতি নয়। মিউয়ন নিউট্রিনোকেও ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো হতে কোনো ভাবে পৃথক করা যায় না, শুধু মাত্র বিভিন্ন মিথষ্ক্রিয়ায় তাদের আচরণ পার্থক্য করা যায়। হয়তোবা একই কথা টাউ মেসন এবং থিটা মেসনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তবে, দুটি নিউট্রিনোর ক্ষেত্রে পার্থক্যকীকরণের অসাধ্য বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট দুটি নিউট্রিনো কল্পনা করে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু মেসনের ক্ষেত্রে বিকল্প রয়েছে। কেমন হয়, যদি সমতা সর্বদা সংরক্ষণযোগ্য না হয়?
চায়নীজ-আমেরিকান পদার্থবিদ চেন নিং ইয়াং (জন্ম: ১৯২২) এবং জাং-দাও লি (জন্ম: ১৯২৬) এই বিষয়টির তাত্ত্বিক ফলাফলটি নিয়ে ১৯৫৬ সালে কাজ করেন এবং এই প্রত্যয় লাভ করেন, সমতা সংরক্ষিত হয় না। অন্ততঃ যেসব বিক্রিয়া দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যস্থতায় হয় সেগুলো। কিন্তু কীভাবে এটি পরীক্ষা করে দেখা যায়?
এর উত্তরটি পাওয়া যাবে একটি বাস্তবতা থেকে। সমতার সরংক্ষণশীলতার বিষয়টি ডান-বাম প্রতিসাম্যের সাথে তুলনীয়। অন্যভাবে বললে, যদি সমতা সংরক্ষণশীল থাকে এবং যদি নির্দিষ্ট কোনো মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে একঝাঁক কণিকা উৎপন্ন হয় তাহলে ডান দিকে যত গুলো কণিকা পাওয়া যাবে তার সমান সংখ্যক কণিকা বাম দিকেও পাওয়া যাবে। আর যদি সমতা সংরক্ষণশীল না হয় তাহলে কণিকা হয় শুধুমাত্র ডানদিকে পাওয়া যাবে অথবা শুধুমাত্র বাম দিকে পাওয়া যাবে। (সমতা সংরক্ষিত না থাকার এই যুক্তিটিকে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে তাঁরা এই মহাবিশ্বকে কেন ডান এবং বামে বিভক্ত করে চিন্তা করতে হবে তার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পাননি।)
তাই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একজন চায়নিজ-আমেরিকান পদার্থবিদ শিয়েন শাং উ একটি পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নিলেন। তিনি তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ কোবাল্ট-৬০ নিয়ে কাজ করলেন। তা বিভাজিত হয়ে বিটা কণিকা উৎপন্ন করে। এবং এই ঘটনা অবশ্যই দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যস্থতায় ঘটে। এই বিটা কণিকাগুলো সবদিকে ছড়িয়ে ছিল। এর একটা কারণ হচ্ছে, পরমাণু নিজেরাও বিভিন্ন দিকে মুখ করে থাকে। সেই কারণে উ বস্তুটিকে একটি শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে স্থাপন করলেন যেন সবগুলো পরমাণু একই দিকে মুখ করে থাকে। এর ফলে উৎপন্ন বিটা কণিকাসমূহকে একই দিকে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে যদি সমতা সংরক্ষণশীল না থাকে। তবে চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতি স্বত্ত্বেও সাধারণ তাপমাত্রায় পরমাণুগুলোর কম্পন বিটা কণিকাকে বিভিন্ন দিকে ছুঁড়তে থাকবে, তাই উ কোবাল্ট-৬০ পরমাণুগুলোকে পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি শীতল করে নিলেন।
যদি সমতা সংরক্ষণশীল না থাকে তাহলে কণিকাগুলোকে শুধুমাত্র একদিকেই পাওয়া যাওয়ার কথা। জানুয়ারি ১৯৫৭ নাগাদ আর কোনো সন্দেহ রইল না। বিটা কণিকাগুলো শুধুমাত্র এক দিকেই নির্গত হলো এবং দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সমতার সংরক্ষণশীলতা রইল না। সেই বছর ইয়াং এবং লী নোবেল পুরস্কার পেলেন।
অন্যান্য মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সমতার সংরক্ষণশীলতা বজায় রইল, এমনকি একটি সাধারণ সূত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত করলে দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও সমতার সংরক্ষণশীলতা বজায় থাকে। সমতার (চ) দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নির্দিষ্ট কণিকা “ডান-হাতি” হলে এর বিপরীত চার্জযুক্ত (ঈ) প্রতিকণিকাটি হবে বাম-হাতি। এর অর্থ হচ্ছে, যদি একটি কণিকা এবং তার প্রতিকণিকাকে একত্রে বিবেচনা করা হয় তাহলে তাদের ঈচ বৈশিষ্ট্য (সমতা ও চার্জ উভয় বৈশিষ্ট্যকে আমলে নিয়ে) সংরক্ষণশীল থাকবে।
কিন্তু পরবর্তীতে, ১৯৬৪ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ ভ্যাল লগসডেন ফিচ (জন্ম: ১৯২৩) এবং জেমস ওয়াটসন ক্রনিন (জন্ম: ১৯৩১) দেখালেন, এমনকি ঈচও সর্বদা সংরক্ষণশীল থাকে না। তাই এর সাথে নতুন বৈশিষ্ট্য, সময় যুক্ত করা হলো। যদি ঈচ সময়ের একমুখী প্রবাহে সংরক্ষণশীল না থাকে তাহলে তা সময়ের বিপরীতমুখেও সংরক্ষণশীল থাকে না। বর্তমানে তাই বিশ্বাস করা হয় কেবল ঈচঞ প্রতিসাম্যতা দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষণশীল থাকে। ক্রনিন এবং ফিচ এই কাজের জন্য ১৯৮০ সালে নোবেল পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেন।
১৯৮১ সালে গেল-ম্যান প্রতিসাম্যের ভিত্তিতে উৎপন্ন বহুভুজাকারে একগুচ্ছ সংরক্ষণশীল বৈশিষ্ট্যের আলোকে হেড্রন সমূহকে আট, নয় বা দশটি করে একক কণিকা নিয়ে শ্রেণিবদ্ধ করেন। তিনি এর মাধ্যমে মৌলের পর্যায় সারণির আদলে হেড্রন কণিকাগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করেন। একই সময়ে ইসরায়েলি পদার্থবিদ ইউভাল নিম্যান (জন্ম: ১৯২৫) একই কাজ করছিলেন।
এক শতাব্দী আগে মেন্ডেলিফের পর্যায়সারনীকে যেমন বিজ্ঞানীরা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন নি, তেমনি গেল-ম্যানের হেড্রন শ্রেণীবিন্যাসটিকেও বিজ্ঞানীদের পক্ষে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। তবে মেন্ডেলিফ পরবর্তীতে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন তাঁর সারণির ফাঁকা স্থানের বিভিন্ন মৌল সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করে এবং পরবর্তীতে সেগুলোর যথার্থতা প্রমাণের মাধ্যমে।
গেল-ম্যান দশটি কণিকার একটি ত্রিভুজকে এমন ভাবে সজ্জিত করেন, যেন এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দুতে বিভিন্ন সংরক্ষণশীলতার বৈশিষ্ট্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তিত হয়। তবে চূড়ার বিন্দুটির প্রতিনিধিত্বশীল কোনো কণিকার উপস্থিতি তখন বিদ্যমান ছিল না।
এই সজ্জা থেকে দেখা গেল নিখোঁজ কণিকাটির সুনির্দিষ্ট ধর্ম থাকবে যার ভর অস্বাভাবিক রকমের বেশি এবং স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যাও অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এর নাম দেওয়া হলো ওমেগা মাইনাস কণিকা, যার অস্তিত্ব কিছুটা সন্দেহের চোখে ধরে নেওয়া হলো।
ওমেগা মাইনাস কণিকার প্রকৃতি থেকে গেল-ম্যানের বিশ্বাস জন্মালো এটি অবশ্যই ঋনাত্মক কেয়নের সাথে প্রোটনের মিথষ্ক্রিয়ায় উৎপন্ন হওয়ার কথা। এই দুটি কণিকাকে খুব উচ্চ শক্তিতে সংঘর্ষ ঘটালে এই ধরনের অস্বাভাবিক ভরের কণিকাটিকে হয়তো পাওয়া যাবে।
গেল-ম্যানকে অতঃপর এই পরীক্ষাটি করার জন্য একটি বড় কণিকা ত্বরণ যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা লোকজনকে রাজি করাতে হলো। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে দলটি লং আইল্যান্ডের ব্রুকহ্যাভেনে অবস্থিত ত্বরণযন্ত্রে ক মেসনকে প্রোটনের সাথে সংঘর্ষ ঘটাতে শুরু করলেন। ১৯৬৪ সালের ৩১ জানুয়ারিতে এমন একটি ঘটনা সনাক্ত করা হলো যা ওমেগা মাইনাস কণিকা ছাড়া ঘটতেই পারে না। একটি কণিকার বৈশিষ্ট্যগুলো হুবহু গেল-ম্যানের অনুমিত ধারণার সাথে মিলে গেল। এই কাজের জন্য ১৯৬৯ সালে গেল-ম্যান নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন। এর ফলে গেল-ম্যানের শ্রেণীবিন্যাসটিকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া হলো। অর্থাৎ হেড্রন চিড়িয়াখানা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে শুরু করেছে।
লং আইল্যান্ডের ব্রুকহ্যাভেনে অবস্থিত বৃত্তাকার সাইক্লোট্রন।