Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বডিলাইনের ব্যবচ্ছেদ: অষ্টম পর্ব

হেলমেট জাতীয় প্রতিরক্ষা সামগ্রী তখনো উন্নতিলাভ করেনি ততটা, এমনকি ব্যাটসম্যানরা মাথায় বর্মজাতীয় কিছু পরলে তাকে দেখা হতো কাপুরুষতার পরিচায়ক রূপে। ব্যাটসম্যানদের রক্ষা করতে তাই আলোচনা চলছিল ভিন্নপথে। জনসম্মুখের চাইতে যার বেশিরভাগ মঞ্চস্থ হয়েছিল পর্দার আড়ালেই। অপ্রীতিকর নানা ঘটনা সামনে চলে আসবে বলে এসব আলোচনার কাগজপত্র ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল বহুকাল আগেই। যুক্তি তো তৈরিই ছিল, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে কিছু রেহাই পেয়েছে নাকি?’

তবুও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা কাগজপত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় অন্তরালের এসব আলোচনার। সিরিজ চলাকালীনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটেছিল সাউথ অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর স্যার আলেকজান্ডার হোর-রুথভেনের, যিনি তখন ছুটি কাটাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডে। কারো কারো মতে, সিরিজের তৃতীয় টেস্ট চলাকালীন তিনি যদি অ্যাডিলেডে থাকতেন, তবে এত বাদানুবাদের প্রয়োজনই পড়তো না। হয়তোবা, বডিলাইনের উত্তাল সময়ে জার্ডিনকে এক কোণে ডেকে নিয়ে তিনি আর্জি জানাতেন বোলিং কৌশল নিয়ে পুনরায় ভেবে দেখতে। জার্ডিনের সঙ্গে না বলতে পারলেও তিনি বডিলাইন নিয়ে কথা বলেছিলেন ডোমিনিয়ন অফিসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হচ্ছে লী উইনসেরের নাম। অ্যাডিলেডের উত্তপ্ত পরিস্থিতি জানিয়ে, হোর-রুথভেনকে ডোমিনিয়ন অফিসে সাত-তাড়াতাড়ি কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনিই।

মাঠের বাইরের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জানতে উইনসেরের ডায়েরিই হয়ে রয়েছে একমাত্র আশ্রয়স্থল। ম্যাসেজ পেয়ে ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই রুথভেন চলে গিয়েছিলেন ডাউনিং স্ট্রিটে, ডোমিনিয়ন্স সচিবের সঙ্গে দেখা করতে। সচিব ছাড়াও এমসিসির প্রধান চার কর্তা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সভাশেষে কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও অচলাবস্থা কাটবার মুখবন্ধ লেখা হয়েছিল এখানেই।

স্যার আলেকজান্ডার হোর-রুথভেন, পর্দার আড়ালের এক নায়ক; Image source: Bodyline Autopsy

পরদিন অ্যাডিলেডে নিজের ডেপুটিকে পাঠানো টেলিগ্রামে হোর-রুথভেন জানিয়েছিলেন, টেস্টের ফলাফলের চাইতেও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্পর্ক। এসিবি ‘আনস্পোর্টসম্যানলাইক’ শব্দের প্রত্যাহার করে নিলেই এমসিসি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানের জন্যে চেষ্টা করবে। এসিবি সে শব্দ তুলে নিয়েছিল, তা তো পাঠকেরা জেনেছেন আগেই।

সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায়ে হোর-রুথভেনের প্রচেষ্টা বজায় ছিল সিরিজশেষেও। ছুটি কাটিয়ে অস্ট্রেলিয়া ফেরত এসে তিনি দেখেছিলেন, গোটা দেশ যেন ‘রানীর দেশ আমাদের সঙ্গে অবিচার করেছে’ ভেবে ফুঁসছে। আর তাদের ভাবনা যে অমূলক নয়, বডিলাইন বোলিংয়ের জন্যে এমসিসির অনুতপ্ত না হওয়াই এর স্বপক্ষে ছিল প্রমাণ। কী করে হারানো ভাবমূর্তি ফেরত আনা যায়, ডোমিনিয়ন্স সচিবকে লেখা চিঠিতে হোর-রুথভেন সে বিষয়েও জানিয়েছিলেন বিশদে।

শেষমেশ অবশ্য হোর-রুথভেন নন, সাম্রাজ্য রক্ষায় ত্রাণকর্তা হয়েছিলেন আরেকজন।

***

অস্ট্রেলিয়ায় ‘বডিলাইন বোলিং নিরোধক আইন’ পাশ হয়েছিল ১৯৩৩ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেই। যার মূল বক্তব্য ছিল, গায়ে বোলিংয়ের চেষ্টা করলেই ডাকা হবে নো-বল। একই ইনিংসে কোনো বোলার বারংবার এই ভীতিকর বোলিংয়ের পুনরাবৃত্তি করলে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে বল, আইন ৪৮(বি)-তে বিস্তারিত লেখা হয়েছিল এ নিয়েই।

অস্ট্রেলিয়ায় ২৮ এপ্রিল পাশ হওয়া আইনের কপি এসিবি এমসিসিতে তার করেছিল সেদিনই, যেন বিলেতেও করা হয় একই আইনের বাস্তবায়ন। ইংলিশ গ্রীষ্ম শুরু হয়নি তখনো, বডিলাইন সামনাসামনি দেখেওনি, ইংল্যান্ড তাই আস্থা রেখেছিল অধিনায়ক আর ম্যানেজারের মন্তব্যে। অস্ট্রেলিয়ার পরামর্শকে ‘বাস্তবায়নের অযোগ্য’ বলে বরং তারা অভিযোগ জানিয়েছিল ইংলিশ ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকদের ছোঁড়া কটূবাক্য নিয়ে। যে অভিযোগ অবশ্য ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছিল কিছুকাল পর। অস্ট্রেলিয়ার দর্শকেরা ক্রিকেটারদের নয়, বরং আপত্তি করেছিল ইংল্যান্ডের বোলিংয়ে; এমসিসি বুঝতে পেরেছিল তা। লারউড ৯৮ রানে ফেরবার পথে দারুণ দর্শক অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়েছিলেন, পাঠকেরা অভিযোগের অসাড়তা এ বাক্যেই বুঝে নেবেন বলে অনুমান।

এমন টেলিগ্রামের জবাবে তো আর কিছু বলার থাকে না। সামনের সিরিজে বডিলাইন বোলিং চলবে না, এমন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছাড়া অস্ট্রেলিয়া সফর করবে না জানিয়েই অস্ট্রেলিয়া মুখ বন্ধ করে ছিল পরের তিন মাস। ততদিনে এমসিসিও বডিলাইনের হাতে-কলমে প্রমাণ পেয়েছিল উইন্ডিজের মাধ্যমে। এমসিসির ভেতরে তাই তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, কী করে অপদস্থ না হয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা যায়।

রবি ম্যাকডোনাল্ড, সাম্রাজ্যের ত্রাণকর্তা; Image source: Bodyline Autopsy

মঞ্চে এরই মধ্যে নয়া চরিত্ররূপে আবির্ভাব ঘটেছিল রবি ম্যাকডোনাল্ডের। নিজে এককালে ক্রিকেটার ছিলেন বলেই ক্রিকেটের ক্রান্তিলগ্ন অনুভব করেছিলেন হৃদয় দিয়ে। এসিবিকে সময়ে সময়ে পরামর্শ দিয়ে, এমসিসির উপরে চাপ বাড়িয়ে তিনিই রক্ষা করেছিলেন ১৯৩৪ অ্যাশেজ নির্বিঘ্নে আয়োজনের সম্ভাবনা। দাবি না মানলে আসন্ন অ্যাশেজ বয়কটের পরামর্শ ছিল তারই মস্তিষ্কপ্রসূত।

বডিলাইন বিরোধী আইন এমসিসি উড়িয়ে দেবার কিছুদিন পরেই স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন (যিনি নিজেও ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ এমসিসি সদস্য) ম্যাকডোনাল্ডকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন,

‘এমসিসিও বুঝে গিয়েছে বডিলাইন বোলিং ক্রিকেটের চেতনার সঙ্গে যায় না।’

কিন্তু বডিলাইন বোলিংকে অক্রিকেটীয় বলা মানে জার্ডিনকে বহিষ্কার করা, সাথে সাথে এতদিন ধরে আঁকড়ে থাকা সমস্ত ফাঁপা বুলির ভিত্তিহীনতা প্রমাণিত হওয়া, কেমব্রিজ-অক্সফোর্ড পাশ দেয়া ভদ্রলোকদের জন্য তা হতো নিদারুণ অপমান। অস্ট্রেলিয়াকে স্বাধীনতা দিলেও ইংরেজরা ঠিক কর্তৃৃৃত্ব ছাড়তে পারেনি তখনো, রাজা হয়ে প্রজার কাছে এমনভাবে পরাজয় মেনে নেয়া যায়?

কীভাবে বডিলাইন বল খেলতে হবে, ছাতাকে ব্যাট বানিয়ে তা-ই দেখাচ্ছেন লর্ড হক, তখন যিনি এমসিসি সভাপতি; Image source: Bodyline Autopsy

এ চিঠি পাবার পরেই ম্যাকডোনাল্ড বুঝে গিয়েছিলেন, বিজয় সুনিশ্চিত। তবে নেগোশিয়েটরের ভূমিকায় সবচাইতে উজ্জ্বল ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন এর কিছুদিন বাদে। একদিকে এসিবি কর্তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বডিলাইনের বদলে ব্যবহার করতে বলেছিলেন ‘ডিরেক্ট অ্যাটাক’ শব্দটি, তাতে এমসিসি নিজেদের পরাজিত ভাববে না। ১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে সেই ‘ডিরেক্ট অ্যাটাক’ ব্যবহার করেই এমসিসিতে তার পাঠিয়েছিল এসিবি। অন্যদিকে ‘বডিলাইনের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিলে অস্ট্রেলিয়া সফর করবে না, আর যদি করেও তবে চারজন বিশালদেহী ফাস্ট বোলার নিয়ে আসবে’ এমন হুমকিতে ম্যাকডোনাল্ড গলিয়ে দিয়েছিলেন এমসিসির কর্তাদের মেকি কাঠিন্য। সরাসরি না বললেও সে বছরেরই ৯ অক্টোবরে পাঠানো এক টেলিগ্রামে এমসিসি ইনিয়ে-বিনিয়ে স্বীকার করেছিল, গত সিরিজে এমসিসির কোনো কোনো বোলারের বল ছিল ক্রিকেটের চেতনা-বহির্ভূত। নব উদ্ভুত ‘ডিরেক্ট অ্যাটাক’ যে কেবল ব্যাটসম্যানের ওপরই নয়, ক্রিকেটের চেতনার ওপরই আঘাত, জানিয়েছিল তা-ও। অস্ট্রেলিয়ার মতো বডিলাইন-বিরোধী আইন পাশ না করলেও আসন্ন সিরিজে বডিলাইন বোলিংয়ের কোনো প্রতিফলন দেখা যাবে না, এমন আশ্বাসেই শেষ হয়েছিল বার্তা।

কিন্তু অক্টোবরের এই বার্তা এসিবিতে পৌছানোর পর দানা বেঁধেছিল আরেক ঝামেলা। এতদিনের পুঞ্জীভূত রাগ-ক্ষোভ-অভিমান যেন উগড়ে দিতে চাচ্ছিলেন একেকজন। ‘ডিরেক্ট অ্যাটাক’ জাতীয় ভণিতা নয়, এসিবি কর্তাদের কেউ কেউ ‘আসন্ন অ্যাশেজে বডিলাইন বোলিং করা হবে না’ এই মর্মে চাইছিলেন পূর্ণ আশ্বাস। নভেম্বরের ১৬ তারিখে এসিবির পাঠানো টেলিগ্রামে পুরোনো গর্ত খোঁড়া হয়েছিল নতুন করে। নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে খামোখাই টেলিগ্রাম চালাচালি হয়েছিল আরও বারদুয়েক। অবশেষে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে এসিবি জানিয়েছিল, এমসিসির বক্তব্য তাদের মনে ধরেছে। সামনের বছরের ৯ মার্চ তাদের ক্রিকেটাররা বিলেত সফরে বেরোবে। দু’দেশের এমন কূটনৈতিক তৎপরতার সবচেয়ে ভালো সারসংক্ষেপ টানা হয়েছিল ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার’ ম্যাগাজিনে:  

“Australia softly cooed that she was going over, and England was asked to be good. England gently whispered that she had not done anything, but it would not happen again.”

সে যা-ই হোক, এবারের মতো পার পাচ্ছেন ভেবে ওয়ার্নার হোর-রুথভেনকে লিখে পাঠালেন,

‘Peace reigns again.’

***

ওয়ার্নার যতই নিজের গদি বেঁচে গিয়েছে ভেবে খুশিতে গদগদ হয়ে চিঠি পাঠান, এমসিসিতে তখনো শান্তি আসেনি পুরোপুরি। পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা সরানোর ব্যবস্থাই যে এতদিনে এমসিসি করেনি।

অমন তীব্র বাক্যবাণের মধ্যেও এমসিসি অধিনায়ক হিসেবে আস্থা রেখেছিল জার্ডিনের উপরেই। রবি ম্যাকডোনাল্ড এমন খবর পেয়ে জানিয়েছিলেন, জার্ডিনকে অধিনায়ক পদে বহাল রাখলে এতদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা উলুবনেই যাবে। কেননা, জিঘাংসা কেবল যে অস্ট্রেলিয়ানদের সাথেই নয়, বরং জার্ডিন জিততে চান সবার সাথেই, ১৯৩৩ সালে ভারত সফরে গিয়ে সে প্রমাণই রেখেছিলেন তিনি। লারউড-ভোস ছিলেন না, এমনকি আগেরবারের অ্যাশেজ দলের হেডলি ভেরিটি ছাড়া জার্ডিন ভারতে নিয়ে যাননি কাউকেই। তবুও দুই পেসার, ক্লার্ক আর নিকোলসকে দিয়ে জার্ডিন বডিলাইনের প্রয়োগ করেছিলেন সমানে। দুজনের কারও গতিই খুব বেশি না হলেও সদ্য ক্রিকেট খেলতে শুরু করা ভারতীয়দের জন্যে তা-ই ছিল অগ্নিবাণ।

কলকাতায় দিলওয়ার হোসেনের মাথার পেছনে বল লাগিয়ে স্ট্রেচার ডাকিয়েছিলেন নিকোলস। হুক করতে গয়ে বল লেগেছিল নওমাল জিওমালের বাঁ চোখের খানিক ওপরে। চটের উইকেটে পাতিয়ালার যুবরাজ, বিজয় মার্চেন্ট, এমনকি এমসিসি দলের কয়েকজনও বলের আঘাতে হয়েছিলেন জর্জরিত। সে ম্যাচের আম্পায়ার টারান্ট ভয় পাচ্ছিলেন, এমন বোলিংয়ে কেউ না আবার মৃত্যুমুখে পড়ে যায়!

টেড ক্লার্ক, জার্ডিন যাকে চেষ্টা করেও লারউড বানাতে পারেননি; Image source: Bodyline Autopsy

সিরিজজুড়েই চলেছিল এমন বোলিং। ভারতে বডিলাইন বোলিংয়ের চর্চার খবর পৌঁছে গিয়েছিল এমসিসিতেও। জার্ডিনকে অধিনায়ক পদে বহাল তবিয়তে রাখলে আরেকবার বয়ে যাবে বডিলাইনের স্রোত, এমন আশঙ্কা যখন দানা বাঁধছে, ভারত সিরিজ শেষে ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডে লেখা কলামে জার্ডিন আচম্বিতে জানিয়েছিলেন, সেবারের ইংলিশ গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে তিনি আর খেলছেন না।

এই খবরে লর্ডসের ক্রিকেট রুমে যে স্বস্তির শ্বাস পড়েছিল, তাতে খুব সম্ভবত নড়ে উঠেছিল সেন্ট জনস উডে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলোও।

***

জার্ডিন সরে গিয়েছিলেন নিজে থেকেই, কিন্তু বডিলাইন বোলিং ভাষা পেয়েছিল যাদের হাতে, সেই লারউড-ভোস জুটিকে কি দলে ফেরানো হয়েছিল? উত্তর, ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বহু দোনামনার পরে ভোস নতমস্তকে সে সুযোগ নিলেও লারউড নেননি, ইংল্যান্ডের হয়ে লারউডের তাই আর কখনোই খেলা হয়নি। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম দ্রুতগতির বোলারদের একজনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার যে থমকে গিয়েছিল মাত্র ২৭ বছর বয়সেই, এর পেছনে অবশ্য তথাকথিত ইংরেজ সভ্যতার দায়ই বেশি।

নিজেদের সভ্যতার শিরোমণি দাবি করা ইংল্যান্ডে তখন শ্রেণিবৈষম্য জারি ছিল ক্রিকেটেও। জার্ডিনের মতো উচ্চবিত্তেরা ক্রিকেট খেলতেন ‘অ্যামেচার’ নামে, আর লারউডের মতো দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা ক্রিকেটে এসে পেতেন ‘প্রফেশনাল’ পদবি। অধিনায়ক নির্বাচিত হতেন অ্যামেচাররাই, প্রফেশনালরা যেন দলে আসতেন তাদের কর্মচারীরূপে। বডিলাইন সিরিজের বৃত্তান্ত পড়ে পাঠক নিশ্চয়ই জেনেছেন, কেমন করে প্রফেশনালরা অ্যামেচারদের গোলাম হয়ে ছিলেন।

এমসিসির কর্তাদের ক্রিকেটীয় চেতনার নামে ভণ্ডামির মুখোশ ধরা পড়েছিল বডিলাইন সিরিজ শেষেও। জার্ডিনকে অধিনায়ক পদ থেকে অপসারণেও বিবেকে বাঁধছিল এমসিসির কর্তাদের। পাছে না আবার শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত সমাজের অবমাননা হয়, এ ভয়ে ভীত ছিলেন তারা। এমনকি চিঠিও এসেছিল এমসিসির দপ্তরে, বডিলাইন-বিরোধী আইন পাশ করতে গিয়ে যেন আবার জার্ডিনের অমর্যাদা না হয়।

আবার সেই এমসিসিই ১৯৩৪ অ্যাশেজ শুরুর আগে সইয়ের জন্যে লারউডের ঠিকানায় পাঠিয়েছিল এক বিবৃতি। যাতে লেখা ছিল,

আমি হ্যারল্ড লারউড, ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজে আমার বোলিংয়ের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’

একই বার্তা গিয়েছিল ভোসের কাছেও। কেবল এবং কেবলমাত্র ক্ষমাপ্রার্থনা করে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেই সুযোগ দেয়া হবে ইংল্যান্ড দলে, লারউড আর ভোসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল তা। যেন জার্ডিন নামক অধিনায়ক কোনোদিন পৃথিবীতে আসেননি, লারউড-ভোস বডিলাইনে বল করেছিলেন ব্যক্তিগত শত্রুতা চরিতার্থ করতে, এমসিসির কর্তাদের স্পিরিট অব দ্য গেম’ নামের বইতে লেখা ছিল এমনটিই।

কী করবেন বুঝতে না পেরে লারউড গিয়েছিলেন মায়ের কাছে। ‘এই বিবৃতিতে সই করলে আমার মরা মুখ দেখবি’ শুনে লারউড আর সই করেননি সে বিবৃতিতে। ভোস এমন কোনো দিব্যি দেননি কাউকে, অনেক দোনামনা কাটিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন দুই বছর বাদে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সঙ্গীন, ক্রিকেট না খেললে ফিরতে হবে কয়লাখনির অন্ধকার জীবনে। একটু ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ভোসের।

বিধাতা আত্মসম্মানবোধ নামক শব্দটা দিয়েছেন ওই জার্ডিনদের পাড়ায়, ভোসদের পাড়ায় এর প্রবেশাধিকার দেননি।

***

জার্ডিনের উত্তরসূরি মনোনীত হয়েছিলেন বব ওয়াইয়াট। এমসিসির কর্তাদের বডিলাইন-বিরোধী কড়া নির্দেশ মেনে চলেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। ওয়াইয়াটের জন্যে অবশ্য এটা নতুন কিছু ছিল না, আগেরবার জার্ডিনের আদেশ তিনি একইরকম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। ইংল্যান্ডকে ১৯৩৪ অ্যাশেজ তিনি অবশ্য জেতাতে পারেননি, এমনকি পারেননি পরের ঊনিশ বছরে নেতৃত্ব দেয়া অধিনায়কেরাও।

১৯৩৪ অ্যাশেজের ছবি। কিছু মাত্রার বডিলাইন বোলিং তখনও হয়েছিল, তবে তা সাড়া তোলেনি। লারউডের গতিই তো ছিল না; Image source: Bodyline Autopsy

১৯৩৪ অ্যাশেজ হার নিয়ে ভাববার অবকাশই অবশ্য পাননি এমসিসির কর্তারা। ইংল্যান্ডজুড়ে তখন বইছিল বডিলাইন-বিরোধী হাওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে লারউড বল করলেই বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল বডিলাইন বোলিংয়ের গুঞ্জন, তা যদি তিনি অর্ধেক গতিতে বল করতেন তবুও। ভোস অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে এক ম্যাচ লেগ-ট্র‍্যাপ রেখে বল করায় ইনজুরির দোহাই দিয়ে পরদিন আর মাঠ নামানো হয়নি তাকে। কোনো ব্যাটসম্যান সামান্য আঘাত পেলেও ম্যাচ বয়কট শুরু করেছিল দলগুলো, লারউড-ভোসের নটিংহ্যামের বিরুদ্ধে তো মাঠে নামতেই অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল ল্যাঙ্কাশায়ার, মিডলসেক্সের মতো কাউন্টিগুলো।

এমন টালমাটাল অবস্থায় সবচেয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত হতে পারতো বডিলাইন-বিরোধী আইন প্রণয়ন। কিন্তু আইন-প্রণয়নের আগে চাই বডিলাইন বোলিংয়ের বিকল্প আবিষ্কার। বডিলাইন বোলিংয়ের বিকল্প কী হতে পারে, তা নিয়ে বহু আগে থেকেই চলছিল আলোচনা। অ্যাডিলেডের আগুনঝরা দিনগুলোর মাঝেই ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি এমসিসি সচিবকে দুই পৃষ্ঠার এক গোপন চিঠি লিখেছিলেন ব্র‍্যাডম্যান। বোলারদের যেন বডিলাইন বোলিংয়ের কথা ভাবতেই না হয়, সে নিমিত্তে এলবিডব্লিউর পরিসীমা অফ-স্ট্যাম্পের বাইরে পড়া বলগুলোতেও বাড়িয়ে দিতে আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি।

ডন ব্র‍্যাডম্যান, বডিলাইন প্রসঙ্গে ঘুরেফিরেই এসেছে তার নাম;  Image source: Bodyline Autopsy

নতুন কিছু অবশ্য নয়, তার আগে-পরে বহুজন বলেছিলেন একই কথা। উডফুলও এক ঘরোয়া আড্ডাতে বলেছিলেন এলবিডব্লিউ আইনে সংশোধন আনয়নের কথা। শেষমেশ ১৯৩৪ সালের ২১ নভেম্বর ইংল্যান্ডে অনুমোদন পায় এলবিডব্লিউর এই নতুন আইন। সাথে সাথে বডিলাইন বোলিংকে (আইনে অবশ্য লেখা হয় ‘ডিরেক্ট অ্যাটাক’) আখ্যা দেয়া হয় অনৈতিক বলে। কোনো বোলার এইরূপ ‘আনফেয়ার প্লে’র আশ্রয় নিলে, তাকে বোলিং সরিয়ে দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয় ম্যাচ পরিচালনাকারী আম্পায়ারদ্বয়ের হাতে।

১৯৩৪ সালে ‘আনফেয়ার প্লে’র এই দুই সংশোধনী ছাপা হয়েছিল মাত্র তিন লাইনে। পরপারে বসে জার্ডিনরা নিশ্চয়ই মিটিমিটি হাসছেন এক্ষণে, সেই তিন লাইনের আইন যে আজ ছয় পৃষ্ঠাতেও আঁটানো যাচ্ছে না! বিশ্বাস না হলে ক্রিকেটের ‘ফেয়ার অ্যান্ড আনফেয়ার প্লে’ বিষয়ক ৪২টি আইন পড়েই দেখুন!

***

আইন বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে অবসান ঘটেছিল বডিলাইনের ঝড়-ঝাপটার। ক্রিকেট যেন আর ক্রিকেট নয়, ঢুকে গিয়েছিল কোনো ধর্মশিক্ষার ক্লাসে। জ্যাক ফিঙ্গলটন যে সময়কালকে বলেছিলেন ‘era of extreme righteousness’।

বোলাররা বাউন্সার দিতে ভয় পেতেন সে সময়টায়। খাটো লেংথে বল করলেই দর্শকসারিতে হুল্লোড় উঠত, ‘বডিলাইন।’ আম্পায়ারদের নামে খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছিলেন ব্যাটসম্যানরাই। ১৯৩৬-৩৭ অ্যাশেজে নতুন করে বডিলাইন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ভেবে প্রেসবক্সে বেড়ে গিয়েছিল সাংবাদিক সমাগম। সেবারে সমস্ত ‘পিচিং দ্য বল আপ’ ডেলিভারি দেখে কেউ কেউ নাকি আক্ষেপ করেছিলেন, ‘এর চাইতে বডিলাইনই ভালো ছিল।’

আক্ষেপ অবশ্য মিটে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই। আরও অনেক নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে ক্রিকেটের নীতি-নৈতিকতা, আইনকানুনও ভেসে গিয়েছিল যুদ্ধের রক্তস্রোতে।

ক্রিকেট পেয়েছিল লারউডের উত্তরসূরি। অবিকল লারউডের ভঙ্গিমায় বল করা রে লিন্ডওয়াল অবশ্য মাথায় চাপাতেন ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। লিন্ডওয়ালের ভোস হয়েছিলেন কিথ মিলার। ১৯৪৮ অ্যাশেজের ওভাল টেস্টে, দু’জনে মিলে বাউন্সারের তুবড়ি ছুটিয়ে বিল এডরিচ আর সাইরিল ওয়াশব্রুকের জীবন করে তুলেছিলেন অতিষ্ঠ। ওয়াশব্রুকের বই থেকে জানা যায়, নিজের বোলারদের এহেন কর্মকাণ্ডের জন্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন ব্র‍্যাডম্যান। ওয়াশব্রুক আশ্চর্যান্বিত হয়ে লিখেছিলেন,

‘এমন অনেক সময় আসে, যখন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন মানুষটিও তার পেসারদের শান্ত করতে অপারগ হয়।’

সেই শুরু। এরপর ইংল্যান্ডে এসেছিলেন ফ্রেড ট্রুম্যান, দক্ষিণ আফ্রিকায় নিল অ্যাডকক। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তো একবারে পেয়েছিল‘ফোর কোয়াট্রেট’, অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল জেফ থমসন, ডেনিস লিলি। নমুনা হিসেবে এরাই যথেষ্ট, চাইলে ব্যাটসম্যানদের শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরানো ফাস্ট বোলারদের নাম করা যাবে অগণিত। এখন তো আর শুধু গা-জোয়ারি বোলিংয়েই আটকে নেই পেসাররা। গালাগাল, অশ্লীল শব্দবাজির ব্যবহারকে তারা নিয়ে গিয়েছেন শিল্পের পর্যায়ে। যে অস্ট্রেলিয়া বডিলাইনে বোলিং করা নিয়ে এককালে তুলেছিল তুলকালাম, সেই অস্ট্রেলিয়ার জেফ থমসন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তিনি পিচে ব্যাটসম্যানদের রক্ত দেখতে ভালোবাসেন। অস্ট্রেলিয়ায় দর্শক বিনোদনের অভিনব পন্থারূপে কেরি প্যাকার ব্যাটসম্যানদের নামিয়ে দিয়েছিলেন ফাস্ট-বাউন্সি পিচে বাউন্সারের মোকাবিলা করতে। ব্যাটসম্যানদের আত্মরক্ষার সামগ্রী ছিল অল্প, ছিল না মাথা বাঁচানোর উপায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের পেসারদের দিয়ে বডিলাইনে বল করিয়ে পার করেছে ‘স্বর্ণযুগ’।

নারী কন্ট্রাক্টর বসে পড়েছেন ক্রিজে, চার্লি গ্রিফিথের বল মাথায় লাগবার পর; Image credit: The Cricketer International  

গায়ে বল লাগবার ঘটনা এরপরও ঘটেছে অহরহ, নিত্যনৈমিত্তিক বলেই এখন আর কেউ গায়েও মাখে না তেমন। ক্রিকেটারদের গায়ে লাগবার ব্যাপারটি কতটা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বোঝাতে পরিসংখ্যানের চেয়ে ভালো আশ্রয় তো আর হয় না। ‘ক্রিকেট ক্যাজুয়ালটিজ’ বইতে আর. এইচ. ক্যাম্পবেল জানাচ্ছেন, ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজ পর্যন্ত দুই দেশের মাঝে হওয়া ১২৯ টেস্টে ক্রিকেটারদের গায়ে (পায়ে নয়) বল লাগবার ঘটনা ঘটেছিল ২০৩ বার। ইংলিশদের ৮৫ বারের বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ানরা আঘাত সয়েছিল ১১৮ বার, যার ভেতর ৩৫টিই সয়েছিলেন বডিলাইন সফরে। ১৯৯৪ সালে ক্যাম্পবেল হয়েছিলেন সাইমন ওয়াইল্ড, তিনি ধর্তব্যে নিয়েছিলেন এর আগের দুই যুগের পরিসংখ্যান। আঘাতপ্রাপ্তির সঠিক সংখ্যা হিসেব করতে পারেননি, শুধু জানাচ্ছেন, আহত হয়ে অবসর নেয়া ব্যাটসম্যানের সংখ্যাটি ৮৯, যার প্রায় অর্ধেকই (৪০) উইন্ডিজের পেসারদের শিকার।

যথেষ্ট গুরুতর দুর্ঘটনাও তো ঘটেছে অনেক। ১৯৬২ সালে চার্লি গ্রিফিথের বল ভারতের বাঁহাতি ওপেনার নারি কন্ট্রাক্টরের মাথায় লেগে তাকে ফেলে দিয়েছিল মৃত্যুশয্যায়। অবস্থা ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এতটাই যে উইন্ডিজ অধিনায়ক ফ্র‍্যাংক ওয়ারেলকেও দিতে হয়েছিল রক্ত। কন্ট্রাক্টরের ভাগ্য ছিল ভালো, তিনি বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন; ফিল হিউজকে সে সুযোগ সৃষ্টিকর্তা দেননি। ঘাড়ে বল লেগে বেচারা চলে গিয়েছেন পরপারে।

ফিল হিউজ প্রাণ দিয়েছেন বাউন্সারে। তাকে ভুলবো কি করে! Image credit: Getty Images 

বডিলাইন সিরিজ কি এমন বোলিংয়ের চাইতেও ভয়াবহ ছিল? নয় তো। তবে ওই সিরিজ নিয়ে এত কথা কেন?

প্রথম বলেই হয়তো!

This article is in Bangla language. This article is on the cricket's most sensational test series, 1932-33 ashes. Necessary images are attached inside.

Featured image © Getty Images

Background Image ©  Getty Images

Reference:

  1. David Frith; (2002); Bodyline autopsy: The full story of the most sensational test cricket series Australia vs England 1932-33 (1st ed.); Aurum Press Ltd, 74-77 White Lion Street, London N1 9PF; ABC Books for the Australian Broadcasting Corporation.
  1. Harold Larwood (Duncan Hamilton).Duncan Hamilton (2009); Harold Larwood (Paperback ed.); 21 Bloomsbury Square, London WC1A 2NS; Quercus.

Related Articles