উডফুল তখন ৩৬ বছরের প্রৌঢ়। বয়সের ছাপ ফেলে পা জোড়াও যেন তাই চলনশক্তি রহিত হতে শুরু করেছিল, সহজাত রিফ্লেক্সেও ধরেছিল মরচে। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ১৭ নম্বর বলটা ঠিক বডিলাইন গোছের কিছু ছিল না, লারউড মিডল স্ট্যাম্প লাইনেই ছুঁড়েছিলেন, এবং সিরিজের ধারা মেনে অতি অবশ্যই শর্ট লেংথে। মধ্য পিচে বল পড়ছে দেখেও উডফুল ব্যাটে খেলতে পারেননি ঠিকঠাক, হয়তো তীব্র গতির কারণে সরার সময়টুকুও পাননি। ফলতঃ বল আঘাত করেছিল বাঁ দিকের চতুর্থ পাঁজরে, ওখানটাতেই হৃৎপিণ্ড থাকে।
উডফুল হাত থেকে ব্যাট ফেলে দিয়েছিলেন তৎক্ষনাৎ, ক্রিজ থেকে সরে যেতে যেতে ফোঁপাচ্ছিলেন সমানে, দাঁত-চোখ খিঁচিয়ে সমস্ত ব্যথা-বেদনা যেন ফুটিয়ে তুলতে চাইছিলেন মুখভঙ্গিতে। যন্ত্রণার পুরোভাগ তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হলেও ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু ছিল না, হাজার পঞ্চাশেক দর্শকের ফুটন্ত গ্যালারি সে দায়িত্ব পালন করতে পারতো ষোলআনা।
ক্রিকেট যে আর সেই ‘জেন্টলম্যানস গেম’ নেই, তা প্রমাণে এমন প্রাণসংশয়ী অবস্থাতেও জার্ডিন চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘ওয়েল বোল্ড, হ্যারল্ড’ বলে। লারউড উডফুলকে এরপরের বলটিই করেছিলেন অফসাইডে কেবল ভোসকে রেখে।
শুশ্রূষা নিয়ে উডফুল ক্রিজে টিকেছিলেন আরও ঘণ্টাখানেক, আঘাতে আঘাতে নীলও হয়েছিলেন বেশ ক’জায়গায়, ব্যাট হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিল আরও একবার। উডফুল আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতেই এমসিসির ম্যানেজার গিয়েছিলেন তাকে সান্ত্বনা জানাতে। উডফুল যার জবাব দিয়েছিলেন,
“I don’t want to see you, Mr. Warner. There are two teams out there. One is trying to play cricket and the other is not.”
আপাতনির্দোষ এই তিন বাক্য সৃষ্টি করে দিয়েছিল আরও লক্ষ-কোটি বাক্যের পথ। কেননা, এতদিন পর্যন্ত বডিলাইন নিয়ে আমজনতা কেবল উশখুশই করতে পারছিল। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলও এমনটা ভাবে কি না, তা নিশ্চিন্তভাবে জানা যাচ্ছিল না এর আগে। এই বাক্য ফাঁস হওয়াতেই প্রকাশ পেয়েছিল, ক্রিকেটাররাও বডিলাইনকে ঘৃণা করে।
শনিবার সন্ধ্যায় ঘটা এই ঘটনা পত্রপত্রিকায় এসেছিল সোমবারে (তখনকার দিনে রবিবারে ছুটি ছিল সাংবাদিকদেরও)। এতদিন পর্যন্ত জেনে আসা ক্রিকেট যেন এই ঘটনাতেই বদলে গিয়েছিল পুরোপুরি। প্রথমবারের মতো ক্রিকেট জায়গা করে নিয়েছিল খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। উডফুলের ইনজুরিকে উপেক্ষা করে ইংল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম আলো ফেলেছিল উডফুল-ওয়ার্নার দ্বন্দ্বের খবর, যেন মাঠে না পেরে মাঠের বাইরেই জিততে চেয়েছিলেন উডফুল।
ড্রেসিংরুমের ভেতরে ঘটা এ ঘটনা কীভাবে সাংবাদিকদের হাতে গেল, তা নিয়েও শুরু হয়েছিল বিস্তর জল্পনা। সে ম্যাচের দ্বাদশ খেলোয়াড় লিও ও’ব্রায়েন ঘটনায় রঙচঙ মাখানোর চেষ্টাও করেছিলেন বিস্তর। শুদ্ধিপরীক্ষার পাল্লায় তার বয়ানের যেটুকু সত্যতার স্বীকৃতি পেয়েছিল, তা মোটামুটি এই যে উডফুল আর ওয়ার্নারের বাকবিতণ্ডা গিয়েছিল প্লেয়ারস এনক্লোজারে থাকা জনাবিশেক মানুষের কানে। এদের ভেতর কে এই খবর বাইরে রটিয়েছেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো তা রহস্য হয়ে রয়েছে আজও। তবে দিনশেষে দায়টা বর্তেছিল মূলত ফিঙ্গলটন আর ব্র্যাডম্যানের কাঁধে।
পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে ফিঙ্গলটনের উপর দায় চাপানোই ছিল সবচাইতে সহজ। প্লাম তার লেখা ‘ক্রিকেট বিটুইন টু ওয়ারস্’ বইতে খোলাখুলিভাবেই দায়ী করেছিলেন ফিঙ্গলটনকে। নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও ‘অ্যাডিলেড লিক’-এর জন্য দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল ফিঙ্গলটনকেই, যে কারণে ১৯৩৪ অ্যাশেজ দলে তার জায়গা হয়নি বলেও মত অনেক বিশ্লেষকের। উনি নিজে অবশ্য এ নিয়ে কথা বলতে যাননি ১৯৬৮ সালের আগে।
১৯৬৮ অ্যাশেজ চলাকালীন ওভাল প্রেসবক্সে বসে ডেভিড ফ্রিথের সঙ্গে আড্ডায় ফিঙ্গলটন অ্যাডিলেড-লিকের দোষী হিসেবে জানিয়েছিলেন ব্র্যাডম্যানের নাম। অবশ্য তার এ কথা যেন বিতর্ক না তোলে নতুন করে, সেজন্যে বেশ শক্তরকম শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন ফ্রিথকে দিয়ে,
‘আমি বেঁচে থাকাকালীন এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করা যাবে না।’
ফিঙ্গলটন ফ্রিথকে যে গল্পটি বলেছিলেন, তা তিনি শুনেছিলেন ক্লড করবেটের কাছ থেকে, তখন যিনি লিখতেন ‘সান’ পত্রিকায়। একই পত্রিকায় লিখতেন ব্র্যাডম্যানও। ফিঙ্গলটনের দাবি অনুযায়ী, ব্র্যাডম্যান করবেটকে টেলিফোন করে ডেকে নিয়েছিলেন নর্থ টেরেসে, এবং সেখানেই দেয়া-নেয়া হয়েছিল উডফুল-ওয়ার্নার দ্বন্দ্বের ইতিবৃত্ত। করবেট এই ঘটনা সম্বন্ধে নিজের দায় এড়াবার জন্যে পুরো ঘটনা জানিয়ে দেন আরও কয়েকজন সাংবাদিককে, যেন তার ঘাড়েই সম্পূর্ণ বোঝা এসে না পড়ে।
ফিঙ্গলটনের দাবি যে বৃথা আস্ফালন নয়, নিজেকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করবার চেষ্টাও নয়, এর প্রমাণ পাওয়া যায় বডিলাইন সিরিজে উপস্থিত সাংবাদিক গিলবার্ট মান্টের কথায়। আজীবন ব্র্যাডম্যানের গুণমুগ্ধ মান্ট অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন নর্থ টেরেসের সন্ধির। কিন্তু ব্র্যাডম্যানের প্রতি তার একনিষ্ঠ ভালোবাসায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল করবেট-কন্যা হেলেনের সঙ্গে কথা বলে। হেলেন তাকে বলেছিলেন,
‘বাবা (ক্লড করবেট) মারা যাবার পরে মা আমাকে বলেছিলেন, খবরটা ব্র্যাডম্যানই দিয়েছিলেন।’
ব্র্যাডম্যান অবশ্য তার জীবদ্দশায় কখনো স্বীকার করেননি এই অভিযোগ, তা এ খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে ক্রিকেটের যত ভালোই করুক না কেন। কারণটি অবশ্য অনুমানযোগ্য। বিশ্বাসভঙ্গ, গোপনীয়তার লঙ্ঘন, হুইসেলব্লোয়িং আজকের দুনিয়ায় চমক জাগায় না তেমন, কিন্তু আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্গে নীতিনৈতিকতাও মস্ত বড় এক অর্জনের বস্তু ছিল!
***
মাঠের বাইরের আগুনঝরা ওই দিনের পর অ্যাডিলেডে মাঠের ক্রিকেট হয়ে পড়েছিল গৌণ। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস কোথায় শুরু হলো, কোথায় থামলো, তা নিয়ে ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টদের আগ্রহে ভাটা পড়েছিল যথেষ্ট। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচক বিন জনসন ইংল্যান্ডের বোলিংকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট মাঠে ঘটা সবচেয়ে অখেলোয়াড়চিত আচরণ।’ ভিক্টোরিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যানন হিউজ ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেছিলেন, ‘বাকি দুই টেস্ট বাতিল করো। ইংল্যান্ডকে অ্যাশেজ দিয়ে দাও। ওরা তো এটার জন্যেই এসব করছে।’ এসিবিও তখন সব দেখেশুনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল লর্ডসে তারবার্তা পাঠানোর। যে খানিক দোনামনা ছিল টেলিগ্রাফ পাঠানো নিয়ে, খুব সম্ভবত তা-ও দূর হয়ে গিয়েছিল সোমবারের খেলা দেখেই।
ফিঙ্গলটন মাঠে যাওয়া-আসা করে ফেলেছিলেন উডফুল ইনজুরির আগেই। ব্র্যাডম্যানও পারেননি ওই নারকীয় তাণ্ডব সামলাতে। আঘাত সামলাতে বাড়তি নিরাপত্তা নিয়ে নেমেছিলেন পন্সফোর্ড, ৮৫ রান করা ছাড়া যার লভ্যাংশ মিলেছিল সামান্যই৷ সাড়ে তিন ঘণ্টার ওই ইনিংসে ঠিক কতটি আঘাত পন্সফোর্ড সয়েছিলেন, তার কড়ায়-গণ্ডায় সঠিক তথ্য জানা যায়নি, তবে কোনো হিসেবেই ডজনের কম পাওয়া যায়নি — যার ভেতরে মাথার পেছনে বল লাগবার ঘটনাও রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়টি যদি পন্সফোর্ড আর ভিক রিচার্ডসনের ৮০ রানের জুটি হয়, দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম অতি অবশ্যই ওল্ডফিল্ডের ৪১। সিরিজের ঘটনা-পরম্পরায় চিন্তা করলে অবশ্য সবচাইতে আলোড়নকারী। ভেরিটির বলে স্ট্রেইট ড্রাইভ কিংবা লেট কাটে মারা বাউন্ডারি থেকে ওল্ডফিল্ড দিয়েছিলেন দারুণ এক ইনিংসের প্রতিশ্রুতি। ২১২ রানে অস্ট্রেলিয়ার সপ্তম উইকেটের পতন হলে শেষ ভরসা হয়ে টিকে ছিলেন ওল্ডফিল্ডই। সেই আশাভঙ্গের ইতিহাস লেখা হয়েছিল মৃত্যুশঙ্কা জাগিয়ে। হন্তারকের ভূমিকায় যথারীতি লারউড।
শর্ট পিচ বলটির গতি এক্সপ্রেস ঘরানার কিছু ছিল না। কিন্তু নিচু সাইটস্ক্রিনের কারণে ওল্ডফিল্ড বলটি হারিয়ে ফেলেছিলেন পলকের জন্যে। শুরুতে কাট খেলতে চাইলেও পরে মনস্থ করেছিলেন, পুল করবেন। বিপত্তি বেঁধেছিল ওখানেই; ব্যাটের কানায় লেগে বল ছুটে গিয়েছিল ওল্ডফিল্ডের মাথায়। বছর তিনেক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার জক ক্যামেরনের (এই লারউডেরই বলে) মাথায় বল লাগবার বীভৎস দৃশ্য ফিরে এসেছিল অ্যাডিলেডে। ব্যাট ছিটকে দিয়ে মাথা ধরে টলতে টলতে ওল্ডফিল্ড ছুটেছিলেন পয়েন্টের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে ছুটে এসেছিলেন মাঠে থাকা ইংল্যান্ডের সমস্ত ক্রিকেটার, গভর্নর্স বক্সে থাকা অস্ট্রেলীয় দলপতি উডফুলও রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নেমে এসেছিলেন মাঠে। ছুটে আসা ইংলিশদের ভেতর ছিলেন লারউডও, তিনি নাকি ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছিলেন ওল্ডফিল্ডের কাছে। ওল্ডফিল্ড যার জবাব নাকি দিয়েছিলেন নিচুস্বরে ‘তোমার কোনো দোষ নেই, হ্যারল্ড’ বলে। (অবশ্য পরবর্তীতে ওল্ডফিল্ড এমন কিছু বলেননি বলেই জানিয়েছিলেন। ইশ, তখন যদি স্ট্যাম্প-মাইক থাকতো!)
নিজেকে এক অর্থে প্রচণ্ড সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন ওল্ডফিল্ড, কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান শেলের আঘাত এমনিতেই তার মস্তিষ্ককে বানিয়ে দিয়েছিল ভেদ্য। সেদিন বলটি আর ইঞ্চিখানেক ডানে-বাঁয়ে লাগলেই অথবা ওল্ডফিল্ডের মাথায় ক্যাপ না থাকলেই হয়তো বা বডিলাইন বোলিং শেষ হতো জীবন কেড়ে নিয়ে।
লারউড অবশ্য দাবি করতে পারেন, ওল্ডফিল্ডের আঘাত পাওয়া বলটি তার মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়নি। তার এ দাবিকে সমর্থন করেছেন ওয়াল্টার হকারও। কিন্তু একই সঙ্গে ‘অ্যাডিলেড অ্যাডভারটাইজার’-এ তিনি জানিয়েছিলেন, ওল্ডফিল্ডের আঘাত পাওয়া বলের আগের পাঁচটি বলই ছিল বডিলাইনে অথবা মিডল-লেগ স্ট্যাম্প লাইনে। এমনকি লারউডের বোলিং প্রান্তের ঠিক পেছনের গ্যালারিতে অবস্থান করে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, ওই স্পেলে লারউড যে ৭২টি বল করেছিলেন, এর ৩৪টিই ছিল বডিলাইনে। অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ে যে প্রতিহিংসাপরায়ণ কোনো মনোভাব ছিল না, তা বোঝাতে তিনি যুক্ত করেছিলেন, এমসিসির ২য় ইনিংসের শুরুতে টিম ওয়াল যে ৫৪টি বল করেছিলেন, তার ভেতরে কেবল দুটো বলকেই ‘বডিলাইনে করা হয়েছিল’ বলা যেতে পারে।
***
ওল্ডফিল্ড প্রাণসংকট কাটিয়ে ফিরলেও মাঠে অবশ্য আর ফিরতে পারেননি সে ম্যাচে। ফিরলেও অবশ্য লাভ হতো বলে মনে হয় না, দু’দলের চার ইনিংস শেষে এমসিসির ৩৩৮ রানে এগিয়ে থাকাটাই তো সব বলে দেয়।
এমসিসি দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিল ১১৯ রানে এগিয়ে থেকে। টাইমলেস টেস্ট হবার কারণে ছিল না সময়ের বাধ্যবাধকতা, জয় নিশ্চিতে এমসিসি ব্যাট করেছিল সাড়ে নয় ঘণ্টা আর ২০০ ওভার। সাড়ে চার ঘণ্টা ব্যাট করে জার্ডিন পেয়েছিলেন ফিফটির দেখা। হ্যামন্ড ৮৫ করে আউট হয়েছিলেন ব্র্যাডম্যানের ফুলটসে, যে বলকে হবস বলেছেন ‘ইতিহাসের নির্বিষতম বল।’ জার্ডিনের পিষে ফেলা নীতির আরেকপ্রস্থ প্রমাণ মিলেছিল এ ইনিংসে। ফিল্ডিংয়ের সময় পাওয়া আঘাতে পেইন্টারের গোড়ালি ফুলে গিয়েছিল অনেকটা। ডাক্তারের তাই পরামর্শ ছিল, পারতপক্ষে তিনি যেন মাঠে না নামেন। কিন্তু নামবার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তো পেইন্টারের হাতে ছিল না। লিড পেরিয়ে গিয়েছে ৫০০-এর ঘর, এমতাবস্থায়ও জার্ডিন তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দশম ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে যেতে। ম্যাচে ফেরবার সামান্যতম সুযোগও যেন অস্ট্রেলিয়ানদের সামনে না থাকে।
৫৩১ রানের টার্গেটে নেমে ফিঙ্গলটন পেয়েছিলেন পেয়ারের দেখা। প্রথম ইনিংস নিশ্চিত করেই শুষে নিয়েছিল পন্সফোর্ডের পুরোটা, দ্বিতীয় ইনিংসে তাই রান করেছিলেন মাত্র তিন। মরার আগে মেরে যাওয়ার নীতি নিয়ে নেমেছিলেন ব্র্যাডম্যান। রে রবিনসন অভিযোগ তুলেছিলেন, বডিলাইন বোলিংয়ের ভয়ে সেদিন নাকি ব্যাটিং অর্ডারে নিজের নাম নিচে নামিয়ে দিতেও অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ক্রিজে নেমে ব্যাট চালিয়েছিলেন সমানে, মন্টি নোবেল যা দেখে বলেছিলেন,
”Brilliant as was his hurricane exhibition, it was not Test cricket.”
ধূমকেতু হয়ে জ্বলে ব্র্যাডম্যান ৭৩ মিনিটে পেয়েছিলেন ছেষট্টির দেখা, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচজয়ের জন্যে যে আরও ৪৬৫ লাগতো!
বডিলাইন বোলিং সয়ে উডফুল অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ব্যাট ক্যারি করেছিলেন দ্বিতীয়বারের মতো। উল্লেখ করবার কারণ, রানের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ পরাজয়ের পর এটা যদি সান্ত্বনা হতে পারে আরকি!
ব্রিসবেনে পরের টেস্ট শুরু হবার আগে মাঝে সময় পাওয়া গিয়েছিল ২০ দিন, কথার লড়াইয়ের জন্যে সময়টা যথেষ্ট।
***
ইংল্যান্ডের বডিলাইন বোলিং নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সর্বত্র। অস্ট্রেলিয়াজুড়ে লারউডকে চিত্রিত করা হয়েছিল খুনিরূপে, নিজের জীবনীতে এর উল্লেখ করেছিলেন লারউডও। বডিলাইন নিয়ে অসন্তোষের আগুন জ্বলছিল ইংলিশ শিবিরেও। লেস অ্যামিস বহু পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তিনি আর হ্যামন্ড বডিলাইনকে সমর্থন করেননি কোনোকালেই। এমনকি সিরিজ শুরুর আগে থেকেই জার্ডিনের কৌশলের বিরোধিতা করে আসছিলেন ম্যানেজার পেলহাম ওয়ার্নারও। যদিও জার্ডিনকে এ বিরোধিতার কথা মুখ ফুটে বলার কাজটিও করেননি তিনি।
টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে, নভেম্বরের ২৯ তারিখে প্লাম তার স্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে জার্ডিনকে অবহিত করেন, ‘such a difficult fellow’ বলে। বছরখানেক আগে জার্ডিনকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেওয়াটাও যে ভুল ছিল, অকপটে তা স্বীকারও করে নিয়েছিলেন সে পত্রে। পতৌদির নবাব তো লেগ-ট্র্যাপে ফিল্ডিং করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন বরাবরই এবং দ্বিতীয় টেস্টের পরে তিনি যে আর খেলেননি, তাতে এই আপত্তির দায় দেখেন অনেকে। গাবি অ্যালেন জার্ডিনকে উল্লেখ করেছিলেন ‘তার দেখা সবচাইতে স্টুপিড মানুষ’ হিসেবে। সিডনিতে প্রথম টেস্টের দিন সকালে জার্ডিন তাকে গিয়ে যখন বলেছিলেন, ‘লেগ-সাইডে আরও ফিল্ডার নিয়ে তোমাকে আরও বেশি বেশি বাউন্সার দিতে হবে‘, তার উত্তর ছিল,
“ডগলাস, আমি এমনটা কখনো করিনি, এবং এমনভাবে আমি কখনো ক্রিকেট খেলবোও না।”
কিন্তু, এভাবে বলা পর্যন্তই সার। বডিলাইনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড দলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো গড়ে ওঠেনি কখনোই। ম্যানেজার প্লামের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যথাযথ, এমসিসির কর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করলেও অস্ট্রেলিয়ায় বডিলাইন-বিরোধী অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেননি একবারও। অ্যাডিলেড টেস্ট শেষে সতীর্থদের কাছে বডিলাইন নিয়ে মতও চেয়েছিলেন জার্ডিন, কিন্তু সেখানেও জয় হয়েছিল বডিলাইনেরই।
যুদ্ধের ময়দানে তো ক্যাপ্টেনের আদেশই শিরোধার্য, তাই না?
***
যুদ্ধের অন্য পক্ষ অবশ্য অ্যাডিলেড টেস্ট চলাকালীনই ঠিক করে ফেলেছিল করণীয়। এসিবি লর্ডসে ইংল্যান্ডের বোলিং নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানিয়েছিল টেস্টের পঞ্চম দিন। অবশ্য বডিলাইন বোলিংয়ের ব্যাপারে গোটা অস্ট্রেলিয়ার আপত্তি থাকলেও এমসিসিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানো নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি এসিবির কর্তারা। ভিক্টোরিয়া, তাসমানিয়া, সাউথ এবং ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা পক্ষে ভোট দিলেও বিপক্ষে গিয়েছিলেন কুইন্সল্যান্ড আর নিউ সাউথ ওয়েলসের সদস্যরা। কারণটিও অনুমানযোগ্য; সিরিজের বাকি দুই টেস্ট হবার কথা ছিল তাদের শহরেই, তারবার্তা পাঠিয়ে রাজস্ব হারানোর কোনো মানেই হয় না।
কিন্তু খেলোয়াড়দের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে ৮-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল তা দাঁড়িয়েছিল এমন:
“Bodyline bowling assumed such proportions as to menace best interests of game, making protection of body by batsmen the main consideration. Causing intensely bitter feeling between players as well as injury. In our opinion is unsportsmanlike. Unless stopped at once likely to upset friendly relations existing between Australia and England.”
কিন্তু পাঠানোর পরে বেঁধেছিল আরেক গোল। এসিবি ব্যর্থ হয়েছিল ঘটনার স্পর্শকাতরতা অনুধাবনে, তাই এমসিসিতে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল স্বাভাবিক গতিতেই। তার পাঠিয়েই সাংবাদিকদের নিজের সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অফিসে ডেকে নিয়ে তারের বিস্তারিত জানিয়েও দিয়েছিলেন এসিবি সচিব বিল জিনস। এসিবি এই তারের গুরুত্ব না বুঝলেও বুঝেছিলেন রয়টার্সের সাংবাদিক গিলবার্ট মান্ট। জরুরি ভিত্তিতে জিন্সের বলা কথার সারসংক্ষেপ ক্যাবল করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লন্ডনের অফিসে। এসিবির বার্তা এমসিসিতে পৌঁছেছিল পরদিন মধ্যদুপুরে, মান্টের তার এর অর্ধদিবস আগে পৌঁছে গোটা ইংল্যান্ডকে তছনছ করে দিয়েছে।
এসিবি তার পাঠাবার দু’দিন আগেই এমসিসির এক কর্তা অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের বোলিং নিয়ে যদি আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ আসে, তবে তারা এ নিয়ে আলোচনা করে নেবেন পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে। কিন্তু প্রতিবাদ যে বিলেতের হাঁড়কাপানো শীতের রাতেই চলে আসবে, তা ভাবেননি কেউই। যেমন ভাবেননি চিরকালই খেলোয়াড়চিত মনোভাব নিয়ে গর্ব করা ইংল্যান্ডের গালে চপেটাঘাত আসবে ‘আনস্পোর্টিং’ ব্যবহারের অভিযোগ তুলে।
অ্যাডিলেড টেস্টের কিছু অংশ ধারণ করা হয়েছিল ক্যামেরার রিলে, কিন্তু তা সাগর পাড়ি দিয়ে বিলেতে পৌঁছুতে সময় লাগতো প্রায় তিন সপ্তাহ। কিন্তু, ধৈর্য্য কি আর অত বাঁধ মানে? আদতেই ইংলিশ দল কোনো অখেলোয়াড়চিত আচরণ করেছে কি না, তার স্বপক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি তখনো। উল্টো ইংল্যান্ডের পত্রপত্রিকার পাতায় যা ছাপা হচ্ছিল, তা স্পষ্টতই নির্দেশ করছিল ইংল্যান্ডের নিষ্কলুষতার। মেলবোর্নে জ্যাক ফিঙ্গলটন আউট হলে ঈশ্বরের দেশ থেকে পাঠানো হয়েছিল,
“Fingleton clean bowled 234 dogged defense courage took innumerable blows”.
কিন্তু, রানীর দেশে এই খবর যেভাবে প্রচার পেয়েছিল, তাতে ফিঙ্গলটনের পাওয়া আঘাতের কোনো উল্লেখমাত্র ছিল না। কেবলমাত্র ভাসা-ভাসা তথ্যের ভিত্তিতে ইংল্যান্ডে বসেই সিডনি সাউদারটন অ্যাডিলেড টেস্ট নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন ইংল্যান্ডের পক্ষে সহানুভূতিসূচক প্রতিবেদন। ‘probably the most unpleasant match’ লিখে তিনি এর সমস্ত দায় চাপিয়েছিলেন দর্শকদের ওপর। জার্ডিনকে নাকি একের পর এক আক্রমণাত্মক, অশ্লীল মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল কোনো কারণ ছাড়াই।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল, প্রায় সবাই বসেছেন মন্তব্যের ডালি খুলে। চায়ের কাপ হাত নিয়ে ঝড় তোলার রীতি তখনো ছিল কি না কে জানে, তবে বডিলাইন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সবাই। বডিলাইন ঠিক কি বেঠিক, কীভাবে বডিলাইন খেলতে হবে, নৈতিক দিক থেকে বডিলাইন সমর্থনযোগ্য কি না, আলোচনা ডালপালা মেলছিল সমস্ত দিকেই। ইংল্যান্ডের প্রায় সবগুলো পত্রপত্রিকার মন্তব্যই ছিল উইজডেনের অনুরূপ, যে কারণে জনমতও গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডের সমর্থনে।
গোটা ইংল্যান্ডে এক নেভিল কার্ডাসই বোধহয় অনুভব করতে পেরেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অনুযোগের কারণ। ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানে লেখা কলামে তিনি বডিলাইনের নৈতিকতা চ্যালেঞ্জ জানানোর সাথে সাথে জানিয়েছিলেন, এমন চলতে থাকলে ক্রিকেট খেলা কমপক্ষে দশ বছরের জন্যে বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। ক্রিকেট বন্ধ করে দেবার ভাবনা যে শুধু কার্ডাসই ভাবেননি, বিল জিন্সের কাছে এমসিসির তদানীন্তন প্রধান অ্যালেন রবার্টসনের পাঠানো এক গোপন চিঠিতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
ওদিকে কুরুক্ষেত্রে কিন্তু মতের অদল-বদল হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। চিঠি সিরিজ শেষে পাঠালেই ভালো হতো বলে এসিবির সমালোচনা করছিলেন কেউ কেউ, ‘আনস্পোর্টসম্যানলাইক’ শব্দের ব্যবহার ইংল্যান্ডকে খেপিয়ে তুলবে বলেও অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অনেকে। সিরিজে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে এমন অভিযোগ অজুহাতের মতো শোনায় বলেই মত দিয়েছিলেন তারা। অপরদিকে, মন্টি নোবেলের মতো সাবেকরা বডিলাইনকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘নৃশংসতা’ রূপে। নোবেল পাশে পেয়েছিলেন হার্বি কলিন্স, হিউ মেসি, জ্যাক রাইডার আর চার্লি টার্নারের মতো ক্রিকেটারদেরও। এক অস্ট্রেলীয় বিচারক তো বডিলাইন বোলিংয়ে কোনো ব্যাটসম্যান আহত হলে বোলারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা উচিৎ বলেও রায় দিয়েছিলেন।
খবর ছড়িয়ে পড়েছিল এ দুই দেশের বাইরেও। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল বডিলাইন নিয়ে, ভারত থেকে রনজিৎসিংজি লিখে পাঠিয়েছিলেন, প্রতিপক্ষের ক্ষতবিক্ষত দেহ মাড়িয়ে জয় পাবার চাইতে হারা ভালো। লেখায় সাম্য আনবার জন্যেই শেষে বোধহয় জুড়ে দিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের বোলিং আতঙ্ক সৃষ্টিকারী, এই অভিযোগ পূর্ণরূপে প্রমাণিত হবার আগে জার্ডিনের ট্যাকটিকস থেকে সরবার কারণ তিনি দেখেন না।
‘বডিলাইন’ নিয়ে নাটক-কবিতা-গানও লেখা হচ্ছিল সমানে, কেউ টেনে এনেছিলেন অতীত। এতসবের ভিড়ে কেবল জ্যাক ফিঙ্গলটনই বোধহয় ধরতে পেরেছিলেন বডিলাইনের প্রকৃত মর্মপীড়া:
“Bodyline prostituted the art of batting. It knew not the delicacy of the back-cut; it denied the grace of a cover drive, cricket’s most graceful stroke. The glorious straight drive, majestic off drive or lofty shots over the off field might never have been born for all birthright bodyline conceded them.”
গায়ে বল করলে এদের কোন শটটাই বা খেলা যায়?