Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিসিবি এবং একটি ‘ধামাচাপা’ সংস্কৃতি

বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার এহসানুল হক সেজানকে আপনার মনে না থাকলেও দোষ দেওয়া চলে না। একটিমাত্র টেস্ট খেলেছেন, তাতে সাকুল্যে রান করেছেন সাতটিমাত্র। ছয়টি ওয়ানডে খেললেও তাতে পারফরম্যান্স ছিলো তথৈবচ। মূলত টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হলেও খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্যটা এসেছিলো বল হাতে, ব্রায়ান লারার উইকেট নিয়েছিলেন বেনোনিতে একটি পরিত্যক্ত ম্যাচে। তবে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপটাই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইতি টেনে দেয়। সম্প্রতি নির্বাচক হিসেবে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি, তবে সেটা খুব একটা গর্বের কারণে নয়।

২০০৭-০৮ মৌসুমে সবরকম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করার পর গত বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের নির্বাচক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সে সূত্রেই গত ২৬ ডিসেম্বর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ে বাংলাদেশ যুব দল, সঙ্গে ছিলেন নির্বাচক সেজানও। তবে গত ৩ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার সময় নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এয়ারপোর্টে এমিরেটসের চেক ইন কাউন্টারে বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মুখে পড়ে গোটা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। আর সেই বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী হিসেবে আঙুল উঠেছে জুনিয়র নির্বাচক কমিটির সদস্য সেজানের দিকেই। অবশ্য শোনা যায়, আগে থেকেই এরূপ অভিজ্ঞতার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া ছিলো দলের অনেকেরই, কেননা এহসানুল হকের খাতায় ইতোপূর্বে যুক্ত হওয়া কিছু ডিমেরিট পয়েন্ট।

ঢাকা থেকে নিউজিল্যান্ড যাওয়ার পথে দুবাই ও সিডনি হয়ে ক্রাইস্টচার্চে যেতে হয়, প্রায় ১৪ ঘণ্টার দীর্ঘ এই ফ্লাইটে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে মাতাল অবস্থায় বাংলাদেশ দলেরই কোনো এক সদস্যের উপরে হঠাৎ চড়াও হওয়ার। একইসাথে তার সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে ভিনদেশী কোনো এক কিশোরীকে নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে নিজের কক্ষে যোগাযোগ করার কথা বলে উত্যক্ত করার। জানা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই যাওয়ার পথে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে এতটাই মাতাল হয়ে যান যে, বিমান থেকে তাকে কয়েকজন মিলে ধরে নামাতে হয়। এমনকি এক পর্যায়ে বেসামাল এহসানুল হককে গ্রেফতারের হুমকিও দেয় এমিরেটস কর্তৃপক্ষ, যদিও সে যাত্রায় যুব দলের সঙ্গে হেড অব ডেলিগেশন ও প্রধান নির্বাচক মাইনুল হক এবং ম্যানেজার দেবব্রত পালের হস্তক্ষেপে সে পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়।

এহসানুল হক সেজান; Credit: ebizctg.com

ডানেডিনে পৌঁছেই নির্বাচকের এহেন আচরণের কথা সবিস্তারে অবহিত করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী এবং গেম ডেভেলপমেন্ট কমিটির প্রধান খালেদ মাহমুদকে। বিব্রত বোর্ড এ সম্পর্কে সবিস্তারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি, এ বিষয়ে কালেরকন্ঠকে নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “‘আপনারা যেমন শুনেছেন, তেমনটি আমিও শুনেছি। আমরা হেড অব ডেলিগেশন ও ম্যানেজারের রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। তাদের রিপোর্টে যদি বিষয়টি উল্লেখিত হয় এবং প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ম্যানেজার দেবব্রত পালও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি,”আমার যা জানানোর, আমি বোর্ডকে জানাব। বাইরে কিছু বলব না।” 

কথাটুকু আপাতত এখানেই বিশ্রাম নিক। চলুন, আমরা এই ফাঁকে একটু পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে আসি। পুরোনো কাসুন্দিটা আমরা মূলত কয়েক ধাপে মাখাবো, সাথে একটু মসলা সরবরাহও করবো।

প্রসঙ্গ সাব্বির

গত ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় লিগের ষষ্ঠ রাউন্ডের খেলা। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে রাজশাহী এবং ঢাকা মেট্রোর মধ্যকার খেলায় রাজশাহী তখন ফিল্ডিংয়ে, সীমানায় দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করছেন সাব্বির রহমান। তার চোখের ধূসর বর্ণের কারণে ১০-১২ বছরের এক কিশোর তাকে ‘ম্যাও’ বলে ডাকে, তাতে মেজাজ হারিয়ে পরিচিত একজনকে দিয়ে প্রহার করেন কিশোরটিকে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ম্যাচ রেফারির সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগও আনা হয়। ফলাফলস্বরূপ, সাব্বিরকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে সাব্বির রহমানের নামে কয়েক দফায় বেশ কিছু শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত অভিযোগ উঠলেও অর্থ জরিমানা ছাড়া বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সাব্বির রহমান; Credit : Cricinfo

সাব্বিরের এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে অর্থ জরিমানা এবং ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি প্রস্তুতির জন্য সাব্বিরকে মিরপুর টেস্টে নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে কস্মিনকালেও কেউ এহেন কারণ দর্শানো দেখেছেন কিনা বলা মুশকিল, টেস্ট খেলিয়ে কিনা একজনের টি-টোয়েন্টি প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে! আর সেটাও এমন এক পরিস্থিতিতে, যেখানে সাব্বিরের দলে সুযোগ পাওয়াটাই ছিলো রীতিমতো অবিশ্বাস্য!

তামিম ইকবালের জরিমানা

গত ২ ডিসেম্বর বিপিএলের ৩৫ তম ম্যাচ, মিরপুরে মুখোমুখি হয়েছিলো তামিম ইকবালের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস এবং মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার রংপুর রাইডার্স। প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে ভয়াবহ সংগ্রাম করে ১৭.১ ওভারে ৯৭ রান করে অলআউট হয় রংপুর, জবাবে ব্যাটিং করতে নেমে পিচের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে কোনোক্রমে ১০০ রান করতে সক্ষম হয় কুমিল্লা। ম্যাচটি চার উইকেটে জিতলেও এই টার্গেট পাড়ি দেওয়ার জন্য কুমিল্লাকে একদম ম্যাচের শেষ ওভার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ম্যাচপরবর্তী প্রেস কনফারেন্সে এসে তামিম ইকবাল বলেন, “হরিবল, হরিবল। হরিবল উইকেট! দশদিন সময় হাতে পাওয়ার পরও কিউরেটর ভালো একটা পিচ তৈরি করতে পারেননি। দর্শকেরা তো মাঠে ৯০-৯৫ রানের ম্যাচ দেখতে আসেন না!” এই কথাটি বলার কারণে তামিম ইকবালকে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, পরেরদিন আরো একটি ‘কোড-অফ-কনডাক্ট’-এর বেড়াজালে আটকে ফেলা হয় ক্রিকেটারদেরকে।

বিপিএলে পিচ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করায় জরিমানা করা হয় তামিম ইকবালকে; Source: Youtube

রীতিমতো অবাক করার মতো ছিলো গোটা বিষয়টাই। তবে এ প্রসঙ্গে বিসিবি প্রেসিডেন্টের বিবৃতি বাকরূদ্ধ করে দিয়েছিলো গোটা দেশকেই, “ওর এই মন্তব্য দেশের ক্রিকেটের জন্য খুবই বিপদজনক। এটা আমাদের ক্রিকেটের প্রচুর ক্ষতি করতে পারে বা পারত। এজন্য আমরা মনে করেছি, সহ-অধিনায়ক হিসেবে কথাবার্তা বলায় ওকে আরও অনেক সতর্ক হতে হবে।” তিনি আরো বলেন, “একটা পিচ নিয়ে ক্রিকেটাররা বলতেই পারে যে টি-টোয়েন্টির জন্য আদর্শ নয়। কিন্তু আপনি আউটফিল্ড নিয়ে বলবেন কেন? কিউরেটর নিয়ে বলবেন কেন?”  ব্যাপারটা যেন এমন, ক্রিকেটারদেরকে ধুয়েমুছে ফেলা যাবে, কিন্তু কিউরেটরের গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচও লাগতে দেওয়া চলবে না! অথচ কাজে আসল ঘাটতিটা যে ছিলো কিউরেটরেরই, সেদিকে নজর নেই কারও। উপরন্তু গোটা ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে তামিমকেই উল্টো পাঁচ লক্ষ টাকা গুণতে হলো!

তামিমের জন্য এই পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানাই হয়তো সবচেয়ে বড় ধাক্কা নয়, সেই ধাক্কাটা এসেছে তার মনস্তত্ত্বে। এমসিজি’র মতো মাঠের সমালোচনায় মেতেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ, সেটাও কিনা অ্যাশেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া’ সেখানে স্মিথের পাশে দাঁড়িয়ে একাত্মতা ঘোষণাও করেছিলেন। আর সেখানে আমাদের বোর্ডের জন্য গোটা ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার এত প্রয়োজন কেন হয়ে পড়লো, সেটা বিস্ময়ের ব্যাপারই বৈকি!

আল-আমিনের রহস্যময় প্রস্থান

হঠাৎ করেই যেন পাইপলাইন থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেন আল আমিন হোসেন, কারণ জানা যায়নি এখনও; Source: DNA India

আরেকটু পিছিয়ে যাই। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশী পেসার আল আমিন হোসেন রাত দশটার পর বাইরে থাকা এবং ‘গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের’ অপরাধে তাকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরত পাঠানো হয়। কখনও তার অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়নি, তবে এরপর ধীরে ধীরে জাতীয় দলের আশপাশ থেকে হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে যান আল আমিন। গোটা ব্যাপারটা নিয়ে একটা ঘোর ধোঁয়াশা তৈরি করা হলেও সেই ধোঁয়াশা কাটাতে এগিয়ে আসেননি কেউই। এমনকি বিশেষ কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। আবারও গোটা বিষয়টাই ধামাচাপা পড়ে যায় সময়ের ব্যবধানে।

ক্যাসিনো-বিতর্ক

ক্যাসিনোতে খালেদ মাহমুদ সুজন; Credit: clickittefaq.com

ঐ বিশ্বকাপেই একটি ভিডিও ফুটেজে টিম ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনকে দেখা যায় একটি ক্যাসিনোতে। ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে স্বীকার করেন, তিনি ক্যাসিনোতে গিয়েছিলেন। তবে মাছরাঙা টেলিভিশনকে দেওয়া বিবৃতিতে দাবি করেন, সেখানে তিনি কোনো জুয়াখেলাতে মত্ত হননি। বরং ক্যাসিনোর পাশের একটি রেস্টুরেন্টে ভূড়িভোজে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। তাতে সত্যতা কতটুকু ছিলো, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও সে যাত্রায় পার পেয়ে যান সুজন।

সাকিবের নিষেধাজ্ঞা

Caption

২০১৪ সালের জুলাই মাসে সাকিব আল হাসানকে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, কারণ ক্যামেরার সামনে সাকিবের ‘গুরুতর অসদাচরণ’। তার এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন বিবৃতি দেন, “ওর আচরণগত একটা বড় সমস্যা আছে, যেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য মোটেই ভালো নয়। আমার মনে হয়, এই ঘটনাটা গোটা দলকেই প্রভাবিত করেছে। আরো বড় সমস্যা হবে যদি অন্য ক্রিকেটাররাও একইরকম ব্যবহার করতে শুরু করে। যদি এমনই চলতে থাকে, বাংলাদেশের সামনে ধ্বংসাত্মক একটি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আর এ কারণেই সাকিবের একটা কড়া শাস্তি প্রাপ্য।”

সেজান-বিতর্ক

আবারও ফিরে আসি এহসানুল হক সেজানের বিষয়টিতে। পুরো অভিযোগটিই অস্বীকার করছেন এহসানুল হক সেজান। তিনি জানান, “আপনারা যে রকম শুনেছেন, ঘটনা কিন্তু ও রকম বড় কিছু নয়। শৃঙ্খলাভঙ্গের কোনো ঘটনাও আমি ঘটাইনি। আসলে সেদিন আমার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছিল। প্রচণ্ড ব্যথা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না বলে কাতরাচ্ছিলাম।”  তবে দলের অন্যদের থেকে পাওয়া তথ্য থেকে সেজানের এই দাবির সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে কোচিং স্টাফের সদস্য সাবেক ক্রিকেটার গোলাম মর্তুজাসহ আরো কয়েকজনের ঘুষি খাওয়ার ঘটনার সঙ্গে সেজানের দাবির মিল যে নেই, সেটা যথেষ্ট সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে কালেরকন্ঠ লিখেছে,“আমরা ওর ওপর খুবই বিরক্ত। আমি যদি আজ মদ খেয়ে মুশফিকদের সামনে মাতলামি করি, তাহলে কিছুতেই সেটি গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। অবশ্যই কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।” 

Credit: Click Ittefaq

তবে সেই শাস্তির ঘোষণা আসেনি এতদিনেও। মাঝে কানাঘুষা শোনা গিয়েছিলো, তাকে নাকি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের নির্বাচক প্যানেল থেকে ‘পদাবনতি’ দিয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ দলের নির্বাচক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। কথাটা শুনতে যত অদ্ভুত শোনাচ্ছে, এর আগের ঘটনাচক্রের দিকে ফিরে তাকালে সেটাকে আর এতটা অদ্ভুত বলে মনে হবে না। কেন? চলুন, তাহলে নাহয় আর দুই-একটা বাক্যব্যয় করি সে ব্যাপারেই! তবে তার আগে আরেকটি ব্যাপারে আলোকপাত না করলেই নয়।

গামিনী-রহস্য

কোনো এক অজানা কারণে বিসিবি বরাবরই উদার ছিল মিরপুর শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কিউরেটর গামিনী ডি সিলভার প্রতি। নানা কারণে বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মিরপুরের উইকেট, এমনকি আইসিসি মিরপুরের আউটফিল্ডকে ‘পুওর’ বলে ডিমেরিট পয়েন্টও দিয়েছিলো। তবু বিসিবি তাতে বিন্দুমাত্র আঁচ লাগতে দেয়নি গামিনী ডি সিলভার গায়ে, বরং নানা ছুঁতোয় তাকে বটবৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছে। মাঝেমধ্যে মিরপুরের স্লো উইকেটের পিছনে কারণ দেখানো হয়েছে অতিরিক্ত ক্রিকেট ম্যাচ হওয়ার কুফল, তবে সেজন্য মিরপুর থেকে সরিয়ে কিছু ম্যাচ ঢাকার বাইরে কিংবা নিদেনপক্ষে ফতুল্লা স্টেডিয়ামেও দেওয়ার কথা ভাবেনি বিসিবি, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। যা হোক, অনেক দিনের বিরতির পর এবারের বিপিএলেও মিরপুরে দেখা গেছে একই রকম উইকেট। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলাতেই জরিমানা গুণতে হয় তামিমকে, তবে গামিনীকে কোনোপ্রকার জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হয়নি!

সন্দেহের তীর গামিনীর দিকে, নীরব বিসিবি; Source: Youtube

ত্রিদেশীয় সিরিজের শুরুতে গামিনীর পরিবর্তে কিউরেটর হয়ে আসার কথা ছিলো জাহিদ রেজা বাবু’র, কিন্তু ‘বিশেষ’ কোনো এক কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রানের পাহাড় গড়ে বাংলাদেশ, জয়টাও আসে অনায়াসেই। কিন্তু এরপর থেকেই রাতারাতি বদলে যায় উইকেটের হালচাল, রান তোলা হয়ে উঠল সবচেয়ে কঠিন কাজ। এমনকি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালেও বিন্দুমাত্র ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ পায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, উপরন্তু শ্রীলঙ্কা অনায়াসেই জিতে নেয় টুর্নামেন্টটি। টুর্নামেন্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে সেই খেদটা ধরা পড়েছিলো অধিনায়ক মাশরাফির গলাতেও, “সবসময় চেয়েছি যে, ভাল উইকেটে খেলতে।  শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগে যে উইকেটে খেলেছিলাম, মানে ৩২০, অন্তত ৩০০-২৮০’র উইকেটে খেলতে।” তাহলে কেন পাওয়া গেলো না তেমন উইকেট? অসহায় হাসি হেসে উত্তর দেন তিনি, “এখন এটা নিয়ে তো আসলে এখানে কিছু বলার নাই।

কেন নিজেদের পছন্দসই পিচ পেলো না বাংলাদেশ? প্রশ্নটা মনে উঁকি দেওয়াটা একেবারে অমূলক নয়; Credit: Cricinfo

কিন্তু সবটার শেষ এখানেই হয় না। ফাইনালে সেই উইকেটই চেয়েছিল বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট, যেমনটা ছিলো প্রথম ম্যাচেও। আর তেমনটাই আশ্বাস দিয়েছিলেন গামিনি। সেই কথা তিনি রাখেননি, নাকি রাখতে পারেননি? যদি না রাখেন, কেন রাখেননি? সেখানে কার স্বার্থোদ্ধারে মত্ত হয়েছিলেন তিনি? আর যদি কথা রাখতে না পারেন, তাহলে সেই ব্যর্থতাটা নিয়ে কতটুকু উদ্বিগ্ন বিসিবি?

কথা সেখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের টেলিভিশন মিডিয়াগুলোতে অভিযোগ আসে, ফাইনালের আগে মিরপুরের অ্যাকাডেমি ভবনে শ্রীলঙ্কার টিম ম্যানেজেমেন্টের সাথে নাকি ঘণ্টা দেড়েক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন গামিনী। এমনকি বিসিবি ও জাতীয় দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি তাদেরকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য দিয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সে অভিযোগের উপর ভিত্তি করেই হোক, কিংবা পিচের অস্বাভাবিক আচরণ, বিসিবি থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় গামিনীকে।

কিন্তু এরপর? তথৈবচ, আর কোনো খোঁজ নেই, অগ্রগতি নেই। হঠাৎ করেই যেন আবারও ধামাচাপা পড়ে গেলো বিষয়টা। মিরপুরে আরো একটি টেস্ট খেলা হয়ে গেলো, অথচ সেই নোটিশের আর কোনো হদিশ নেই। লিখতে গিয়ে মাথায় একটা লাইন ঘুরছে, ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’! আবারও ধামাচাপা পড়ে গেলো কি গোটা বিষয়টি? এত ধামা বিসিবি কোথায় খুঁজে পান, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

কেন অস্বাভাবিক নয় এ ঘটনাপ্রবাহ?

Credit: Jagonews24.com

খুব বেশি মাথা খাটাতে হয় না আসলে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বর্তমান টেকনিক্যাল ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন ক্যাসিনোতে যাওয়ার ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে, এহসানুল হক সেজানের শৃঙ্খলাভঙ্গের ব্যাপারটিও বিসিবি কর্তৃপক্ষ বেমালুম ভুলে বসে আছেন কিনা কে জানে! সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে সুজন বলেছেন, “বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে আমার কাজ করতে ইচ্ছেই করছে না। নোংরা লাগছে জায়গাটা।” সামান্য পিচ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করাতেই যখন তামিম ইকবালের পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা হয়েছিলো, সাধারণ দর্শকেরা সুজনের এই মন্তব্যের পর রীতিমত শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম, না জানি তার ভাগ্যে কী আছে! হা হতোস্মি, কোথায় কী! বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা দেখা গেলো না বিসিবি’র, উক্তিটা যেন এমন কিছুই ছিলো না!

গোটা ঘটনাপ্রবাহ শুধু গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে একটাই বার্তা দেয়, ক্রিকেটার এবং বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিমাপের মাপকাঠি ভিন্ন। ‘কোড অফ কনডাক্ট’-এর শিকলটা শুধু যেন ক্রিকেটারদের গলাতেই পরানো, বাকিরা সেই আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ। অন্য কোনো দেশের বোর্ড প্রেসিডেন্ট সেই দলের একাদশ নির্বাচনে এভাবে হস্তক্ষেপ করেন কিনা, জানা নেই। তবে সেটা যে খুব স্বাভাবিক নয়, সেটা বুঝতেও দিগ্বজ হতে হয় না।

‘ধামাচাপা’র এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে ঠিক নতুন নয়। তবে গত বেশ কিছুদিনে কেন যেন সে হারটা উল্লেখযোগ্য হারেই বেড়ে গেছে। কেন এই সংস্কৃতির প্রচলন? কেন এই অস্বাভাবিক বৈষম্যমূলক আচরণ বোর্ডের? কার স্বার্থোদ্ধার হচ্ছে এই সংস্কৃতিতে? কেনই বা এত অসংলগ্ন সিদ্ধান্তের ছড়াছড়ি বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেটে? উত্তরগুলো যত দ্রুত মিলবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ততই মঙ্গল। নতুবা, ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ক্রিকেট, সেটা নিয়ে সংশয়ের জায়গাটা নেহায়েত কম নয়!

Featured Image Credit : BDNews24.com

Related Articles