Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বরফ গলা নদী: জহির রায়হানের কালজয়ী এক উপন্যাস

“হাজার বছর ধরে” উপন্যাসটি বাংলাদেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমের আওতাভুক্ত হওয়ায় সবারই পড়া আছে। সেই সূত্রে জহির রায়হান নামটি নিশ্চয়ই অচেনা নয়। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বর্বরতা ও গণহত্যা নিয়ে জহির রায়হান নির্মিত ইংরেজি ডকুমেন্টারি “স্টপ জেনোসাইড” নামের একটি ডকুমেন্টরির কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তার নাম চর্চিত ছিল।

বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের কথা এলে অবধারিতভাবে জহির রায়হানের নাম চলে আসে। তিনি যেমন কাগজে-কলমে একটি কাহিনী সুন্দরভাবে বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন, ঠিক তেমনি দক্ষ ছিলেন সেই গল্পকে সিনেমার পর্দায় দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রেও। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস “শেষ বিকেলের মেয়ে” প্রকাশিত হয়। “বরফ গলা নদী” তাঁর রচিত চতুর্থ উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।

বইটির প্রচ্ছদ; Image Source: অনুপম প্রকাশনী

কাহিনী

নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মরিয়ম টিউশনি করে সংসারে অবদান রাখার চেষ্টা করে। ওর বড় ভাই মাহমুদ সাংবাদিকতার চাকরিতে টিকে থাকার চেষ্টায় নিজের মনের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। বাবা হাসমত আলী সামান্য কেরানীর চাকরি করেন। মা সালেহা বিবি, ছোট বোন হাসিনা আর দুই ছোট ভাই খোকন আর দুলুকে নিয়ে বিশাল এই পরিবারের ব্যয়ভার করা বাবার একার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই জীবনযুদ্ধে লড়ে যেতে হয় ওদের।

নোংরা এক গলিতে ভাঙাচোরা ভাড়া বাসায় থাকে ওরা। বৃষ্টি হলে ছাত থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ে। মেঝেতে এটা ওটা বসিয়ে সেই পানিকে জায়গা করে দিতে হয়। নড়বড়ে ছাতটায় একসাথে কয়েকজন ওঠা যায় না। যদি ভেঙ্গে পড়ে!

মরিয়ম যাকে পড়ায় তার নাম সেলিনা। সেলিনার পরিবার বেশ ধনী। সেলিনার বড় বোনের দেবর মনসুর মরিয়মকে নিয়মিত অনুসরণ করে। মরিয়ম বিষয়টা খেয়াল করলেও পাত্তা দেয় না। জাহেদ নামের এক পুরুষ ওর জীবনটা যেভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে সেটা আজও ভোলেনি মরিয়ম।

ওর কাছে “সব পুরুষই সমান। সবাই শুধু ভোগ করতে চায়। প্রেমের কোনো মূল্য নেই ওদের কাছে। দেহটাকে পাবার জন্য কত অভিনয়ই না করতে পারে ওরা!”

ওদিকে সেলিনার মা আনিসা বেগম মনসুরের সাথে সেলিনার বিয়ে দেবেন বলে পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু মনসুর তো মরিয়মের পিছু ছাড়ে না।

পরিবারের বড় ছেলে মাহমুদ। শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছে না। ছোটখাট যা করছে তাতে পরিবারকে সুখী করা সম্ভব হচ্ছে না। বড়লোকদের প্রতি একধরনের ক্ষোভ কাজ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মাহমুদের মনে। নিজের আর্থিক অক্ষমতাকে সে ক্ষোভে রূপান্তরিত করে বড়লোকদের উপর উগলে দেয়। সমাজ বদলে দেয়ার মতো বড় আদর্শ বুকে পোষা মাহমুদ জীবনের কঠিন চপেটাঘাত খেতে খেতে মানসিকভাবে ধীরে ধীরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরিবারের বন্ধনও ওর কাছে মেকি ও বাহুল্য বলে মনে হয়।

একদিন নিউমার্কেটে মরিয়মের সাথে মনসুর, সেলিনা আর আনিসা বেগমকে দেখতে পায় মাহমুদ। বড়লোকের গাড়ি চড়ে বোনকে বেড়াতে দেখে তার মেজাজ চড়ে যায়। বাসায় ফিরে বোনকে শ্লেষমাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করে। একটা পারিবারিক যুদ্ধের অবতারণা হয় তখন।

“পড়ানোর কাজটা কি নিউমার্কেটে সারা হয়?”

মরিয়ম জবাব দেয়, “ওরা নিউমার্কেট যাচ্ছিল, সঙ্গে নিয়ে গেল আমায়…।”

“তুমি গেলে কেন? ওদের সঙ্গে সম্পর্ক হলো মালিক আর মাস্টারনির সম্পর্ক। ওদের মেয়েকে পড়াও আর বিনিময়ে টাকা পাও। নিউমার্কেটে ওদের সঙ্গ দেবার জন্য নিশ্চয় কোনো বাড়তি টাকা তোমাকে দেয় হয় না?”

ছেলের চিৎকার শুনে মা সালেহা বিবি এগিয়ে আসেন। সব শুনে মেয়ের পক্ষ নেন তিনি। “নিউমার্কেটে গেছে তাতে হয়েছে কী, এমন কী অন্যায় করেছে যে তুই বকছিস ওকে?”

“তুমি যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না মা। নিউমার্কেটে ও যাবে না কেন, একশোবার যাবে, কিন্তু ওই বড়লোকদের বাচ্চাগুলোর সঙ্গে নয়।” মাহমুদ নিজেকে কিছুটা সংযত করে বলে।

সালেহা বিবি রেগে জিজ্ঞেস করেন, “কেন ওরা কি মানুষ না?”

“কই ওরা তো আমাকে নিয়ে যায় না? নিউমার্কেট কেন, সদরঘাট পর্যন্তও ওরা মোটরে করে নিয়ে যাবে না আমায়। তোমার মেয়েকে দেখবে বুড়িগঙ্গা ওপারেও নিয়ে যাবে। কই দশ টাকা বেতন এ মাসে বাড়িয়ে দেবে বলে কথা দিয়েছিল, বাড়িয়েছে? ওদের আমি চিনিনে ভেবেছো? সব ব্যাটা বেঈমান।”

মরিয়ম, মনসুর, সেলিনার সম্পর্কের পরিণতি কী হবে? জাহেদ কে? মরিয়মের সাথে জাহেদের কী হয়েছিল? বিতৃষ্ণার শক্ত খোলস গায়ে চড়ানো মাহমুদের ভবিষ্যৎ কী? হাসমত আলীর পরিবারের গন্তব্য কোথায়? এসব উত্তর জানতে হলে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আপনাকে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’।

রিভিউ

ক্ষয়িঞ্চু নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের ঘাত-প্রতিঘাত, আনন্দ, বেদনা, পাওয়া-না পাওয়াগুলোকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে ‘বরফ গলা নদী’। ১৯৬৯ সালের একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রা কেমন ছিল সেই ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে উপন্যাসটি থেকে।

মূল প্রচ্ছদের অংশবিশেষ; Image Source: Sayeem Shams

উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে মেকি বলে মনে হয় না। এত সাধারণ, এত বাস্তব, এত চেনা যে চরিত্রগুলোর সাথে পাঠক হিসেবে মিশে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় না মোটেও। শব্দের ছোঁয়ায় বাস্তবসম্মত দৃশ্যপট সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক জহির রায়হান।

কিন্তু কিছু কমতিও রয়ে গেছে। উপন্যাসটা শেষ করার পর সচেতন পাঠকদের মনে যুক্তির বিচারে কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে। কিন্তু উপন্যাস হাতড়ে হয়তো জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্পয়লার এড়াতে বিষয়গুলো উহ্য রাখা হলো।

তারপরও সবদিক বিবেচনায় ‘বরফ গলা নদী’ বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ হিসেবে পাঠকদের কাছে জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হলেও পাঠকদের কাছে যে উপন্যাসটির আবেদন এখনও কমেনি তার প্রমাণ পাওয়া যায় বইটির সংস্করণ সংখ্যা ও সালের দিকে তাকালে।

সংস্করণ ও অন্যান্য তথ্য; Image Source: সাঈম শামস্

বইটি থেকে জহির রায়হানের কিছু দুর্দান্ত লাইনের উদ্ধৃতি টেনে রিভিউয়ের ইতি টানা যাক,

“…অতীত। বর্তমান। ভবিষ্যৎ।

ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে জীবনটাকে বিশ্লেষণ করার মতো প্রবৃত্তি না হলেও, জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো, টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে দেখা দেয় মনে। সেখানে আনন্দ আছে, বিষাদ আছে। ব্যর্থতা আছে, সফলতা আছে। হাসি আছে, অশ্রু আছে।

অতীতের মতো বর্তমানও যেন ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ওঠা আর পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা কেউ বলতে পারে না। …”

লেখক পরিচিতি

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীতে জন্ম নেয়া জহির রায়হান বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্প রচয়িতা। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৬১ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনও আসেনি’ মুক্তি পায়। সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য আদমজী পুরস্কার, নিগার পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত করা হয় তাঁকে।

তিনি ব্যক্তি জীবনে দুটো বিয়ে করেছিলেন। জনপ্রিয় নায়িকা সুমিতা দেবীকে ১৯৬১ সালে ও বিখ্যাত নায়িকা সুচন্দাকে ১৯৬৬ সালে বিয়ে করেছিলেন তিনি।

জীবন থেকে নেয়া সিনেমার নায়িকা সুমিতা দেবী ও পরিচালক জহির রায়হান; Image Source: nirapadnews.com

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি এই মেধাবী পরিচালক ও ঔপন্যাসিক বিহারী এবং ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হন।

বই প্রোফাইল

নাম: বরফ গলা নদী
লেখক: জহির রায়হান
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬
ধরন: হার্ডকভার
প্রকাশক: অনুপম প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ১৯৬৯
মূল্য: ১৪০ টাকা

Featured Image: imgur.com

Related Articles