Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাঙ্কারের দেশ আলবেনিয়া

১১,১১০ বর্গ মাইলের ছোট দেশ আলবেনিয়া। ইউরোপের এই ছোট দেশটিই পৃথিবীতে বাঙ্কারের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পুরো দেশ জুড়ে ঠিক কতটি বাঙ্কার আছে সেই সর্ম্পকে সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল। কারো কারো মতে, সংখ্যাটি ১,৭৫,০০০। আবার কারো মতে ৭,৫০,০০০। আলবেনিয়ার রাস্তার ধার, ফসলের মাঠ, পাহাড়-পর্বত, হোটেল-মোটেল, স্কুল-কলেজ-ঘরবাড়ির আঙিনা, বাজারসহ এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ক্রংকিটের ঢালাই দেওয়া ব্যাঙের ছাতার মতো মাশরুম আকৃতির বাঙ্কারের মাথাগুলোকে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে থাকতে দেখা যাবে না।

এক হিসেবে দেখা গেছে, আলবেনিয়ায় প্রতি বর্গ মাইলে ২.২টি বাঙ্কার তৈরি করা হয়েছিল। দুই-তিনজনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বাঙ্কার থেকে শুরু করে পুরো মন্ত্রীসভাকে পারমাণবিক হামলা থেকে রক্ষা করার মতো বাঙ্কারও সেখানে রয়েছে। আর এসব তৈরি হয়েছে আলবেনিয়ার বাম শাসক এনভার হোক্সার শাসনামলে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৮৫ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শক্ত হাতে আলবেনিয়াকে শাসন করেছেন। তার শাসনামলের একটি লম্বা সময় জুড়ে আলবেনিয়া ছিল বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক দেশ।

স্বাধীনতা প্যারেডের সালাম গ্রহণ করছেন আলবেনিয়ার শাসক এনভার হোক্সা; Image Source: USHMM

দেশ জুড়ে অসংখ্য বাঙ্কার তৈরি করা হয় এনভার হোক্সার সরাসরি নির্দেশে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৮৫ সাল অর্থাৎ মৃত্যুর আগপর্যন্ত দেশ শাসন করার সময় এনভার হোক্সা সবসময় ন্যাটো বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ভীত থাকতেন। ক্ষমতার শুরুর দিকে হোক্সা ছিলেন সোভিয়েতপন্থী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়েনের সাথে ওয়ারশ চুক্তি সই করে আলবেনিয়া শীতল যুদ্ধে সোভিয়েত ব্লকে যোগ দেয়।

তবে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর থেকে হোক্সার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের টানাপোড়েন শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু পদক্ষেপ, যেমন- প্রতিবেশী যুগোস্লাভিয়ার উপর থেকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা, শিল্পায়ন বাদ দিয়ে কৃষিকাজের প্রতি মস্কোর অতিরিক্ত উৎসাহ প্রদানকে হোক্সা ভালভাবে নেননি। এ টানাপোড়েনের মধ্যে ১৯৬৮ সালে চেকোস্লাভিয়ার সংস্কারবাদী বামপন্থী নেতা আলেক্সজান্ডার ডুবেক মানবিক সমাজতন্ত্র স্লোগানকে সামনে রেখে দেশটির উদারপন্থী সংস্কার শুরু করেন।

ডুবেকের প্রস্তাবিত সংস্কারে জনগণের উপর থেকে সরকারী নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করাসহ এমন কিছু কার্যক্রম ছিল যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। সে বছরের আগস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ারশ প্যাক্টের মিত্রদেশগুলোর সম্মিলিত সেনাবাহিনী চেকোস্লাভিয়ায় প্রবেশ করে আলেক্সজান্ডার ডুবেককে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে।

এভাবেই পড়ে আছে হাজার হাজার বাঙ্কার; Image Source: Works That Work

এই আগ্রাসনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ওয়ারশ প্যাক্টে সই করা সব দেশের অবশ্য সায় ছিল না। যদিও তারা সোভিয়েত বলয় ত্যাগ করেনি। কিন্তু এনভার হোক্সা ওয়ারশ প্যাক্ট থেকে আলবেনিয়ার নাম প্রত্যাহার করলে আলবেনিয়া সোভিয়েত ব্লক থেকে বেরিয়ে যায়। ঐদিকে হোক্সা ন্যাটোতেও যোগ দিলেন না, বরং একাকী পথ চলার সিদ্ধান্ত নেন।

সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বছরই হোক্সার সরাসরি তত্ত্বাবধানে আলবেনিয়া জুড়ে বাঙ্কার নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি বিভিন্ন বাঙ্কারের মডেল অনুমোদন করেন। তার আশঙ্কা ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেকোনো সময় আলবেনিয়া আক্রমণ করতে পারেন। তিনি ধারণা করেন, সোভিয়েত বা বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই ও আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজন অজস্র বাঙ্কার। একইসাথে গেরিলা যুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করা হয়।

একেকটি ছোট বাঙ্কার নির্মাণে বর্তমান সময়ের হিসেবে আনুমানিক ১,১০০ ডলারের মতো খরচ করা হয়। বাঙ্কার মডেল তৈরির সময় লক্ষ্য রাখা হয়, প্রতিটি বাঙ্কার যেন ট্যাংক আক্রমণ সহ্য করতে পারে। জনশ্রুতি আছে, দেশব্যাপী বাঙ্কারের মডেল অনুমোদনের আগে হোক্সা মডেল নির্মাতাদের বাঙ্কারের ভেতর ঢুকিয়ে তার উপর ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ করেছিলেন, যাতে তিনি বাঙ্কারের ক্ষমতা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। রাশিয়াকে ত্যাগ করার পর আলবেনিয়া মিত্র দেশ হিসেবে চীনকে বেছে নেয়। তবে চীনের সাথেও তাদের মৈত্রীতা ১৯৭৭ এর দিকে শেষ হয়ে যায়। সোভিয়েত আক্রমণের পাশাপাশি ন্যাটোর সামরিক অভিযানের ভয়েও ভীত ছিলেন হোক্সা।

এই বাঙ্কারটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেস্টুরেন্টে পরিণত করা হয়েছে; Image Source: worksthatwork.com

আলবেনিয়া জুড়ে আনাচে-কানাচে কংক্রিটের বাঙ্কার তৈরি করার এই মহাযজ্ঞের ব্যাপারটি সেসময় বিশ্বব্যাপী জানাজানি হয়নি। এনভার হোক্সার শাসনামলে আলবেনিয়া ছিল লৌহকপাটে বন্দী এক দেশ। আলবেনিয়া মূলত ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্মের দেশ হলেও সেসময় ধর্মকর্ম নিষিদ্ধ ছিল। বিদেশ ভ্রমণ কিংবা বহির্বিশ্বে সাধারণ জনগণের সহজ যোগাযোগের সকল পথ বন্ধ ছিল। গুপ্ত পুলিশ দিয়ে জনগণের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হতো। বিদেশীদের প্রবেশে প্রচুর বিধিনিষেধ ছিল।

সোভিয়েত ও ন্যাটোর ভয়ে বাঙ্কার নির্মাণের এ কার্যক্রম সেসময় জনমনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। দেশবাসী সার্বক্ষণিক কিছু একটা ঘটার জন্য প্রস্তুত থাকতো। যুদ্ধ শুরু হলে কীভাবে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হবে সে বিষয়ে তরুণদের নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। এনভার হোক্সা নিজ সীমান্তের বাইরের সবাইকে শক্র ভাবতেন। চিন্তা-চেতনায় তিনি স্ট্যালিনের মতো প্রচন্ড নিয়ন্ত্রক সরকারের অনুসারী ছিলেন। তার মৃত্যুর ৫ বছর পর ১৯৯০ সালে আলবেনিয়ায় এই কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে।

বাঙ্কারগুলো সর্ম্পকে অনেক তথ্যই এখনও সবার অজানা। ২০১৪ সালে তৎকালীন আলবেনিয়ান প্রধানমন্ত্রী এডি রামা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের সময় কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথিকে ১৯৭৮ সালে মাটির ১০০ ফুট গভীরে নির্মিত ১০৬ কক্ষের এক সুবিশাল বাঙ্কার ভবন ঘুরিয়ে দেখান। রাজধানী তিরানার কাছেই নির্মিত এ বাঙ্কারটি সোভিয়েত কিংবা আমেরিকান হামলার আশংকায় নির্মাণ করা হয়। পারমাণবিক হামলায় রক্ষা পেতে সক্ষম এ বাঙ্কারটি এখন হোটেল ও জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাঙ্কারটিকে ঘিরে মানুষের আগ্রহও কম না। ২০১৪ সালে একে হোটেল ও জাদুঘর রূপান্তর করা হয়। হোটেল উদ্বোধনের প্রথম দু’বছরেই ৭০,০০০ এর উপর পর্যটক বাঙ্কার-হোটেলে থাকার জন্য আসে।

বাঙ্কারগুলোকে এভাবেই জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে; Image source: The Edwardsville Intelligencer

তবে আলেবেনিয়ার বাকি বাঙ্কারগুলোর মতো এ বাঙ্কারটিও কখনোই শক্রর আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়নি। ১৯৮৫ সালে এনভার হোক্সার মৃত্যুর পর বাঙ্কার নির্মাণের এই মহোৎসব বন্ধ হয়ে যায়। বাঙ্কার নির্মাণের হিড়িকের কারণে আলবেনিয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক বিভিন্ন ব্যাপারে যথাযথ বিনিয়োগ তখনকার সরকার করতে পারেনি। বর্তমানে আলবেনীয়রা এ বাঙ্কারগুলোকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। কেউ কেউ বাঙ্কারে দোকান দিয়েছে, পোষা প্রাণীর ঘর বানিয়েছে, আবার কেউ স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করছে বাঙ্কারগুলোকে। অনেক জায়গায় ছোট পরিসরে এসব বাঙ্কারে বিশ্বযুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট শাসনের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে মিউজিয়ামও তৈরি করা হয়েছে।

বাঙ্কারগুলোকে পর্যটকদের অবকাশ যাপনের জন্য সংস্কার করা হচ্ছে; Image Source: Daily Mail

আলেবেনীয় সরকার এ বাঙ্কারগুলোকে কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে যে দেশের প্রতি বর্গ মাইলে দুটির উপর বাঙ্কার রয়েছে, সেখানে সব বাঙ্কারের প্রতি নজর দেওয়া সম্ভব না। বহু জায়গায় বাঙ্কারের ভেতরটা আগাছায় ভরে উঠেছে। অনেক বাঙ্কার ভেঙেও গেছে। সমুদ্র তীরসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্কারের বেরিয়ে থাকা মাথাগুলো জনসাধারণের চলাচল ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে প্রতি চারজন আলবেনীয় নাগরিকের মাথাপিছু একটি করে বাঙ্কার রয়েছে। বাঙ্কারগুলো ভাঙা হবে নাকি ঐতিহ্য হিসেবে রক্ষা করে অন্য কাজে ব্যবহার করা হবে, এ বিষয়ে আলবেনিয়ার জনগণ আজও দ্বিধান্বিত।

This article is in Bangla language. Albenia is a country of bunkers. The article describes the history of these bunkers. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: Wikimedia Commons

Related Articles