Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নিকোপলিসের ক্রুসেড: হুমকির মুখে ওসমানীয় সাম্রাজ্য

পূর্বকথন

১৩৮৯ সালে সংঘটিত কসোভোর যুদ্ধে জয় পেয়েছিল ওসমানীয় বাহিনী। আর এ জয়ের ফলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যায় অনেক বেশি। এর ফলে একদিকে যেমন বলকান অঞ্চলের অধিকাংশই এসে গিয়েছিলো তাদের অধীনে, তেমনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যও সংকুচিত হতে হতে কনস্টান্টিনোপলের কাছাকাছি এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো।

তৎকালীন ওসমানীয় সাম্রাজ্য

১৩৯৩ সালে বুলগেরিয়ার শাসক ইভান শিশমানের অস্থায়ী রাজধানী নিকোপলিস চলে যায় ওসমানীয়দের হাতে। উত্তর-পশ্চিম বুলগেরিয়ায় দানিয়ুব নদীর দক্ষিণ তীরের বন্দর নগরী ভিদিনের শাসক হিসেবে তখনও ছিলেন শিশমানের ভাই ইভান স্ট্রাটসিমির, তবে ততদিনে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এক সামন্তরাজ। এভাবে রাজ্য সম্প্রসারণের প্রায় সকল সমীকরণই তখন যাচ্ছিলো ওসমানীয়দের পক্ষে।

ইভান স্ট্রাটসিমির

এ সময় থেকেই নড়েচড়ে বসতে শুরু করে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিপক্ষরা। তারা বুঝতে পারে যে, একমাত্র ক্রুসেড তথা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমেই ওসমানীয়দের এ অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব, ইসলামী শাসন থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলকান অঞ্চলগুলোকে।

  • বিপদে পড়ে গিয়েছিলো হাঙ্গেরী। তারাই ছিলো তখন মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের পরবর্তী লক্ষ্যস্থল, অন্তত অগ্রগামীতার ধরন সেটাই বলছিলো।
  • আতঙ্কে ছিলো ভেনিসবাসী। কারণ বলকান পেনিনসুলায় ওসমানীয় বাহিনীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ ছিলো মোরিয়া ও ডালমেশিয়ার মতো অঞ্চলগুলো তাদের হাতে চলে যাওয়া। ফলে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, আয়োনীয় সাগর ও এজিয়ান সাগরে কমে যেত ভেনিসের প্রভাব।
  • জেনোয়াকেই বা বাদ দেই কেন? ভয় তাদের মনেও ছিলো। যদি ওসমানীয় সাম্রাজ্য দানিয়ুব নদী এবং দার্দানেলিস, মারমারা সাগর ও বসফরাস প্রণালীতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতো, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতো তারা। কারণ সেই অঞ্চলে কাফফা, সাইনোপ ও আমাস্রার মতো তাদের গুরুত্বপূর্ণ কলোনীগুলোর অবস্থান ছিলো।

হাঙ্গেরীর রাজা সিগিসমুন্ড

সব মিলিয়ে নিজেদের ক্রমশ বিকশিত করতে গিয়ে আশেপাশে ভালোই শত্রু জুটিয়ে ফেলেছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্য। ১৩৯৪ সালে তাই বাইজান্টাইন সম্রাট ম্যানুয়েল দ্বিতীয় পালাইয়োলগোস এবং হাঙ্গেরীর রাজা সিগিসমুন্ড সাহায্য চেয়ে পাঠান পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে। সেই সাথে তারা এটাও জানান যে, সুলতান বায়েজিদ নাকি দম্ভোক্তি করে বলেছেন তার সেনাবাহিনীকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে নেতৃত্ব দেয়ার কথা। রোমে যাত্রাবিরতি দিয়ে সেইন্ট পিটারের চিত্রকর্মের পেছনে তিনি তার ঘোড়াগুলোকে খাওয়াবেন! অবশেষে একই বছর পোপ নবম বোনাফিস ডাক দিয়ে বসেন আরেকটি ধর্মযুদ্ধের।

পোপ নবম বোনাফিস

ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড ও ফ্রান্সের রাজা ষষ্ট চার্লসের মেয়ে ইসাবেলার মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক তখন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার শতবর্ষী যুদ্ধে খন্ডকালীন শান্তির পতাকা ওড়াচ্ছিলো। সিগিসমুন্ডের কাছ থেকে সাহায্যের আবেদন পেয়ে তাই তিনিও আর বসে থাকতে পারেন নি। যুদ্ধ করে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের একটা হেস্তনেস্ত করার শপথ নেন তিনি। ক্রুসেডের ডাকে স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছিলো ফ্রান্সের অভিজাত সমাজও।

সৈন্য সংখ্যা

এবার আসা যাক কোন পক্ষে কত সংখ্যক সৈন্য যুদ্ধ করেছে তার আলোচনায়। যেহেতু নিকোপলিসের এ ক্রুসেডটি সংঘটিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় ছয়শ বছর আগে, তাই যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা যে অতটা সঠিকভাবে জানা যাবে না, তা বলা বাহুল্য।

ওসমানীয় কিংবা খ্রিষ্টান- উভয় পক্ষের ঐতিহাসিকেরাই এ যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছেন। এর পেছনে কারণটাও বেশ মজার। নিকোপলিসের এ ক্রুসেডে শেষ পর্যন্ত জয় পেয়েছিল ওসমানীয় বাহিনী। ওসমানীয় পক্ষের ঐতিহাসিকদের বেলায় দেখা যায় খ্রিষ্টান বাহিনীর সৈন্য সংখ্যাকে মুসলিমদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ করে দেখাতে, যাতে করে এ জয়ের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে পরাজিত খ্রিষ্টান বাহিনীর কিছু ঐতিহাসিক মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যাকে তাদের তুলনায় দ্বিগুণ দেখিয়েছেন যাতে এটাকে পরাজয়ের একটা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো যায়!

এই যেমন ওসমানীয় পক্ষের হাতে যুদ্ধবন্দী জোহান শ্লিটবার্গারের কথাই ধরা যাক, যুদ্ধের সময় যার বয়স ছিলো ১৬ বছর। তার মতে খ্রিষ্টান বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিলো মাত্র ১৬,০০০ এর মতো। পক্ষান্তরে তুর্কীদের ছিলো প্রায় ২,০০,০০০ এর মতো সৈন্য!

সুলতান প্রথম বায়েজিদ

পনের শতকের তুর্কী ঐতিহাসিক শুকরুল্লাহ-এর মতে ওসমানীয় ও তাদের প্রতিপক্ষের ছিলো যথাক্রমে ৬০,০০০ ও ১,৩০,০০০ এর মতো সেনা। উনিশ শতকের জার্মান ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিষ্টানদের পক্ষে ৭,৫০০-৯,০০০ ও ওসমানীয়দের পক্ষে ১২,০০০-২০,০০০ সেনা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ডেভিড নিকোলের মতে ওসমানীয় বাহিনীতে ১৫,০০০ ও খ্রিষ্টান বাহিনীতে ১৬,০০০ এর মতো সেনাসদস্য ছিলো। ওসমানীয় বাহিনীতে ১,৫০০ এর মতো ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সার্বিয়ান নাইটও ছিলেন, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রিন্স স্টেফান লাজারেভিচ।

প্রিন্স স্টেফান লাজারেভিচ

  • ফরাসি বাহিনী এ যুদ্ধে ২,০০০ নাইট ও স্কয়ার (নাইটের অনুচর) নিয়ে এসেছিলো। সেই সাথে ছিলো ৬,০০০ ভাড়াটে তীরন্দাজ ও পদাতিক সেনা। সব মিলিয়ে তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১০,০০০ এর মতো।
  • গুরুত্বের দিক দিয়ে এরপরেই ছিলো রোডসের নাইটস হসপিটালারেদের অবস্থান।
  • ভেনিসের পক্ষ থেকে এসেছিলো নৌবাহিনী।
  • হাঙ্গেরীয়দের উদ্যোগে জার্মানির রাইনল্যান্ড, বাভারিয়া, স্যাক্সনি ও অন্যান্য অঞ্চলের প্রিন্সরা এতে যোগদান করে।
  • এছাড়া ফরাসি রাজদূতের ঘোষণায় পোল্যান্ড, বোহেমিয়া, নাভারে ও স্পেন থেকেও সৈন্য এসেছিলো।
  • ১,০০০ ইংরেজ নাইট এ যুদ্ধে যোগদান করে থাকার কথাটা বেশ বিতর্কিত।
  • উপরে খ্রিষ্টান বাহিনীর যে সৈন্য সংখ্যার কথা জানালাম, সেটাও যে পুরোপুরি সঠিক তার নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। কারণ তাদের আরো অনেক রকম সৈন্য সংখ্যার কথাও জানা যায়।

নাইটদের বিবর্তন

Mounted Sergeant-at-arms

ওসমানীয় বাহিনীর কিছু সেনা

আকিঞ্চি

সিপাহী

সিপাহী

জেনিসারি তীরন্দাজ

ওয়ালাশীয় অশ্বারোহী সেনা

চতুর্দশ শতকের ফরাসি নাইট

৬,০০০-৮,০০০ হাঙ্গেরীয়, প্রায় ১০,০০০ ফরাসি, ইংরেজ ও বারগান্ডিয়ান, মির্চা দ্য এল্ডারের নেতৃত্বাধীন প্রায় ১০,০০০ ওয়ালাশীয়, প্রায় ৬,০০০ জার্মান এবং প্রায় ১৫,০০০ ডাচ, বোহেমিয়ান, স্প্যানিশ, ইতালীয়, পোলিশ, বুলগেরীয়, স্কটিশ ও সুইস সেনার কথাও জানা যায়। আবার ভেনিস, জেনোয়া ও সেইন্ট জনের নাইটদের কাছ থেকে নৌ সাহায্যও এসেছিলো। এভাবে সৈন্য সংখ্যা ৪৭,০০০-৪৯,০০০ এ গিয়ে ঠেকে। আবার কোনো কোনো বর্ণনানুযায়ী এটি ১,২০,০০০-১,৩০,০০০! অর্থাৎ খ্রিষ্টান বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়ায় কোনটি যে সঠিক বা কাছাকাছি তা ছয়শ বছর পর ল্যাপটপের সামনে বসে অনুমান করাও কষ্টসাধ্য।

যাত্রা শুরু

সৈন্য সংখ্যার বিতর্ককে পাশে রেখে এখন সামনে এগোনো যাক। যুদ্ধে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশের রাজাদের মনস্থির করা এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের সেনাবাহিনীকে সাজানোর পর শুরু হলো যুদ্ধযাত্রা।

দ্বিতীয় ফিলিপ

এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি। বার্গান্ডির ডিউক দ্বিতীয় ফিলিপও শুরুতে বলেছিলেন ক্রুসেডে অংশ নেয়ার কথা। তার সাথে তিনি নিতে চেয়েছিলেন ল্যাঙ্কাস্টারের ডিউক জন অফ গাউন্ট এবং অরলিন্সের ডিউক লুইসকেও। ফিলিপ চেয়েছিলেন এ ক্রুসেডে নেতৃত্ব দিতে। অবশ্য এর পেছনে স্বধর্মের অস্তিত্ব ও মর্যাদা সমুন্নত করার চাইতে নিজের ও নিজের বংশের ক্ষমতা প্রদর্শন ও মর্যাদা সমুন্নত করাটাই ছিলো তার মুখ্য উদ্দেশ্য। শেষ পর্যন্ত এই তিনজনের কেউই ক্রুসেডে অংশ নেন নি। ফিলিপ অবশ্য তার ২৪ বছর বয়সী বড় ছেলে নাভার্সের কাউন্ট জনকে ক্রুসেডে পাঠিয়েছিলেন, সাথে আরো ছিলেন কনস্টেবল ডি’ইউ ও মার্শাল বৌচিকট। আর তাদের বয়স ও অভিজ্ঞতা তুলনামূলক কম হওয়ায় সাথে যোগ দিয়েছিলেন কাউচির লর্ড সপ্তম এঙ্গেরান্ড।

নাভার্সের কাউন্ট জন

পূর্ব ফ্রান্সের শহর দিজন থেকে ১৩৯৬ সালের ৩০ এপ্রিল যাত্রা শুরু হয় খ্রিষ্টান বাহিনীর। তাদের লক্ষ্য ছিলো স্ট্রাসবুর্গের রাস্তা ধরে বাভারিয়া হয়ে দানিয়ুবের উত্তর দিকে যাত্রা করা। সেখান থেকে নদীপথে সিগিসমুন্ডের সাথে বুদায় মিলিত হওয়াই ছিলো তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এরপর কী হবে তা নিয়ে অবশ্য নিজেরাও নিশ্চিত ছিলো না তারা। শুধু পরিকল্পনায় ছিলো বলকান অঞ্চল থেকে তুর্কীদের বিতাড়িত করে কনস্টান্টিনোপলের সাহায্যার্থে এগিয়ে যাওয়া। এরপর ফিলিস্তিন ও সেপালক্রে চার্চকে স্বাধীন করার পরিকল্পনাও ছিলো তাদের। সবশেষে বিজয়ীর বেশে ইউরোপে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যই ছিলো তাদের, শুধু ছিলো না যথোপযোগী কর্মপরিকল্পনা।

ফরাসি বাহিনী যাচ্ছিলো বেশ উৎসবমুখর সাজে সজ্জিত হয়েই। তাদের সাথে চব্বিশটি গাড়ি জুড়ে শুধু তাঁবু আর প্যাভিলিয়নই ছিলো। সবুজ মখমলের তৈরি সেসব চাদরে ছিলো বাহারি নকশা। ১৩৯৬ সালের জুলাই মাসে যখন সেই বাহিনী বুদায় পৌঁছে, তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন রাজা সিগিসমুন্ড। আনন্দের আতিশায্যে তিনি এক পর্যায়ে বলেই ফেলেন যে, এখন তিনি যে কেবল ওসমানীয় বাহিনীকে ইউরোপ থেকে বিদায় করতে পারবেন তা নয়, বরং যদি আকাশটাও ভেঙে পড়ে তাহলে নিজের বর্শার সাহায্যে সেটাকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়েও রাখতে পারবেন! হয়তো এমন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই পরবর্তীতে কাল হয়েছিলো তাদের জন্য।

ওদিকে বুদায় খ্রিষ্টান বাহিনীর যুদ্ধ পরিষদে বেঁধে যায় গন্ডগোল। সুলতান বায়েজিদ ১৩৯৫ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ১৩৯৬ এর মে-তে তিনি আসবেন হাঙ্গেরী দখল করতে। কিন্তু জুলাইয়ের শেষ হয়ে এলেও তার দেখা না পাওয়ায় ফরাসিরা তাকে কাপুরুষ ভাবা শুরু করে। সিগিসমুন্ড অবশ্য তার মিত্রদের শান্ত থেকে ক্রুসেডের পরিকল্পনায় অটল থাকার অনুরোধ করেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি নিয়ে বায়েজিদই আসেন এখানে। কিন্তু এতে আঁতে ঘা লেগেছিলো ফরাসি বাহিনী ও তাদের মিত্রদের। তারা নিজেরাই বরং সুলতান বায়েজিদের সাথে লড়াইয়ের জন্য এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

সুলতান প্রথম বায়েজিদ

এরপরই যাত্রা শুরু হলো সম্মিলিত খ্রিষ্টান বাহিনীর। তারা চলতে লাগলো দানিয়ুব নদীর পশ্চিম তীর ধরে। হাঙ্গেরীর কিছু সেনা অবশ্য রওয়ানা দিয়েছিলো উত্তর দিকে। ট্রানসিলভানিয়া ও ওয়ালাশীয় সৈন্যদের একত্রিত করতেই ছিলো তাদের এ যাত্রা। একসময় তারা প্রবেশ করলো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। এরপরই শুরু হয়েছিলো তাদের ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটতরাজ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলো ফরাসি বাহিনী। কোনো কোনো ঐতিহাসিক একইসাথে মদ ও নারী নিয়ে তাদের মেতে ওঠার ব্যাপারেও উল্লেখ করেছেন। অবশ্য পূর্বের বাক্যটির ব্যাপারে আপত্তিও কাছে কিছু ঐতিহাসিকের।

এরপর তারা গিয়ে পৌঁছান ভিদিনে যার শাসক ছিলেন ইভান স্ট্রাটসিমির। ওসমানীয়দের সামন্তরাজ হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছাই তার ছিলো না। তাই তিনি বিনা প্রতিরোধে আত্মসমর্পন করে নেন। শহরটি দখলের সময় সামান্য সংঘর্ষ হয়েছিলো ওসমানীয়দের থেকে নিয়োজিত সেনা ছাউনিতে। তবে সেখানে অল্পতেই জয় পায় খ্রিষ্টান বাহিনী। এতে অবশ্য হিতে বিপরীত হয়ে গিয়েছিলো তাদের জন্য। ফরাসি সৈন্যরা এ খন্ডযুদ্ধে বিজয়ের পর ভাবতে শুরু করে দিলো যে, ওসমানীয় বাহিনী হয়তো ক্রুসেডের ময়দানে তাদের সামনে টিকতেই পারবে না!

পরবর্তীতে এ বাহিনী যাত্রা করে ভিদিনের ৭৫ মাইল দূরবর্তী ওরয়াহোভো দূর্গ দখল করতে। প্রথম রাতে দূর্গের সেনারা প্রতিরোধ করলেও পরদিন সকালে তারা সিগিসমুন্ডের কাছে আত্মসমর্পন করে। তবে তারা এই শর্ত দিয়েছিলো যে, তাদের জীবন ও সম্পদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। সিগিসমুন্ড সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। তবে বাগড়া বাধায় ফরাসি বাহিনী। গেট খোলার সাথে সাথে তারা শহরে প্রবেশ করে এবং হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের লীলাখেলায় মেতে ওঠে। বন্দী করা হয় এক হাজারের মতো নগরবাসীকে, জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো নগরই। হাঙ্গেরীয়রা ফরাসিদের এ আচরণকে একেবারেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। তারা একে ফরাসিদের পক্ষ থেকে তাদের রাজার অপমান হিসেবেই দেখেছিলো।

খ্রিষ্টান বাহিনীর যাত্রাপথ

এরপর ওরয়াহোভোতে সেনাছাউনি স্থাপন করে খ্রিষ্টান বাহিনী এগোতে শুরু করে নিকোপলিসের দিকে। পথিমধ্যে আরো কিছু দুর্গ তাদের বশ্যতা মেনে নেয়। কিন্তু সৌভাগ্য বলতে হবে ওসমানীয় বাহিনীর। যাত্রাপথে থাকা একটি নগরদুর্গ কোনোভাবে নজর এড়িয়ে যায় খ্রিষ্টান বাহিনীর। ফলে সুযোগ বুঝে সেখানকার দূতেরা ঝড়ের বেগে রওয়ানা দেয় তাদের সুলতানকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খবর দিতে। এটা ছিলো আর কিছুদিন পরেই হতে যাওয়া যুদ্ধে ওসমানীয়দের জন্য অন্যতম আশীর্বাদস্বরূপ ঘটনা। ১২ সেপ্টেম্বর অবশেষে নিকোপলিস দুর্গের একেবারে কাছাকাছি চলে আসে তারা।

অবরোধের কবলে নিকোপলিস

নিকোপলিস দুর্গটি ছিলো প্রকৃতপক্ষে দ্বি-স্তর প্রাচীর বেষ্টিত একটি শহর। এটি একটি উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে অবস্থিত ছিলো। দুটি দেয়ালের মাঝে তুলনামূলক উঁচু দেয়ালটি ছিলো পাহাড়ের চূড়ার দিকে। আর অপেক্ষাকৃত নিচু দেয়ালটির অবস্থান ছিলো পাহাড়ের পাদদেশে। এ দুর্গই ঘিরে ফেলেছিলো ক্রুসেডের উদ্দেশ্যে আগত বহুজাতিক খ্রিষ্টান সেই বাহিনী। তখন নিকোপলিসের শাসক ছিলেন দোয়ান বে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, সুলতান বায়েজিদ তার বাহিনী নিয়ে অবশ্যই নিকোপলিসবাসীর সাহায্যার্থে ছুটে আসবেন। তাই তিনিও বড় রকমের অবরোধের শিকার হবার মতো প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।

ওদিকে পরিকল্পনাগত একটি ভুল করে ফেলেছিল অবরোধকারী বাহিনী। তারা শহরের দেয়াল ভাঙার মতো কোনো মেশিন, যা ইংরেজিতে Siege Engine নামে পরিচিত, তা নিয়ে আসে নি। সীজ ইঞ্জিনের অনুপস্থিতি, পাহাড়ের খাড়া ঢাল আর দুর্গের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টান বাহিনী শুধুমাত্র অবরোধেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হলো। এরপর তারা জল ও স্থলপথে শহরটি থেকে যাওয়া-আসার সকল পথই বন্ধ করে দিলো।

এভাবে চলে গেলো দু’সপ্তাহের মতো সময়। খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-ফূর্তি, গল্প-গুজব, খেলাধুলা আর ওসমানীয় বাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে কটুক্তি করে দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো অবরোধকারীদের।

খ্রিষ্টান বাহিনীর ভুলে কিংবা ওসমানীয় বাহিনীর আশীর্বাদ স্বরুপ যে দূতেরা ছুটে গিয়েছিলো সুলতান প্রথম বায়েজিদের কাছে, তারা তাদের কাজ যথার্থভাবে শেষ করতে পারলো। ক্রুসেডের এমন সংবাদ পেয়ে আর এক মূহুর্তও দেরি করেন নি সুলতান, সাথে সাথেই কনস্টান্টিনোপলে অবরোধ তুলে নিয়ে উত্তরে নিকোপলিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি। পথিমধ্যে তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন সার্বিয়ার সামন্তরাজ স্টেফান লাজারেভিচ।

হাঙ্গেরীর রাজা সিগিসমুন্ড তার ৫০০ অশ্বারোহী সেনাকে পাঠিয়েছিলেন ওসমানীয় বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে। অবরোধের তিন সপ্তাহ পর হঠাৎ করেই ছুটে এলো এক দূত। হাঁপাতে হাঁপাতে বিশাল ওসমানীয় বাহিনীর আগমনের খবর জানালো সে। মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় এভাবে ওসমানীয়দের আগমন প্রত্যাশা করে নি কেউই। সবার চোখ তখন কপালে উঠলো। ওদিকে অবরুদ্ধ নিকোপলিসবাসীও কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলো ওসমানীয় বাহিনীর আগমনের বার্তা। আনন্দের আতিশায্যে তারাও হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দেয়, বাজাতে থাকে নানা বাদ্য।

সুলতান বায়েজিদের আগমন

এমন পরিস্থিতিতে ওসমানীয়দের অগ্রযাত্রা বিলম্বিত করতে ৫০০ অশ্বারোহী ও ৫০০ তীরন্দাজ নিয়ে এগিয়ে যান কাউচির লর্ড এঙ্গেরান্ড। তার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ওসমানীয়দের বেশ কিছু সেনা হতাহত হয়। এ ঘটনা অবশ্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য। আক্রমণ শেষে এঙ্গেরান্ড ক্যাম্পে ফিরে আসলে একদিকে প্রশংসার জোয়ার যেমন তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিলো, তেমনি অন্যান্য নেতারা এটাকে তাদের নিজেদের বীরত্ব প্রকাশের সুযোগ হাতছাড়া হওয়া ভেবে উল্টো এঙ্গেরান্ডকে কথা শুনিয়ে দিলো!

যুদ্ধ

এবার তাহলে একে একে যুদ্ধের ঘটনা তুলে ধরছি তৎকালীন ঐতিহাসিকদের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে। নিকোপলিসের এ ক্রুসেডটি সংঘটিত হয়েছিলো ১৩৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। ছবির সাথে ঘটনাগুলো কল্পনা করে নিলে মনে হবে হলিউডের কোনো সিনেমাই আপনি দেখছেন!

খ্রিষ্টান বাহিনীর পেছনে ছিলো নিকোপলিসের দুর্গ এবং দানিয়ুব নদী। যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্বের দিকটা ঢালু থাকায় সেখান দিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীর চলাচল ছিলো কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে পশ্চিমে ছিলো বনাঞ্চল। তাদের নৌবাহিনীও ছিলো দানিয়ুব নদীতে।

তাদের প্রথমেই ছিলো কাউন্ট অফ নাভার্সের নেতৃত্বাধীন নাইট বাহিনী। এর পেছনে ছিলো সিগিসমুন্ডের নেতৃত্বাধীন পদাতিক ও অশ্বারোহী সেনার দল। দুই পাশে ছিলো ট্রানসিলভানিয়ান ও ওয়ালাশীয় সেনাদের সমাবেশ।

ওসমানীয় বাহিনীর প্রথমে ছিলো হালকা অস্ত্রে সজ্জিত অনিয়মিত অশ্বারোহী বাহিনী, যাদের বলা হয় আকিঞ্চি। আকিঞ্চিদের পেছনেই পোঁতা ছিলো অনেকগুলো সূক্ষ্মাগ্র লাঠি যাতে করে সেগুলো প্রতিপক্ষের ঘোড়ার পেটে ঢুকে থমকে দেয় তাদের অগ্রযাত্রা। এর পেছনে ছিলো আজাপ বাহিনী যারা হালকা অস্ত্রে সজ্জিত অনিয়মিত পদাতিক সেনা। আজাপদের পরেই ছিলো জেনিসারি দল যারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বেশ চৌকশ একদল পদাতিক সেনা। বাহিনীর দুই পাশে ছিলো আনাতোলীয় ও রুমেলীয় সিপাহীদের সমাবেশ। আর পেছনে সিপাহীদের নিয়ে রিজার্ভ ফোর্সে ছিলেন সুলতান বায়েজিদ নিজে। তার সাথে সার্বিয়ান নাইটদের নিয়ে ছিলেন স্টেফান লাজারেভিচ।

১, ২) প্রথমেই ফরাসি নাইটরা হামলা চালায় আকিঞ্চিদের উপর। আকিঞ্চি বাহিনী শুরুতে কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে পারলেও পরে সেটা ভেঙে যায়, সৃষ্ট ফাটল দিয়ে স্রোতের মতো প্রবেশ করে দেয় ফরাসিরা। অবশ্য আকিঞ্চিদের মূল কাজ ছিলো প্রতিপক্ষের শুরুর দিকের যাত্রায় বিঘ্ন ঘটানো। তাই তাদের কাজটা তারা ঠিকভাবেই শেষ করেছিলো। ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে এরপর যারা জীবিত ছিলো, তারা গিয়ে আশ্রয় নিলো দুই পাশে পদাতিক বাহিনীর সাথে।

৩, ৪) আকিঞ্চিদের পেছনে থাকা সূক্ষ্মাগ্র লাঠিগুলো এরপর মূল বাধা হয়ে দাঁড়ালো ফরাসিদের জন্য। অনেকের ঘোড়াই মারাত্মক আহত হলো এতে। নাইটদের অনেকে তখন মাটিতে নেমে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সেই লাঠিগুলো সরাতে। সেই সময় ওসমানীয় তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যও ছিলো ঘোড়াগুলোই, কারণ নাইটদের বর্ম ভেদ করে তীর পৌঁছানোর চেয়ে ঘোড়াকে আহত করাই ছিলো বেশি সহজ। একই সময় চৌকশ জেনিসারি বাহিনীও হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের উপর। তখন সমানে সমানে যুদ্ধ চলতে থাকে দু’পক্ষের মাঝেই। অবশ্য নাইটদের ভারী বর্ম তাদের বাড়তি প্রতিরক্ষা দিচ্ছিলো। একসময় যুদ্ধে বিজয়ের পাল্লা হেলে পড়তে শুরু করে খ্রিষ্টান বাহিনীর দিকেই।

৫) আনাতোলীয় ও রুমেলীয় সেনারা এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে নাইটদের উপর।

৬) যুদ্ধের এ পর্যায়ে সুলতান বায়েজিদ নিজেও কম আশ্চর্য হন নি। কারণ ভারী অস্ত্র ও বর্মে সজ্জিত নাইটদের সামনে ওসমানীয় বাহিনীকে বেশ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিলো। তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে যেতে থাকলেন তিনি।

যুদ্ধের এ পর্যায়ে এসেই বেশ বড়সড় ভুল করে ফেলেছিলো ফরাসি নাইটরা যার খেসারত তাদের দেয়া লেগেছিলো অগণিত মৃত্যু, পরাজয় আর সর্বশেষ মুক্তিপণ দেয়ার মাধ্যমে। নাইটদের এ দলের অধিকাংশ সদস্যই ছিলো তরুণ। তাদের রক্তও তখন ছিলো টগবগে। তাই আগপিছ না ভেবে তারা এগোতে শুরু করে দিলো। সেই সময় যদি তারা সিগিসমুন্ডের বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে এগোনোর চিন্তা করতো, তাহলে যুদ্ধের ফলাফল হয়তো তাদের পক্ষেও যেতে পারতো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছিলো অন্যরকম।

নাইটেরা ভাবলো যে, সামনে পাহাড়ের উপরেই আছে ওসমানীয় বাহিনীর শিবির। তারা সেগুলো ধ্বংস করতে তখন পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলো। এ সময় তাদের অর্ধেকের বেশিই ছিলো অশ্বহীন। পাহাড়ে উঠে তারা আশা করেছিলো পলায়নরত ওসমানীয় সেনাদের দেখতে পাবে। কিন্তু এখানেই লুকনো ছিলো সুলতানের মূল কৌশল।

পাহাড়ের উপরে নিজের শক্তিশালী সিপাহীদের রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে অপেক্ষারত ছিলেন সুলতান প্রথম বায়েজিদ। ফরাসি নাইটদের দেখেই যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলো তারা, ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো নাইটদের উপর। ততক্ষণে ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ের উপর উঠে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো ফরাসি নাইটরা। এ আক্রমণের ধকল তাই আর সইতে পারলো না তারা। যারা পারলো, তারা পালিয়ে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করলো। আর অন্যরা সবাই কচুকাটা হতে থাকলো এবার ওসমানীয় বাহিনীর হাতে। অবশেষে কাউন্ট অফ নাভার্স ওসমানীয় বাহিনীর হাতে বন্দী হলে আত্মসমর্পন করে নাইট বাহিনী।

১) হাঙ্গেরীর রাজা সিগিসমুন্ড ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে, যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতছাড়া হতে শুরু করেছে। তাই এবার তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে আক্রমণে চলে আসলেন।

২) কাপুরুষের মতো কাজ করেছিলো সেদিন ওয়ালাশীয় ও ট্রানসিলভানিয়ান বাহিনী। যুদ্ধের ফলাফল তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে দেখে তারা তাদের সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে নিজেদের দেশ রক্ষার্থে রেখে দেয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলো। সুযোগ বুঝে তাই সটকে পড়েছিলো তারা।

৩) সুলতান বায়েজিদের বাহিনীর হাতে আটককৃতদের ততক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওসমানীয় বাহিনীর শিবিরে।

৪) হাঙ্গেরীয়দের হাতে আবারো পর্যুদস্ত হতে হলো আকিঞ্চি ও আজাপদের।

৫) এরপর অগ্রসরমান হাঙ্গেরীয়দের রুখতে এগিয়ে গেলো রুমেলীয় ও আনাতোলীয় সিপাহীরা। আবারো শুরু হলো তুমুল লড়াই।

১-৩) এবার তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেলো সিপাহী আর হাঙ্গেরীয় সেনাদের মাঝে। অন্যদিকে আকিঞ্চিরা আবারো আক্রমণে ফিরে এলো। এবার তারা পেছন থেকে চেপে ধরলো হাঙ্গেরীয়দের। সবার শেষে সুলতানের নির্দেশে স্টেফান লাজারেভিচ তার নাইট বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন হাঙ্গেরীয়দের পাশ বরাবর। চারদিক থেকে এত আঘাত সইতে না পেরে এবার জীবন বাঁচাতে ছুটে পালাতে লাগলো হাঙ্গেরীয় সেনারা।

৪-৬) খ্রিষ্টান বাহিনীর অবশিষ্টরা ওসমানীয় অশ্বারোহী বাহিনীর তাড়া খেয়ে এবার দানিয়ুব নদী দিয়ে পালাতে শুরু করলো। অতিরিক্ত সৈন্যের ভারে ডুবে যায় বেশ কিছু নৌকা, কিছু কিছু নৌকায় আগে থেকেই চড়ে থাকা সেনারা অন্যরা উঠতে গেলে ফেলে দিচ্ছিলো। কেউ কেউ আবার সাঁতার কাটতে কাটতেই ক্লান্ত হয়ে ডুবে যায়। একসময় প্রতিপক্ষের যুদ্ধ শিবিরও এসে গেলো ওসমানীয়দের হাতে। কাউন্ট অফ নাভার্স সহ আরো অনেক অভিজাত ফরাসি যোদ্ধা সেইবার বন্দী হন। সহযোদ্ধাদের সহায়তায় ভেনিসের এক জাহাজে চড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন সিগিসমুন্ড। পরবর্তীতে তিনি শুধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এই ফরাসিদের গর্ব আর অহঙ্কারের জন্যই আজ আমরা হেরে গেলাম। যদি তারা আমার উপদেশ শুনতো, শত্রুদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য পর্যাপ্ত সেনা আমাদের ছিলো!

ফলাফল

যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল ওসমানীয় বাহিনীই। তবে উভয় পক্ষেরই অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো এ যুদ্ধে। সুলতান যখন ওরয়াহোভোতে গণহত্যার কথা জানতে পারলেন, তখন মারাত্মক রেগে গিয়েছিলেন তিনি। তাই যুদ্ধবন্দী প্রায় ৩,০০০ জনকে হয় শিরোচ্ছেদ কিংবা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে হত্যা করা হয়েছিলো। নিজের বাহিনীর এভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়াও সুলতানকে দুশ্চিন্তিত করে তুলেছিলো।

এই হারের পর থেকে ১৪৪০ সালের আগ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপের পক্ষ থেকে ওসমানীয়দের রুখতে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানা যায় নি। ক্রুসেডের ব্যাপারে বেশ হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলো তারা এবারের যুদ্ধে হেরে। অল্প কিছুদিন পর ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মাঝে আবারো শুরু হয় মাঝখানে স্তিমিত হয়ে পড়া শতবর্ষের যুদ্ধ। ওদিকে ওয়ালাশীয় বাহিনীও ওসমানীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম বজার রাখে।

এ জয়ের ফলে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো সেভাবে মাথা তুলে আর দাঁড়াবার সাহস করলো না অনেক দিন। ওদিকে ওসমানীয় বাহিনীও আবার ফিরে গেলো কনস্টান্টিনোপলে, বলকান অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হলো তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। তারা হয়ে উঠলো মধ্য ইউরোপের জন্য এক জীবন্ত দুঃস্বপ্নের প্রতিশব্দ।

সুলতান প্রথম বায়েজিদ তার জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধটি করেছিলেন আরেক বিখ্যাত সমরনায়ক তৈমুর লংয়ের বিপক্ষে আঙ্কারার যুদ্ধে। আমাদের পরবর্তী পর্ব হবে সেই আঙ্কারার যুদ্ধকে ঘিরেই। আজকের মতো তাই আপাতত লেখা এখানেই শেষ করছি।

Related Articles