Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিমখানা ক্লাব ও নব্বইয়ের দশকের সিলেট লিগ

খুব জোরালো ও অকাট্য প্রমাণ হয়তো নেই, তবে কিছু বইপত্রে স্পষ্ট উলে­খ রয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম রেকর্ডকৃত ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিলো সিলেটে। ১৮৪৫ সালের ৩ মার্চ সিপাহীদের বিরুদ্ধে ইংরেজ অফিসাররা ম্যাচ খেলেছিলেন। উপমহাদেশে সবচেয়ে পুরনো ম্যাচ হিসেবে সিলেটের চা বাগানে হওয়া ১৭৩ বছর আগের এই ম্যাচকেই ধরা হয। তখন ম্যাচটির খবর প্রকাশিত হয়েছিলো লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘স্পোর্টিং ইন্টিলিজেন্স’ ম্যাগাজিনে। পরবর্তীতে ভারতের রণজয় সেন নামক ইতিহাসবিদ তার রচিত ‘ন্যাশন অ্যাট প্লে: আ হিস্টোরি অফ স্পোর্টস ইন ইন্ডিয়া’ বইয়েও ম্যাচটির কথা লিখেছিলেন।

শুধু উপমহাদেশ কেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এই বদ্বীপে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা তৈরিতে সিলেটের ভূমিকা অনেক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ৯০’র দশকে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বেশ জমজমাট ক্রিকেট লিগ অনুষ্ঠিত হতো। ঢাকা, চট্টগ্রামের পরই ছিল সিলেটের স্থান।

মনোমুগ্ধকর সিলেট স্টেডিয়াম; Image Credit: G.M. Sujan

তখন সিলেট লিগে খেলতেন একঝাঁক তারকা ক্রিকেটার। শুধু গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, গোলাম ফারুক সুরু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খানদের কথাই বলা হচ্ছে না, নব্বই দশকের ওই সময়ে সিলেট লিগে খেলেছেন বিদেশি তারকা ক্রিকেটাররাও। সেই তালিকায় আছেন শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অজুর্না রানাতুঙ্গা, ভারতের প্রয়াত ক্রিকেটার রমন লাম্বা, অজয় শর্মাদের মতো ক্রিকেটার। বলা বাহুল্য, সিলেট লিগে রানাতুঙ্গার সেঞ্চুরিও ছিল, সেটাও লিগের এক ঐতিহাসিক ম্যাচে। রুমেশ কালুভিথারানা, অশোকা ডি সিলভারাও খেলেছেন এখানে। পারিশ্রমিকের অংক বেশ ভালো ছিল বলে প্রচুর ক্রিকেটার খেলতে যেতেন সিলেট লিগে।

জিমখানা ক্লাব, মোহামেডান, অনির্বাণ ক্রীড়াচক্রের মাঝে লিগে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। পাল্লা দিয়ে ঢাকা থেকে ক্রিকেটার নিয়ে আসতো এই তিন ক্লাব। তাদের মধ্যে জিমখানা ক্লাবকে ধরা হয় সিলেটের ক্রিকেটের সূতিকাগার। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুম থেকে ২০১৭-১৮ মৌসুম পর্যন্ত সিলেট প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৭ বার, যার মধ্যে ১৪ বারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জিমখানা ক্লাব। চারবার রানার্সআপও হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি।

জিমখানা ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ তকরিমুল হাদী কাবী গত অক্টোবরে জিমখানা ক্লাবের দপ্তরে বসে এক আড্ডায় জানালেন, সিলেটের ক্রিকেটের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে। বেশ রোমাঞ্চ নিয়ে সিলেট লিগের একটি ম্যাচের কথা উলে­খ করেন তিনি, যা এখনও তখনকার সময়ে খেলা ক্রিকেটারদের মুখে মুখে ফেরে।

জিমখানা ক্লাবের প্রারম্ভের কোনো এক সময়ে তোলা স্থিরচিত্র; Image Credit: Muntasir Nirob

১৯৮৮ সালে সিলেট লিগে একটি ম্যাচ সবার মনে দাগ কেটে আছে। জিমখানা-অনির্বাণের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচটি টাই হয়ে গিয়েছিল। উপচে পড়া দর্শক সমাগমের মাঝেই অনির্বাণ ২১২ রান তুলেছিলো। জবাবে গোলাম ফারুক চৌধুরী সুরুর ৮৪ (বিসিবির পেস বোলিং কোচ, জাতীয় দলের সাবেক পেসার), জায়েদ আহমদ চৌধুরীর অপরাজিত ৫০ রানের পরও জিমখানা ২১২ রান টপকাতে পারেনি। তারাও একই স্কোর গড়ে।

সিলেট লিগের প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরিবেশের একটা নজির এই ম্যাচটি বহন করছে। ৯০’র দশকে সিলেট লিগকে স্মরণ করে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন,

‘তখন অনেক জমজমাট ছিল। তখন তো অনেক পারিশ্রমিক পাওয়া যেত। তখনই আমরা এক ম্যাচ ২৫ হাজার টাকাও পেয়েছি। ১৫-২০ হাজারও পেতো অনেকে। আমি জিমখানা ও মোহামেডানে খেলেছিলাম। রমন লাম্বা, রানাতুঙ্গা, অজয় শর্মারাও খেলেছিলো।’

লিগ শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ছিল, তা-ই নয়। প্রচুর দর্শকও ভিড় করতো তারকাদের নিয়ে গড়া জিমখানা-অনির্বাণের খেলা দেখতে। নান্নু বলেছেন,

‘লিগটা ভালোই ছিল। ঢাকার পর চট্টগ্রামের লিগটা বেশি জমতো, তারপরই সিলেটের লিগটা। ভালোই লাগতো। তখন তো আমরা ঢাকা থেকে ক্রিকেটাররা গেলে অনেক দর্শক হতো। সবাই উৎসাহ নিয়ে খেলা দেখতে যেত। মাঠের চারপাশ ভরে যেত। সকাল থেকে মানুষ আসতো আমাদের খেলা দেখতে। আকরাম, বুলবুল, লিপু ভাইও খেলেছে।’

জিমখানা ক্লাব প্রতিষ্ঠার গল্প

জিমখানা ক্লাবের গৌরবোজ্জ্বল সময়ের সারথিরা; Image Credit: Muntasir Nirob

সন্ধ্যার সেই আড্ডা ক্রমেই জমে উঠছিলো। সৈয়দ তকরিমুল হাদী কাবী বলছিলেন সোনালী স্মৃতির কথা। জিমখানা ক্লাবের প্রতিষ্ঠার গল্প জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন,

‘জিমখানা ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে। তখন যতটুকু মনে পড়ে, ছয়জন ছিলেন ফাউন্ডার মেম্বার। এটা মূলত আমাদের মহল্লাভিত্তিক ক্লাব ছিল। এই দরগা মহল্লা। তখন ওইভাবে সিলেটে ক্রিকেট খেলা হতো না। পেশাদার ছিল না এতটা। বিভিন্ন মহল্লায় শীতের দিনে ক্রিকেট খেলা হতো। আমার কাজিন, ডাক নাম ছিল খসরু, উনি মারা গিয়েছেন। উনিই আসলে জিমখানা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি আমাদের মহল্লার আরও পাঁচ-সাতজন বড় ভাইরা ছিল।’

ইংল্যান্ডে ব্যবসা করতেন খসরু। ক্রিকেটের মৌসুমে চলে আসতেন সিলেটে। নিজেই গাঁটের টাকা খরচ করে চালাতেন খেলা। সিলেটে জিমখানা ক্লাব একটা জায়গায় অনন্য যে, এই ক্লাবের ক্রিকেটের বাইরে অন্য কোনো ইভেন্টের দল ছিল না।

রানাতুঙ্গা-রমন লাম্বাদের স্মৃতি

অর্জুনা রানাতুঙ্গা; Image Credit: Reuters

রানাতুঙ্গা, রমন লাম্বা, অজয় শর্মারা যখন সিলেট খেলেছেন, তখন এই সৈয়দ তকরিমুল হাদী কাবী কিশোর বয়সের। বিশ্ব ক্রিকেটের এমন বড় তারকাদের খেলতে দেখার স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেছেন,

‘রমন লাম্বা, অজয় শর্মা খেলেছে। রানাতুঙ্গা জিমখানা ক্লাবে খেলে নাই, জিমখানার বিপক্ষে খেলেছে। যেই ম্যাচটাকে সিলেটের ক্রিকেটের ঐতিহাসিক ম্যাচ বলা হয়, সেই ম্যাচে রানাতুঙ্গা খেলেছিলো অনির্বাণ ক্রীড়াচক্রের হয়ে। ওই ম্যাচে রমন লাম্বা জিমখানার পক্ষে খেলে নাই। ওই ম্যাচটা হয়েছিলো জেলা মাঠে, ৯০’র দশকে হয়েছিলো। ওরা সেই ম্যাচে আগে ব্যাট করে ২১২ রানের মতো করে, রানাতুঙ্গা সেঞ্চুরি করেছিল। সুরু ভাই ৮৪ রানের মতো করেছিল। সেই ম্যাচে ২১২ রান তাড়া করতে গিয়ে ম্যাচটা টাই হয়। তখন একটা মিথ ছিল সিলেট লিগে, এখনও আছে, ‘অনির্বাণ যত ভালো টিম করুক, জিমখানার সাথে জিততে পারে না।’ জিমখানা তখন অনেকটা মহল্লার প্লেয়ার নিয়েই দল গড়তো। ওই ম্যাচটায় পরিপূর্ণ দর্শক ছিল।

সিলেট লিগে সবসময় বাইরের প্লেয়ার খেলে গেছে। যত বড় বড় বাংলাদেশের প্লেয়ার, আমার মনে হয় না কেউ বলতে পারবে, তারা সিলেটে এসে খেলে নাই প্রতিটা মৌসুমে। শ্রীলঙ্কান উইকেটকিপার কালুভিথারানা, অশোকা ডি সিলভা, এমন নয়জন শ্রীলঙ্কান প্লেয়ার খেলেছিলো জিমখানা ক্লাবে। তখন কোনো বাধা ছিল না। একটা সাল, আমার মনে আছে তখন আপনি চাইলে এগারোজন বাইরের প্লেয়ার নিতে পারতেন।’

আলোর মিছিলে সিলেটের ক্রিকেট

৯০’র সেই স্বর্ণালী যুগের পর সিলেটের ক্রিকেট সারাদেশের আলোচনায় এসেছিলো এনামুল হক জুনিয়র, রাজিন সালেহ, অলক কাপালি, তাপস বৈশ্যদের দিয়ে। একই সময়ে তারা খেলেছিলেন জাতীয় দলে। তাদের পর আবার কয়েক বছর তিমিরে হারিয়েছিলো সিলেটের ক্রিকেট। তবে সর্বশেষ ২-৩ বছরে রঙ ফিরেছে সিলেটের ক্রিকেটাঙ্গনে, জাতীয় পর্যায়ে সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করছেন অনেক ক্রিকেটার।

আবু জায়েদ চৌধুরী রাহী, খালেদ আহমেদরা বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেসার। এইচপি, ‘এ’ দল, বিসিবির বয়সভিত্তিক দলেও সিলেটের তরুণ ক্রিকেটারদের লম্বা লাইন আছে। হালের সময়টা তাই সৈয়দ তকরিমুল হাদী কাবীদের কাছে স্বপ্নের সময়। তিনি বলেছেন,

‘আগে হয়তো সিলেটের ৫০ জন ছেলে খেলতো। এখন সিলেটের তো ৫০ জনের ওপরে তো ঢাকাতেই খেলে। এখন প্রতিযোগিতাও অনেক বেশি। সুযোগ পেতে হলে খুব বেশি ভালো করতে হয়। খুব ভালো করলে তখন মিডিয়াতে আসে, সবার নজরে আসে।’

রঙ ফিরছে সিলেট ক্রিকেটে, পাইপলাইনে আছেন অনেক ক্রিকেটাররাই; Image credit: The Daily Star

সিলেটের এই সাবেক ক্রিকেটার, বর্তমানে ক্রীড়া সংগঠকের আশা, অচিরেই আবার দেশের ক্রিকেটের নেতৃত্ব দেবে সিলেট। জাতীয় পর্যায়ের জন্য সর্বাধিক ক্রিকেটারের যোগান দেবে এই অঞ্চল। সৈয়দ তকরিমুল হাদী কাবী বলেছেন,

‘এখন আমার জানামতে, এইচপি’তে আমাদের চারটা প্লেয়ার আছে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে আমাদের তিনটা প্লেয়ার ছিল। আমাদের একটা স্পিনার নাঈম আহমেদ, ও দেশসেরা স্পিনার হয়েছে স্পিন হান্টে। বর্তমানে এবাদত এইচপিতে আছে, ও পেসার হান্ট থেকে এসেছে। সিলেটে কাজ হচ্ছে।’

নব্বইয়ের দশকের সেই সোনালী সময়েই সিলেটের ক্রিকেটারদের জাতীয় পর্যায়ে বিকশিত না হওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল ঢাকাবিমুখতা। ঢাকায় গিয়ে ক্রিকেট খেলতে চাইতেন না বেশিরভাগ ক্রিকেটার। সময় বদলেছে, এখন সিলেটের অনেক ক্রিকেটার খেলেন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে। রাহী-খালেদদের পাশাপাশি জাকির হাসানরাও এখন জাতীয় পর্যায়ে সিলেটের মুখ। তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে এই অঞ্চলের ক্রিকেট। আর হ্যাঁ, পেছনের লাইনটাও ছোট নয়।

This article is in Bangla language. It is about Gymkhana club, a local cricket club in Sylhet. This article also focused on the throwback to the nineties, as the discussion proceeded. 

Featured Image: Getty Images

Related Articles