Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডার্বি দেল্লা ম্যাদোন্নিনা: মিলান শহরের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের ধ্রুপদী মহারণ

ডার্বি দেল্লা ম্যাদোন্নিনা বা ডার্বি ডি মিলানো – ইংরেজিতে ‘দ্য মিলান ডার্বি’। ইউরোপিয়ান ফুটবলের কল্যাণে বর্তমানে ‘ডার্বি’ শব্দের সাথে পরিচয় আছে বেশিরভাগ ফুটবলানুরাগীর৷ একই শহর বা কাছাকাছি অবস্থান করে এমন দু’টি দলের মধ্যে খেলা হলে তাকে লোকাল ডার্বি বা কেবল ‘ডার্বি’ বলা হয়। যেকোনো খেলায় পেশাদার দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিরাজ করে। খেলাধুলার ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খেলা দেখতে আসা দর্শক পর্যন্ত সকলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ অনুভব করেন। খেলার স্পন্সর এবং সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুনে ঘি ঢালে। আর লড়াই যখন নিজের এলাকায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাপিয়ে যায় সবকিছুকে। হালকা হাসি-ঠাট্টা থেকে শুরু করে রক্তারক্তি, খুনোখুনি পর্যন্ত হয়। ক্লাবের সমর্থকেরা ডার্বিকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যুদ্ধ বলে মনে করে, অন্যান্য ম্যাচের চেয়ে ডার্বি নিয়ে তাদের থাকে বিশেষ পরিকল্পনা। দিনশেষে নিজের দলকে জয়মাল্য বরণ করতে দেখাটাই এসব পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য। ফুটবলে ডার্বির কোনো অভাব নেই।

আজকের আলোচনা মিলান ডার্বি নিয়ে, যাতে অংশ নেয় ইতালিসহ পুরো ইউরোপের অন্যতম সফল এবং জনপ্রিয় দুই ক্লাব এসি মিলান এবং ইন্টার মিলান। 

দুয়োমো ডি মিলানোর স্বর্ণালি ম্যাদোন্নিনা; Image Credit : pinterest.com

 

শুরু করা যাক ‘মিলান ডার্বি’কে কেন ‘ডার্বি দেল্লা ম্যাদোন্নিনা’ নামে ডাকা হয়, সেটির কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে। গুগলে মিলান শহরের নাম সার্চ করা হলে রেজাল্টে যে সকল ছবি আসবে, তাতে উপরের দিকে থাকবে ডুয়োমো ডি মিলানো বা মিলান ক্যাথিড্রালের ছবি। ভ্রমণপিয়াসী মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করা স্থাপনাটি হলো মিলানের প্রধান গির্জা। এই ক্যাথিড্রালের ওপর ভার্জিন ম্যারির (খ্রীস্ট ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রীস্টের মা) একটি স্বর্ণালি ভাষ্কর্য রয়েছে, যেটিকে ম্যাদোন্নিনা নামে ডাকা হয়। ম্যাদোন্নিনা শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হলো ‘লিটল ম্যাডোনা’। এই ভাষ্কর্যের নামানুসারে মিলান ডার্বিকে ‘ডার্বি দেল্লা ম্যাদোন্নিনা’ নামে ডাকা হয়।  

বিভিন্ন সময়ে এসি মিলানের লোগো; Image Credit : acmilan.com

 

এসি মিলানের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালে ১৬ই ডিসেম্বর (মতান্তরে ১৩ই ডিসেম্বর)। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এটির নাম ছিল ‘মিলান ফুটবল অ্যান্ড ক্রিকেট ক্লাব’। ১২ জন ফাউন্ডিং মেম্বারের মধ্যে ছিলেন ইংরেজ এবং ইতালীয় নাগরিক৷ এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হন হার্বাট কিলপিন এবং আলফ্রেড এডওয়ার্ডস নামে দুই ইংরেজ। যদিও এসি মিলানের ব্যাজে থাকা ইংল্যান্ডের পতাকার মতো অংশটি আসলে সরাসরি প্রতিষ্ঠাতাদের ইংরেজ বংশগতির প্রতিনিধিত্ব করে না। নগররাষ্ট্র থাকাকালীন সময়ে মিলানের পতাকাও দেখতে এরূপ ছিল। সে সময়কার মিলানের প্রতীক বা কোট অভ আর্মসেও এরকম অংশের উপস্থিতি দেখা গেছে – যা শোভা পেত সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র এবং পোশাকে।

মিলানের পতাকা এবং মাঝে আছে কোর্ট অভ আর্মস; Image Credit : besthqwallpapers.com

 

১৮৭০ সালে নটিংহ্যামে জন্ম নেওয়া কিলপিন ১৮৯১ সালে পাড়ি জমান ইতালিতে। সেখানে তিনি কাজ করতেন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে আর ফুটবল খেলতেন ইন্টারন্যাৎজিওনালে তুরিনোর হয়ে। ধারণা করা হয়, কিলপিনই বিদেশে ফুটবল খেলা প্রথম ইংরেজ। পরে তিনি মিলানে চলে যান, যেখানে তার সাথে এওয়ার্ডসের মতো কয়েকজন ইংরেজ প্রবাসীর দেখা হয়। 

এডওয়ার্ডস এবং কিলপিন; Image Credit : www.museodelmarchioitaliano.it

 

এডয়ার্ডসও কাজের উদ্দেশ্যেই মিলানে এসেছিলেন। সদ্য প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দায়িত্ব বর্তায় তার উপর – যে পদ তিনি পরবর্তীতে অলঙ্কৃত করেন ১০ বছর৷ দলের জার্সি এবং রংয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেন কিলপিন। এ ব্যাপারে তার বিখ্যাত উক্তিটি নিম্নরুপ :-

“We will be a team of devils. Our colours will be red like fire and black like the fear we will invoke in our opponents.”

লাল-কালো রংয়ের উপর ভিত্তি করেই মিলানকে ‘রোজোনেরি’ নামে ডাকা হয়। এছাড়া ‘দিভালো’ বা ‘দ্য ডেভিল’ নামে তাদের আরেকটি ডাকনাম রয়েছে। কেন, সেটা তো বোধহয় নতুন করে ব্যাখ্যার আর প্রয়োজন পড়ছে না।

খেলাধুলার দিক থেকেও ক্লাবের সময় ভালো যাচ্ছিল। ১৯০১ সালে তারা প্রথমবারের মতো ইতালিয়ান টাইটেল জেতে৷ এরপর ১৯০৬ এবং ১৯০৭ সালে তারা পরপর দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়৷ পরের বছর ইতালীয় ফুটবল ফেডারেশন সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের ঘরোয়া খেলায় লিগ হবে দু’টি। একটি হলো ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, অন্যটি ফেডেরাল চ্যাম্পিয়নশিপ। এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পাবে ইতালিয়ান লিগ, যেখানে কেবল সে দেশের লোকেরাই খেলতে পারবে। অন্যদিকে ফেডেরাল চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয়তার বালাই নেই। খেলতে পারবে সবাই।

ফেডারেশনের সিদ্ধান্তে ক্লাবের পরিবেশ গুমোট হয়। কারণ মিলানের গঠনে বিদেশীরা রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিন্তু ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্থানীয়দের জন্যে। প্রেসিডেন্ট এডওয়ার্ডস শেষ পর্যন্ত ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ কিন্তু প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত নিয়ে মনোমালিন্য শুরু হয় – যার ফলশ্রুতিতে তারা ১৯০৮ সালে ফেডেরাল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়, কিন্তু কিছুদিন পর আবার নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় সেই লিগ থেকে। 

ইন্টারের প্রতিষ্ঠাতাবৃন্দ; Image Credit : passioneinter.com

 

ক্লাব কোন লিগে অংশ নেবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব যখন চরমে, তখনই ক্যালেন্ডারের পাতায় আসে ১৯০৮ সালের ৯ই মার্চ। সেদিন ক্লাবের পদস্থ কর্মকর্তারা বসেন মিলানের ভাগ্য-নির্ধারণী সভায়। স্থান ‘Ristorante L’orologio Di Milano’ নামক রেস্টুরেন্ট। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ক্লাব বিভক্ত হবে দুই ভাগে। একভাগের নাম থাকবে মিলান, তারা আগের মতোই লাল-কালো জার্সি পরবে, খেলবে ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। অন্য ভাগের নতুন নাম হয় ইন্টারন্যাৎজিওনালে মিলানো; তারা নিজেদের পতাকাতলে স্থান দেবে বিদেশীদেরকেও, এবং খেলবে ফেডেরাল চ্যাম্পিয়নশিপে। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা খেলতে পারবে বলেই নতুন ক্লাবের নামে ইন্টারন্যাৎজিওনালে শব্দের সংযুক্তি ঘটে – যা প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিষ্ঠাতাদের কণ্ঠে:

“This wonderful night bestows us with the colours of our crest: black and blue against a gilded backdrop of stars. It shall be called International, because we are brothers of the world.”

ইন্টারের লোগোর বিবর্তন; Image Credit : twitter.com

 

জার্সির কালো-নীল বর্ণের উপর ভিত্তি করে ‘নেরাজ্জুরি’ ডাকনাম পায় ইন্টার। ‘লা বিনিয়ামাতা’ (দ্য ওয়েল-চ্যারিশড ওয়ান) এবং ‘বিসসিওনে’ (দ্য বিগ গ্রাস স্নেইক) নামেও পরিচিত তারা।

ইন্টারের ইতিহাসের প্রথম শিরোপা আসে ১৯১০ সালে এবং দ্বিতীয়টি আসে ১৯২০ সালে। উভয় দলের নাম কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। মিলানের পুরো নাম ‘অ্যাসোসিয়াৎজোনে ক্যালসিও মিলান’। প্রথম অফিশিয়াল মিলান ডার্বি অনুষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালের ১০ই জানুয়ারি। মিলান ইন্টারকে ৩-২ ব্যবধানে পরাজিত করে সেই ম্যাচে৷ এখানে উল্লেখ্য, আগের বছর আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়ার এবং কোন লিগে খেলবে, এই দু’টি প্রশ্নে বিভক্ত হলেও পরবর্তী বছরে মিলান নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে যোগ দেয় ফেডেরাল চ্যাম্পিয়নশিপে। এখন পর্যন্ত অফিশিয়াল (২৩২টি) এবং আনঅফিশিয়াল (৭১টি) মিলে মোট দুই দলের মাঝে খেলা হয়েছে মোট ৩০৩ বার৷ অফিশিয়াল ম্যাচে জয়ের পাল্লা (৮৫টি) ইন্টারের দিকে ভারী হলেও ১১৪টি ম্যাচ জিতে সব মিলিয়ে এগিয়ে আছে মিলান৷ ১৪টি গোল করে গোলদাতার তালিকায় শীর্ষে আছেন মিলান কিংবদন্তি আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো। 

প্রাচীন অন্যসব ক্লাবের মত মিলানের ক্লাব দুটির সাথেও জড়িয়ে আছে সামাজিক শ্রেণী ব্যবধান। ইন্টারের সামনে সুযোগ ছিল ভালো মানের দেশি এবং বিদেশি খেলোয়াড় ক্রয়ের৷ স্বদেশী সমর্থকদের পাশাপাশি বিদেশী সমর্থকদের কাছ থেকেও তারা অর্থ সংস্থান করতে পারত। ফলে তাদেরকে বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি বলা হতো। অন্যদিকে মিলানের সমর্থনে ছিলো ব্লু কলার মিলানিজরা। তাই তারা ছিল প্রলেতারিয়েতদের প্রতিনিধি৷ মোটরসাইকেলে চেপে আসতেন বলে ইন্টারভক্তদের ডাকা হতো মোতোরেত্তা নামে। আর ট্রামে চলাচল করা মিলানিজদের বলা হতো ট্র্যামভিয়ের। তবে বর্তমানে উভয় দলের মালিকানা বিদেশী কর্পোরেশনের হাতে থাকায় এ সংক্রান্ত জল্পনা-কল্পনা নেই৷ 

অবাক করা বিষয় হলেও সত্যি, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল হোম গ্রাউন্ড হিসেবে একই মাঠ ব্যবহার করে। চল্লিশের দশকে কয়েক বছর ভিন্ন ভেন্যুতে খেলা উপভোগ করা মিলান ভক্তরা এটিকে ডাকে ‘স্যান সিরো’ নামে। ১৯৪৭ থেকে এটিকে ইন্টারও হোম গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের ভক্তদের কাছে এর ডাকনাম ‘জিউসেপ্পে মেয়াজ্জা’৷ কারণ দুই বছর মিলানে খেললেও মেয়াজ্জার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ইন্টারে। ৮০,০১৮ আসন বিশিষ্ট সুবিশাল স্টেডিয়ামটি ‘স্যান সিরো’ নামেই বেশী খ্যাত। সম্প্রতি উভয় ক্লাব যদিও ঐতিহ্যবাহী স্টেডিয়ামটির পাশে নতুন স্টেডিয়াম তৈরির ব্যাপারে মত দিয়েছে।

মিলানের ম্যাচের দিন স্যান সিরো; Image Credit : acmilan.com

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আবার লিগ চালু হলে প্রথম মৌসুমেই শিরোপা ঘরে তোলে ইন্টার। মিলানের ইতিহাসে তখন অন্ধকার দিক। পরবর্তী শিরোপা জিততে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। একবার ছুরিকাঘাতে এক সমর্থকের মৃত্যু হলেও ইতালি তথা অন্যান্য ইউরোপীয় ডার্বির তুলনায় মিলান ডার্বি কম নৃশংস। তার কারণ মিলানের ১৮ বার এবং ইন্টারের ১৯ বার সিরি-আ জয়ের ফলে শহরে বারবার জয়োৎসব হয়েছে৷ আবার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসর চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও সাফল্য পেয়েছে উভয় দল। মিলান জিতেছে ৭ বার, ৩ বার জিতেছে ইন্টার। ফলে কেবল ডার্বি জেতাটাই শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড ছিল না। 

মাঝে কিছুদিন বন্ধ্যাকাল কাটলেও মিলান আবার ফিরছে পুরনো রূপে। ৭ বছর বাদে আগামী মৌসুমে দেখা যাবে চ্যাম্পিয়নস লিগে।  ইন্টারের অবস্থা মিলানের মতো করুণ না হলেও তারাও ভুগেছে। সিরি-আ’র পয়েন্ট তালিকায় জুভেন্টাসের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ইঁদুর-বিড়াল দৌড় চলছে তাদের মাঝে। চ্যাম্পিয়ন হবে এদের মধ্যে কেউ। পাঁড়-ভক্তদের মতো সাধারণ ফুটবল ভক্তরাও আশায় বুক বাঁধছেন, আবার ‘ডার্বি দেল্লা ম্যাদোন্নিনা’ ফিরে পাবে তার পুরনো চেহারা৷ আবার দুই মিলানের হতে মাঠ মাতাবেন রথী-মহারথীরা।

Related Articles