Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিজেপির নির্বাচনী ব্যর্থতা: এবার শরিকদের মন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মোদী-অমিত শাহ

এজন্যই বলে, রাজনীতিতে সবই সম্ভব। এই কয়েক মাস আগেও যখন ত্রিপুরাতে দীর্ঘ দুই দশকের বাম শাসনের গণেশ উল্টে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় এল, তখন বলা হচ্ছিল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ফের আরেকবার জিততে চলেছেন তিনি।

কিন্তু সম্প্রতি কর্ণাটক নির্বাচন এবং এগারোটি উপনির্বাচনের ফল দেখে পর্যবেক্ষকদের মতামত ঘুরে গেছে অনেকটাই। কর্ণাটকে বৃহত্তম দল হিসেবে শেষ করলেও মাত্র কয়েকটি আসনের অভাবে বিজেপি যখন সেখানে সরকার গড়ে তাদের প্রিয় কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করতে পারল না, তখন মোদী এবং তার সেনাপতি বিজেপির জাতীয় সভাপতি অমিত শাহের উদ্যম যেন অনেকটাই ধাক্কা খেল।

বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ ইদানিং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ‘সম্পর্ক ফর সমর্থন’ প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন; এখানে তাকে দেখা যাচ্ছে ভারতের বিশিষ্ট শিল্পপতি রতন টাটার সঙ্গে (বাম দিক থেকে দ্বিতীয়); Source: Amit Shah Twitter handle @AmitShah

অন্যদিকে, এগারোটি উপনির্বাচনে মাত্র দু’টিতে (জোট এনডিএ ধরলে তিনটি) জিতে বিজেপি ফের দেখল যে কর্ণাটকের মতো অন্যত্রও বিরোধীরা জোট বেঁধে লড়লে তাদের পক্ষে লড়াইটা বেশ কঠিন হয়ে যায়।

চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর মোদীর শাসনযন্ত্রে একটু হলেও যেন জং পড়েছে বলে মনে হচ্ছে, আর তাতেই উৎসাহী হয়ে উঠেছে বিরোধীরা। ঘটনার ধারা অনেকটা ১৯৭৭ সালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হারাতে তামাম বিরোধীদের একাট্টা হওয়ার মতো। যদিও সেই বিকল্প সরকার টেকেনি বেশিদিন। একইরকম ঘটনা দেখা গিয়েছিল ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধী সরকারের পতনের পরেও।

২০১৯-ও কি সেরকমই কিছু হতে চলেছে?

এখনই সেরকম ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ কঠিন। সত্যি বলতে, ভারতের নির্বাচন নিয়ে আগাম মন্তব্য করা বেশ ঝুঁকির কাজ। কারণ, এখানে নানা ধরনের কার্য-কারণ মাথায় রেখে পর্যবেক্ষকদের এগোতে হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে এইটুকু অন্তত বলা চলে যে, ২০১৯-এ জয়ীর শিরোপা পেতে মোদী-শাহ জুটিকে কিছুদিন আগেও যতটা আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছিল, এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না।

যদিও তার মানে এই নয় যে মোদী এবং বিজেপি যথেষ্ঠ দুর্বল হয়ে পড়েছে- তারা সামনের লোকসভা নির্বাচনে জিতবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে এমনটিও নয়। সামনে বিজেপি-শাসিত তিনটি রাজ্য যথাক্রমে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীশগঢ়ে গেরুয়া বাহিনী জিতলেই ফের বদলে যাবে নির্বাচন, এমনটাই বিশেষজ্ঞদের মতামত। কিন্তু কর্ণাটক এবং উপনির্বাচনের ফলাফলের পরে বিজেপি নেতৃত্ব যেভাবে তার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক এলায়েন্স বা এনডিএর জোটসঙ্গীদের সঙ্গে বেড়া মেরামতির কাজে মনোনিবেশ করেছে, তাতে এটা বলা যেতেই পারে যে, অমিত শাহরা এখন ‘প্ল্যান বি’ তৈরি করতে তৎপর।

গত ৫ জুন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Twitter handle of Narendra Modi @narendramodi

বিজেপির এই ‘প্ল্যান বি’ ২০১৪তে দরকার পড়েনি

বিজেপির এই প্ল্যান বি-র কাজে হাত দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যখন বিজেপির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীকে প্রশ্ন করা হতো যে, তার দল সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও তিনি কাউকে জোটসঙ্গী হিসেবে পাবেন কিনা, মোদী বলতেন, সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটা তিনি দেখবেন। সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি অবশ্য, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই সরকার গঠন করে।

এমনকি এনডিএর সদস্যদের সাহায্যও মোদীকে নিতে হয়নি সরকার গঠনে- এতটাই একচেটিয়া ছিল তার সেই জয়। মোদীর মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগে অভিযুক্ত নেতার পক্ষে কতটা বিরোধী দলগুলিকে কাছে টানা সম্ভবপর হতো, সেই প্রশ্নও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল সেবার। চুনোপুঁটি নানা দলও বিজেপির তরীতে এসে ওঠে এই বুঝে যে, দেশের রাজনৈতিক বাতাবরণ তখন শুধুই মোদীময়।

এবারে কিন্তু সেই প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে পারে আবার। আর পাঁচ বছর শাসন করার পরে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার বোঝা নিয়ে মোদীকে কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে বেশ সমঝেই। অমিত শাহ ইতিমধ্যেই এনডিএর বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ শরিকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ শুরু করে দিয়েছেন হাওয়া বুঝে।

এদের মধ্যে আছে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা, পাঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দল এবং বিহারের সংযুক্ত জনতা দল। বাকি দুটি দল শিবসেনার মতো বিজেপির উপরে অতিশয় বিরক্ত না হলেও, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে তারাও বিজেপির উপরে জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দেবে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

সংযুক্ত জনতা দলের প্রধান তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমার তো গত লোকসভা নির্বাচনের আগে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়েই গিয়েছিলেন মোদীর উত্থানের বিরোধিতা করে। এবারেও তিনি ঘটনার ঘনঘটায় সেই জোটেরই শরিক এবং ২০১৯-এ তিনি কী করেন সেটাই দেখার বিষয়।

লোক জনশক্তি দলের দলিত নেতা রামবিলাস পাসোয়ানও কয়েকমাস আগে বিজেপিকে সাবধানবাণী শুনিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিজের ভাবমূর্তির আশু পরিবর্তনের জন্যে। আর দক্ষিণে তো চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি ইতিমধ্যেই বিজেপির সঙ্গে ত্যাগ করেছে, আগামী বছরের অন্ধ্রপ্রদেশ নির্বাচনের আগে রাজ্যের জন্যে বিশেষ তকমা পাওয়ার দাবিতে।

বিজেপির এই আচমকা সাবধানতা অবলম্বন বুঝিয়ে দেয় যে, দেশজুড়ে যে বিরোধীদের নানা জোট বাস্তবায়িত হচ্ছে ২০১৯-কে পাখির চোখ করে, তাতে তারাও নিজেদের জোটশক্তি ঝালিয়ে নিতে তৎপর। প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশে বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনে হাত মিলিয়েছে রাজ্যস্তরে ঘোর দুশমন সমাজবাদী এবং বহুজন সমাজ পার্টির মতো দলও; কর্ণাটকে একসঙ্গে হয়েছে কংগ্রেস এবং জনতা দল (সেকুলার)। ২০১৪ সালে যে ধর্মীয় মেরুকরণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে উত্তরপ্রদেশে বাজিমাত করেছিল বিজেপি, তা সম্প্রতি কৈরানা উপনির্বাচনে দেখা যায়নি। উল্টো আঞ্চলিক রাষ্ট্রীয় জনতা দল কংগ্রেসসহ সমাজবাদী এবং বহুজন সমাজ পার্টির সমর্থন নিয়ে বিরাট ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছে বিজেপিকেই।

সিঙ্গাপুরের যোগাযোগ এবং তথ্যমন্ত্রী এস ঈশ্বরণের সঙ্গে আলাপচারিতায় ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু; এবছর মার্চ মাসে বিজেপির জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স থেকে বেরিয়ে যান চন্দ্রবাবু; Source: Twitter handle of Chnadrababu Naidu @ncbn

পাশাপাশি, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি, কৃষক সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে জর্জরিত মোদী সরকারের পক্ষে রাতারাতি জাদুবলে সব বদলে দেওয়াও অসম্ভব। সম্প্রতি একটি সমীক্ষা এও জানিয়েছে যে, মোদীর জনপ্রিয়তা ভারতের গ্রামগুলোতে নিম্নমুখী কারণ কৃষকরা বিরক্ত। আর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো জুটেছে বিজেপির বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীদের অসংবেদনশীল মন্তব্য, যা নিয়ে যারপরনাই ক্ষুব্ধ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও।

গত ৬ জুন ভারতের মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে পুলিশের গুলিচালনায় ছয়জন কৃষকের মৃত্যুর বছর পূরণ হলো; কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী সেখানে কৃষকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে গত বছরের ঘটনায় আত্মীয়পরিজনদের হারানো এক কৃষক তার কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে; Source: Rahul Gandhi Twitter handle @RahulGandhi

এই অবস্থায় শরিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা যে একটি বড় কাজ, তা বুঝেছে বিজেপির একক শক্তিতে বিশ্বাসী নেতৃত্ব। গত মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের আগে ও পরে যে শিবসেনার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ককে উন্নত করার কথা যাদের মনে হয়নি একটুও, তারাই এখন সেই দলের সঙ্গে কোলাকুলিতে আগ্রহী।

কিন্তু নিজেদের ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা হটিয়ে এই বিজেপির পক্ষে কতটা জোটসঙ্গী পেয়ে তাদের সঙ্গে জোটধর্ম পালন করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। এনডিএর শরিক তো বটেই, ভবিষ্যতে সরকার গঠনে যদি এনডিএর বাইরের কোনও দলকে কাছে টানতে হয়, তাহলে মোদী-শাহরা কতটা কী করতে পারবেন? এক জম্মু ও কাশ্মীরেই সেখানকার আঞ্চলিক পিডিপি দলের সঙ্গে সরকার চালাতে গিয়ে চূড়ান্ত জেরবার হতে হয়েছে বিজেপিকে। এই জন্যই আসলে বলা হয়, রাজনীতিতে সবই সম্ভব।

রাহুল গান্ধী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা এযাবৎ মোদী এবং বিজেপির জয়রথ গড়গড়িয়ে চলতে দেখলেও কর্ণাটকের খেলা ঘোরার খেলা যেন তাদের নতুন উদ্যম এনে দিয়েছে মোদীকে রোখার ব্যাপারে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে শৈলশহর দার্জিলিঙে একটি অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী-বিরোধী শক্তির অন্যতম বড় স্তম্ভ হতে চলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী; Source: Twitter handle of Mamata Banerjee @MamataOfficial

যদিও এই মুহূর্তে সমীকরণ মোদীরই পক্ষে, কেননা বিরোধীরা গত কয়েক বছরে বেশ কিছু উপনির্বাচনে জয় পেলেও, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সেভাবে ধরাশায়ী করতে পারেনি- ত্রিপুরা ছাড়াও আসাম, উত্তরপ্রদেশ এমনকি জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যেও ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। যদি রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীশগঢ়েও বিজেপি জিতে যায়, তাহলে বিরোধীদের নব্য উৎসাহ ফের অনেকটাই মিইয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু যদি তারা এই তিনটির মধ্যে অন্তত একটি রাজ্যেও জিততে পারে, তাহলে ২০১৯ এর লড়াই অনেকটাই জমে যাবে।

Featured Image Source: The Finacial Express

Related Articles