Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাম্প্রতিক ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের অন্তর্নিহিত কারণ || পর্ব–১

সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়ার দুই মুসলিম–অধ্যুষিত রাষ্ট্র ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী সম্পর্কে দ্বন্দ্বের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাষ্ট্র দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব, প্রচারণা যুদ্ধ ও সামরিক ভীতি প্রদর্শনে লিপ্ত হয়েছে। ইরান ও আজারবাইজান উভয়েই বিপুল পরিমাণ হাইড্রোকার্বন সম্পদে সমৃদ্ধ, উভয় রাষ্ট্রেরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামরিক শক্তি রয়েছে (ইরান বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের একটি অন্যতম শীর্ষ সামরিক শক্তি এবং সম্প্রতি আজারবাইজান দক্ষিণ ককেশাসের শীর্ষ সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে) এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে উভয় রাষ্ট্রেরই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতির পর্যালোচনায় ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কের সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পটভূমি

বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ৪টি রাষ্ট্রে শিয়া মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং এই ৪টি রাষ্ট্র হচ্ছে ইরান, ইরাক, আজারবাইজান ও বাহরাইন। এই রাষ্ট্র চারটির মধ্যে দুইটি অনারব শিয়া–অধ্যুষিত রাষ্ট্র ইরান ও আজারবাইজান পরস্পরের প্রতিবেশী এবং রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে বিস্তৃত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংযোগ বিদ্যমান। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বর্তমান আজারবাইজানি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড সুদৃঢ়ভাবে ‘ইরানি বিশ্ব’ (Iranian World) বা ‘ইরানি প্রভাব বলয়ে’র (Iranian sphere of influence) অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া কর্তৃক এই ভূখণ্ড দখল করে নেয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের সিংহভাগ জুড়ে এই ভূখণ্ড বিভিন্ন ইরানি রাষ্ট্রের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ ছিল। কিন্তু ১৮০৪–১৩ ও ১৮২৬–২৮ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধদ্বয়ে রাশিয়ার নিকট ইরানের পরাজয়ের পর বর্তমান আজারবাইজানি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আজারবাইজান ইরানি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ১৯১৮ সালে আজারবাইজান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি বলশেভিকদের পরিচালিত একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থান ও আজারবাইজানে সোভিয়েত রুশ লাল ফৌজের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে আজারবাইজান একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, এবং ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে। ১৯৯১ সালের অক্টোবরে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পর আজারবাইজান একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

মানচিত্রে ইরান, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, তুরস্ক এবং ইসরায়েল; Source: Middle East Eye

সেসময় অনেকেরই ধারণা ছিল, স্বাধীনতা লাভের পর আজারবাইজান আবার ইরানি প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে। বস্তুত ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও ইরানের মধ্যবর্তী সীমান্তের নিকটে বসবাসকারী সোভিয়েত আজারবাইজানি জনসাধারণ ইরানি–সোভিয়েত সীমান্তবর্তী বেড়া উপড়ে ফেলে এবং সোভিয়েত ও ইরানি আজারবাইজানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সংযোগ স্থাপনের দাবি জানায়। উল্লেখ্য, ইরানের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের ৪টি প্রদেশ (পূর্ব আজারবাইজান, পশ্চিম আজারবাইজান, আরদাবিল ও জাঞ্জান) জাতিগত আজারবাইজানি–অধ্যুষিত এবং প্রদেশগুলো একত্রে ‘ইরানি আজারবাইজান’ নামে পরিচিত। বস্তুত বর্তমানে আজারবাইজানের চেয়ে ইরানে বেশি সংখ্যক জাতিগত আজারবাইজানি বসবাস করে, এবং ইরানে বসবাসকারী আজারবাইজানির সংখ্যা দেড় কোটি থেকে প্রায় দুই কোটির মধ্যে বলে ধারণা করা হয়।

কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আজারবাইজান ইরানি প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া কর্তৃক আজারবাইজান দখলের পর রুশ সরকার আজারবাইজানে ইরানি প্রভাব হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এর ফলে আজারবাইজানি জনসাধারণের মধ্যে ইরানি প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায় এবং রুশ প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আজারবাইজানি জনসাধারণ ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে ওসমানীয়/তুর্কি প্রভাব বিস্তৃতি লাভ করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কিছু আজারবাইজানি বুদ্ধিজীবী ‘পশ্চাৎপদ’ ইরানের পরিবর্তে ‘তুলনামূলকভাবে অগ্রসর’ ও ‘পশ্চিমামুখী’ ওসমানীয় রাষ্ট্রকে আজারবাইজানিদের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন এবং আজারবাইজানি জনসাধারণের মধ্যে ‘বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদ’ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯১৮ সালে আজারবাইজানের স্বাধীনতা লাভের পর স্থাপিত ওসমানীয়–আজারবাইজানি সামরিক–রাজনৈতিক মৈত্রীর ফলে এই প্রক্রিয়া আরো বেগবান হয়। পরবর্তীতে ওসমানীয় রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং বলশেভিকরা আজারবাইজানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করে। এর ফলে বিংশ শতাব্দীতে তুরস্ক ও আজারবাইজানের আদর্শিক গতিপথ ছিল আংশিকভাবে সমান্তরাল। 

ইরানের মানচিত্রে ইরানি আজারবাইজান (গাঢ় সবুজ রঙে চিহ্নিত); Source: Hogweard/Wikimedia Commons

অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দীতে ইরান ছিল একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ‘ইসলামি বিপ্লবে’র পর ইরান একটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হয়। এর ফলে তদানীন্তন ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত আজারবাইজানের সঙ্গে ইরানের আদর্শিক পার্থক্য আরো তীব্র হয়। তদুপরি, সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক ভ্লাদিমির লেনিন কর্তৃক প্রবর্তিত ‘কোরেনিজাৎসিয়া’ (রুশ: коренизация) বা ‘আদিবাসীকরণ’ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার আজারবাইজানের অভ্যন্তরে আজারবাইজানি জাতিসত্তার বিকাশের জন্য বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে আজারবাইজানিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে এবং এর ফলে তারা পরোক্ষভাবে তাদের ‘স্বজাতি’ তুর্কিদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ইরান ও সোভিয়েত আজারবাইজানের মধ্যে যে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বন্ধন ছিল, সেটি বহুলাংশে হ্রাস পায়।

এর ফলশ্রুতিতে ভূরাজনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও আদর্শিকভাবে সাম্যবাদের ব্যর্থতা স্বাভাবিকভাবেই সদ্য স্বাধীন আজারবাইজানকে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের দিকে ঠেলে দেয়। প্রাথমিকভাবে ইরান সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ইরানি সীমান্তে একটি শিয়া–অধ্যুষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের (আজারবাইজানের) প্রতিষ্ঠা লাভকে নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করে এবং ইরান ছিল আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু শীঘ্রই ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কে নানাবিধ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি পার্তিয়াসি’ (আজারবাইজানি: Azərbaycan Xalq Cəbhəsi Partiyası) দলীয় প্রার্থী আবুলফাজ এলচিবে বিজয়ী হন, এবং তার সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদী ও অতি তুর্কিপন্থী (এবং অতি রুশবিরোধী ও ইরানিবিরোধী) পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। এলচিবে খোলাখুলিভাবে ইরানি আজারবাইজানকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আজারবাইজানের সঙ্গে সংযুক্ত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং ইরানি সরকারের পতন ঘটানোর আহ্বান জানান।

আজারবাইজানি সরকার কর্তৃক ইরানি আজারবাইজানের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাকে ইরান নিজস্ব ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং এর ফলে ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু স্থায়ী দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে সংঘটিত একটি অভ্যুত্থানে এলচিবে ক্ষমতাচ্যুত হন, কিন্তু ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকে। আজারবাইজান কর্তৃক ইরানি আজারবাইজানকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টার প্রত্যুত্তরে ইরান নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্বে পরোক্ষভাবে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখকে (আজারবাইজানের অভ্যন্তরে অবস্থিত আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র) সমর্থন প্রদান করতে শুরু করে। ১৯৮৮–১৯৯৪ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আজারবাইজান ও আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ মিত্র তুরস্ক স্থলবেষ্টিত আর্মেনিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে এবং আর্মেনীয়–আজারবাইজানি ও তুর্কি–আর্মেনীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।

মানচিত্রে ইরানি–আজারবাইজানি ও ইরানি–আর্মেনীয় সীমান্ত; Source: CuriousGolden/Wikimedia Commons

ইরান উক্ত তুর্কি–আজারবাইজানি অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব বহুলাংশে কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আর্মেনিয়াকে সহায়তা করে এবং তাদেরকে জ্বালানি ও অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে আরম্ভ করে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের পর থেকে ইরান আজারবাইজানের অভ্যন্তরে অবস্থিত আর্তসাখের অধিকাংশ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করে। তদুপরি, আজারবাইজানি সরকার বরাবরই সন্দেহ করে এসেছে যে, ইরান আজারবাইজানের অভ্যন্তরে ‘উগ্র’ ইসলামপন্থী দলগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে এবং ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে বসবাসকারী জাতিগত তালিশদেরকে আজারবাইজানি সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে।

অবশ্য ইরান খোলাখুলিভাবে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের প্রতি সমর্থন প্রদান থেকে বিরত থাকে এবং রাষ্ট্র দুইটিকে প্রদত্ত ইরানি সহায়তা ছিল মূলত অর্থনৈতিক ধাঁচের, সামরিক ধাঁচের নয়। তদুপরি, এই যুদ্ধে ইরান যে সম্পূর্ণভাবে আর্মেনিয়ার পক্ষ নিয়েছিল, এমনটাও নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ইরান নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্ব নিরসনে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতা করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইরান আজারবাইজানিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণাভিযান বন্ধ করার জন্য আর্মেনিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করে এবং এই চাপ কার্যকর করার জন্য ইরানি–আজারবাইজানি ও ইরানি–আর্মেনীয় সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে। তদুপরি, আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রে’র ওপর আর্মেনিয়া যাতে আক্রমণ না চালায়, সেজন্য ইরান আর্মেনিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করে এবং যুদ্ধ চলাকালে নাখচিভানকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

১৯৯৪–পরবর্তী ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কের ধারা

সামগ্রিকভাবে, আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বাকু ও তেহরানের মধ্যে জটিল এক ধরনের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং পরবর্তীতেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। রাষ্ট্র দুটি একে অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সংযোগ অব্যাহত রাখে। যেমন: ইরান আজারবাইজানের সঙ্গে একটি অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, আজারবাইজানি নাগরিকদের ইরানে প্রবেশের জন্য ভিসা সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে দেয়, নাখচিভানকে জ্বালানি সরবরাহ করতে শুরু করে, আজারবাইজানে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানি ভূখণ্ড হিসেবে অভিহিত করেন এবং উভয় রাষ্ট্র জ্বালানি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রাক্তন ইরানি রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি এবং আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ। রুহানির শাসনামলের প্রথমদিকে ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল; Source: AzerNews

কিন্তু একই সঙ্গে রাষ্ট্র দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। যেমন: আজারবাইজানি সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে ইরানি আজারবাইজানকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালায়, ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধকে সমর্থন করে এবং ২০১২ সালে ২২ জন আজারবাইজানি নাগরিককে ইরানের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিকল্পনা করার দায়ে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে, ইরান আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে এবং আজারবাইজানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘আজারবাইজান ইসলাম পার্তিয়াসি’কে (আজারবাইজানি: Azərbaycan İslam Partiyası) আর্থিক ও অন্যান্য সমর্থন প্রদান করে।

তদুপরি, আজারবাইজানি পররাষ্ট্রনীতিকে ইরান নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজারবাইজান তুরস্ক ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এবং উভয় রাষ্ট্রই বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য ইরানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিশেষত বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যবর্তী সম্পর্ক খুবই তিক্ত, এবং ইরানি সরকারের ধারণা, ইরানের ওপর সহজে আক্রমণ পরিচালনার জন্য ইসরায়েল আজারবাইজানি ভূখণ্ডকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বিশ্লেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ইতোমধ্যেই আজারবাইজানি ভূখণ্ডে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছে, কিংবা না করে থাকলেও যে কোনো মুহূর্তে আজারবাইজানি বিমানঘাঁটিগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার অনুমোদন লাভ করেছে। তাছাড়া ইসরায়েলের জ্বালানি চাহিদার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আজারবাইজান সরবরাহ করে এবং আজারবাইজান ইসরায়েলের কাছ থেকে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে। এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি–আজারবাইজানি মৈত্রীকে ইরান নিজস্ব নিরাপত্তার (বিশেষত ইরানি পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তার) জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

ইরানি–সমর্থিত ‘আজারবাইজান ইসলাম পার্তিয়াসি’র নেতা মোভসুম সামাদভ আজারবাইজানি সরকারকে উৎখাত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; Source: Musalmanislam/Wikimedia Commons

২০২০ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের মাত্রা তীব্র হয়ে ওঠে এবং একইসঙ্গে আজারবাইজান ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বও বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আর্তসাখে জ্বালানি সরবরাহ ও আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বকে উস্কে দেয়ার দায়ে ইরানকে অভিযুক্ত করে। আজারবাইজানি উপ–পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালাফ খালাফভ ইরানি উপ–পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেইয়্যেদ আব্বাস আরাকচিকে ফোন করে এই বিষয়ে প্রতিবাদ জানান এবং আজারবাইজানি সরকার এই বিষয়ে জবাবদিহিতা করার জন্য আজারবাইজানে নিযুক্ত ইরানি কূটনীতিকদের তলব করে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্ত সংঘর্ষের সময় ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব করে।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ শুরুর পর ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ থাকে এবং উভয় পক্ষকে দ্রুত শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানায়। কিন্তু আজারবাইজানি প্রচারমাধ্যম দাবি করে যে, এই যুদ্ধে ইরান কার্যত আর্মেনিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে এবং রাশিয়া ইরানি ভূখণ্ড ব্যবহার করে আর্মেনিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে। অবশ্য ইরান এই অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আজারবাইজানের অনুকূলে যেতে শুরু করলে ইরান তাদের আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে আসে এবং নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানি ভূখণ্ড হিসেবে অভিহিত করে বিবৃতি প্রদান করে। কিন্তু আজারবাইজানি জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইরানি সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যকে বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং আজারবাইজানিদের মধ্যে ইরানিবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পায়।

২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ পরাজিত হয় এবং আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজারবাইজানি নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়। ১০ নভেম্বর রুশ মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া আর্তসাখে একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। ১১ নভেম্বর রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং সেটির শর্তানুযায়ী নাগর্নো–কারাবাখে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য আজারবাইজানের আগদামে একটি যৌথ রুশ–তুর্কি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। অর্থাৎ, এই যুদ্ধের ফলে আজারবাইজানের অভ্যন্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ও তুর্কি সামরিক উপস্থিতি স্থাপিত হয় এবং কিছু কিছু বিশ্লেষক আজারবাইজানকে একটি ‘রুশ–তুর্কি কন্ডোমিনিয়াম’ (condominium) হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, ‘কন্ডোমিনিয়াম’ বলতে এমন একটি ভূখণ্ডকে বোঝায় যেটির নিয়ন্ত্রণ একাধিক বহিঃশক্তির হাতে ন্যস্ত।

২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় ইরানি আজারবাইজানিরা আজারবাইজানের পক্ষে বিক্ষোভ করছে; Source: Facebook/Asia Times

উল্লেখ্য, ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরান দক্ষিণ ককেশাসে প্রভাব বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের পর দক্ষিণ ককেশাসের বৃহত্তম রাষ্ট্র আজারবাইজান কার্যত দৃঢ়ভাবে রুশ ও তুর্কি প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু এতদঞ্চলে ইরানি প্রভাব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায়। তদুপরি, যুদ্ধ চলাকালে ইরানি আজারবাইজানিরা আজারবাইজানের পক্ষে বিক্ষোভ করে এবং যুদ্ধে আজারবাইজানের বিজয়ের ফলে ইরানি সরকারের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দেয় যে, আজারবাইজানি সামরিক সাফল্য ইরানি আজারবাইজানিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের বিস্তার ঘটাতে পারে।

২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অর্জিত বিজয় উদযাপনের জন্য আজারবাইজানি সরকার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে একটি বৃহৎ মাত্রার সামরিক প্যারেডের আয়োজন করে এবং আজারবাইজানি ও তুর্কি সৈন্যরা এই প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান একমাত্র বিদেশি অতিথি হিসেবে এই প্যারেড পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেখানে ভাষণ প্রদানকালে তিনি একটি কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করেন। এর ফলে তুর্কি–ইরানি ও ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বে একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়।

এরদোয়ান যে কবিতাটির অংশবিশেষ আবৃত্তি করেছিলেন, সেটির রচয়িতা আজারবাইজানি কবি বখতিয়ার ভাহাবজাদেহ এবং শিরোনাম ‘গুলুস্তান’। কবিতাটির যে অংশটুকু এরদোয়ান আবৃত্তি করেছিলেন, সেটির বাংলা অনুবাদ হচ্ছে, “তারা আরাস নদীকে পৃথক করেছে এবং একে পাথর ও রড দিয়ে ভরাট করেছে। আমি তোমার কাছ থেকে আলাদা হবো না। তারা আমাদের বলপূর্বক আলাদা করেছে।” উল্লেখ্য, কবিতাটি রচিত হয়েছিল সোভিয়েত শাসনামলে এবং কমিউনিস্টরা আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে যে ইরানিবিরোধী প্রচারণা অভিযান চালিয়েছিল, এই কবিতা ছিল তারই অংশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাশিয়া বর্তমান আজারবাইজানের ভূখণ্ড ইরানের কাছ থেকে দখল করে নেয় এবং এর ফলে আজারবাইজান দুই খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই কবিতায় উক্ত বিভাজনকে কৃত্রিম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং পরোক্ষভাবে দুই আজারবাইজানের পুনরেকত্রীকরণের ইঙ্গিত করা হয়েছে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত বিজয়সূচক প্যারেডে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান ভাষণ দিচ্ছেন; Source: Reuters/Dhaka Tribune

কমিউনিস্টরা এই কবিতাটির মাধ্যমে ইরানি আজারবাইজানকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করে সোভিয়েত আজারবাইজানের সঙ্গে যুক্ত করার প্রতি ইঙ্গিত করত, আর এরদোয়ান এই কবিতাটি আবৃত্তি করে ইরানি আজারবাইজানকে বর্তমান আজারবাইজানের সঙ্গে যুক্ত করার প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। অন্তত ইরানি সরকার সেরকমই বুঝেছিল। এজন্য ইরানি সরকার এরদোয়ানের উক্ত কবিতা আবৃত্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং এর ফলে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির উপক্রম হয়। অবশ্য ইরান ও তুরস্ক কূটনৈতিকভাবে এই সঙ্কট মীমাংসার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু উক্ত ঘটনাটি ইরানি আজারবাইজানে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দেয়ার ক্ষেত্রে আজারবাইজান ও তুরস্কের ভূমিকা সম্পর্কে ইরানকে আরো উদ্বিগ্ন করে তোলে।

অর্থাৎ, ১৯৯১ সালে আজারবাইজানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে পরোক্ষভাবে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে এবং ২০২০ সাল থেকে এই দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এই দ্বন্দ্ব তুলনামূলকভাবে আরো তীব্র রূপ ধারণ করে এবং এর ফলে ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্ক একটি নতুন স্তরে পৌঁছে যায়। ২০২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি অনলাইনভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ‘মিনভাল.আজ’–এ (minval.az) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল, আজারবাইজান ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ‘রিসেট’ (reset) করতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব কার্যত উক্ত ‘রিসেট’–এর যৌক্তিক সম্প্রসারণ মাত্র।

Related Articles