Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্লাউস ফকস: পদার্থবিজ্ঞানী না গুপ্তচর?

স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাল সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হঠাৎ করেই জানান দিলো তাদের কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, কোনোভাবে আমেরিকার পারমাণবিক বোমা বানাবার গোপন প্রকল্প ম্যানহাটন প্রজেক্টের মুল্যবান বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো পাচার হয়েছে সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের কাছে। আমেরিকান কোড ব্রেকাররা ১৯৪৪ সালে ‘চার্লস’ নামের এক ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্র থেকে মস্কোতে পাঠানো কিছু টেলিগ্রাম খুঁজে পেলেন, যেখানে পারমাণবিক বোমার তথ্যাদির বিশদ বিবরণ রয়েছে।

পত্রিকার পাতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার সংবাদ; ছবিসূত্র: havewenodecency.weebly.com

তবে এমন একটি-দুটি নয়, শ’খানেক ছদ্মনামের বেড়াজালে ভর্তি এনক্রিপ্টেড টেলিগ্রামের খোঁজ পেলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘আর্মি সিগনাল ইন্টেলিজেন্স’ এর একটি দল। গোয়েন্দা দলের ধারণা, ‘চার্লস’ নামের এই ব্যক্তিটি হয়তো ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথে সরাসরি জড়িত কেউ। নইলে প্রজেক্টের খুঁটিনাটির এমন বিশদ তথ্য তার কাছে থাকা অসম্ভব। কিন্তু কে ‘চার্লস’ নামের এই গুপ্তচর?

ভেনোনা প্রজেক্ট

গোপন তথ্যের পাচারকারীদেরকে খুঁজতে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কার্টার ক্লার্ক ‘আর্মি সিগনাল ইন্টেলিজেন্স’-এর একদল কোড ব্রেকারকে সাথে নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তথ্য পাচারের মাধ্যম হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্যন্ত অনেকগুলো গোপন টেলিগ্রাম লাইনের খোঁজ পেয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দারা। সন্দেহ আরো জোরালো হয়েছিলো যখন এই টেলিগ্রাম মেসেজগুলোর কোনো অর্থ বের করতে পারছিলেন না সিগনাল ইন্টেলিজেন্সের দক্ষ কোড ব্রেকাররা। গুপ্তচরদের ধরতে ক্লার্কের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘ভেনোনা প্রজেক্ট’।

ভেনোনা প্রজেক্টের গোপন দলিল; ছবিসূত্র: theblackvault.com

‘ওয়ান টাইম প্যাড’ নামের বিশেষ এক ধরনের এনক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিলো যুক্ত্ররাষ্ট্র থেকে মস্কোতে এই টেলিগ্রাম প্রেরণের ক্ষেত্রে। এই ওয়ান টাইম প্যাডের রহস্য উদঘাটন করতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছিলো সিগনাল ইন্টেলিজেন্সের কোড ব্রেকারদের।

সিগনাল ইন্টেলিজেন্সের কোড ব্রেকাররা; ছবিসূত্র: commons.wikimedia.org

তবে শেষ নাগাদ মেরেডিথ গার্ডনার নামের এক তরুণ কোডব্রেকার প্রথম এই কোড ব্রেক করেন এবং তথ্য উদঘাটন শুরু করেন। ভেনোনা প্রজেক্টের কোড ব্রেকাররা ১৯৪৮ পর্যন্ত কাজ করে ৩৪৯ জন সোভিয়েত গুপ্তচরকে শনাক্ত করেন।

তরুণ কোডব্রেকার মেরেডিথ গার্ডনার; ছবিসূত্র: nsa.gov

মার্কিন সংবাদপত্রগুলোর সামনের পাতায় একের পর এক আসতে লাগলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মার্কিন সামরিক খাতে অনুপ্রবেশকারী সোভিয়েত গোয়েন্দাদের কথা। যদিও ভেনোনা প্রজেক্ট অনেক টেলিগ্রামের কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি, কিন্তু যাদের নাম বেরিয়ে এসেছিলো, তাদের অনেকেই যুদ্ধকালীন জড়িত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করা জার্মান এক পদার্থবিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করেছেন সোভিয়েত গোয়েন্দাসংস্থার এজেন্টদের কাছে। কিন্তু কে এই জার্মান বিজ্ঞানী? আর কেন তিনি সোভিয়েত এজেন্টদের তথ্য সরবরাহ করলেন ?

ক্লাউস ফকসই কি সেই ‘চার্লস’?

১৯১১ সালে জার্মানিতে জন্ম হয় তার। লিপজিগ ইউনিভার্সিটি থেকে গণিত আর পদার্থবিদ্যায় স্নাতক পড়েন তিনি। পশ্চিম ইউরোপের তরুণ সমাজের মধ্যে তখন মার্ক্সবাদ আর কমিউনিজমের একটা জোয়ার চলছে। ১৯৩০ সালে প্রতিভাবান আর রাজনীতি সচেতন তরুণ ক্লাউস ফকস যোগ দিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে একদিকে নাৎসিবাদের উত্থান হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে কমিউনিস্টদের উপর দমন পীড়ন।

তরুণ ক্লাউস ফকস; ছবিসূত্র: commons.wikimedia.org

দেশজুড়ে কমিউনিস্টদের উপর ধরপাকড় শুরু হলে তরুণ ক্লাউস ফকস চলে আসেন ইংল্যান্ডে। ১৯৩৭ সালে পর্দাথবিদ্যায় পিএইডি শেষ করে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্নের সাথে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৪১ সালে ক্লাউস ফকস আর রুডলফ পেইরেলস মিলে পারমাণবিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী গবেষণা করেন। আর এর সুবাদেই প্রতিভাবান ক্লাউস ফকসের ডাক পড়ে ব্রিটিশ পারমাণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্প। এই প্রকল্প সাংকেতিকভাবে পরিচিত ছিলো ‘Tube Alloys’ নামে।

‘ Tube Alloys’ প্রজেক্টে কর্মরত বিজ্ঞানীদের একাংশ; ছবিসূত্র: amazonaws.com

ততদিনে ক্লাউস ফকস পেয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের নাগরিকত্বও। পাশাপাশি স্বাক্ষর করেছেন ‘অফিশিয়াল সিক্রেকটস এক্ট’, যেটিতে তিনি ইংল্যান্ডের পারমাণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্পের কাজ ও তথ্য কারো কাছে ফাঁস করবেন না বলে সম্মত হয়েছিলেন।

ডাক এলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে

১৯৪৩ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পর একদিকে তখন নাৎসি জার্মানিতে পারমাণবিক বোমা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে, অন্যদিকে আইস্টাইন-সাইলার্ড চিঠি পেয়ে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব পারমাণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্প ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা প্রকল্প ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’; ছবিসূত্র: atomicheritage.org/

মার্কিন এই প্রকল্পে সহায়তা করতে রাজি হয়েছিল ইংল্যান্ড। ব্রিটিশ পারমাণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্প ‘Tube Alloys’ এর একদল বিজ্ঞানী এরই অংশ হিসাবে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ক্লাউস ফকস ছিলেন এদেরই একজন ।

পদার্থবিজ্ঞানী থেকে গুপ্তচর হয়ে ওঠার দিনগুলো

জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে এসে বেশ একাকী হয়ে পড়েছিলেন ক্লাউস ফকস। কমিউনিস্ট মতাদর্শগুলো নিয়ে কথা বলার মতো কাউকেই হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এই পদার্থবিদ। তখনই তার সাথে দেখা হয় জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির আরেক সদস্য ইয়ুর্গেন কাজনস্কির সাথে। জার্মানি থেকে ব্রিটেনে আসা ইয়ুর্গেন তখন লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিক্স এর প্রফেসর। তার মাধ্যমেই ক্লাউস ফকসের সাথে যোগাযোগ হয় সিমন ডেভিডোভিচ ক্রেমার নামে সোভিয়েত দূতাবাসের এক সামরিক কর্মকর্তার সাথে। এই ক্রেমার ছিলেন সোভিয়েত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট। তার কাছেই ফকস সরবরাহ করতেন ব্রিটিশ পারমাণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্পের তথ্য। এভাবে তিনি জড়িয়ে পড়েন সোভিয়েত গুপ্তচরদের বৃত্তে। যুক্তরাষ্ট্রে যাবার পরে খনি থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে, তাকে বোমা তৈরির উপযোগী কীভাবে বানানো যেতে পারে সেটা নিয়ে তাত্ত্বিক কাজ করেন এই বিজ্ঞানী। পাশাপাশি অন্যান্য কোন বিজ্ঞানীদের কে কী করছেন, তার অনেক কিছুই জানা ছিলো তার। পাশাপাশি আমেরিকার প্রথম সফল পারমাণবিক বিস্ফোরণ ‘ট্রিনিটি টেস্ট’ এর সময় উপস্থিত ছিলেন এই বিজ্ঞানী।

ম্যানহাটনে প্রোজেক্টের লস আলমোস ল্যাবরেটরীতে কর্মরত থাকার সময়ে ক্লাউস ফকসের ব্যাজ; ছবিসূত্র: atomicheritage.org

এসব মূল্যবান তথ্যের বিশদ বিবরণ তিনি পাঠাতে থাকেন সোভিয়েত এজেন্টদের কাছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের পারমাণবিক বোমার গবেষণা নতুন মাত্রা পায়। ইতিহাসবিদদের গবেষণার তথ্য বলছে, ক্লাউস ফকস ম্যানহাটন প্রজেক্টের ৪০০ কোটি ডলার ব্যয়ে করা বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের অনেক তথ্যই ফাঁস করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে।

ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট

১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভেনোনা প্রজেক্ট থেকে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য যখন বেরিয়ে এসেছে তখন ক্লাউস ফকস ফিরে গেছেন ইংল্যান্ডে। যুদ্ধের পরপরই তিনি আবার ব্রিটিশ পারমাণবিক প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি তাকে নিযুক্ত করা হয় হারওয়েল এটমিক রিসার্চ প্রকল্পের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান হিসাবে। যুদ্ধের পরেও তার সাথে যোগাযোগ ছিলো সোভিয়েত গুপ্তচর আলেকজান্ডার ফেকলিসভের সাথে। কিন্তু ততদিনে এফবিআই নিশ্চিত যে ‘চার্লস’ নামের তথ্যপাচারকারী ব্যক্তিটি খ্যাতিমান পদার্থবিদ ক্লাউস ফকস ছাড়া আর কেউ নয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দাসংস্থা এমআই-৫ (MI5) তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের কাছে তিনি তার দোষ স্বীকার করেন। পাশাপাশি ব্রিটিশ কোর্টে তার জবানবন্দী থেকে এই কাণ্ডে জড়িত থাকা বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ছিলো তার পাচারকৃত তথ্যের বাহক হ্যারি গোল্ড, ডেভিড গ্রিনগ্লাস, জুলিয়াস আর ইথেল রোসেনবার্গ।

ক্লাউস ফকসের সাজার খবর; ছবিসূত্র: historicalnews.com

১৯৫০ সালে ব্রিটিশ আদালত ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস এক্ট’ লংঘনের দায়ে ক্লাউস ফকসকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দেয়। তবে ৯ বছর কারাদন্ড ভোগের পরে ১৯৫৯ সালের ২৩ জুন তাকে পূর্ব জার্মানি যেতে দেওয়া হয়।

আবার জন্মভূমিতে

কমিউনিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত পূর্ব জার্মানি তাকে সম্মানের সাথেই বরণ করে। তাকে নিয়োজিত করা হয় ‘সেন্ট্রাল ইন্সটিউট অভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ এর সহকারী পরিচালক হিসেবে। ইস্ট জার্মান একাডেমি অভ সাইন্সের ফেলোও নির্বাচিত হন ব্রিটেনফেরত এই বিজ্ঞানী। ১৯৮৮ সালে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ক্লাউস ফকসের সমাধি ; ছবিসূত্র: commons.wikimedia.org

১৯৭৯ সালে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ক্লাউস ফকসকে পূর্ব জার্মানির সর্বোচ্চ সম্মান ‘কার্ল মাক্সস মেডেল অভ অনার’ দিয়ে সম্মানিত করে।

ফিচার ছবিসূত্র: ralf-heiser.info

Related Articles