Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য মারকিউরি: অতীতের চোখে দেখা ভবিষ্যতের রেলগাড়ি

অতীতের ট্রেন বা রেলগাড়ি বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল ধোঁয়ার মেঘ ওড়ানো কালো রঙের লোহার কোনো যন্ত্রদানবের কথা। চ্যাপ্টা নাক আর সূচাল দাঁতের মতো কাউক্যাঁচার মিলিয়ে সেই রেলগাড়ির চেহারার মাঝেই কেমন একটা ভীতি সৃষ্টিকারী ভাব থাকত।  কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- দ্য মারকিউরি নামের ট্রেনটি সেই জবড়জং রেলগাড়ির আমলে তৈরি হলেও এর চেহারা থেকে শুরু করে ভেতরের চেহারা সবকিছুতেই ছিলো ভবিষ্যতের ছোঁয়া। 

১৯৩৬ সালে নির্মিত দ্য মারকিউরি পরিচিত ছিল ‘ট্রেন অব টুমরো’ নামে। এর চোখধাঁধানো ডিজাইন সেসময়ের মানুষকে যেমন বিস্মিত করত, তেমনি বিস্মিত করে চলছে আধুনিক সময়ের মানুষকেও। তবে ‘ভবিষ্যতের’ চেহারা দেয়া যানবাহন নির্মাণের নজির যে মারকিউরি নির্মাণের আগেও ছিল না সেরকম নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় গাড়ি এবং রেলগাড়িকে নানাভাবে আধুনিক চেহারা দেবার চেষ্টা করেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ সফল হননি। 

মারকিউরি ট্রেনের সম্মুখভাগ; Image Source: american-rails

মারকিউরির নকশাকারী হেনরি ড্রেফাস সেসব পুরনো ধারণা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের মতো করে তৈরি করেন ইতিহাসখ্যাত এই রেলগাড়ির ডিজাইন। তবে মারকিউরি নির্মাণের শুরুটা খুব একটা সুবিধার ছিল না তার জন্য। এজন্য দায়ী অবশ্য তার ডিজাইন না, বরং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা। 

গ্রেট ডিপ্রেশনের ঠিক পরবর্তী সেই সময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ লগ্নি করার মতো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। রেলপথ পরিচালনার জন্য যে সকল সংস্থা কাজ করত, তাদের অনেকগুলোর অবস্থাই তখন বেশ নাজুক। নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেইলরোড পরিচালকরা ক্লিভল্যান্ড থেকে ডেট্রয়েট পর্যন্ত চলাচলের জন্য নতুন ট্রেন যুক্ত করার কথা ভাবছিলেন। সেই অনুযায়ী হেনরি ড্রেফাসকে বলা হয় ভিন্ন ধারার নতুন কোনো নকশা প্রস্তুত করতে। 

ড্রেফাস ছিলেন সেসময়ের বিখ্যাত একজন নকশাকারক, যিনি মারকিউরি ছাড়াও আরো নানা যন্ত্রাংশের নকশার জন্যে প্রসিদ্ধ। বহু খাটাখাটনি করে তিনি এবং তার ডিজাইনার টিম ‘ভবিষ্যতের’ ট্রেনের একটি নকশা তৈরি করেন। দুর্বার গতি আর যুগান্তকারী নকশার অনন্য সংমিশ্রণে কল্পনা করা এই রেলগাড়ির নাম ঠিক করা হয় রোমান দেবতা মারকিউরির নামানুসারে। নকশাটি নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেইলরোড পরিচালকরা পছন্দ করলেও নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি হয়ে যাবে বিধায় পুরো প্রজেক্ট তারা বাতিল করে দেন। 

শুরুতেই এমন হোঁচট খেয়ে ড্রেফাস সেদিনের জন্য কাজ বন্ধ করে নির্জন কোথাও সময় কাটিয়ে আসবেন বলে পরিকল্পনা করেন। ট্রেনে চেপে যেতে যেতে তিনি চিন্তা করছিলেন কীভাবে তার ডিজাইন করা রেলগাড়ির নির্মাণ খরচ কমিয়ে আনা যায়। এ কথা ভাবতে ভাবেতেই ট্রেন একসময় মট হ্যাভেনের রেইলরোড ইয়ার্ডে এসে থামে। 

মারকিউরি ট্রেনের বিজ্ঞাপন; Image Source: Wikipedia 

সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশের দশকের কিছু রেলগাড়ির কামরা তার নজর কাড়ে। মাথায় বইতে থাকা চিন্তার ঝড় যেন হঠাৎ করেই থেমে যায়। নির্জনে সময় কাটানোর চিন্তা বাদ দিয়ে ফিরতি ট্রেন ধরে সোজা নিউ ইয়র্কে সেন্ট্রাল রেইলরোড অফিসে ফিরে আসেন ড্রেফাস। উপস্থিত পরিচালক কমিটিকে তিনি জানান- ট্রেন নির্মাণের খরচ কমানোর উপায় হবে নতুনভাবে রেলগাড়ি নির্মাণ না করে পুরাতন রেলগাড়িকে নতুন রূপ দিয়ে। 

নির্মাণব্যয় কমে আসায় ড্রেফাসের পরিকল্পনা এবার অনুমোদন এবং বরাদ্দকৃত অর্থ পেয়ে যায়। পুরোদমে মারকিউরি নির্মাণের কাজ শুরু হয় ইন্ডিয়ানাতে অবস্থিত ইন্ডিয়ানাপোলিস রেল কারখানাতে। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয় ইঞ্জিনের সাথে সাতটি কোচ যুক্ত করে নির্মাণ করা হবে ট্রেন। 

বেশ ছিমছাম, পরিপাটি চেহারা দেবার পরিকল্পনা করা হয় মারকিউরিকে। দু’রঙা ধূসর আর অ্যালুমিনিয়াম ট্রিম করা ট্রেনের প্রতিটি কামরার দু’পাশে জুড়ে দেয়া হয় ট্রেনের জন্যে বিশেষভাবে নির্মাণ করা লোগো। এক কামরা থেকে অন্য কামরার মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনা হয়, বগি সংযোজনের ব্যবস্থাতেও আনা হয় পরিবর্তন। 

সে সময়ের সাধারণ ট্রেনের পাশে মারকিউরি; Image Source: George Blount photo

মারকিউরির ইঞ্জিন হিসেবে বেছে নেয়া হয় সেসময় সাধারণ যাত্রীসেবায় নিয়োজিত কে-ক্লাস ৪-৬-২ ইঞ্জিনকে। নিউ ইয়র্কের আলবানিতে নির্মিত এই ইঞ্জিন ছিলো ‘প্যাসিফিক টাইপ’-এর। শক্ত ধাতব মুখোশ আঁটা একচোখা কোনো যোদ্ধার মতো দেখতে সেই ইঞ্জিন পুরোটাই ঢাকা ছিল ধাতব পাত দিয়ে। এর নিচেই ঢাকা পড়ে যায় ট্রেনের এক্সটেরিয়র পাইপ, কাউ ক্যাচার আর অন্য সব ফিটিং। 

কিন্তু তারপরেও সেখানেই ক্ষান্ত দেননি ড্রেফাস। আরো নতুনত্ব আনার উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনের চাকা আর রেইলরডগুলো উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। উন্মুক্ত সেই চাকায় তিনি যুক্ত করেন বৈদ্যুতিক বাতি, যেন রাতের অন্ধকারে চলন্ত ট্রেনের চাকার ঘূর্নন দূর থেকেই সবাই দেখতে পায়। 

গতানুগতিক সাধারণ ট্রেন থেকে আলাদা করার জন্যে প্রতিটি প্যাসেঞ্জার বগিতেও আনা হয় বিশেষ পরিবর্তন। ছিমছাম পরিপাটি চেহারা দিতে ড্রেফাস আসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন করেন। গ্রুপে চলাচলকারী যাত্রী এবং একা চলাচলকারী যাত্রীদের জন্যে তৈরি করেন আলাদা ধরনের আসন ব্যবস্থা।

ড্রেফাসের মুন্সিয়ানার ছাপ দেখা যায় প্রতিটি কামরার ভেতরের রঙ থেকে কার্পেটিং, সিল করা জানালা, আলো চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থাসহ সবকিছুতে। তিনি মারকিউরিতে যোগ করেন সেসময়ের আধুনিকতম সংযোজন (যা সেসময়ের দামী অন্য রেলগাড়িতেও ব্যবহৃত হতো)- এয়ার কন্ডিশনার বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।  

নিউ ইয়র্কের পথে মারকিউরি; Image Source: american-rails.com

এই ট্রেনে ছিল একটি পার্লার, ডাইনার, এমনকি যাত্রীদের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে দেবার জন্যে গোলাকৃতির অবজারভেশন কার। সেখানে মাঝে বসার স্থানে ছিল স্পিডোমিটার, যেন যাত্রীরা মনোরম পরিবেশের সাথে ট্রেনের গতিও দেখে নিতে পারে। রান্নার ঘর আর খাবার ঘরকে ড্রেফাস নিয়ে যান ট্রেনের একেবারে পেছনে। প্রতিটি কোচ সেকশনে ছিল ধূমপানের কামরা।

১৯৩৬ সালের ২৫ জুন প্রথমবারের মতো যাত্রা করে মারকিউরি। নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেইলরোডের যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, অর্থাৎ নতুন যাত্রীদের আকৃষ্ট করা, তাতে পুরোপুরি সফল হয় মারকিউরি। দ্রুতই মানুষ এই অবাক করা ভবিষ্যতের রেলগাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়। 

শুরুর কয়েকমাস নিউ ইয়র্কের নানা রুটে ঘোরাঘুরির পর অবশেষে ক্লিভল্যান্ড থেকে ডেট্রয়েটের রেলপথে যুক্ত করা হয় মারকিউরিকে। প্রথম বছরেই ট্রেনটি ১,১২,০০০ যাত্রী পরিবহন করে। এর সফলতার কারণে এক বছর পূর্তিতে মারকিউরিতে আরো দুটি কামরা যুক্ত করা হয়। এবং এর জনপ্রিয়তার ধারা অব্যাহত থাকায় ১৯৩৯ সালে একই সিরিজের আরো দুটি ট্রেন নির্মাণ করা হয়। 

মারকিউরি বিষয়ক লেখা ও ট্রেনের নকশা; Image Source: Wikipedia

শিকাগো এবং সিনসিনাটির মাঝে চলাচলকারী সেই রেলগাড়িগুলো দেখতে মূল মারকিউরি থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। প্রবল বিক্রমে মারকিউরি ট্রেন চলতে থাকে নিউ ইয়র্কের রেলপথ কাঁপিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন প্রযুক্তি আসতে শুরু করায় ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে ট্রেন ফ্রম ফিউচারের আকর্ষণ। শিকাগো এবং সিনসিনাটির রেলগাড়িগুলো বন্ধ হয়ে যায় পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে। অবশেষে ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে ড্রেফাসের নকশায় তৈরি মূল ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটে মারিকিউরি যুগের।

Related Articles