Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভিনগ্রহের এক জাদুকর এবং কিছু অজানা কথা

যদি ফুটবল মাঠ হয় একটি বিশাল ছবি আঁকার ক্যানভাস, আমি বলবো মেসি তার পিকাসো! যদি ফুটবল মাঠ হয় একটি বিশাল নাট্যমঞ্চ, আমি বলবো মেসি তার শেক্সপিয়ার! যদি ফুটবল খেলা হয় সাহিত্যকর্ম, আমি বলবো মেসি তার রবীন্দ্রনাথ! যদি ফুটবল খেলা হয় মুষ্টিযুদ্ধ, আমি বলবো মেসি তার মোহাম্মদ আলী! যদি ফুটবল খেলা হয় গ্রিক দেবতাদের লড়াই, আমি বলবো মেসি তার জিউস!

হ্যাঁ, লিওনেল মেসির প্রশংসা করতে গেলে আপনাকে এসব উপমার সাহায্য নিতেই হবে। মেসি কে নিয়ে কিছু লিখতে চান? অভিধান জানা আছে তো ঠিকমত? না থাকলে সেই কাজ আপনাকে দিয়ে হবে না। কেননা অভিধানের শব্দ ভান্ডারে টান পড়ে যায় তাকে নিয়ে লিখতে গেলে!

১৯৮৭ সালের ২৪ জুন মধ্যরাতের কথা। আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের সান্তাফে অঙ্গরাজ্যে তখন শুনশান নীরবতা নেমে এসেছে। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল ইটালিয়ানো হসপিটালের দশ নম্বর রুমে জেগে আছে ইস্পাত ব্যবসায়ী হোর্হে হোরাসিও মেসি এবং তার স্ত্রী, খন্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মী সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি এবং কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স। কিছুক্ষণ পরেই সেই রুমে আকাশ থেকে খসে পড়ল একটি তারা। ভাবছেন এ আবার কী গাঁজাখুরি গল্প! তবে জেনে নিন- সেই তারার নাম হচ্ছে লিওনেল মেসি! এবার বিশ্বাস হলো তো?

মেসির পৈতৃক পরিবারের আদি নিবাস ছিল ইতালির আকোনা শহরে। কোনো এক এঞ্জেলো মেসি নামের পূর্বপুরুষ আর্জেন্টিনায় চলে আসলে তারা সেখানেই বসবাস করতে থাকে। মেসির বড় দুইভাই রদ্রিগো ও মাতিয়াস এবং ছোট বোন মারিয়া সল। পাঁচ বছর বয়সেই গ্রান্দোলি নামক লোকাল ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন মেসি যার কোচ ছিল তারই বাবা হোর্হে। ৮ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন স্থানীয় ক্লাব ‘নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ’-এ। ক্লাবটি এতটাই প্রতিভাবান ছিল যে এর পরের চার বছরে তারা মাত্র একটি ম্যাচ হেরেছিল! তাদের এই বিস্ময়কর রেকর্ডের জন্য পরবর্তীতে তারা পরিচিত হন ‘দ্য মেশিন অব ৮৭’ নামে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে মেসির বয়স যখন ১১, তখন তার শরীরে গ্রোথ হরমোনের সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয় ক্লাব রিভার প্লেট তার প্রতি আগ্রহ দেখালেও তার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। মেসির ভক্তরা এ পর্যন্ত পড়ে আবার রিভার প্লেটকে গালি দিবেন না যেন। কেননা তারা সেদিন মেসির ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হলে মেসির গল্পটা যদি অন্যরকম হয়ে যেত! হ্যাঁ, রিভার প্লেটের অনাগ্রহের কারণেই তো এগিয়ে আসে বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্সাস। মেসির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তিনি মেসির বাবার সাথে মেসিকে বার্সেলোনার ইয়ুথ একাডেমীতে ভর্তি করালে মেসির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবেন, এই মর্মে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তাই রিভার প্লেট গালির বদলে ধন্যবাদ পেতেই পারে! মজার ব্যাপার হলো, মেসির বাবার সাথে রেক্সাস যখন চুক্তি করেন, তখন হাতের কাছে কোন কাগজ না পেয়ে একটি ন্যাপকিন পেপারেই চুক্তি সই করেন!

২০০০ সাল থেকে মেসির ক্যারিয়ার শুরু। সে বছর তিনি জুনিয়র র‍্যাঙ্কে খেলা শুরু করেন। ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে তিনি ইয়ুথ একাডেমীতে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ২০০৩-৪ মৌসুমে তিনি একাডেমীর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে খেলেন! ক্লাবের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সেই বছর তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিল বার্সেলোনা। এবারো তার বার্সায় থেকে যাবার জন্য আপনি আরেকজন ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানাবেন। তিনি হচ্ছেন সেস্ক ফাব্রিগাস। ক্লাবে প্রশিক্ষণ কমিটির অনুরোধে তাকে রেখে শেষ পর্যন্ত ফাব্রিগাসকে ছেড়ে দেয় বার্সা।

পরের বছরই অবিরাম ভাল খেলে যাবার পুরষ্কার পান মেসি। ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর এস্পানিওল এর বিপক্ষে লা লীগায় অভিষেক হয় মেসির। পরের বছর আলবেসেতের বিপক্ষে বার্সার হয়ে লা লীগার ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে গোল করেন মেসি। পরবর্তীতে বোয়ান কিরকিচ এই রেকর্ড ভেঙে দেয়। মজার ব্যাপার হলো কিরকিচের সেই গোলটিও আসে মেসির পাস থেকেই। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে স্প্যানিশ নাগরিকত্ব লাভ করলে চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলার সুযোগ পান মেসি। সে মৌসুমে লা লীগায় ১৭ ম্যাচে ছয় গোল এবং চ্যাম্পিয়নস লীগে ৬ ম্যাচে এক গোল করেন মেসি।

জারাগোজার বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক গোল করেন মেসি; ছবিসূত্রঃ www.imscouting.com

২০০৬-০৭ মৌসুমে মেসি নিজেকে দলে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২৬ ম্যাচে ১৪ গোল করে দলে নিজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করান। তবে গোল সংখ্যার চেয়েও যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হচ্ছে সে মৌসুমে এল ক্লাসিকোতে মেসির গোল পাওয়া। বার্সেলোনার চির প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে হ্যাট্রিক করে তিনি জানিয়ে দেন যে সময় এবার তার। ম্যাচটি ড্র হয়েছিল ৩-৩ গোলে। প্রতিবারই বার্সা গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ছিল আর প্রতিবারই ত্রাতা হয়ে আসছিলেন মেসি। সেই ম্যাচের পরই সকলের চোখে পড়তে থাকেন মেসি। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা সত্যিকারের উচ্চতা পায় গেটাফের বিপক্ষে এক চোখ ধাঁধানো গোলে। গোলটি এতোটাই চমৎকার ছিল যে সেটিকে শতাব্দীর সেরা ম্যারাডোনার সেই গোলটির সাথে তুলনা করেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বলেন মেসি সেই গোলটি বর্তমান শতাব্দীর সেরা গোল। গোলটি করতে মেসি ৬২ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন এবং পরাস্ত করেছিলেন ছয় জন খেলোয়াড়কে যার মধ্যে গোলকিপারও ছিল। আর এই বিষয় গুলো হুবহু মিলে যায় ম্যারাডোনার ৮৬’র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক গোলের সাথে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, অনেকে তার নাম রাখেন ‘মেসিডোনা’!

পরের বছর মেসি ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে তার শততম ম্যাচ খেলতে নামেন। সেই বছরই তিনি প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি অর এবং ফিফা বর্ষসেরা পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। কিন্তু সব মিলিয়ে সেই মৌসুমটি মেসির কেটেছিল দুঃস্বপ্নের মতোই। কেননা ইঞ্জুরির কারণে সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সেবার ম্যাচ খেলেছিলেন মাত্র ১৩টি।

২০০৮-০৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ের উদযাপন করছে বার্সেলোনা; ছবিসূত্রঃwww.dailymail.co.uk

২০০৯ সাল থেকেই মেসির রকেট গতিতে এগিয়ে চলা শুরু হয়। সে বছর মেসি সর্বমোট ৩৮ গোল নিয়ে মৌসুম শেষ করেন। গোলে সহায়তা করেন ১৮টি। তার এই অবিশ্বাস্য সাফল্য বার্সেলোনাকে এনে দেয় লা লীগা এবং কোপা দেল রে এর শিরোপা। অন্যদিকে চ্যাম্পিয়নস লীগে ৮ গোল করে বার্সেলোনার খেলোয়াড় হিসেবে এক মৌসুমে রিভালদোর সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটি ভেঙে দেন। সাথে বার্সাকে জেতান চ্যাম্পিয়নস লীগও। ফলে প্রথমবারের মতো কোনো স্প্যানিশ দল হিসেবে ট্রেবল শিরোপা জয়ের রেকর্ড করে বার্সেলোনা। হাঁপিয়ে গেলেন কি বার্সার জয়রথ দেখে? হাঁপালে চলবে না। কেননা বছরের শেষে এস্তেদিয়েন্তেসকে হারিয়ে ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফিটাও ঘরে তোলে বার্সা। অন্যদিকে সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে বার্সার হয়ে ব্রাজিলীয়ান গ্রেট রোনালদোর করা ৪৬ গোলের রেকর্ডে ভাগ বসান মেসি।

সবকিছু মিলিয়ে একটি অসাধারণ বছর পার করার পর মেসি যেন ঠিক করলেন এবার অন্য কিছু করা যাক। তাই ২০১০ মৌসুমকে বানালেন হ্যাট্রিকের বছর। হ্যাট্রিক করা যেন তার কাছে ডাল ভাত। মৌসুমের শুরুতেই টানা তিন ম্যাচে হ্যাট্রিক করে লা লীগার ইতিহাসে একটানা হ্যাট্রিক করার রেকর্ড করেন। অর্সেনালের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লীগের একটি ম্যাচে তো চার গোলই করে বসেন! তার পা থেকে গোল আসবে সেটাই যেন নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে ততদিনে।

প্রতিপক্ষের নিকট ততদিনে ত্রাস বনে যাওয়া এই বা পায়ের জাদুকর সেইবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের বিপক্ষে ছিলেন আরও ক্ষুরধার। কোপা দেল রের ফাইনালে সেবার রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয় আগের বারের চ্যাম্পিয়ন বার্সা। মেসি যদিও গোল করেছিলেন, রিয়াল ম্যাচটি জিতে যায়। কিন্তু টুর্নামেন্টে সাত গোল করে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সাথে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। ঘরোয়া লীগে গোল করার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লীগে উভয় লেগে গোল করে একাই রিয়ালকে ২-০ গোলে হারিয়ে প্রতিযোগিতার বাইরে ছিটকে দেন। ফাইনালেও তিনি জয়সূচক গোল করেন। তার জাদুতেই মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ৩য় ইউরোপ শিরোপা ঘরে তোলে বার্সা। সবমিলিয়ে ৫৩ গোল এবং ২৪ এসিস্ট নিয়ে মৌসুম শেষ করেন তিনি।

প্রত্যেক মৌসুমে নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যচ্ছিলেন আর্জেন্টাইন বিস্ময় মেসি। নিজেই যেন হয়ে ওঠেন নিজের প্রতিযোগী। প্রতিটি মৌসুমেই একের পর এক রেকর্ড ভেঙে নিজের নাম লেখাতে থাকেন মেসি। হ্যাট্রিক আর কোয়াড্রুপলও যখন তার নিকট পান্তা ভাত হয়ে গেছে, তখন তিনি চ্যাম্পিয়নস লীগে বায়ার্ন লেভার্কুসেনের বিপক্ষে একাই পাঁচ গোল করে ইতিহাস গড়েন। ২০১১-১২ মৌসুমটি যদিও বার্সেলোনার জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না, তবুও মেসি ছিলেন আপন প্রতিভায় উজ্জ্বল। লা লীগা এবং চ্যাম্পিয়নস লীগ উভয় শিরোপাই বার্সার হাতছাড়া হয়ে যায়। কেবল কোপা দেল রে-তে শিরোপা ধরে রাখে তারা। কিন্তু মেসি রেকর্ড গড়েই চলেছেন। লা লীগার এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৫০ গোল করার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লীগেও এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৪ গোল করার রেকর্ড করেন। এই মৌসুম শেষ করেন ৭৩ গোল আর ২৯ এসিস্ট নিয়ে!

যদি কেউ আপনাকে বলে সে সমুদ্রের ঢেউ গুণে শেষ করবে, আপনি তাকে নিঃসন্দেহে পাগল বলবেন। ঠিক তেমনিভাবে মেসির রেকর্ড বলে শেষ করার মতো পাগলামী আমি করবো না। রেকর্ড তো তার নিকট শ্বাসপ্রশ্বাস এর মতোই স্বাভাবিক! তবে যেসব রেকর্ডের কথা না বললেই নয়, সেগুলো নিয়ে বলা যেতেই পারে। এই যেমন ২০১২ সালে এক পঞ্জিকাবর্ষে ৯১ গোল করার রেকর্ড করেন মেসি। এর আগে এই রেকর্ডটি ছিল জার্ড মূলারের যিনি করেছিলেন ৮৫ গোল। ২০১৩ সালে তো তিনি আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করেন। লা লীগায় টানা উনিশ ম্যাচে জাল খুঁজে পাবার বিস্ময়কর কীর্তি গড়েন ক্ষুদে জাদুকর মেসি! একের পর এক ইঞ্জুরিতে পড়ে সেবছর খুব একটা খেলতেই পারেননি তিনি। ২০১৪ সালটা নিজের গড়ে দেয়া স্ট্যান্ডার্ড এর চেয়ে খারাপ যায় তার জন্য।

২০১৫ সালেই আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন তিনি। সেই মৌসুমে নেইমার আর সুয়ারেজের সাথে মিলে ৫৮ গোল করেন মেসি। আর ‘এমএসএন’ ত্রয়ীর মোট গোল হয় ১২২টি! পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে লা লীগায় নিজের ৩০০ তম গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন মেসি। একই বছর এপ্রিলে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে ব্যক্তিগত ৫০০ গোলের ঈর্ষণীয় মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন তিনি। ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৪১ গোল ও ২৩টি এসিস্ট করেন মেসি।

ক্লাব ফুটবলে যার পায়ে গড়াগড়ি খায় সম্ভাব্য সকল রেকর্ড, সেই মেসিই জাতীয় দলের হয়ে বেশ সাদামাটা। ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল হাঙ্গেরির বিপক্ষে এক বিতর্কিত লাল কার্ড দেখে। প্রথম ম্যাচেই মাত্র দুই মিনিটেই লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাই যেন অনেক দিন বয়ে বেড়ান তিনি। আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে নিজের প্রথম গোল করেন ২০০৬ সালের মার্চে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে। সে বছর বিশ্বকাপেও দলে ডাক পান মেসি। তিনটি ম্যাচে বদলি হিসেবে মাঠে নামার সুযোগ পান এবং একটি গোলও করেন। আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির সাথে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়।

পরের বছর কোপা আমেরিকায় মেসির নৈপুণ্যে হেসে খেলে ফাইনালে উঠে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হেরে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। টুর্নামেন্টে দুই গোল এবং দুই এসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন মেসি। ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আর ব্যর্থ হননি মেসি। টুর্নামেন্টে তিন গোল করে দলকে এনে দেন স্বর্ণপদক। আর ব্রাজিলকে সেমি ফাইনালে হারিয়ে আগের বছরের কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারার প্রতিশোধটাও খুব ভাল করেই নেন!

এরপরই জাতীয় দলে যেন অতলে তলিয়ে যান মেসি। ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ১৮ ম্যাচের মাত্র ৩টিতে জাল খুঁজে পান বাম পায়ের এই জাদুকর। সে বছর বিশ্বকাপে জাতীয় দলের হয়ে তার গোল করতে না পারাটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বিশ্বকাপ জুড়ে মাত্র তিনটি এসিস্ট করেন মেসি। কিন্তু জাল খুঁজে পাননি একবারও। ফলে কোচ ম্যারাডোনার অধীনে বিশ্বকাপে যাওয়া আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হেরে বাদ পড়ে।

২০১০ থেকে ২০১৪, এই সময়কালে মেসি তার ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল তম সময় পার করেন বার্সেলোনার জার্সি গায়ে। কিন্তু স্বদেশের হয়ে ততটা কার্যকর না হতে পারায় প্রতিনিয়তই তাকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে। ২০১১ কোপা আমেরিকায়ও আকাশসম প্রত্যাশা ছিল মেসির কাছে যা তিনি পূরণে ব্যর্থ হন। টুর্নামেন্টে তিনি কোনো গোল করতে পারেননি এবং যথারীতি আর্জেন্টিনা কোনো দৃশ্যমান সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।

২০১৪ বিশ্বকাপই সম্ভবত লিওনেল মেসির জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনের মঞ্চ তৈরী করে দিয়েছিল। গ্রুপ পর্বে তার অসাধারণ পারফর্ম্যান্সে আর্জেন্টিনা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে যায়। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যচে চারবার জাল খুঁজে পান মেসি। ফলে উজ্জীবিত আর্জেন্টিনা স্বপ্ন দেখছিল ৮৬’র পর আরও একটি বিশ্বকাপ জয়ের। কিন্তু আফসোস! সেমিফাইনাল থেকেই ছন্দ হারান মেসি। যদিও সেমির ম্যাচটি টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় আর্জেন্টিনা, দলের প্রাণভোমরা মেসি যে হারিয়ে খুঁজছেন নিজেকে। ফল যা হবার তাই হলো। আরও একবার বিশ্ব আসরে জার্মানির কাছে হারলো আর্জেন্টিনা। আর এক প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড় মেসি কাছে এসেও বিশ্বকাপ হাতে না তুলতে পারার হতাশায় নিমজ্জিত হলেন। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার, গোল্ডেন বল পাওয়াটা তাই তার কাছে যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতোই হয়েছিল।

২০১৫ কোপা আমেরিকায় মেসির খেলায় ভর করে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। ভাগ্যবিধাতা যেন ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি প্রতিবার মেসিকে চ্যাম্পিয়ন হবার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবেন ঠিকই কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবার স্বাদ আস্বাদন করতে দেবেন না। তাই তো ফাইনালে চিলির কাছে পেনাল্টি শ্যুটআউটে হেরে শিরোপা বঞ্চিত হয় আর্জেন্টিনা। পরের বছর কোপা আমেরিকার শতবর্ষী আসরেও ফাইনালে চলে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু বিধিবাম, ফাইনালে আবারো সেই চিলির সাথে হেরে জাতীয় দলের হয়ে নিজের প্রথম বড় কোনো সাফল্যের স্বাদ নেয়া থেকে আরও একবার কাছে গিয়ে ফিরে আসেন মেসি।  প্রহসনের ব্যাপার হলো, সেই ম্যাচে টাইব্রেকারে হারে আর্জেন্টিনা এবং প্রথম শ্যুটই মিস করেন মেসি নিজে! পরপর তিনটি বড় টুর্নামেন্টের শিরোপার কাছে গিয়ে ফিরে আসার মানসিক যন্ত্রণা তাকে এতোটাই পীড়া দেয় যে, তিনি জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন! তবে আশার ব্যাপার হলো অবসর ঘোষণার মাত্র দুই মাসের মাথায় ভক্তদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আবার জাতীয় দলে ফেরেন এই ফুটবল গ্রেট। যদিও পরে তার স্বদেশী কিংবদন্তী ম্যারাডোনা তার অবসরে যাওয়াকে ব্যক্তিত্বহীনতা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন!

বদান্যতার জন্য মেসির সুনাম আছে যথেষ্ট। ২০০৭ সালে তিনি দুস্থ শিশুদের জন্য ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা চালু করেন। ২০১০ সালে তিনি ইউনিসেফের ‘গুডউইল দূত’ মনোনীত হন। ২০১৩ সালে তিনি একটি শিশু হাসপাতালে ছয় লক্ষ ইউরো দান করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে মেসি মিডিয়ার আড়ালে থাকতেই ভালবাসতেন। তার বর্তমান বান্ধবী এন্তোনেলা রোকাজ্জোর সাথে স্থির হবার আগে তার বেশ কিছু প্রেম ছিল। আর্জেন্টাইন গ্ল্যামারাস মডেল লুসিয়ানা স্যালাজার সাথেও তার প্রণয় ছিল কিছুদিন। তবে রোকাজ্জোর সাথে তাকে প্রথম দেখা যায় একটি বার্সা-এস্পানিওল ডার্বির সময়। ২ নভেম্ভর ২০১২ সালে মেসি-রোকাজ্জো দম্পতির ঘরে প্রথম সন্তান থিয়াগোর জন্ম হয়। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মেসি তার দ্বিতীয় সন্তান মাতিও এর বাবা হন এবং ২০১৮ সালের তৃতীয় ছেলে সিরোর জন্ম হয়। খেলোয়াড়ি জীবনে সফলতার পাশাপাশি ব্যাপক অর্থ সম্পদের ও মালিক হন মেসি। 

মেসির কিছু বিশেষ রেকর্ড

  • সর্বোচ্চ সাতবার ফিফা ব্যালন ডি অর জয়।
  • টানা এগারো মৌসুমে ৪০ এর অধিক গোল।
  • ফিফা প্রো বিশ্ব একাদশে রোনালদোর সাথে সর্বোচ্চ ১৫ বার মনোনয়ন।
  • একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ছয়টি ভিন্ন ক্লাব প্রতিযোগিতায় একই মৌসুমে গোল করা।
  • এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ ৯১ গোল করার রেকর্ড।
  • টানা ২১ ম্যাচে গোল (৩৩) করার রেকর্ড।
  • একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে লীগের সকল দলের বিপক্ষে টানা গোল করার রেকর্ড।

লিওনেল মেসির সম্বন্ধে কিছু তথ্য যা আপনি না জেনে থাকতে পারেন

  • মেসি জন্মসূত্রে আর্জেন্টাইন এবং পরে স্পেনের নাগরিকত্ব পেলেও তার পূর্বপুরুষরা ইতালিয়ান!
  • আর্জেন্টিনার বৈপ্লবিক নেতা চে গুয়েভারা যে শহরে (রোজারিও) জন্মগ্রহণ করেন, মেসিও সেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি তার জন্মের শহর রোজারিওর আন্তর্জাতিক দূত।
  • ম্যারাডোনার মতো তারও রয়েছে ‘হ্যান্ড অব গড’।২০০৬ সালে তিনি রিক্রিয়েটিভো নামের একটি দলের সাথে হাত দিয়ে গোল করেন!
  • মেসি তার বাঁ কাঁধে তার মায়ের ছবি ট্যাটু করিয়েছেন।
  • চ্যাম্পিয়নস লীগে তার সর্বোচ্চ সংখ্যক হ্যাট্রিক রয়েছে।
  • খাবারের প্রতি তার রয়েছে অত্যাধিক ঝোঁক। তার প্রিয় খাবার এস্কাওপে মিলানিজ।

মেসির বর্তমান মৌসুম নিয়ে কিছুই বলা হলো না। বল হলো না তার আরও অনেক রেকর্ড নিয়ে। থাকুক না কিছু কথা না বলা। যখন নামটি হয় লিওনেল মেসি, তখন তাকে নিয়ে বলে শেষ করা কি আদৌ সম্ভব? আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির মতোই তিনি জ্বলজ্বল করছেন। তাকে নিয়ে আরো কতশত লেখা হবে তার কি ইয়ত্তা আছে? তাকে নিয়ে লিখবার জন্য লেখকের অভাব হবে না, কলমের কালির অভাব হতেই পারে। তিনি অনন্য। তিনি অসাধারণ। তিনি কোটি মানুষের ভালবাসা। তিনিই লিওনেল মেসি।

তথ্যসূত্র

১)  en.wikipedia.org/wiki/Lionel_Messi

২) thefamouspeople.com/profiles/lionel-messi-5242.php

৩) fourfourtwo.com/news/messi-has-no-personality-maradona

৪) sportskeeda.com/football/lionel-messi-world-records-barcelona-superstar/5

The article is about som known-unknown facts of Leo Messi. Lionel Andrés Messi Cuccittini is an Argentine professional footballer who plays as a forward and captains both Barcelona and the Argentina national team.

Related Articles