Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্পার্টাকাসের মস্কো অথবা মস্কোর স্পার্টাকাস

মস্কোর স্পার্তাক স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের দুই প্রান্তে দুটো গোলপোস্ট। একদিকে কোনো বৈচিত্র্য নেই, সবকিছুই সাদামাটা। কিন্তু অন্যদিকে চোখ ফেরালেই চোখজোড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যাবে আপনার। গোলপোস্টের ঠিক পাশেই চারজন মানুষের ভাস্কর্য। দুজন বসে আছেন, তাদের মাঝখানে রাখা একটি ফুটবল। হাত নেড়ে কিছু একটা বলছেন একজন, অপরজন মনোযোগী শ্রোতা। বাকি দুজন দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন আশপাশটা। হাতে যেন প্রচুর সময়, কোনো তাড়া নেই।

তারা চারজন; Source:futbolgrad.com

স্টেডিয়ামে ভাস্কর্য থাকে। অনেক স্টেডিয়ামেই আছে। কিন্তু তা সাধারণত থাকে স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখে। কিন্তু এ যে স্টেডিয়ামের ভিতরে, এমনকি গোলপোস্টেরও পাশে। কারা এরা? কেনইবা এদের ভাস্কর্য এখানে?

এর পিছনে রয়েছে চমকপ্রদ এক ইতিহাস। আজকের স্পার্তাক মস্কো ক্লাব শুরু হয়েছিল এদের হাত ধরেই। এরা ৪ ভাই। নিকোলাই, আলেক্সান্দর, আন্দ্রে ও পিতর; সংক্ষেপে স্টারোস্টিন ব্রাদার্স। কোনো না কোনো খেলার সাথে জড়িত ছিলেন প্রত্যেকেই। তবে বড় ভাই নিকোলাই স্টারোস্টিন ছিলেন সব থেকে সরেস। ফুটবল আর আইস হকি দুটোই খেলতেন সমান তালে। এমনকি এই দুই খেলাতে দেশটির প্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি।

উপরে বাম থেকে আলেক্সান্দর ও নিকোলাই এবং নিচে বাম থেকে আন্দ্রেই ও পিতর; Source: skyscrapercity.com

১৯৩০ দশকের প্রথম দিকে তারা অনেকটা খেলাচ্ছলেই একটা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেয়া হয় মস্কো স্পোর্ট সার্কেল। পরে ক্লাবের নাম বদলে রাখা হয় রেড প্রেসনিয়া। প্রেসনিয়া ছিল স্টারোস্টিন ভাইদের জন্মস্থান। সেসময় মস্কোতে অনেকগুলো ক্লাব ছিল বটে, কিন্তু প্রত্যেকটা ক্লাবই ছিল কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের অঙ্গসংগঠন। যেমন, লোকোমোটিভ মস্কো ছিল রেলওয়ের শ্রমিকদের ক্লাব। ডায়নামো মস্কো ছিল এনকেভিডি নামের এক প্রতিষ্ঠানের, প্রতিষ্ঠানটিকে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির পূর্বসূরী বলে মনে করা হয়। সিএসকেএ মস্কো ছিল সেনাবাহিনীর লোকেদের ক্লাব। টর্পেডো মস্কো নামেও একটা ক্লাব ছিল, মোটরযানের চালক এবং শ্রমিকরা খেলতো সেখানে। এই অবস্থায় স্টারোস্টিন ভাইয়েরা ঠিক করলেন, তারা যে ক্লাবটা গঠন করবেন তা কোনো নির্দিষ্ট পেশার মানুষের হবে না, হবে সকল সাধারণ মানুষের। এককথায়, জনগণের দল।

প্রথমদিকে নিজেরাই খেলতেন, সাথে খেলতো আরও অনেকেই। সেসময় টিকিট বিক্রির টাকা দিয়ে চলতো ক্লাবটা। আস্তে আস্তে ক্লাব বড় হয়, প্রয়োজন পড়ে নিজেদের একটা স্টেডিয়ামের। রেড প্রেসনিয়া চলে যায় ১৩,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতার টমস্কি স্টেডিয়ামে। এরপরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, নিয়মিতভাবে স্পন্সর আসতে থাকে ক্লাবটির কাছে। এই সময়ই স্টারোস্টিন ভাইদের সাথে পরিচয় হয় এক খেলাপাগল মানুষের, যার নাম আলেক্সান্দর কোসারেভ। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট যুব ইউনিয়নের সভাপতি। ক্লাবটা ঢেলে সাজানোর জন্য ৪ ভাইকে দায়িত্ব দিলেন তিনি।

১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাস। সে সময়ই আরেকবার নাম বদলাল ক্লাবের। রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সেই বিখ্যাত দাস, স্পার্টাকাসের নাম থেকেই নেয়া হলো স্পার্তাক। সাথে লাগিয়ে দেয়া হলো মস্কো। জন্ম হলো স্পার্তাক মস্কোর। স্টেডিয়ামের ভেতরের কথা তো বলাই হলো। স্টেডিয়ামের বাইরে এখনও সদম্ভে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন স্পার্টাকাস, ভাস্কর্যের বেশে। এবং নাম বদলের দেড় বছরের মাথায় ১৯৩৬ সালের শরতে প্রথম লিগ জিতে নিল স্পার্তাক মস্কো। এবং সেদিন থেকে ডায়নামো মস্কো আর স্পার্তাক মস্কোর মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হলো, সমান তালে তা চলছে আজও।

স্পার্তাক মস্কো স্টেডিয়াম; Source: gazeta.ru

কোসারেভ ছিলেন ক্ষমতাবান মানুষ। আর এটা ধ্রুব সত্যি যে, ক্ষমতাবান মানুষের বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে ক্ষমতাবান শত্রুর। স্টারোস্টিন ভাইয়েরা, বিশেষ করে নিকোলাইয়ের দিকে চোখ পড়ল এনকেভিডির প্রধান লেভ্রেন্তি বেরিয়া’র।

লেভ্র‍্যান্তি বেরিয়া; Source: bbc.com

আগেই বলা হয়েছে, এনকেভিডির দলের নাম ছিল ডায়নামো মস্কো, স্পার্তাক যেবার চ্যাম্পিয়ন হয়, সেবার রানার্স আপ হয়েছিল ডায়নামো। নতুন আসা এক পুঁচকে দলের কাছে লিগ হারানোটা ভালোভাবে নিলেন না বেরিয়া। সাথে নিকোলাইয়ের প্রতি তার কিছু ব্যক্তিগত বিদ্বেষও ছিল। এ কথা নিজেই একবার বলেছিলেন নিকোলাই। ‘২০ এর দশকে এক জর্জিয়ান দলকে হারিয়েছিল নিকোলাইয়ের দল, সে দলের ডিফেন্ডার ছিলেন বেরিয়া নামের একজন।

সে সময়ের রাশিয়া সম্পর্কে একটু বলে নেয়া যাক। লেনিন চলে গেছেন, ক্ষমতায় এসেছেন স্ট্যালিন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, মানুষ সুখেই আছে। কিন্তু এক চাপা ভয় কাজ করে চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে; কখন, কাকে, কী অপরাধে যে পুলিশ গ্রেফতার করবে তা কেউই বলতে পারে না।

বেরিয়ার কাছে সুযোগ এলো ১৯৩৭ সালের দিকে। স্টারোস্টিন ভাইদের কাছের কিছু মানুষকে গ্রেফতার করল পুলিশ। অত্যাচারের ফলে মুখ খুলল তারা, জানিয়ে দিল স্ট্যালিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে স্টারোস্টিন ভাইয়েরা।

ঘটনাটা ঘটানোর সম্ভাব্য জায়গা ছিল রেড স্কয়ার, মে দিবসের প্যারেড দেখতে সেখানে গিয়েছিলেন স্ট্যালিন। কিন্তু কিছুই ঘটল না সেখানে। হাল ছাড়ল না পুলিশ, আরও খোঁজখবর করতে লাগল তারা। কিন্তু একপর্যায়ে ক্ষান্ত দিতে বাধ্য হলো, কারণ তাদের হাতে তেমন কোনো প্রমাণ ছিল না যা দিয়ে অপরাধী প্রমাণ করা যাবে স্টারোস্টিন ভাইদেরকে।

এর পরের বছর ভালো বিপদে পড়ে গেলেন স্টারোস্টিনরা। কমিউনিস্ট যুব ইউনিয়ন বন্ধ ঘোষণা করে গ্রেফতার করা হলো আলেক্সান্দর কোসারেভকে। পরে গুলি করে মারা হলো তাকে।

কোসারেভের মতো একজন ক্ষমতাশালী বন্ধু মারা যাওয়ায় একা হয়ে গেলেন নিকোলাই এবং তার ভাইয়েরা। এদিকে তক্কে তক্কে থাকলেন বেরিয়া, একটা মাত্র সুযোগ পেলেই খতম করে দেবেন তিনি স্টারোস্টিনদের।

পরের বছর। ১৯৩৯ সালের সোভিয়েত কাপ। সেমিতে স্পার্তাক হারাল ডায়নামো টিবিলিসিকে, ফাইনালে হারাল স্ট্যালিনেটস লেনিনগ্রাদকে। ডায়নামো টিবিলিসি ছিল বেরিয়ার এলাকার এক ক্লাব। এই হার তারা জ্বালা বাড়িয়ে দিল। এরপরে তিনি যা করলেন, তা এককথায় ন্যাক্কারজনক। ট্রফি স্পার্তাকের হাতে তুলে দেয়ার পরেও তিনি পুনরায় সেমি ফাইনাল খেলার নির্দেশ দিলেন। আর আগের সেমির রেফারিকে গ্রেফতার করে জেলে পুরে রাখল পুলিশ। কিন্তু তাতে কি আর স্পার্তাককে ঠেকানো যায়? দ্বিতীয় সেমিতেও টিবিলিসিকে হারাল স্পার্তাক। দলের হার দেখে চেয়ারে লাথি মেরে রাগে গজরাতে গজরাতে মাঠ ছাড়লেন লেভ্রেন্তি বেরিয়া।  

এর বছর তিনেক পরের কথা, ১৯৪২ সাল। এক রাতে মাথায় শীতল স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল নিকোলাইয়ের। অবশেষে সুযোগ পেয়েছেন বেরিয়া, এবার প্রতিশোধের পালা।

গ্রেফতার করে ৪ ভাইকেই মস্কোর কুখ্যাত লুবিয়াঙ্কা কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। হাস্যকর এক অভিযোগ আনা হলো তাদের বিরুদ্ধে। তারা নাকি বুর্জোয়াদের খেলা প্রচারে সাহায্য করেছেন! মৃত্যুদণ্ডই হওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সৌভাগ্য, মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে নেমে এলো। শাস্তি ভোগ করার জন্য সাইবেরিয়ার এক কুখ্যাত লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হলো তাদের।  

ফুটবল আরেকবার ত্রাতা হয়ে এলো নিকোলাইয়ের জীবনে। খেলোয়াড় হিসেবে তার সুনাম শুনে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ সেখানকার স্থানীয় ক্লাবের কোচ হিসেবে চাইল তাকে। না করার কোনো কারণ ছিল না নিকোলাইয়ের, যোগ দিলেন তিনি। এখানে ৩ বছর কাটানোর পরে জীবনে নতুন মোড় এলো তার, তাকে ফোন করলেন ভাসিলি স্ট্যালিন। সম্পর্কে তিনি ছিলেন জোসেফ স্ট্যালিনের ছেলে। বিমান বাহিনীতে একটা ফুটবল দল ছিল তার, সেখানে কোচ হিসেবে তিনি নিকোলাইকে চাইলেন। আরেকটা ‘গুণ’ ছিল তার, বেরিয়াকে পছন্দ করতেন না তিনি।

কিন্তু বেরিয়াও তো এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন।

ইঁদুর বিড়াল খেলা শুরু হলো এবার। একপর্যায়ে বেরিয়ার হাত থেকে বাঁচতে ভাসিলির বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন নিকোলাই। শেষপর্যন্ত ঝামেলা এড়াতে কাজাখাস্তানের এক ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। তবে তার বাকি ৩ ভাইয়ের অবশ্য সেই সৌভাগ্য হয়নি। শাস্তির পুরো মেয়াদ শেষ করার পরেই মুক্তি পান তারা।

পাশার দান পাল্টে যায় ১৯৫৩ সালে। স্ট্যালিন মারা যান, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই অভিযোগে বেরিয়াকেই গ্রেফতার করা হয় এবার, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও করা হয় তার। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দীকে ক্ষমা করে আদেশ জারি করে রাষ্ট্র, তার মধ্যে ছিল স্টারোস্টিন ভাইদের নামও। আদেশ জারির পরে ১৯৫৪ সালে দেশে ফিরে আসেন নিকোলাই, প্রায় ১২ বছর পরে একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে দেশের বাতাসে শ্বাস নেন তিনি।  

এর পরে আর তেমন কিছু বলার নেই। বাকি জীবনটা শান্তিতেই কাটাতে পেরেছেন চার ভাই। আলেক্সান্দর আর পিতর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না, তবে খেলার উপরে বেশ কিছু বই লিখেছেন আন্দ্রে। মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি মস্কো ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

আন্দ্রেই স্টারোস্টিন; Source: revolvy.com

আর নিকোলাই স্টারোস্টিন স্পার্তাক মস্কোর দায়িত্বে ছিলেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে ভাইদের মধ্যে সবার শেষে তিনি যখন মারা যান, তখন তার বয়স ৯৪ বছর। তিনি মারা যাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিজেদের ১৬তম লিগ জিতে নেয় স্পার্তাক মস্কো।

শেষ বয়সের নিকোলাই; Source: bbc.com

পাঠক, যদি কখনও রাশিয়াতে যান, তবে মস্কোর স্পার্টাকাসদের একনজর দেখে আসতে একদম ভুলবেন না কিন্তু!

Related Articles