Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাতারে আলো ছড়াবেন যে দশ তরুণ

“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ,
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি।”

বয়সের হিসাবে তারা ঠিক ঠিক আঠারো নন বটে, মোটামুটি সতেরো থেকে উনিশের মধ্যেই তাদের আনাগোনা। তবে কৈশোর পেরিয়ে সদ্য তারুণ্যে পা রাখি রাখি করা এই ‘টিনএজার’রা স্পর্ধায় মাথা তোলবার ঝুঁকি নিয়েছেন, প্রতিভা আর পায়ের জাদুতে নজর কেড়েছেন ফুটবল-দুনিয়ার। ফুটবল-রাজ্যের আগামী দিনের রাজারা নিজেদের ভালোভাবে চেনানোর জন্য, নিজেদের নৈপুণ্যে বিশ্বকে মোহিত করার জন্য ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’কে বেছে নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক দশজন সম্ভাবনাময় তরুণ খেলোয়াড় সম্পর্কে, যারা নিজেদের রঙে রাঙাবেন কাতার বিশ্বকাপ।

পেদ্রি গঞ্জালেস (স্পেন)

“পেদ্রি আমাকে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। আর যদি জাত প্রতিভার কথা বলি, এই মুহূর্তে পেদ্রিই পৃথিবীর সেরা।”

– জাভি হার্নান্দেজ (কোচ, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা)

বিশ্বকাপে এনরিকের তুরুপের তাস হতে চলেছেন পেদ্রি; ছবি: গেটি ইমেজেস
বিশ্বকাপে এনরিকের তুরুপের তাস হতে চলেছেন পেদ্রি; ছবি: গেটি ইমেজেস

বর্তমান পৃথিবীর অনূর্ধ্ব-১৯ বয়সী ফুটবলারদের মধ্যে পেদ্রি গঞ্জালেসই সবচেয়ে বেশি আলোচিত, এবং সেটা যৌক্তিক কারণেই। দুর্দান্ত ড্রিবলিং, চমৎকার পাসিং আর তরুণ কাঁধটার উপরে বসানো পরিণত মস্তিষ্কটা ব্যবহারে ইতোমধ্যেই বার্সেলোনা আর স্পেনের মধ্যমাঠে রাজত্ব করতে শুরু করেছেন এই তরুণ স্প্যানিশ। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়া এই তরুণের বল পুনর্দখলের সামর্থ্যকে ইদানিং তুলনা করা হচ্ছে লিওনেল মেসির সাথেও। প্রতিপক্ষকে ‘নাটমেগ’ করতেও পারদর্শী পেদ্রি। পারফরম্যান্সের এই ধারাটা অব্যাহত রাখতে পারলে আর সুস্থ থাকলে হয়তো ক্যারিয়ার শেষে হুয়ান রোমান রিকেলমে, রোনালদিনহো, লুইস সুয়ারেজ, বা মেসির মতো একবিংশ শতাব্দীর নাটমেগের রাজাদের সাথেই তুলনা হবে এই ‘সোনার ছেলে’র।

যে কারণে ‘সোনার ছেলে’ বললাম, ইউরোপের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য ২০০৩ সাল থেকে চালু হওয়া ‘গোল্ডেন বয় অ্যাওয়ার্ড’-এর বর্তমান বিজয়ীর নাম পেদ্রি গঞ্জালেস, যে পুরস্কারটা এর আগে পেয়েছেন ওয়েইন রুনি, লিওনেল মেসি, সার্জিও আগুয়েরো, কিলিয়ান এমবাপ্পে, আর্লিং হালান্ডের মতো খেলোয়াড়রা। পেদ্রির সামনেও তাহলে পূর্বসূরীদের মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎই পড়ে আছে!

২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর রাউন্ড অব সিক্সটিনে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে স্পেনের জার্সি গায়ে মাঠে পা রাখামাত্রই পেদ্রি হয়ে গিয়েছেন ইউরোর নকআউট পর্বের ম্যাচে খেলতে নামা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। ১৮ বছর ২১৫ দিন বয়সে এই রেকর্ড গড়ার পথে পেদ্রি ভেঙে দিয়েছেন ওয়েইন রুনির আগের রেকর্ডটা। ঐ ইউরোর সেরা তরুণ খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন পেদ্রি। সব মিলিয়ে কাতারে এই তরুণের পায়ের ঝলক দেখার জন্য ফুটবলপ্রেমীরা যে মুখিয়ে থাকবেন, এটা আর না বললেও চলছে!

জুড বেলিংহাম (ইংল্যান্ড)

“এই ছেলেটার ভয়ঙ্কর রকমের সম্ভাবনা আছে। সে শারীরিকভাবেও শক্তিশালী। গ্যারেথ সাউথগেট নিশ্চয়ই মুখিয়ে আছেন ওর সাথে কাজ করার জন্য। অসাধারণ একজন প্রতিভা।”

– রয় কিন (সাবেক ফুটবলার)

ইনল্যান্ডের তরুণ মিডফিল্ডার জুড বেলিংহাম; ছবি: গেটি ইমেজেস
ইংল্যান্ডের তরুণ মিডফিল্ডার জুড বেলিংহাম; ছবি: গেটি ইমেজেস

মাত্র আঠারো বছর বয়সেই শারীরিকভাবে শক্তিশালী জুড বেলিংহামের টেকনিককে তুলনা করা হচ্ছে গত ত্রিশ বছরের অন্যতম দুই মিডফিল্ডার প্যাট্রিক ভিয়েরা আর স্টিভেন জেরার্ডের সাথে। এমনকি রয় কিন, যার মুখ থেকে প্রশংসাবাণী পেলে স্বয়ং ভিয়েরা-জেরার্ডও হয়তো বর্তে যাবেন, বেলিংহাম সেটাও পেয়ে গেছেন এই বয়সেই। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের এই মিডফিল্ডার সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন রয় কিন।

বেলিংহামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ইংল্যান্ডের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটও। নাম্বার সিক্স, নাম্বার এইট, এবং নাম্বার টেনে খেলতে সক্ষম এই মিডফিল্ডারকে ঘিরে ইতোমধ্যেই ইউরোপের বড় বড় ক্লাবের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। ডর্টমুন্ডে যোগদানের আগে ষোল বছর বয়সে বার্মিংহ্যাম সিটির মূল দলে এক মৌসুম খেলেছিলেন বেলিংহাম, হয়েছিলেন বার্মিংহ্যাম সিটির ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। অবিশ্বাস্যভাবে ২০১৯ সালে তার ক্লাব ছাড়ার সাথে সাথে তার পরিহিত ২২ নম্বর জার্সিটাকেও অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে বার্মিংহ্যাম সিটি

গত বছর ইংল্যান্ডের জার্সিতে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ৯০ মিনিট খেলা বেলিংহামের আগে কোনো সতেরো বছর বয়সী এই কাজ করেছিলেন ১৪০ বছর আগে। কিছুদিন পরে, ২০২১ সালের জুন মাসে ইউরোর ইতিহাসেও সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হয়েছিলেন বেলিংহাম, যদিও মাত্র ছয় দিন পরেই পোল্যান্ডের ক্যাসপার কোজলোস্কি রেকর্ডটা নিজের করে নেন। বিশ্বকাপগামী ইংল্যান্ড দলেও বেলিংহামের জায়গা মোটামুটি পাকা, এখন শুধু আলো ছড়ানোর অপেক্ষা!

ফেলিক্স আফেনা-জিয়ান (ঘানা)

“সে একটা রত্ন। অবিশ্বাস্য যে তার বয়স মাত্র উনিশ বছর। সে খুবই সৃষ্টিশীল, মাঠে মুভমেন্টও দারুণ। রক্ষণেও সে নিজেকে উজাড় করে দেয়।”

– ওটো আডো (কোচ, ঘানা জাতীয় ফুটবল দল)

ঘানার উনিশ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড ফেলিক্স আফেনা-জিয়ান; ছবি: গেটি ইমেজেস
ঘানার উনিশ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড ফেলিক্স আফেনা-জিয়ান; ছবি: গেটি ইমেজেস

 

মাত্র আঠারো মাস আগের কথা। ফেলিক্স আফেনা-জিয়ান তখন বেরেকাম প্রেসবিটারিয়ান সিনিয়র হাই স্কুলে পড়ছিলেন। স্কুলের লেখাপড়া করতে করতে তার দূরতম কল্পনায়ও হয়তো আসেনি, কিছুদিন পরই তার নাম লেখা থাকবে সিরি-আ’তে রোমার শুরুর একাদশে, ভাবতেও পারেননি ঘানার বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার দাবিদার হবেন তিনি! অথচ আঠারো মাস পরে সেটাই কি না বাস্তব হলো!

১৮ বছর ৩০৬ দিন বয়সে আফেনা-জিয়ান রোমার জার্সিতে নিজের প্রথম গোল করেছিলেন। গোলের পরপরই আফেনা-জিয়ান একটা ব্যতিক্রমী আলোচিত উদযাপন করেছিলেন, পার্শ্বরেখার কাছে ছুটে গিয়ে কোচ হোসে মরিনহোকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সিরি-আ’তে গোল করতে পারলে এক জোড়া কেডস উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা। মরিনহোও কথা রেখেছিলেন, পরের দিনই এই তরুণকে উপহার দিয়েছিলেন ৮০০ ইউরো দামের এক জোড়া বালেন্সিয়াগা স্নিকার।

জেনোয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জয়ের ঐ ম্যাচের দুটো গোলই এসেছিল আফেনা-জিয়ানের পা থেকে, এর মধ্যে দ্বিতীয় গোলটা তো অবিশ্বাস্য। বক্সের অনেক বাইরে থেকে দুর্দান্ত শটে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন আফেনা-জিয়ান। এই জোড়া গোলের মাধ্যমে আফেনা-জিয়ান হয়ে যান সিরি-আ’র ইতিহাসে এক ম্যাচে একাধিক গোল করা তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ বিদেশী। প্রথম দুইজন হলেন ভালেরি বোজিনোভ (১৭ বছর ৩৩৭ দিন) এবং আলেসান্দ্রো পাতো (১৮ বছর ১৪৭ দিন)।

শারীরিক শক্তি আর দারুণ ভারসাম্যের ফলে বল পুনর্দখলের লড়াইয়ে জিততে পারেন আফেনা-জিয়ান, এগিয়ে থাকেন প্রতিপক্ষের সাথে শারীরিক টক্করেও। দারুণ গতি, স্কিল, ট্যাপ-ইন এবং লং রেঞ্জ গোল করার সামর্থ্যও তাকে সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে রাখে।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা আফ্রিকান দেশটার নাম ঘানা। আসমোয়াহ জিয়ান, করিম আবদুল রাজ্জাক, আবেদি পেলে, টনি ইয়েবোয়াহের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের উত্তরসূরী হিসেবে ১৯ বছর বয়সী তরুণ ফেলিক্স আফেনা-জিয়ানের ওপর বাড়তি নজর রাখতেই হচ্ছে।

গাভি (স্পেন)

“সে অসাধারণ। তার খেলা স্কুলমাঠে বা বাড়ির পেছনে খেলার মতোই সাবলীল। সে-ই স্পেন জাতীয় দলের বর্তমান, সে-ই ভবিষ্যৎ।”

– লুইস এনরিকে (কোচ, স্পেন জাতীয় ফুটবল দল)

স্পেনের মধ্যমাঠের নতুন তারকা গাবি; ছবি গেটি ইমেজেস
স্পেনের মধ্যমাঠের নতুন তারকা গাভি; ছবি গেটি ইমেজেস

মাত্র সতেরো বছর বয়স, কাগজে কলমে এখনো বার্সেলোনা জুভেনিল ‘এ’ দলের খেলোয়াড়, অথচ এখনই ক্লাবের মূল দলের শুরুর একাদশে জায়গা পাকা করে ফেলেছেন পাবলো মার্টিন পায়েজ গাভিরা, সংক্ষেপে ‘গাভি’। বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়ার এই মেধাবী ছাত্রের খেলার ধরণকে অনেকটা লা মাসিয়ারই সাবেক দুই ছাত্র জাভি হার্নান্দেজ আর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার সংমিশ্রণ বলা যেতে পারে। অসাধারণ ভিশন, চমৎকার নিয়ন্ত্রণ, বিরল ফুটবলীয় মেধা, আর দারুণ ড্রিবলিং-পাসিং দিয়ে ইতোমধ্যেই দর্শক-সমর্থকদের মন জয় করে নিয়েছেন গাভি। আক্রমণের পাশাপাশি সহায়তা করেন দলের রক্ষণেও, ট্যাকল করে বল কেড়ে নিতে পারেন দারুণভাবে। ক্লাব-সতীর্থ দানি আলভেজও মুগ্ধ তাতে, 

“সে ছিল আমার কাছে একটা বিস্ময়ের নাম। বার্সাকে খুব কাছ থেকে খেয়াল রাখার পরও ওকে আমি চিনতামই না। সে এমনিই দুর্দান্ত এক খেলোয়াড়, তার উপরে আবার পাগলাটে রকমের কমপিটিটিভ।”

গত বছরের অক্টোবরে এল ক্লাসিকোতে অভিষেক হয় গাভির। এই ম্যাচের শুরুর একাদশে যখন তিনি সুযোগ পান, তখন তার বয়স ১৭ বছর ৮০ দিন। গত ৮০ বছরে তার চেয়ে কম বয়সে কেউ এল ক্লাসিকোর শুরুর একাদশে জায়গা করে নিতে পারেননি। গত ফেব্রুয়ারিতে লা লিগায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম হিসেবে গোল করেছিলেন গাভি, ১৯৯৪ সাল থেকে সর্বকনিষ্ঠের রেকর্ডটা রাউল গঞ্জালেসের দখলে।

স্পেনের শত বছরের ফুটবলীয় ইতিহাসে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার গাভি, গত অক্টোবরে ইতালির বিপক্ষের মাঠে নামার মাধ্যমে এই রেকর্ডে নিজের নাম লিখে ফেলেছেন তিনি। মাত্র ছয় ম্যাচ খেলেই কোচ এনরিকের মনও জয় করে নিয়েছেন গাভি, লা রোহাদের মধ্যমাঠে তার জায়গা নিতে তাই আর সন্দেহ নেই আপাতত।

স্পেনের বিশ্বকাপযাত্রা শুরুর সময়ে গাবির বয়স হবে ১৮ বছর ১১০ দিন। মাঠে নামলেই তাই তিনি সেস ফ্যাব্রিগাসকে ছাড়িয়ে হয়ে যাবেন স্পেনের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার। আর যদি তিনি বিশ্বকাপে গোল পান, তাহলে তিনিই হয়ে যাবেন বিশ্ব আসরে গোল করা সর্বকনিষ্ঠ ইউরোপীয়, রোমানিয়ার বিপক্ষে ১৮ বছর ১৯১ দিন বয়সে গোল করে যে রেকর্ডটা চব্বিশ বছর ধরে দখলে রেখেছেন ইংল্যান্ডের মাইকেল ওয়েন। গাভি কি রেকর্ডগুলো পুনরায় লিখতে বাধ্য করতে পারবেন?

মার্সেলো ফ্লোরেস (মেক্সিকো)

“সে অসামান্য প্রতিভাবান। বল পায়ে সে অত্যন্ত দক্ষ। মেক্সিকানদের জন্য এমন খেলোয়াড় পাওয়াটা দারুণ ব্যাপার।”

– জেরার্ডো মার্টিনো (কোচ, মেক্সিকো জাতীয় ফুটবল দল)

মেক্সিকোর তরুণ মিডফিল্ডার মার্সেলো ফ্লোরেস; ছবি: গেটি ইমেজেস
মেক্সিকোর তরুণ মিডফিল্ডার মার্সেলো ফ্লোরেস; ছবি: গেটি ইমেজেস

ক্লাবের মূল দলে খেলার আগেই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন তরুণ মিডফিল্ডার মার্সেলো ফ্লোরেস। মেক্সিকোর কোচ জেরার্ডো ‘টাটা’ মার্টিনো অবশ্য তাতে একেবারেই অবাক নন, এর আগে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি হাভিয়ের মাশ্চেরানোকেও তো একইভাবে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে দেখেছেন তিনি!

যা-ই হোক, আর্সেনালের যুব দলের হয়ে আলো ছড়ানো মার্সেলো ফ্লোরেসের সামনে সুযোগ ছিল কানাডা অথবা ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে জড়ানোর। তবে জন্মস্থান কানাডার হয়ে, বা ইংল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েও মার্সেলো বেছে নিয়েছেন মেক্সিকোকেই। গত নভেম্বরে, অনূর্ধ্ব-২০ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ২-১ গোলে পরাজিত করার ম্যাচেই তার পায়ের ঝলকের দেখা মেলে। ফলাফলটাও এসে যায় হাতেনাতে। জাতীয় দলে ডাক পান মার্সেলো, চিলির বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্রয়ের ম্যাচে অভিষেকও হয়ে যায় তার।

লিওনেল মেসিকে আদর্শ মানা এই ফুটবলারের রক্তেই বইছে ফুটবল। মা রুবেন ফ্লোরেস ছিলেন মেক্সিকোর সাবেক ফুটবলার, বাবা ছিলেন ক্যায়ম্যান দ্বীপপুঞ্জের নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার। ফ্লোরেসের দুই বোন সিলভানা আর তাতিয়ানাও খেলেন যথাক্রমে লন্ডনের দুই স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব টটেনহ্যাম আর চেলসির হয়ে।

বিশ্বকাপে সৌদি আরব আর পোল্যান্ডের পাশাপাশি মেক্সিকোর গ্রুপে আছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাও। স্বপ্নের নায়কের সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের পারফরম্যান্স দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই নিজেকে উজাড় করে দেবেন ‘মেক্সিকোর মেসি’!

জামাল মুসিয়ালা (জার্মানি)

“অমিত সম্ভাবনাবান। তার ফিনিশিং দক্ষতা দারুণ, ড্রিবলিং অসাধারণ। একটা দুর্দান্ত ক্যারিয়ারের সব সম্ভাবনাই আছে তার মধ্যে।”

– জুলিয়ান নাগেলসমান (কোচ, বায়ার্ন মিউনিখ)

জার্মানির জার্সিতে আলো ছড়াচ্ছেন জামাল মুসিয়ালা; ছবি: গেটি ইমেজেস
জার্মানির জার্সিতে আলো ছড়াচ্ছেন জামাল মুসিয়ালা; ছবি: গেটি ইমেজেস

বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২১ পর্যায়ে গায়ে জড়িয়েছেন ‘তিন সিংহ’ সম্বলিত জার্সি, তবে জাতীয় দল হিসেবে বেছে নিয়েছেন জন্মভূমি জার্মানিকেই। বায়ার্ন মিউনিখের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় জামাল মুসিয়ালার ওপর বিশ্বকাপেও বাড়তি নজর রাখতেই হচ্ছে।

দারুণ ড্রিবলিংয়ের সাথে নিখুঁত ফিনিশিং-দক্ষতা, দুইয়ে মিলে জামাল মুসিয়ালার সামনে অপেক্ষা করছে চমৎকার ভবিষ্যৎ। জামালকে বাড়তি সুবিধা দিবে তার মাঠের বিভিন্ন পজিশনে খেলার সামর্থ্য। মূল স্ট্রাইকারের পেছনে, উইংয়ে, বা বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে পারেন জামাল।

১৭ বছর ১১৫ দিন বয়সে বুন্দেসলিগায় অভিষেক হয়েছিল জামালের, বায়ার্নের জার্সিতে তার চেয়ে কম বয়সে বুন্দেসলিগাতে খেলতে নামেননি আর কেউ। এই রেকর্ড গড়ার ক্ষেত্রে টনি ক্রুস, ডেভিড আলাবা, পিয়েরে-এমিল হয়বিয়ার মতো তারকাদের পেছনে ফেলেছিলেন তিনি, যদিও পরে ১৬ বছর বয়সী পল ওয়ানারের কাছে রেকর্ডটা হারাতে হয়েছে তাকে। গত বছরের ইউরোতে মাঠে নামার মাধ্যমে জামাল হয়ে গেছেন কোনো মেজর টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা কনিষ্ঠতম জার্মান খেলোয়াড়।

২০০৬ বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড় হয়েছিলেন লুকাস পোডোলস্কি, ২০১০ সালে টমাস মুলার। স্বদেশী দুই পূর্বসূরীর মতো জামাল মুসিয়ালাও নিশ্চয়ই নিজেকে চেনানোর মঞ্চ হিসেবে বিশ্বকাপকে বেছে নিতে চাইবেন!

ইউনুস মুসা (ইউএসএ)

“তাকে থামানো যেকোনো দলের জন্যই কঠিন। সে প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষের রক্ষণের জন্য হুমকি তৈরি করে। সে দ্রুতগতিসম্পন্ন, ক্ষীপ্র, এবং বলকে নিজের পায়ের কাছে রাখতে ভালোবাসে।”

– গ্রেগ বারহাল্টার (কোচ, ইউএসএ জাতীয় ফুটবল দল)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ খেলোয়াড় ইউনুস মুসা; ছবি: গেটি ইমেজেস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ মিডফিল্ডার ইউনুস মুসা; ছবি: গেটি ইমেজেস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জন্ম, বাবা-মা ঘানার নাগরিক, বেড়ে উঠেছেন ইতালি ও ইংল্যান্ডে, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ইংরেজদের হয়ে ত্রিশোর্ধ্ব ম্যাচও খেলেছেন, তবে জাতীয় দলের প্রশ্নে ইউনুস মুসা বেছে নিয়েছেন জন্মভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ গ্যারেথ সাউথগেট অবশ্য মুসাকে ইংল্যান্ডের জার্সিতেই নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সোনালি প্রজন্মটাই মুসাকে বেশি আকর্ষণ করেছে।

স্প্যানিশ লা লিগার ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ার মধ্যমাঠের খেলোয়াড় এই ইউনুস মুসা। তিনজনের মিডফিল্ডের সর্বডানের অবস্থানটাই তাঁর পছন্দের। শারীরিকভাবে শক্তিশালী, গতি আছে, ড্রিবলিংটাও করতে পারেন ‘তড়িৎগতিতে’, সব মিলিয়ে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবের নজর কেড়েছেন এই উনিশ বছর বয়সী। ১৭ বছর ৩৩৭ দিন বয়সে ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে লা লিগায় প্রথম গোল করেন ইউনুস মুসা, ভ্যালেন্সিয়ার ইতিহাসে যা দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম। প্রথমজন হুয়ান মেনা, ১৯৪১ সালে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে লা লিগায় গোল করেছিলেন।

এনগোলো কান্তে, পল পগবা, ক্রিস্টিয়ান পুলিসিচদের আদর্শ মানা এই তরুণের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সেই মেক্সিকোর বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে কাতার বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বকাপের স্বপ্নযাত্রায়ও এই তরুণের স্বাপ্নিক পারফরম্যান্সই চাইবে মার্কিনরা!

ফ্লোরিয়ান ভির্টজ (জার্মানি)

“ফ্লোরিয়ানের টেকনিক খুবই ভালো। সে অত্যন্ত সৃষ্টিশীল, দ্রুত, প্রচুর দৌড়াতে পারে, আর তার শটে জোর আছে। সে একটা পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ।”

– হ্যান্সি ফ্লিক (কোচ, জার্মানি জাতীয় ফুটবল দল)

জার্মানির তরুণ প্লেমেকার ফ্লোরিয়ান ভির্টজ; ছবি: গেটি ইমেজেস
জার্মানির তরুণ প্লেমেকার ফ্লোরিয়ান ভির্টজ; ছবি: গেটি ইমেজেস

ক্লাব-সতীর্থ প্যাট্রিক শিক সত্যায়িত করে দিয়েছেন,

“ভির্টজের সামনে খেলা যেকোনো স্ট্রাইকারের জন্যই স্বপ্নের মতো।”

শারীরিকভাবে শক্তিশালী, থ্রু-বল দিতে পারদর্শী, আর দ্রুতগতিসম্পন্ন এমন একজন প্লেমেকারকে পাওয়া যেকোনো দলের জন্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই অ্যান্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছিঁড়ে খেলার বাইরে চলে গেলেও জার্মান কোচ ফ্লিকের চোখে কাতারগামী জার্মান বিমানে ভির্টজের আসনটা পাকা। জেনারেল ম্যানেজার অলিভিয়ের বিয়েরহফও বলছেন একই কথা,

“আমি নিশ্চিত যে ভির্টজ ইনজুরি থেকে সময়মতো ফিরে আসতে পারবে। তার জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্যের দরজা উন্মুক্ত থাকবে।”

২০২০ সালের জুন মাসে, সতেরোতম জন্মবার্ষিকীর এক মাস পরেই বেয়ার লেভারকুসেনের হয়ে স্কোরশিটে নিজের নাম তুলেছেন ভির্টজ, বুন্দেসলিগার ইতিহাসে যা কনিষ্ঠতম। পরে অবশ্য রেকর্ডটা ভেঙে দিয়েছিলেন ইউসুফা মৌকোকো। বয়সভিত্তিক পর্যায়েও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন ভির্টজ, জার্মানির অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে গত বছর জিতেছেন ইউরো। জাতীয় দলের হয়েও ইতোমধ্যে চারটা ম্যাচ খেলেছেন এই আঠারো বছর বয়সী। ম্যাচের সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরো বাড়বে বিশ্বকাপে, গোলের খাতাটাও হয়তো খোলা হয়ে যাবে সাথে!

রিকার্ডো পেপি (ইউএসএ)

“রিকার্ডো পেপি সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সেরা জাত ফিনিশার। তার গোলগুলো অনেকটা রবার্ট লেভানডফস্কির মতো। সে সম্ভাব্য সকল উপায়ে গোল করতে পারে, মাঠের যেকোনো প্রান্ত থেকে।”

– হিথ পিয়ার্স (সাবেক ফুটবলার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ ফরোয়ার্ড রিকার্ডো পেপি; ছবি: গেটি ইমেজেস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ ফরোয়ার্ড রিকার্ডো পেপি; ছবি: গেটি ইমেজেস

শারীরিকভাবে শক্তিশালী খেলোয়াড়দের, বল হোল্ড করে অন্য আক্রমণে ওঠার সুযোগ করে দেন, ফিনিশিংটাও দারুণ – সব মিলিয়ে ‘টার্গেটম্যান’ হওয়ার সব ধরনের গুণাবলি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ১৯ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের মধ্যে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে আদর্শ মানা এই পেপি গত বছরে মেজর লিগ সকারে এফসি ডালাসের হয়ে হ্যাটট্রিক করে নিজের আগমনী বার্তাও শুনিয়েছেন, হয়ে গেছেন এমএলএসে হ্যাটট্রিক করা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। মেজর লিগ সকার ছেড়ে এরপর পাড়ি জমিয়েছেন জার্মান বুন্দেসলীগার ক্লাব অগসবুর্গে, ক্যারিয়ারটাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে নিশ্চয়ই খুব সাহায্য করবে এই দলবদলটা।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মাঠে নেমেছেন ১১টা ম্যাচে, লক্ষ্যভেদ করেছেন তিনবার। স্বর্ণালী প্রজন্মের ক্রিস্টিয়ান পুলিসিচ, সার্জিনো ডেস্ট, ওয়েস্টন ম্যাককেনির মতো সতীর্থদের পাশে নিয়ে নিশ্চয়ই বিশ্ব আসরে বহুদূর যেতে চাইবেন রিকার্ডো পেপি!

লুকা রোমেরো (আর্জেন্টিনা)

“আমি ওর বয়সী কারো মধ্যে ওর মতো প্রতিভা বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দেখিনি। ট্রেনিংয়েও ও অসাধারণ।”

– মাউরিজিও সারি (কোচ, লাৎসিও)

আর্জেন্টিনার সতেরো বছর বয়সী প্লেমেকার লুকা রোমেরো; ছবি: গেটি ইমেজেস
আর্জেন্টিনার সতেরো বছর বয়সী প্লেমেকার লুকা রোমেরো; ছবি: গেটি ইমেজেস

আর্জেন্টাইন, অসাধারণ প্রতিভাবান, বাঁ পায়ে খেলেন, দারুণ ড্রিবলিং করেন, প্লেমেকিংয়ে ভালো – লিওনেল মেসির কথাই সবার আগে মনে পড়ছে তো? না, লিওনেল মেসি নন, সতেরো বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইনের নাম লুকা রোমেরো। মাঠের খেলায় মেসিকে মনে করিয়ে দেওয়া এই কিশোর আর্জেন্টিনা দলের ট্রেনিংয়ে মুগ্ধ করেছেন স্বয়ং লিওনেল মেসিকেও।

২০২০ সালে মায়োর্কার হয়ে খেলতে নেমে হয়ে গেছেন লা লিগায় খেলা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। পরের বছর ক্লাব পাল্টে লাৎসিওতে গেছেন, এরপর হয়েছেন লাৎসিওর ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। সম্প্রতি লিওনেল স্কালোনিও তাকে ডেকেছেন আর্জেন্টিনা দলে, নিজেকে প্রমাণ করতে ভোলেননি সেখানেও।

লিওনেল মেসি আর আনহেল ডি মারিয়ার মতো ‘বাঁ পায়ের জাদুকর’দের উপস্থিতির জন্য আপাতত জাতীয় দলের জার্সিতে তাকে নিয়মিত দেখা যাবে কি না, বলা কঠিন। তবে লিওনেল স্কালোনি হয়তো সবাইকে চমকে দিয়ে কাতারগামী বিমানে তুলে দিতেও পারেন মেক্সিকোতে জন্মগ্রহণ করা এই প্লেমেকারকে। আর বিশ্বকাপে খেলতে নামলেই রোমেরো হয়ে যাবেন বিশ্ব আসরে আলবিসেলেস্তেদের প্রতিনিধিত্ব করা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে হবেন অষ্টম সর্বকনিষ্ঠ। লুকা রোমেরো কোচের আস্থার প্রতিদানটা দিতে পারবেন তো?

পেলে থেকে লিওনেল মেসি, অথবা হালের কিলিয়ান এমবাপ্পে, বিশ্বকাপে অভিষেকের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের বয়সই ছিল সতেরো থেকে উনিশের মধ্যে। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে আলো ছাড়িয়েছেন তারা প্রত্যেকেই, নামের সাথে তারকাখ্যাতিও পাকাপাকিভাবে জড়িয়ে গেছে তখন থেকেই। সময়ের সাথে সাথে ব্যাটনটা এবার পেদ্রি-গাবি-বেলিংহাম-মুসিয়ালার হাতে, তাহলে ফুটবলের ইতিহাসে নিজের নামটা খোদাই করার শুরুটা হোক এই বিশ্বকাপেই!

This article is in Bangla language and it is about the youngsters who are most likely to shine in the upcoming FIFA World Cup. Necessary links and sources are attached inside.

Featured image: Getty Images

Related Articles