Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ববি ডানবার: ভুল পরিচয়ে অন্যের জীবন যাপন করা এক হতভাগা

ববি ডানবার এক হতভাগ্য ব্যক্তির নাম, যার পুরো জীবনটাই কেটেছে মিথ্যের উপর, অন্যের জীবনকে নিজের জীবন মনে করে। তার নিখোঁজ হওয়ার রহস্য, পরবর্তীতে ফিরে আসার ঘটনা এবং ১০০ বছর পর প্রকৃত রহস্যের সমাধান যেকোনো কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।

মায়ের সাথে ববি ডানবার; Source: seattlepi.com

ববি ডানবারের জন্ম ১৯০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায়। তার বাবার নাম পার্সি ডানবার এবং মায়ের নাম লেসি ডানবার। ১৯১২ সালের আগস্ট মাসে, ববির বয়স যখন ৪ বছর, তখন তার বাবা-মা তাকে নিয়ে লুইজিয়ানার সোয়েইজ লেকে মৎস্য শিকার ভ্রমণে যান। ভ্রমণে থাকা অবস্থায় আগস্টের ২৩ তারিখে ৪ বছর বয়সী বালক ববি ডানবার নিখোঁজ হয়ে যায়।

ববির নিখোঁজ সংবাদ পুরো আমেরিকা জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বেচ্ছাসেবী অনুসন্ধানী দলের শতশত সদস্য ববির সন্ধানে পুরো এলাকা চষে ফেলে। কিন্তু কোথাও ববির খোঁজ মেলেনি। দীর্ঘ আট মাস পর, ববির বাবা-মা যখন এক প্রকার মেনেই নিয়েছিলেন যে ববি হয়তো চিরতরে হারিয়ে গেছে, তখন মিসিসিপির পুলিশ ববির মতো চেহারার এক বালককে খুঁজে পায়। বালকটি উইলিয়াম ক্যান্টওয়েল ওয়াল্টার্স নামে এক পিয়ানো মেরামতকারীর সাথে অবস্থান করছিল।

ওয়াল্টার্স দাবি করে, ছেলেটি ববি ডানবার না; বরং তার নাম চার্লস ব্রুস অ্যান্ডারসন, ডাকনাম ব্রুস। তার মায়ের নাম জুলিয়া অ্যান্ডারসন, যে ওয়াল্টার্সদের বাসায় কাজ করত। ওয়াল্টার্সের দাবি অনুযায়ী, জুলিয়ার অনুরোধে সে গত ১৩ মাস ধরে ছেলেটিকে লালন-পালন করে আসছিল। কিন্তু পুলিশ ওয়াল্টার্সের কথা বিশ্বাস না করে তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ডানবার দম্পতিকে সংবাদ দেয় তাদের ছেলেকে শনাক্ত করতে আসার জন্য।

পত্রিকার পাতায় ববি ডানবারের সংবাদ; Source: afterfeed.com

সংবাদ পেয়েই ডানবার দম্পতি মিসিসিপিতে ছুটে যান। ববিকে তারা প্রথম দেখাতেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন কিনা, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। কিছু কিছু পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, লেসি ডানবারকে দেখামাত্রই ববি তাকে চিনতে পারে এবং ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। কিন্তু অন্যান্য পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী, ববি তার মাকে চেনার মতো কোনো লক্ষণ দেখায়নি, বরং সে কেঁদে উঠেছিল। অন্যদিকে লেসি ডানবারও প্রথমে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি যে, ছেলেটি আসলেই ববি কিনা।

একই রকম পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায় ববির ভাই আলঞ্জোর সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা নিয়েও। কিছু পত্রিকার দাবি অনুযায়ী, ববি আলঞ্জোকে চিনতে পারার কোনো লক্ষণ দেখায়নি। কিন্তু অন্য কিছু পত্রিকার বর্ণনা মতে, আলঞ্জোকে দেখে ববি সাথে সাথেই তার নাম ধরে ডেকে ওঠে এবং তাকে চুমু খায়।

প্রথম সাক্ষাতের বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি প্রায় সব পত্রিকা এ বিষয়ে একমত যে, পুলিশ প্রথমে সাময়িকভাবে ববিকে ডানবার দম্পতির সাথে থাকার অনুমতি দেয়। পরদিন সকালে লেসি ডানবার যখন ববিকে গোসল করাতে যান, তখন তিনি ববির শরীরের জন্মদাগ এবং বাম পায়ে একটি পোড়া দাগের চিহ্ন দেখতে পেয়ে তাকে নিজের ছেলে হিসেবে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করেন। ফলে পুলিশ ডানবার দম্পতিকেই ববির পিতা-মাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং অপহরণের অভিযোগে ওয়াল্টার্সকে আটক রাখে।

নিখোঁজের আগে (বামে) ও পরে (ডানে) ববি ডানবার; Source: afterfeed.com

ববিকে নিয়ে ডানবার দম্পতি লুইজিয়ানায় ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই সেখানে হাজির হন জুলিয়া অ্যান্ডারসন। ওয়াল্টার্সের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে তিনি ববিকে ব্রুস হিসেবে এবং নিজেকে ব্রুসের মা হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, ববি/ব্রুস তার সন্তান, কিন্তু তিনি তাকে মাত্র দু’দিনের জন্য ওয়াল্টার্সের কাছে রেখে অন্য জায়গায় গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য জানা যায়, ববি/ব্রুস আসলে ১৩ মাস ধরে ওয়াল্টার্সের সাথে বসবাস করছিল।

পুলিশ জুলিয়ার বক্তব্য যাচাই করার জন্য তার সামনে ববি সহ একই বয়েসের এবং একই দৈহিক গড়নের পাঁচটি বালককে উপস্থিত করে এবং তাদের মধ্য থেকে ববিকে খুঁজে বের করতে বলে। ১৩ মাস ধরে ছেলেকে না দেখায় জুলিয়া তাকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। ফলে পুলিশের মনে বদ্ধ ধারণা হয় যে, জুলিয়ার দাবি আসলে মিথ্যা।

নিখোঁজের আগে (বামে) ও পরে (ডানে) ববি ডানবার; Source: afterfeed.com

পরের দিন সকালে জুলিয়া পুনরায় থানায় যান এবং ববির জামা খুলে তার জন্মদাগ দেখে তাকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করেন। কিন্তু ততক্ষণে তার আগের দিনের ব্যর্থতা পুলিশের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে দিয়েছিল। তাছাড়া স্থানীয় পত্রিকাগুলো জুলিয়ার বিবাহ বহির্ভূত অবস্থাতেই তিন সন্তানের জননী হওয়ার ঘটনার উপর আলোকপাত করে তার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ফলে আদালতের রায়ও স্বাভাবিকভাবেই জুলিয়ার বিরুদ্ধে যায়।

আদালত ববিকে ডানবার দম্পতির সন্তান হিসেবে রায় দেয়, জুলিয়াকে মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং অপহরণের অভিযোগে ওয়াল্টার্সকে কারাদণ্ড দেয়। ববি আদালতের রায় পেয়ে ডানবার দম্পতির সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং সুখী ও পরিপূর্ণ জীবনযাপন শেষে ৫৮ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও চার সন্তান রেখে গিয়েছিলেন।

২০০৪ সালে, ববির মৃত্যুর ৩৮ বছর পরে, তার দৌহিত্রী মার্গারেট ডানবার কাটরাইট ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে নতুন করে তার দাদার নিখোঁজ রহস্যের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেন। তিনি পুরানো পত্রিকা সংগ্রহ করেন, জুলিয়া অ্যান্ডারসনের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, এমনকি আদালতে উপস্থাপন করা তথ্য-প্রমাণগুলোও যাচাই করে দেখেন। এক পর্যায়ে তার সন্দেহ থাকে, তার দাদা হয়তো আসলে ববি ডানবার না-ও হতে পারেন।

পত্রিকার পাতায় ববির সংবাদ; Source: scribol.com

মার্গারেট বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পরিবারের সদস্যদেরকে ডিএনএ টেস্টের ব্যাপারে রাজি করান। ববি ডানবারের ছেলে, রবার্ট ডানবার জুনিয়র এবং ববির ছোট ভাই আলঞ্জোর ছেলে ডিএনএ টেস্টে অংশগ্রহণ করেন। ববি যদি সত্যি সত্যিই ডানবারদের সন্তান হতেন, তাহলে টেস্টে অংশগ্রহণকারী দুই চাচাতো ভাইয়ের ডিএনএতে প্রচুর মিল দেখা যেত। কিন্তু টেস্টের ফলাফল থেকে দেখা যায়, তাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই! অর্থাৎ ববি আসলে ডানবার পরিবারের সন্তান না, তিনি আসলেই জুলিয়া অ্যান্ডার্সনের ছেলে চার্লস ব্রুস অ্যান্ডারসন তথা ব্রুস!

মার্গারেট পরবর্তীতে ২০০৮ সালে এক রেডিও ডকুমেন্টারিতে তার তদন্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। অ্যান্ডারসন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, মামলায় হেরে গেলেও জুলিয়া অ্যান্ডারসন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায়ই ববির/ব্রুসের কথা উল্লেখ করতেন। অ্যান্ডারসন পরিবারের সদস্যরা সব সময়ই ব্রুসকে ডানবার পরিবার দ্বারা অপহৃত হিসেবে বিবেচনা করত।

ডানবার পরিবারের সাথে ববি; Source: afterfeed.com

উভয় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, ব্রুস যদিও ববি ডানবার হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে সুখী জীবন যাপন করেছিলেন, কিন্তু মনের গহীনে হয়তো তিনি তার সত্যিকার পরিচয় নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় একাধিকবার অ্যান্ডারসন পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন।

১৯৪৪ সালে ব্রুস, জুলিয়া অ্যান্ডারসনের ছেলে, অর্থাৎ তার সৎ ভাই হলিসের সাথে দেখা করেন। তার বোন জুলসও দাবি করেন, কাছাকাছি সময়ে এক ব্যক্তি তার সাথে দেখা করেন এবং দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। যদিও তিনি তার সত্যিকার পরিচয় দেননি, কিন্তু জুলসের ধারণা, তিনি ছিলেন ব্রুস।

পরিণত বয়সে ববি ডানবার; Source: seattlepi.com

বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে দেরিতে হলেও ব্রুসের সত্যিকার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার ববি ডানবারের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে রহস্য আজও সমাধান করা সম্ভব হয়নি। সে কি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল? নাকি কারো দ্বারা অপহৃত হয়েছিল? মার্গারেট কাটরাইট মনে করেন, ববি হয়তো লেকের পানিতে পড়ে গিয়েছিল এবং সেখানের পানিতে থাকা কুমীরগুলো তাকে খেয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এতদিন পরে সেটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই।

ফিচার ইমেজ- Worldation.com

Related Articles