Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোডেক্স গিগাস: শয়তানের বাইবেল

গভীর রাত্রি, নিস্তব্ধ পরিবেশ। আশেপাশে কোনো মানুষজন জেগে নেই। শুধু জেগে আছেন এক হতভাগা সন্ন্যাসী। তিনি একাকী জেগে আছেন এক বন্ধ কারাগারে। কিন্তু তিনি অলস বসে নেই।

তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে চলেছেন। থামার কোনো লক্ষণও নেই। ওদিকে কারাপ্রহরী রাত্রির শেষ প্রহরের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। রাত শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু লেখা শেষ হচ্ছে না। সন্ন্যাসীর চেহারা ভয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো। রাতের মধ্যে শেষ করতে না পারলে পরদিন ভোরেই সন্ন্যাসীর গর্দান যাবে।

নিরুপায় সন্ন্যাসী বুঝতে পারলেন, পৃথিবীর কোনো মানুষ একরাত্রির ভেতর এই বই শেষ করতে পারবে না। এখন তার কাছে একটাই পথ খোলা আছে। আর ভাবার সময় নেই। সন্ন্যাসী একপাশে বসে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিলো না। সন্ন্যাসী আশা ছেড়ে দিলেন। ঠিক তখন এক দমকা হাওয়ায় কারাগারের সব মশাল নিভে গেলো। সন্ন্যাসীর সামনে রাখা কাগজ সব তছনছ হয়ে গেলো বাতাসের আঘাতে। অন্ধকার কারাগারে তার সামনে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তির উদ্ভব হলো। ভীত সন্ন্যাসী কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লেন ছায়ামূর্তির পায়ে। সে ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, স্বয়ং শয়তান!

সন্ন্যাসী শয়তানের কাছে হাতজোড় করলেন। অনুরোধ করলেন, বইটি ভোর হবার পূর্বেই শেষ করে দিতে। শয়তান রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু একটি শর্ত বেঁধে দিলো। বিনিময়ে সন্ন্যাসীর আত্মা শয়তানকে উৎসর্গ করতে হবে। বেচারা সন্ন্যাসী উপায় না দেখে রাজি হয়ে যান। জিতেও যেন হেরে গেলেন তিনি। তার চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু ঝরতে থাকে। আর তার সামনে বিকট শব্দে হাসতে থাকে শয়তান। সেই হাসির শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার পালা। শয়তানের হাসির শব্দে রাত্রির নীরবতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।

পরদিন রাজদরবারে বিশাল পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির হলেন সন্ন্যাসী। রাজদরবারের সবাই তাজ্জব বনে গেলেন। স্বয়ং রাজা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। তিনি প্রশ্ন করলেন সন্ন্যাসীকে, “এটা কী সন্ন্যাসী?

ক্লান্ত সন্ন্যাসীর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠলো। তিনি স্থানীয় ভাষায় বলে উঠলেন, “কোডেক্স গিগাস”, যার অর্থ বিশাল বই। সেই বিশাল বইয়ে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন এই সন্ন্যাসী। কী অবাক কাণ্ড! সভাসদরা উত্তেজনায় কানাকানি করতে লাগলো।

রাজা সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কথামতো তিনি সন্ন্যাসীকে মুক্তি দিলেন। মুক্তির ফরমান হাতে নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলেন তিনি। তিনি আজ মুক্ত। ঠিক তখন পথের মধ্যে লুটিয়ে পড়লেন সন্ন্যাসী। দূর থেকে বিকট শব্দে হাসতে থাকলো শয়তান। সে আজ জয়ী হয়েছে। আজ তার আনন্দের দিন।

শিল্পীর তুলিতে কোডেক্স গিগাস প্রদর্শনের দৃশ্য; source: stillunfold.com

‘শয়তানের বাইবেল’ নামে পরিচিত বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি ‘কোডেক্স গিগাস’ নিয়ে এমন গল্প প্রচলিত আছে সেই ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে। গল্পের সাক্ষী কেউ বেঁচে নেই। তাই এর সত্যতা নির্ণয়ে মানুষ প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে আরো রোমাঞ্চকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। তবে কি এটি আসলেই শয়তানের বাইবেল? চলুন জানা যাক।

কোডেক্স গিগাস কী?

‘কোডেক্স গিগাস’ বা ‘গিগাস কোডেক্স’ শব্দের অর্থ বিশাল পুস্তক। এর দ্বারা বইটির বিশালতার কথা বোঝানো হয়েছে। বইটি দেখতে যেমন বড়, তেমনি ওজনেও ভারি। বইটিতে গাধার চামড়া দিয়ে তৈরি মোট ৩১০টি পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে। বইটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থ প্রায় ২০ ইঞ্চি। ১৬৫ পাউণ্ড ভারি বইটি প্রায় ৮.৭ ইঞ্চি মোটা। কারো পক্ষে বইটি একা বহন করা সম্ভব নয়। বীরত্ব দেখিয়ে কেউ চেষ্টা করলে গুরুতর আহত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই বিশাল বইটি একা বহন করা বেশ বিপজ্জনক!; source: hexapolis.com

বইটির শেষদিকের অনেকগুলো পৃষ্ঠার হদিস মেলেনি। ইতিহাসবিদদের মতে, ইচ্ছাকৃতভাবে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে কোডেক্স গিগাস সবচেয়ে বড় পাণ্ডুলিপি। কিন্তু কী কারণে একে শয়তানের বাইবেল বলা হয়? এর পেছনের গল্পটা কী? এর উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সন্ন্যাসীর গল্পে। চোখ মেলে তাকাতে হবে আরেকটু পেছনে।

প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের কোনো এক রাজার আমলের কথা। সময়টা তখন ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। রাজ্যের এক সন্ন্যাসী খুব গুরুতর অন্যায় করে বসেন। তাকে রাজার কাছে আনা হলো বিচারের জন্য। রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু সন্ন্যাসী রাজার কাছে আর্জি করলেন, তাকে যেন শেষবারের মতো একটি সুযোগ দেয়া হয়। বিনিময়ে তিনি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান সংকলন করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেবেন। রাজা তার প্রস্তাবে রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু তাকে সময় দিলেন মাত্র একরাত্রি। সন্ন্যাসী রাজি হয়ে গেলেন। তিনি কাজে লেগে গেলেন। কিন্তু টানা লেখার পরেও সেই পাণ্ডুলিপি শেষ করা সম্ভব হলো না। শেষপর্যন্ত সন্ন্যাসী নরকের রাজপুত্র লুসিফারের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। লুসিফার তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। বিনিময়ে সন্ন্যাসী নিজের আত্মা উৎসর্গ করে দিলেন লুসিফারের প্রতি। লুসিফার এক মুহূর্তের মধ্যে সেই পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করে দিল।

শিল্পীর কল্পনায় নরকের রাজপুত্র লুসিফার; source: deviantart.net

কিন্তু ফিরে যাওয়ার পূর্বে রেখে গেলেন তার স্বাক্ষর। পাণ্ডুলিপির ২০৯ পৃষ্ঠায় তার স্বাক্ষরসরূপ এক কদাকার শয়তানের ছবি অঙ্কিত হয়েছে। তার ঠিক বিপরীত পৃষ্ঠায় আঁকা হয়েছে স্বর্গীয় শহর জেরুজালেমের ছবি। সেই ছবির কারণে এর নাম হয়ে গেলো ‘শয়তানের বাইবেল’। তখনকার যুগে শিল্পকর্মে শয়তানের প্রতিকৃতির ব্যবহার বিরল ছিল না। প্রায়ই শয়তান এবং তার অভিশপ্ত শিষ্যদের ছবি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পাণ্ডুলিপির শয়তানের প্রতিকৃতি ছিল একটু আলাদা ধাঁচের। এখানে শয়তান ছিল সম্পূর্ণ একা এবং নগ্ন।

১৫৯৪ সাল পর্যন্ত এটি চেক প্রজাতন্ত্রের শহর শ্রুদিমের একটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত ছিল। এরপর রাজা দ্বিতীয় রুডলফ সেখান থেকে বইটি ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধার নেন। তিনি প্রাগ শহরে নিয়ে আসেন বাইবেলখানা। কিন্তু তার সেই প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান তিনি। ১৬১৮ সালের দিকে চেক প্রজাতন্ত্রে যুদ্ধ বেঁধে যায়। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চলা যুদ্ধে চেকরা অনেক কিছুই হারিয়েছে।

শয়তানের প্রতিকৃতির বিপরীত পৃষ্ঠায় আঁকা স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম; source: atlasobscura.com

এমনকি কোডেক্স গিগাসও তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো। ১৬৪৮ সালে যুদ্ধ শেষে সুইস সৈনিকরা সুবৃহৎ পাণ্ডুলিপিটি স্টকহোমে নিয়ে আসেন। পাণ্ডুলিপিটি সেখানে Royal Library of Stockholm-এ সংরক্ষণ করা হয়। এরপর সেটি সুইস গবেষকদের নজরে আসে। অনুসন্ধানের পর বের হয়ে আসে এর রোমাঞ্চকর ইতিহাস। ২০০৭ সালে পুনরায় প্রাগে ফিরিয়ে আনা হয় এই পাণ্ডুলিপিটি। প্রথমদিকে জনসাধারণের জন্য বইটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হলেও, সম্প্রতি এই সুবিধা বাতিল করা হয়।

গল্পের সত্যতা যাচাই

বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এর ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করেছেন। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, বইটি লেখতে সময় লেগেছিলো মাত্র একটি রাত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই তথ্যের সাথে একমত নন। সুইডেন জাতীয় গ্রন্থাগারের গবেষকদের মতে, যদি লেখক পুরো সপ্তাহ জুড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে লিখে থাকেন, তাহলেও বইটি শেষ করতে তার লেগে যাবে প্রায় ত্রিশ বছর। কিন্তু সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা কাজ করা হয়তো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সময়টা বেড়ে বিশ থেকে ত্রিশ বছর ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তাহলে কি বইটি সংকলন করতে একরাত নয়, প্রায় ত্রিশ বছরের মতো লেগেছিলো? source: Julia World

তাহলে বিজ্ঞান সন্ন্যাসী আর লুসিফারের গল্পকে মানতে নারাজ। কিন্তু হাতের লেখা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে, পাণ্ডুলিপিটি একজনের দ্বারাই লেখা হয়েছে। বাইবেলে লাল, নীল, হলুদ এবং সবুজ রঙের কালি ব্যবহার করে হয়েছে। ছবিগুলোর ক্ষেত্রেও এই রঙগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।

শয়তানের বাইবেলের সূচিপত্র

শয়তানের বাইবেল নামটা শোনার পর থেকে সবার মাথায় একটাই প্রশ্ন- কী লেখা আছে এর ভেতর? ইতিহাসবিদরা ইতিমধ্যে পুরো পাণ্ডুলিপির লেখা উদ্ধার করে ফেলেছেন। তাদের মতে, কোডেক্স গিগাস একটি মধ্যযুগীয় জ্বলজ্যান্ত বিশ্বকোষ। পুরো বাইবেলটি লেখা হয়েছে ল্যাটিন ভাষায়। পাণ্ডুলিপির শুরুতে পবিত্র ওল্ড টেস্টামেন্ট সংযুক্ত আছে। ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ছাড়াও ফ্লেভিয়াস জোসেফাস নামক এক পণ্ডিত রচিত The Jewish War and Jewish Antiquities গ্রন্থ, সেইন্ট ইসিডোর রচিত একটি বিশ্বকোষ (Encyclopedia), যাজক কোমাক রচিত The Chronicle of Bohemia গ্রন্থ এবং বাইবেলের নতুন টেস্টামেন্ট সংযোজিত রয়েছে।

বাইবেলটি ঘেঁটে ইতিহাসবিদদের বের করা কিছু মজার তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো,

  • পুরো পাণ্ডুলিপিতে মাত্র দুটি ছবি অঙ্কিত হয়েছে- নরকের রাজপুত্র লুসিফার এবং স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম।
  • ছবিতে লুসিফারকে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে থাকা অবস্থায় আঁকা হয়েছে। তাই হঠাৎ করে এর দিকে তাকালে মনে হবে লুসিফার বুঝি বই থেকে বের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

    সেই বিখ্যাত লুসিফারের প্রতিকৃতি; source: imgur.com

  • বইয়ের এক পাতায় চোর ধরার জন্য বেশ কার্যকরী দুটি জাদুমন্ত্র বাতলে দেয়া হয়েছে। চোর ধরতে আগ্রহী পাঠকরা সেটি লুফে নিতে পারেন। তবে অবশ্যই তাকে ল্যাটিন ভাষা জানতে হবে।
  • শয়তানের আছর থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন অদ্ভুত রীতির বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।

শয়তানের আছর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় লেখা আছে বইটিতে; source: Youtube

  • স্বর্গীয় শহরের ছবিতে কোনো মানুষের ছবি আঁকা হয়নি। শহরটি জনমানবশূন্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

জনমানবহীন স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম; source: Pinterest

  • লুসিফারের গায়ে মোটা উলের তৈরি রাজকীয় পোশাক ‘আরমিন কোট’ পরিহিত ছিল। যার মাধ্যমে তাকে ‘নরকের রাজপুত্র’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

সম্প্রতি কোডেক্স গিগাস নিয়ে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেল ‘National Geography’ বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে। এর ইতিহাস নিয়ে আগ্রহের যেন কমতি নেই জ্ঞানপিপাসুদের। এই অদ্ভুত পাণ্ডুলিপিটি এর অলৌকিক ইতিহাস ছাপিয়ে ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকবে জ্ঞানের অসামান্য ভাণ্ডার হিসেবে। এখন পর্যন্ত সেই সন্ন্যাসীর নাম জানা সম্ভব হয়নি। তাই গবেষণাও শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তার নাম জানা হয়ে যাবে। আশা করা যায়, বিজ্ঞান আমাদের বেশিদিন অপেক্ষা করাবে না।

ফিচার ইমেজঃ Escape Rooms Prague

Related Articles