Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত

সত্তরের দশকের রক সংগীতের প্রসঙ্গ আসলে প্রথমেই মাথায় আসে পশ্চিমা ব্যান্ডগুলোর নাম। লেড জ্যাপলিন, পিঙ্ক ফ্লয়েড, ব্ল্যাক স্যাবেথ, জুডাস প্রিস্ট, দ্য রোলিং স্টোনস, কুঈন, ইগলস, এসি/ডিসি, ডিপ পার্পেল এবং স্কর্পিয়নস ইত্যাদি ব্যান্ডগুলোর অবদানের কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এই ব্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী ও জনপ্রিয় ব্যান্ড ছিল বিটলস। কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতেই ভেঙ্গে যায় ব্যান্ডটি। বিশ্ব রক সংগীতের সাথে যে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর নাম জড়িয়ে আছে তা নয়, জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নামও এবং তা বেশ ভালোভাবেই। সত্তরের দশকে রক সংগীতের জগতে ঘটে যায় এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা যার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ এবং বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম এক সদস্যের নাম। হ্যাঁ, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ও জর্জ হ্যারিসনের কথাই বলা হচ্ছে এখানে।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অন্যদের সাথে জর্জ হ্যারিসন; source- thedailystar.net

রক সংগীতের ইতিহাসে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোনো যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সহায়তার উদ্দেশ্যে বৃহৎ পরিসরে আয়োজিত প্রথম দাতব্য কনসার্ট এটি। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অনুষ্ঠিত না হলে হয়ত লাইভ এইড, ফার্ম এইড এবং কনসার্ট ফর কম্পুচিয়া ইত্যাদির মতো বৃহৎ দাতব্য কনসার্টগুলো আয়োজন করার সাহস ও অনুপ্রেরণা কোনোটাই পেত না শিল্পী ও আয়োজকেরা। যদিও বিটলসের লিড গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের প্রচেষ্টা ছাড়া এ কনসার্টটি সফল হতো না, তবে এর পেছনে মূল অবদান ছিল সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশংকরের। তিনিই প্রথম এ ধরণের উদ্যোগ নেন এবং কথা বলেন হ্যারিসনের সাথে। হ্যারিসনকে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সংকটের কথা জানান। বাঙালি ঘরে জন্ম নেয়া পণ্ডিত রবিশংকরের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশে।

পণ্ডিত রবিশংকর এবং জর্জ হ্যারিসনের; source- kmuw.org

 

যেভাবে হলো কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

সময়টা ১৯৭১ সাল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক মাস হলো। পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এ দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচার ও বর্বর গণহত্যা আরো চরম আকার ধারণ করে এ সময়। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে লাখ লাখ মানুষ। তারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধের আগে ‘৭০ এ ভোলায় হয়েছিল এক ভয়াবহ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস (সাইক্লোন), যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানী ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের সাহায্য পায়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। সাইক্লোন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, সব মিলিয়ে বেশ সংকটাপন্ন সময় কাটাচ্ছিল এ দেশের মানুষ।

সিমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ; source- macaulay.cuny.edu

ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর অধিকাংশই ছিলো মহিলা ও শিশু। সেখানে পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব ছিল। কলেরার মতো রোগগুলো সেখানে মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। ফলে প্রতিদিনই শত শত মানুষ মারা যাচ্ছিল এবং শিশু মৃত্যুহার ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) অস্ত্রসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছিল।

সানডে টাইমসে প্রকাশিত অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের প্রতিবেদন; source-bdnews24.com

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে পণ্ডিত রবিশংকর বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানতে পারেন, বিশেষ করে সানডে টাইমস-এ করা অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের প্রতিবেদন থেকে। শেকড় যে দেশে, সে দেশের এমন অবস্থা দেখে স্থির থাকতে পারেননি রবিশংকর। তিনি তাঁর বন্ধু-শিষ্য জর্জ হ্যারিসনকে বাংলাদেশের সংকটের কথা জানান এবং সংগ্রহ করা পত্র-পত্রিকার অংশবিশেষ দেখান। বাংলাদেশের এ দুর্বিষহ অবস্থা হ্যারিসনকেও গভীরভাবে ব্যথিত করে। তখন তারা লস অ্যাঞ্জেলসে রাগা সংগীতের কাজ করছিলেন। ক্লাউস ভোরম্যানের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ফ্রিয়ার পার্কে এক নৈশভোজে রবিশংকর খুব দুঃখসহকারে বাংলাদেশের সংকটের কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে লস অ্যাঞ্জেলসে অবস্থানকালে তিনি তার পরিকল্পনার কথা জানান। রবিশংকর চাইছিলেন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় আকারের দাতব্য কনসার্ট করতে, যা থেকে অন্তত ২৫ হাজার ডলার ওঠানো যায়। এ ব্যাপারে তিনি হ্যারিসনের সাহায্য চান।

হ্যারিসন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কনসার্টটির জন্য কাজ শুরু করেন। তাঁর বই ‘আই-মি-মাইন’ হতে জানা যায়, পরবর্তী তিন মাস তিনি টেলিফোন যোগাযোগ করতে থাকেন অন্যদের সাথে, তাদেরকে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করতে। তখন বিটলস ভেঙে গিয়েছিল এবং অন্য সদস্যদের সাথে আগের মতো সর্ম্পক ছিল না হ্যারিসনের। তারপরেও তাঁদের এ কনসার্টে যোগ দিতে বলেন হ্যারিসন। রিঙ্গো স্টার রাজি হয়ে গেলেন। পল ম্যাককার্টনি রাজি হননি, আর জন লেননের যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও পরে কিছু কারণে আর যোগ দেননি। এছাড়া ইরিক ক্লাপটন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, বব ডিলান, ব্যাডফিঙ্গারসহ আরো শিল্পীদের যোগ দিতে বলেন হ্যারিসন।

হ্যারিসনের ‘বাংলা দেশ’ গানটির একটি বিজ্ঞাপন; source- globalcitizen.org

প্রস্তুতির বিভিন্ন পর্ব শেষে ২৭ জুলাই হ্যারিসন তাঁর ‘বাংলাদেশ’ গানটি মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সংকটের কথা তুলে ধরেন। ঐ দিনই এক প্রেস কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে হ্যারিসন ও রবিশংকর কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। হ্যারিসন কেন এ কনসার্ট করতে আগ্রহী হলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তাঁর বন্ধু চেয়েছিল, তাই”। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয় নিউইর্য়কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন আর তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১ আগস্ট।

প্রেস কনফারেনসে রবিশংকর, হ্যারিসন ও অ্যালেন ক্লাইন; source- foroactivo.com

যা হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশে

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইর্য়কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ঐতিহাসিক এ কনসার্টটি সম্পন্ন হয়। সেদিন দুটো কনসার্টের আয়োজন করা হয়- প্রথমটি দুপুর ২:৩০ মিনিটে এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা ৮:০০ টায়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে ছিল সকল শিল্পী, খ্যাতনামা তারকা। তাঁদের এই লাইনআপকে বলা হয়েছিল ‘সুপার গ্রুপ’। কনসার্টের পূর্বে সুপার গ্রুপের সকলকে কল করে উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলেন হ্যারিসন। তবে ডিলান আসবেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না তিনি, তাই ডিলানের নামের পাশে এঁকে দিয়েছিলেন ‘?’ চিহ্ন

এখানে আগত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে কনসার্টটির সূচনা করেন হ্যারিসন। কনসার্টের শুরুতে পণ্ডিত রবিশংকর তাঁর দলসহ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করেন, যার মধ্যে ছিল কনসার্টের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ‘বাংলা ধুন’ ও অন্যান্য পরিবেশনা। তাঁদের ৪৫ মিনিটের পরিবেশনা শেষে একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দেয়া হয়।

কনসার্টে পণ্ডিত রবিশংকর তাঁর দলসহ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করছেন; source- pinterest.com

বিরতিতে নেদারল্যান্ডের এক টিভি চ্যানেলের ধারণ করা বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতা ও প্রাকৃতিক বির্পযয়ের ফুটেজ দেখানো হয়। এ ফুটেজটি উপস্থিত দর্শকদের বাংলাদেশে চলা সংকটের এক বাস্তব ধারণা দেয়। এরপর ছিল হ্যারিসনের পরিবেশনা, তাঁর সাথে ছিলেন রিঙ্গো স্টার, ইরিক ক্লাপটন (যিনি অসুস্থ ছিলেন), বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ক্লাউস ভোরম্যান, জিম কেল্টনারসহ ১৮ জন মিউজিশিয়ান। এটি ছিল হ্যারিসন ও ক্লাপটনের বেশ কয়েক বছর বিরতির পর প্রথম কোনো কনসার্টে পরিবেশনা। হ্যারিসন ডিলানের স্লটের সময় হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখেন ডিলান উপস্থিত হয়েছেন। ডিলানের উপস্থিতি শুধু হ্যারিসনের জন্য নয়, দর্শকদের জন্যেও এক বিশাল চমক ছিল। হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি দিয়ে প্রথম কনসার্টটি শেষ হয়।

কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রথম কনসার্টটির সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় হ্যারিসন-ডিলান সহ সকলে অনেক উত্সাহের সাথে দ্বিতীয় কনসার্টটি করেন। দ্বিতীয় কনসার্টটিতে পরিবেশনা তালিকায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এবারও কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায় এবং কনসার্ট শেষে ডিলান হ্যারিসনকে বলেছিলেন, আমরা হয়ত আরো একটি কনসার্ট করতে পারতাম।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের একটি টিকিটের অংশবিশেষ; source- udiscovermusic.com

এটি ছিলো ইতিহাসের অন্যতম বড় কনসার্ট। ৪০ হাজার মানুষ টিকিট কিনে এ কনসার্ট উপভোগ করে।

সুপার গ্রুপ

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সুপার গ্রুপের সকল সদস্যই এককভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। নিচে সদস্যদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো-

জর্জ হ্যারিসন

গিটারিস্ট, গায়ক, সংগীত পরিচালক ও প্রযোজক। এ প্রতিভাবান সাবেক বিটলস হিসেবে অধিক পরিচিত।

পণ্ডিত রবিশংকর

পুরো নাম রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সেতার বাদক, ভারতীয় বাঙালি, যিনি পরবর্তীতে রাজ্যসভার (ভারতীয় সংসদ) সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজির জন্য সংগীত তৈরি করেন। সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে।

আলী আকবর খান

কিংবদন্তি সরোদ বাদক। তিনি সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে, জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। প্রথম ভারতীয়, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে এলপি (এক ধরনের রেকর্ড/অ্যালবাম)-তে রের্কড করেন।

আল্লা রাখা

ওস্তাদ আল্লা রাখা কুরেশি ছিলেন বিখ্যাত তবলা বাদক। তিনি পণ্ডিত রবিশংকরের সহচর ছিলেন। এ সময়ের বিখ্যাত তবলা বাদক জাকির হুসেইন তাঁর ছেলে।

কমলা চক্রবর্তী

তানপুরা বাদক ও বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর স্ত্রী।

রিঙ্গো স্টার

বিটলস ব্যান্ডের বিখ্যাত ড্রামার। বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর একক শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন।

ইরিক ক্লাপটন

বিখ্যাত ব্রিটিশ গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট। রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ গিটারিস্টের তালিকায় দ্বিতীয় তিনি।

বিলি প্রিস্টন

বিখ্যাত সেশন কি-বোর্ডিস্ট ও ভোকালিস্ট।

লিয়ন রাসেল

ভোকালিস্ট, মিউজিশিয়ান, লেখক ও সুরকার।

ক্লাউস ভোরম্যান

জার্মান বেইজিস্ট ও আর্টিস্ট (অংকন শিল্পী)।

জিম কেল্টনার

আমেরিকার বিখ্যাত সেশন ড্রামার।

ব্যাডফিঙ্গার

ব্রিটিশ রক ব্যান্ড।

বব ডিলান

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ। জনপ্রিয় গায়ক, মিউজিশিয়ান, সুরকার, লেখক, চিত্রকর ও ভাস্কর। বব ডিলান ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশে সুপার গ্রুপের এই সকল সদস্য ছাড়াও অনেক মিউজিশিয়ান অংশগ্রহণ করেছিলেন।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান; source- BBC

প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব

পণ্ডিত রবিশংকরের ধারণা ছিলো কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে অন্তত ২৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, তবে দুটি কনসার্ট শেষে ২,৪৩,৪১৮.৫০ ডলার উঠে আসে। এখান থেকে যে শুধু অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা নয়, বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা রেখেছে কনসার্টটি। আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমগুলোতে যেখানে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিবেদন হচ্ছিল, সেখানে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই কনসার্টটি। রবিশংকর এ কনসার্ট সম্পর্কে বলেন, “এক দিনেই সকলে বাংলাদেশের নাম জেনে যায়। এটা ছিল অলৌকিক”। ১২ আগস্ট কনসার্ট থেকে সংগ্রহ করা অর্থ ইউনিসেফের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যা দিয়ে পরবর্তীতে বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়।

দাতব্য কনসার্টের ধারণাটি এখন সকলের কাছেই বেশ পরিচিত। বিশেষ করে রক ধারায় এ ধরনের কনসার্ট প্রায়ই হয়ে থাকে। কিন্তু সত্তরের দশকে এটাই ছিল প্রথম। সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এ কারণগুলো প্রচলিত হয়ে গেলেও ঐ সময়ে এটা ছিল অনন্য, অনেক সাহসের ব্যাপার। তারা ছিল পথিকৃৎ”। শুধু দাতব্য কনসার্টের ধারণাটি নয়, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিল প্রথম কোনো বড় কনসার্ট, যেখানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও রক সংগীত একই মঞ্চে পরিবেশিত হয়।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশে রিঙ্গো স্টার; source- pinterest.com

বিটলসের মতো জনপ্রিয় ব্যান্ড ভেঙ্গে যাওয়ার পর রক সংগীতের ভক্তদের মাঝে দেখা দেয় হতাশা, এমন সময় হ্যারিসন বিটলস ব্যান্ডের ড্রামার রিঙ্গো স্টার সহ সুপার গ্রুপকে নিয়ে করা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ভক্তদের পুনরুজ্জীবিত করেছিল। কনসার্টে উপস্থিত দর্শকের সংখ্যা ও তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ বিশ্ব সংগীতকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি মুক্তির মধ্য দিয়ে কনসার্টটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ৯ আগস্ট পণ্ডিত রবিশংকর, আলী আকবর খান ও আল্লা রাখার তৈরি ‘জয় বাংলা’ ইপি (এক ধরনের রেকর্ড/অ্যালবাম) মুক্তি পায়। এ অ্যালবাম থেকে আয় করা অর্থ বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তায় ব্যয় করা হয়।

‘জয় বাংলা’ ইপি এর প্রচ্ছদ; source- bootlegzone.com

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ লাইভ রেকর্ড করা হয়েছিল যা ভিডিও এবং অডিও অ্যালবাম আকারে পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ২০ তারিখে অডিও অ্যালবামটি তিনটি রেকর্ডের (গ্রামোফোন) একটি বক্স আকারে বাজারে মুক্তি পায়। ১৯৭২ সালে ডকুমেন্টারিসহ ভিডিও অ্যালবামটি প্রকাশ পায়।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের রেকর্ড, ১৯৭১; source- ebay.com

পরবর্তী বছরগুলোতে-

  • ১৯৭৩ সালে অ্যালবামটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়।
  • ১৯৯১ সালে অ্যালবামটি দুটি সিডি আকারে প্রকাশ করা হয়।
  • ২০০১ সালে (মৃত্যুর আগে) অ্যালবামটি পুনরায় প্রকাশের জন্য কাজ করছিলেন হ্যারিসন, যা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
  • ২০০৫ সালের অ্যালবামটি একটি নতুন ডকুমেন্টরি সহ (Concert for Bangladesh Revisited with George Harrison and Friends) ডিভিডি আকারে প্রকাশিত হয়।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি এর প্রচ্ছদ, ২০০৫; source- amazon.com

অ্যালবামগুলো থেকে আয় হওয়া অর্থ দাতব্য কাজে ব্যয় হয়েছে এবং হচ্ছে। ইউনিসেফের হ্যারিসন ফান্ডে জমা হওয়া এ অর্থ থেকে স্বাধীনতার পরও বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশে সাহায্য পাঠানো হয়। পরবর্তীতে এ ফান্ডের অর্থায়নে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুদের জরুরি স্বাস্থ্য বিষয়ে সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ২০১৬ সালের দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য কিছু কর্মসূচি এখনো চলছে এ ফান্ডের সহায়তায়।

৪৬ বছর হয়ে গেছে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের। জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশংকর সহ সুপার গ্রুপের সকল শিল্পী মানবতার তাগিদে করেছিলেন কনসার্টটি। এটি না হলে হয়ত কয়েক লক্ষ শরণার্থীকে স্বাধীন ভূখন্ডে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে মরতে হত অন্যের ভূখন্ডে। হয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্ববাসীর সমর্থন বা সহায়তা কোনোটাই পেত না বাংলাদেশ। তাই আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করি পণ্ডিত রবিশংকরের স্মৃতির প্রতি।

ফিচার ইমেজ- creativeindiamag.com

Related Articles