Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একটি ভুল, এন্টিবায়োটিক রূপকথা এবং নির্মম ভবিষ্যৎবাণী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাধারণ কিছু রাসায়নিক গ্যাসের অসাধারণ এক খলনায়কে পরিণত হবার কথা যেমন বিশ্ববাসী জানে, তেমনি একই প্রেক্ষাপটে সাধারণ এক রাসায়নিক পদার্থ পেনিসিলিন হয়ে উঠে জীবন রক্ষাকারী মহাকাব্যিক এক ওষুধি দ্রব্য। এন্টিবায়োটিক নামে পরিচিত পেনিসিলিন মানব জাতির ইতিহাসকে অন্য দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এক রাসায়নিক পদার্থ। পৃথিবী নামক গ্রহে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, ঠিক তখন সাধারণ কাটাছেড়ায় কিংবা অপারেশনে মারা যাচ্ছিলো শত শত মানুষ। সাথে আছে সিফিলিস, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, টাইফয়েড, গনোরিয়া সহ ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত শত শত রোগ।

ঠিক তখনই পেনিসিলিন নামক এন্টিবায়োটিক বদলে দেয় এই দৃশ্যপট। সাধারণ কাটাছেড়ার ফলে সুযোগ সন্ধানী জীবাণুর আক্রমণে নাজুক সৈনিকেরা দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সাধারণ ডেটল-সেভলনের মতো এন্টিসেপ্টিক চারপাশ পরিষ্কার রাখে। কিন্তু জীবাণু যখন রোগীর ভেতরেই প্রবেশ করে তখন তা সামলানো খাদ্যযোগ্য এন্টিবায়োটিক ছাড়া এক কথায় অসম্ভব। তাছাড়া এই এন্টিবায়োটিক দিয়েই ঠেকানো যাবে ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগসমূহ। তাই বাঘাবাঘা সব বিজ্ঞানী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এন্টিবায়োটিকের খোঁজ চালাচ্ছিলেন। পেনিসিলিন হলো মানবজাতির ইতিহাস বদলে দেওয়া সেই এন্টিবায়োটিক।

জীবন বাঁচানো এন্টিবায়োটিক (ছবিসূত্রঃ NCBI)

রূপকথা লিখবেন যিনি

পৃথিবী নামক গ্রহে এন্টিবায়োটিক রূপকথার নায়ক ফ্লেমিং জন্ম নেন স্কটল্যান্ডের এক দরিদ্র পরিবারে। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে আসা ফ্লেমিং ১ম বিশ্বযুদ্ধে রয়্যাল আর্মির ডাক্তার হিসাবে যোগ দেন। সেখানেই তিনি দেখেন কীভাবে সেনাদের সামান্য ক্ষত জীবাণুর সংস্পর্শ পেয়ে প্রাণঘাতী হয়ে উঠে। যুদ্ধ থেকে ফিরে ১৯১৮ সালে তিনি যোগ দেন সেন্ট মেরি হাসপাতালে।

ভাগ্যবান এক ভুল দিয়ে গল্পের শুরু

১৯২৮ এর সেপ্টেম্বর মাস, বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং টাইফয়েড রোগের জীবাণুর কোনো সম্ভাব্য প্রতিষেধক পাওয়া যায় কিনা তাই নিয়ে কাজ করছিলেন। অন্য সব সাধারণ দিনের মতোই তার ল্যাবরেটরিতে স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামক এক ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে কাজ করেছিলেন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের একদিন বেচারা ফ্লেমিং ভুল করে ল্যাবরেটরিতে ব্যাক্টেরিয়া জন্মাবার পাত্র অর্থাৎ পেট্রিডিশগুলো পরিষ্কার না করেই ফেলে রেখে দেন অনেক দিন। কিছুদিন পরে ফ্লেমিং দেখতে পান সেই প্লেটে এমন একটা কিছু জন্মাচ্ছে যার কারণে তার চারপাশে জন্মাচ্ছে না সেই ব্যাক্টেরিয়া।২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৮ এ ফ্লেমিং নিশ্চিত হন পেনিসিলিয়াম নামক খুব সাধারণ এক ছত্রাকের জন্মাবার কারণেই ঠিক এমনটি হচ্ছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই ঘটনাকে অনেকে বলেন “Most Fortunate Mistake“।

পেনিসিলিয়ামের আশেপাশে খালি জায়গা , যেখানে জন্মাতে পারেনি ব্যাকটেরিয়া (ছবিসূত্রঃ Wikipedia)

ফ্লেমিং এর জানা ছিলো প্রায় ঠিক একই ধরনের পেনিসিলিন ছত্রাকই ব্যবহৃত হয় বিখ্যাত ডেনিশ ব্লু চিজ (Danish Blue Cheese) তৈরীতে। ঘটনাক্রমে ১৮৭৪ সালে আরেক বিজ্ঞানী উইলিয়াম রবার্টস তার গবেষণাগারে কয়েক টুকরো ব্লু চিজ ফেলে চলে গিয়েছিলেন। প্রায় কয়েক সপ্তাহ পড়ে থাকার পরেও সেটি অক্ষত থাকে। এতে কোনো পচন ধরেনি। এই ঘটনা বেশ চিন্তিত করে তাকে। এই চিজ নিয়ে বিস্তর গবেষণার পরে ফলাফল হিসাবে উল্লেখ করেন যে ব্লু চিজের পেনিসিলিয়াম মূলত এই ঘটনার জন্যে দায়ী। লুইস পাস্তুরও এক পরিক্ষা করে নিশ্চিত হন যে আগে থেকেই পেনিসিলিয়াম জন্মানো পাত্রে এনথ্রাক্স জীবাণু জন্মায় না।

ফ্লেমিং ম্যাজিক

দীর্ঘ পরীক্ষার পর ফ্লেমিং নিশ্চিত হন যে পেনিসিলিয়াম ছত্রাকটি পেনিসিলিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক ক্ষরণ করে, যা ব্যাক্টেরিয়াকে প্রতিহত করে। শুধু তাই নয় তিনি দেখতে পান এই রাসায়নিক পদার্থে স্কারলেট ফিভার, নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া আর মরণঘাতী মেনিনজাইটিস জীবাণুও জন্মাতে পারে না। এমনকি গনোরিয়ার মতো রোগের জীবাণুকেও জন্মাতে দেয় না এই রাসায়নিক দ্রব্য। ইউরোপের শীতপ্রধান দেশে নিউমোনিয়ার উপদ্রব আর যৌনবাহিত রোগ গনোরিয়া তখন বিশ্বজুড়ে আতংক ছড়াচ্ছিলো। ফ্লেমিং চিন্তা করেন কিভাবে এই রাসায়নিক দিয়ে এসব রোগের মোকাবেলা করা যায়। মূলত তিনি তার ল্যাবরেটরিতে পেনিসিলিয়াম জন্মানো থেকে শুরু করে কিভাবে পেনিসিলিন আলাদা করা যায় এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করেন।

পেনিসিলিনের বিজ্ঞাপন (ছবিসূত্রঃ Wikipedia )

একটি গবেষণাপত্র, অধ্যবসায় আর সাফল্য

ফ্লেমিং এর এই যুগান্তকারী গবেষণা ১৯২৯ এর মাঝামাঝি “ব্রিটিশ জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথোলজি” নামক জার্নালে প্রকাশ পায়। কিন্তু এই গবেষণা বিজ্ঞানী মহলে তেমন সাড়া ফেলেনি। ১৯২৯ থেকে ১৯৪০ নাগাদ পেনিসিলিন নিয়ে টানা কাজ করেন বিজ্ঞানী ফ্লেমিং। ছত্রাক থেকে এই পদার্থ নিয়ে আলাদা করা এবং চিকিৎসাকাজে পেনিসিলিন ব্যবহার করার চেষ্টা করে এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই বিজ্ঞানী।

সেই কঠিন মুহুর্তে তার দেখা হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ দুই গবেষক হাওয়ার্ড ফ্লোরে এবং আরনেস্ট বরিস কেইনীর সাথে। সাথে ছিলেন রসায়নবিদ নর্ম্যান হিটলি। এই তিনজন মিলে আবিষ্কার করেন পেনিসিলিনের রাসায়নিক কাঠামো আর কিভাবে তা পৃথক করা যায়। এরপর সেই রাসায়নিকের ব্যবহার শুরু হয় ইঁদুর এবং আরো কয়েকটি প্রাণীর উপরে। ১৯৪১ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরপরই আমেরিকা পাড়ি জমান হাওয়ার্ড ফ্লোরে এবং আরনেস্ট বরিস। আমেরিকার এক হাসপাতালে ১৯৪২ এর মার্চে এনি মিলার নামে প্রথম কোনো বেসামরিক রোগীকে পেনিসিলিন দেয়া হয়, যার গর্ভপাত পরবর্তী জটিলতা পরবর্তীতে প্রাণঘাতী ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশনে রুপ নেয়। বাঁঁচার আশা শেষ হয়ে যাওয়া এই রোগীর উপর প্রথম সফলভাবে কাজ করে। এন্টিবায়োটিকের এই অভূতপূর্ব সাফল্য নতুন যুগের সূত্রপাত করে।

আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, হাওয়ার্ড ফ্লোরে এবং আরনেস্ট বরিস কেইনী (ছবিসূত্রঃ Wikipedia)

যুদ্ধজয়ের অজানা এক অস্ত্র

২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ এর জানুয়ারী থেকে মে, এই কয়েক মাসের মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ইউনিট পেনিসিলিন তৈরী করে আমেরিকার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। যুদ্ধের শেষ নাগাদ এক হিসাবে দেখা যায় আমেরিকাতে ৬৫০ বিলিয়ন ইউনিট পেনিসিলিন তৈরী হয়েছে, যা মিত্র বাহিনীতে জীবাণু সংক্রান্ত রোগের মৃত্যু হার ৯০ শতাংশ হ্রাস করে। আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান কোনো কোনো মিডিয়াতে পেনিসিলিনকে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ জয়ের অদৃশ্য হাতিয়ার হিসাবে উল্লেখ করা হয়। যুদ্ধ শেষে জীবন রক্ষাকারী এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন বিশ্বব্যাপী প্রস্তুত করা শুরু হয়।

পেনিসিলিন তৈরীর রিএক্টর (ছবিসূত্রঃ NCBI)

খ্যাতির স্বর্ণশিখরে

এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা প্রমাণ হবার পরেই খ্যাতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যান ফ্লেমিং। ১৯৪৩ এ রয়্যাল সোসাইটি অফ বায়োলজির ফেলো নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪৪ সালে তাকে সম্মানিত করা হয় নাইটহুড দিয়ে। যুদ্ধের পর ১৯৪৫ এ চিকিৎসাবিদ্যার নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয় ফ্লেমিং, ফ্লোরে এবং কেইনকে। টাইমসের প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন পেনিসিলিন ম্যান নামে খ্যাত ফ্লেমিং। ২০০০ সালে করা এক জরীপে পেনিসিলিন স্থান করে নেয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবে। ১৯৫৫ সালের ১১ মার্চ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন পেনিসিলিন ম্যান। কিন্তু তিনি পিছনে রেখে গেছেন মহাকাব্যিক রাসায়নিক পদার্থ।

টাইমের প্রচ্ছদে পেনিসিলিন ম্যান (ছবিসূত্রঃ Time)

ভবিষ্যৎবাণী

অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাওয়া এক ভবিষ্যতবাণী (ছবিসূত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার)

তবে যাবার আগে ফ্লেমিং সতর্ক করে গেছেন এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার নিয়ে। অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার যে পেনিসিলিন প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়ার জন্ম দিবে তা তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন ১৯৪৫ সালে নোবেল নিতে গিয়ে দেওয়া লেকচারেই। লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো এই এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিনের অপব্যবহার যে পেনিসিলিন প্রতিরোধী জীবাণু তৈরী করতে পারে এর উদাহরণ জীবদ্দশায়ই দেখে যান ফ্লেমিং।

নির্মমভাবে তার ভবিষ্যৎবাণী সত্য করে দিয়ে ১৯৪৭ এ প্রথম এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে এসে মানবজাতির এন্টিবায়োটিক অপব্যবহারের মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে পেনিসিলিন এখন প্রায় অকেজো এক এন্টিবায়োটিকের নাম। কাজ করে না কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধেই। পেনিসিলিনের পর জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আবিষ্কার হয়েছে অনেক এন্টিবায়োটিক। কিন্তু থামছে না অপব্যবহার। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক সেবন বন্ধ করলে হয়তো এই অপব্যবহারে লাগাম টেনে ধরা যেতে পারে। তাই সুন্দর আগামীর জন্যে নিশ্চিত হোক সঠিক আর নির্দেশিত মাত্রায় এন্টিবায়োটিক সেবন।

তথ্যসূত্র

১) ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3673487/

২) en.wikipedia.org/wiki/History_of_penicillin

৩) content.time.com/time/covers/0,16641,19440515,00.html

৪) en.wikipedia.org/wiki/Alexander_Fleming

৫) businessinsider.com/alexander-fleming-predicted-post-antibiotic-era-70-years-ago-2015-7

৬) pbs.org/newshour/rundown/the-real-story-behind-the-worlds-first-antibiotic/

Related Articles