ইসরায়েলের গোপন অপারেশন: সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি’র গুপ্তহত্যা

১৯৪৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। জেরুজালেমের রুমানিয়ান চার্চের ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের প্রশাসনিক ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেণ্টের (সিআইডি) বিশেষ ইহুদী বিভাগের কমাণ্ডার, টম উইলকিন। তার গন্তব্য ছিল সিআইডির নিকটবর্তী রাশিয়ান কম্পাউণ্ড, যেখানে ইহুদী গুপ্ত সংস্থাগুলোর সদস্যদেরকে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। অন্য সব সময়ের মতো সেদিনও উইলকিন সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করছিলেন। রাস্তা পার হওয়ার আগেই তিনি উঁকি মেরে দেখে নিয়েছিলেন রাস্তার দু’পাশ, এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে স্পর্শ করে রেখেছিলেন তার রিভলভারটি। কিন্তু তার জানার কথা ছিল না, একটু সামনের সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটের এক অন্ধকার সরু গলির ভেতর তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওঁৎ পেতে ছিল কুখ্যাত ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন ‘লেহি‘র এক সদস্য, ডেভিড শমরন।

লেহি ছিল ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাপূর্বকালীন সময়ে সক্রিয় ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মৌলবাদী। লেহি শব্দটি মূলত ‘ফাইটার্স ফর দ্য ফ্রিডম অফ ইসরায়েল’ এর হিব্রু নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে, আরেকটি সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। লেহির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উগ্র জায়নবাদী নেতা আভরাহাম স্টার্ন, যার নামানুসারে লেহিকে ক্ষমতাসীন ব্রিটিশরা স্টার্ন গ্যাং বলেই সম্বোধন করত। নামে স্বাধীনতা সংগঠন হলেও বাস্তবে লেহির কর্মকাণ্ড যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল, সেটি পরবর্তীকালে স্বীকার করেছিলেন সংগঠনটির অপারেশন বিভাগের প্রধান এবং পরবর্তীকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইতজাক শামিরও।

টম উইলকিন; Source: Wikimedia Commons

চল্লিশের দশকে সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূমি ছিল ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেট শাসনের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশরা অটোমানদেরকে পরাজিত করে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে তৎকালীন জাতিপুঞ্জ ব্রিটিশদেরকে ফিলিস্তিন শাসনের অনুমতি দিয়েছিল, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের ব্রিটিশ শাসনকেই বলা হয় ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেট শাসন। আর এই সময়ের ফিলিস্তিনকে বলা হয় ম্যাণ্ডেটরি ফিলিস্তিন।পুরো ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের শাসনামল জুড়েই জায়নবাদী ইহুদীরা সক্রিয় ছিল ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিজেদের জন্য একটি ইহুদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে। এই জায়নবাদীদের মধ্যে কেউ ছিল রাজনৈতিকভাবে তাদের দাবি পেশ করে ধীরে ধীরে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু তার বিপরীতে অনেকেই ছিল বল প্রয়োগের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব ইসরায়েল সৃষ্টি করার পক্ষে। লেহি ছিল এই দ্বিতীয় প্রকারের সংগঠন।

যদিও ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ইহুদী নেতা লায়নেল ওয়াল্টার রথশিল্ডের প্রতি প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদীদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন, কিন্তু তার ঘোষণায় কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা দিন-তারিখ নির্ধারিত ছিল না। এবং বাস্তবে ব্রিটিশরা দ্রুত ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে নিজেরাই ফিলিস্তিন শাসন করে যেতে থাকে। ফলে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পথে স্থানীয় আরবদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন ব্রিটিশরাও হয়ে উঠতে থাকে উগ্রপন্থী ইহুদীদের সবচেয়ে বড় শত্রু। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, দ্রুত ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করার একটাই উপায়, তা হলো ব্রিটিশ অফিসারদের উপর একের পর এক আক্রমণ, গুপ্তহত্যা।

সন্ত্রাসী সংগঠন লেহির লোগো; Source: Wikimedia Commons

চল্লিশের দশকে লেহির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের সিআইডির কমাণ্ডার টম উইলকিন। কারণ উইলকিন সাধারণ কোনো অফিসার ছিলেন না, তিনি ছিলেন সিআইডির বিশেষ একটি ইউনিটের প্রধান, যাদের কাজ ছিল লেহি তথা স্টার্ন গ্যাংসহ অন্যান্য গুপ্ত ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি নিজেও হিব্রু ভাষা জানতেন এবং দীর্ঘ ১৩ বছর চাকরির সুবাদে হিব্রু ভাষায় পারদর্শী তার একটি বিশাল গুপ্তচরের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের মাধ্যমে তিনি ইহুদীদের অনেকগুলো গোপন অপারেশনের সংবাদ আগেই পেয়ে যেতেন এবং অপারেশন পরিচালনার আগেই অভিযান চালিয়ে তা ব্যর্থ করে দিতেন।

টম উইলকিনের অভিযানগুলোর কারণে লেহি এবং অন্যান্য গুপ্ত ইহুদী সংগঠনগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছিল না। তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা উইলকিনের অভিযানে ধরা পড়ে, অনেকের বিচারে শাস্তি হয়, কারো কারো মৃত্যুদণ্ডও হয়। বাকিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সংগঠনের অনেক গোপন তথ্য জেনে নেয় উইলকিন। লেহির বেশ কয়েকটি গোপন অস্ত্রভাণ্ডারও বাজেয়াপ্ত হয় উইলকিনের তৎপরতায়। এসব কারণে উইলকিনকে হত্যা করা লেহির জন্য জরুরী ছিল। ফলে লেহির অপারেশন বিভাগের প্রধান, ইতজাক শামির টম উইলকিনকে হত্যার নির্দেশ জারি করেন। হত্যাকান্ডের দায়িত্ব এসে পড়ে ডেভিড শমরন এবং তার সহকর্মী ইয়াকভ বানাইয়ের উপর।

লেহি তথা স্টার্ন গ্যাং এর প্রতিষ্ঠাতা আভ্রাহাম স্টার্ন; Source: Wikimedia Commons

টম উইলকিনের উপর হত্যাচেষ্টা অবশ্য সেবারই প্রথম ছিল না। প্রায় তিন বছর আগে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে লেহির প্রথম অপারেশনটিই ছিল উইলকিনের উপর। সে সময় অবশ্য উইলকিন না, তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উইলকিনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জোফ্রি মর্টন। ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারির ঐ অপারেশনে লেহির গুপ্তঘাতকরা তেল আবিবের ইয়েল স্ট্রিটের একটি ভবনের ভেতরে এবং ছাদের উপর বোমা পেতে আসে। মর্টন এবং উইলকিনের ঐ ভবনটিতে যাওয়ার কথা থাকলেও তাদের একটু দেরি হওয়ায় তারা পৌঁছার আগেই বোমা বিস্ফোরিত হয়। নিহত হয় তিনজন ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা এবং দুজন ইহুদী ও একজন ব্রিটিশ বেসামরিক নাগরিক।

সে ঘটনার পরপরই ব্রিটিশ ডিফেন্স সিকিউরিটি অফিস (এমআই৫ এর ঔপনিবেশিক শাখা) স্টার্ন গ্যাংকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে। তাদের অভিযানে শেষপর্যন্ত লেহির প্রতিষ্ঠাতা আভ্রাহাম স্টার্ন, অপারেশন প্রধান ইতজাক শামিরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেপ্তার হন। বন্দী থাকা অবস্থাতেই জোফ্রি মর্টনের গুলিতে মারা যান আভ্রাহাম স্টার্ন। প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে লেহির অন্য সদস্যরা মর্টনের উপর আবারও আক্রমণ করে। এবারের আক্রমণে মর্টন গুরুতরভাবে আহত হন এবং শেষপর্যন্ত ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যান। মর্টনের স্থলে দায়িত্ব নেন টম উইলকিন, আর অন্যদিকে বন্দী অবস্থা থেকে পালাতে সক্ষম হওয়া ইতজাক শামির পুনরায় দায়িত্ব পান লেহির অপারেশন প্রধান হিসেবে।

জোফ্রি মর্টন; Source: Wikimedia Commons

ইতজাক শামিরের নির্দেশে ডেভিড শমরন এবং ইয়াকভ বানাই টম উইলকিনের উপর হামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেন। জেরুজালেমের রুমানিয়ান চার্চের বাসভবনে উইলকিনের অবস্থান নিশ্চিত করার পর তারা তাদের অভিযান শুরু করেন। শমরন এবং বানাই অবস্থান নেন সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটের এক অন্ধকার সরু গলির ভেতর। তাদের পকেটে ছিল রিভলভার এবং গ্রেনেড। রাস্তার অপর পাশে মুদির দোকার সামনে এবং অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নেয় লেহির অন্যান্য এজেন্টরা। তাদের পরনে ছিল পরিচ্ছন্ন স্যুট এবং হ্যাট, যেন তাদেরকে ব্রিটিশ বলে মনে হয়।

টম উইলকিন যখন রাশিয়ান কম্পাউণ্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেন, তখন মুদির দোকানের সামনে অবস্থান নেওয়া লেহির এক এজেন্ট উঠে দাঁড়ায় এবং তার হ্যাটটি মাটিতে ফেলে আবার কুড়িয়ে নেয়। এটি ছিল শমরন এবং বানাইয়ের প্রতি তার বিশেষ সিগনাল। তারা গলি থেকে বের হয়ে উইলকিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রথমে তারা উইলকিনকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যান। পকেট থেকে তাদেরকে সরবরাহ করা উইলকিনের ছবি বের করে আবারও নিশ্চিত হয়ে নেন তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে। এরপর ঘুরে উল্টোদিকে হেঁটে আসতে থাকেন। পকেটে শক্ত হাতে ধরে রাখেন তাদের রিভলভার এবং গ্রেনেড।

ডেভিড শমরন (বাম) ও ইয়াকভ বানাই (ডানে); Source: lehi.org.il

অপারেশনের আগে বানাই শমরনকে অনুরোধ করেছিলেন যে, তিনিই প্রথমে উইলকিনকে গুলি করবেন। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি শমরন। পকেট থেকে রিভলভার বের করে গুলি করতে শুরু করেন। দুজনেই পুরো ম্যাগাজিন শেষ করে ফেলেন উইলকিনের উপর। তাদের ১৪টি গুলির মধ্যে ১১টিই আঘাত করে উইলকিনের শরীরে। উইলকিন ঘুরে দাঁড়ান, পকেট থেকে তার রিভলভারটিও বের করেন, কিন্তু ততক্ষণে তার শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে যান তিনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে তার।

বহু বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে শমরন স্বীকার করেছিলেন, উইলকিন হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। তারা বিশ্বাস করতেন, যত বেশি ব্রিটিশ অফিসারের লাশবাহী কফিন ব্রিটেনে ফেরত যাবে, তাদের ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যও তত দ্রুত অর্জিত হবে। তার শুধু একটাই আফসোস, সেদিন উইলকিনকে হত্যার পর তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে তারা তার সাথে থাকা ব্রিফকেসটা নিয়ে যেতে পারেননি। সেটা নিতে পারলে হয়তো তারা ব্রিটিশ গোয়েন্দাবাহিনীর অনেক গোপন তথ্য জানতে পারতেন, যা তাদের পরবর্তী অপারেশনগুলোতে কাজে আসত।

স্টার্ন গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, মাঝে ইৎজাক শামির; Source: Wikimedia Commons

ব্রিটিশ অফিসার টম উইলকিনকে হত্যা লেহির একমাত্র অপারেশন ছিল না, বা লেহিও ইহুদীদের একমাত্র বা প্রথম গুপ্ত সংগঠন ছিল না। লেহির এবং অন্যান্য সংগঠনের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে এই সিরিজের পরবর্তী পর্বগুলোতে। প্রথম কয়েকটি পর্বে থাকবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইহুদীদের ব্রিটিশ এবং নাৎসি বাহিনীবিরোধী অপারেশনগুলো এবং তাদের গোপন সংগঠনগুলোর পরিচয়। কিন্তু এরপরে ধীরে ধীরে স্থানীয় আরবদের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনি বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত তাদের অপারেশনগুলোও উঠে আসবে।

উপস্থাপনার প্রয়োজনে আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন উৎসের সাহায্য নেব। তবে আমাদের প্রধান উৎস থাকবে সম্প্রতি প্রকাশিত ইসরায়েলি সাংবাদিক ও গবেষক রোনান বার্গম্যানের বই Rise and Kill Fisrt: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations, যে বইটিতে উঠে এসেছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন অজানা অপারেশনের কাহিনী। বইটির একটি অধ্যায় অবলম্বনে আমাদের আগের একটি লেখা আপনি পড়ে নিতে পারেন এই লিংক থেকে, যেখানে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার লক্ষ্যে সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের অনেকগুলো অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে।

এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো:

(২) উগ্র জায়নবাদের উত্থান(৩) ইহুদীদের নৈশ প্রহরী হাশোমারের ইতিহাস

ফিচার ইমেজ: Youtube

Related Articles