Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেফ্‌রি ডাহ্‌মার: নরখাদক ও বিকৃত যৌনমানসিকতার ভয়াবহ এক সিরিয়াল কিলার

১৯৬০ সালের মে মাসের ২১ তারিখের কথা। আমেরিকার উইস্‌কন্সিন অঙ্গরাজ্যের ওয়েস্ট অ্যালিস শহরে জয়েস অ্যানেট ডাহ্‌মার ও লিওনেল হার্বার্ট ডাহ্‌মার দম্পতির ঘর আলো করে সেদিন জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান। বাবার সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয় জেফ্‌রি লিওনেল ডাহ্‌মার। টেলিটাইপ মেশিন ইন্সট্রাক্টর মা এবং মারকোয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষার্থী বাবার ঘরে আদর-যত্নেই বড় হচ্ছিলো ছোট্ট ডাহ্‌মার।

তবে দুনিয়াতে আসলে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী না। ডাহ্‌মারের কপালের সুখও তাই বেশিদিন সইলো না। তার মায়ের কিছুটা মানসিক সমস্যা ছিলো। তিনি সবসময় দুশ্চিন্তায় ভুগতেন, অন্যদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে চাইতেন এবং কারণে-অকারণে স্বামী ও প্রতিবেশীদের সাথে তর্ক জুড়ে দিতেন। নিজের পড়াশোনার জন্য ডাহ্‌মারের বাবাকেও অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে কাটাতে হতো। যখন তিনি বাসায় আসতেন, তখন জয়েস সামান্য ব্যাপারেই খিটমিটে মেজাজ দেখানো শুরু করলে তাকে শান্ত করতেই ব্যস্ত থাকা লাগতো হার্বার্টকে। ফলে পরিবারের ছোট সদস্যটির দিকে ঠিকমতো নজর দিতে পারতেন না কেউই।

dahmer-17

১৭ বছর বয়সে জেফ্‌রি ডাহ্‌মার

এভাবেই একসময় স্কুলের গন্ডিতে পা রাখে জেফ্‌রি ডাহ্‌মার। স্কুলে তার বন্ধু-বান্ধব বলতে তেমন কেউ ছিলো না। চুপচাপ থাকতেই বেশি পছন্দ করতো সে। তবে ছোটবেলা থেকেই পশুপাখির প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ ছিলো তার। মাঝে মাঝেই ফড়িং, প্রজাপতি কিংবা অন্যান্য পোকামাকড় ধরে সেগুলো জারে রেখে দিতো সে। কখনো রাস্তায় কোনো মৃত প্রাণী পেলে তা বাসায় কিংবা বাসার পেছনের জঙ্গলের মতো জায়গায় নিয়ে কেটে দেখতো ছোট ডাহ্‌মার। ডাহ্‌মারের মতে, মৃত প্রাণীদের প্রতি তার এ আকর্ষণের শুরু বছর চারেকের দিকে, যখন সে তারা বাবাকে তাদের বাড়ির নিচ থেকে কোনো এক প্রাণীর হাড় সরাতে দেখেছিলো। হাড়ের সংঘর্ষের শব্দ ডাহ্‌মারকে এতটাই আনন্দ দিয়েছিলো যে, সেখান থেকেই মৃত প্রাণীদের হাড় সংগ্রহ করে তা নিয়ে খেলা করা রীতিমত তার নেশা হয়ে দাঁড়ায়।

হাই স্কুলে ভর্তি হবার পর ডাহ্‌মার আস্তে আস্তে বিয়ার ও স্পিরিটে আসক্ত হয়ে পড়ে। অমনোযোগীতার দরুণ তার পরীক্ষার ফলাফলও ছিলো মোটামুটি মানের। বয়ঃসন্ধিকালে নিজের সম্বন্ধে এক নির্মম সত্য টের পেয়ে যায় ডাহ্‌মার- বিপরীত লিঙ্গের চেয়ে সমলিঙ্গই তাকে বেশি আকর্ষণ করে! নিজের এ সমকামী মনোভাবের কথা অবশ্য বাবা-মাকে জানায় নি ডাহ্‌মার। এমনকি কৈশোরে সে একটি ছেলের সাথে কিছুদিন সম্পর্কেও জড়িয়েছিলো, তবে তাদের মাঝে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয় নি।

তবে নিজের বিচিত্র যৌনাকাঙ্ক্ষা তাকে সর্বদাই তাড়া করে বেড়াতো। মিলিত হবার সময় পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখা এবং কিছুটা কর্তৃত্ব প্রদর্শনের চিন্তা সবসময়ই তার মাথায় ঘুরপাক খেতো। ১৬ বছর বয়সে প্রথম এমন এক সুযোগ পেয়ে যায় কিশোর ডাহ্‌মার। একদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া এক লোককে রাস্তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সে। আশেপাশে কাউকে না দেখে অজ্ঞান সেই লোকটির সাথেই মিলিত হয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে সে। লোকটি জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঝামেলা করতে পারে ভেবে একটু দূরেই ঝোপের আড়ালে বেসবল ব্যাট হাতে বসে ছিলো সে, ভেবেছিলো লোকটি এ পথে আসলে আঘাত করে ঠান্ডা করে দিবে। লোকটি সেদিন এ পথে না আসায় বেঁচে গিয়েছিলো। আর ডাহ্‌মারের জীবনে এটিই ছিলো কাউকে হত্যার প্রথম পরিকল্পনা।

ওদিকে জয়েস ও হার্বার্ট ডাহ্‌মারের মাঝে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছিলো। অবশেষে ১৯৭৮ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। জয়েস তার বাবা-মায়ের পরিবারে ফিরে যান। তবে জেফ্‌রি ডাহ্‌মারের বয়স ততদিনে ১৮ হয়ে যাওয়ায় নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তার নিজের হাতেই ছিলো। আর এ ১৮ থেকেই যেন প্রকাশ পেতে থাকে ডাহ্‌মারের ভেতরে থাকা আসল রুপটির…

বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও ডাহ্‌মার তাদের আগের বাসাটিতেই একা থাকতো। ১৯৭৮ সালের ১৮ জুনের কথা। সেদিন একসাথে অ্যালকোহল পানের কথা বলে ডাহ্‌মার স্টিভেন মার্ক হিক্স নামের এক ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসে। কয়েক ঘন্টা ধরে মদ্যপান ও গান শোনার পর হিক্স চলে যেতে চাইলেও ডাহ্‌মার তাকে যেতে দিতে চাইছিলো না। তাই চুপ করে পেছন থেকে গিয়ে হিক্সের মাথায় দুবার ১০ পাউন্ডের মুগুর দিয়ে আঘাত করে সে। এতে হিক্স অজ্ঞান হয়ে গেলে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে ডাহ্‌মার। এরপর তার মৃতদেহকে উলঙ্গ করে তার উপর হস্তমৈথুন করে নিজের বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা প্রথম বাস্তবায়িত করে সে। পরদিন মৃতদেহটি কেটে বাসার পেছনে কবর দেয় সে। সপ্তাহখানেক পর দেহটি আবার কবর থেকে তুলে হাড় থেকে মাংস আলাদা করে সে। তারপর মাংসগুলো এসিডের দ্রবণে দ্রবীভূত করে টয়লেটে ফ্লাশ করে দেয় সে। তারপর হাড়গুলো ভারী হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চূর্ণ করে সেগুলো ছড়িয়ে দেয় বাড়ির পেছনের জঙ্গলে! এটিই ছিলো জেফ্‌রি ডাহ্‌মারের প্রথম খুনের ঘটনা।

এর মাসখানেক পর ডাহ্‌মার ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় বিজনেসে মেজর করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কয়েক মাস পর এখান থেকেও ঝরে যায় সে। এরপর বাবার পীড়াপিড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে নাম লেখায় সে, প্রশিক্ষণ নেয় মেডিকেল স্পেশালিষ্ট হিসেবে। এখানে গিয়েও তার কুকীর্তি থেমে থাকে নি। ১৯৭৯ সালে এক সৈন্যকে ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে ধর্ষণ করে সে। আরেক সৈন্যকে তো টানা ১৭ মাস ধরে যৌন নির্যাতন করেছিলো সে। পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তির কারণে তার কাজের মানও দিন দিন নেমে যেতে থাকে। অবশেষে ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে ডাহ্‌মারকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

সেই বছরের ডিসেম্বরে ডাহ্‌মারের বাবা ও সৎ মা তাকে তার দাদীর কাছে পাঠিয়ে দেন। দুনিয়াতে সম্ভবত এ মানুষটির জন্যই ডাহ্‌মারের মনে কিছুটা মায়া জন্মেছিলো। সেখানে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে সে। তবে মদকে তখনো ছাড়তে পারে নি ডাহ্‌মার। ১৯৮২ সালের শুরুর দিকে মিলওয়াউকী ব্লাড প্লাজমা সেন্টারে ফ্লেবোটোমিস্ট হিসেবে একটি চাকরিও জুটিয়ে ফেলে সে। অবশ্য ১০ মাস পর চাকরিটি খুইয়ে বসে ডাহ্‌মার। আর এর অল্প কিছুদিন আগে থেকে আবারো শুরু হয় তার পদস্খলন। ১৯৮২ সালের ৭ আগস্ট উইস্‌কন্সিন স্টেট ফেয়ার পার্কে ২৫ জন নারী ও শিশুর সামনে নিজের গোপনাঙ্গ দেখানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে, গুণতে হয় ৫০ ডলার ও কোর্টের খরচাপাতির জরিমানা।

dahmer-1982

১৯৮২ সালে ডাহ্‌মার

১৯৮৫ সালে মিলওয়াউকী অ্যাম্ব্রোসিয়া চকলেট ফ্যাক্টরিতে মিক্সার হিসেবে যোগ দেয় ডাহ্‌মার। সেখানে চাকুরিরত অবস্থায় একদিন ওয়েস্ট অ্যালিস পাবলিক লাইব্রেরিতে অপরিচিত এক লোক তাকে ওরাল সেক্সের প্রস্তাব দিলে সে তা ফিরিয়ে দেয়। তবে সেদিনের এ ঘটনাই তার কৈশোরের বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষাকে আবার জাগ্রত করে তোলে। ফলে মিলওয়াউকীর সমকামী পানশালা, স্নানাগারগুলোতে তাকে নিয়মিতই দেখা যেতে থাকে।

মিলনের সময় সঙ্গীর নড়াচড়া করাকে বেশ বিরক্তিকর লাগতো ডাহ্‌মারের। তাই ১৯৮৬ সালের জুন থেকে সঙ্গীকে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতো সে। এরপর অচেতন সেই দেহের সাথেই মিলিত হতো সে। এভাবে প্রায় ১২ জনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পর স্নানাগার কর্তৃপক্ষ তার সদস্যপদ বাতিল করে দেয়। তবে ততদিনে ডাহ্‌মারকে এর নেশা পেয়ে বসেছিলো। তাই এরপর থেকে বিভিন্ন হোটেলে একই কাজ করতে থাকে সে।

১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসের কথা। মিশিগান অঙ্গরাজ্যের অন্টোনাগন গ্রামের ২৫ বছর বয়সী স্টিভেন টুয়োমির সাথে পরিচয় হয় ডাহ্‌মারের। সে তখন টুয়োমিকে অ্যাম্বাসেডর হোটেলে তার সাথে সন্ধ্যায় কিছু সময় কাটানোর আমন্ত্রণ জানায়। শুধু অচেতন করে মিলিত হওয়া ছাড়া টুয়োমিকে খুন করার কোনো পরিকল্পনাই তার ছিলো না। তবে পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার। কারণ ডাহ্‌মার দেখতে পায় যে, তার নিচে টুয়োমির অচেতন দেহটি পড়ে আছে, বুকে আঘাতের চিহ্ন, মুখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে রক্ত। ডাহ্‌মারের নিজের হাত আর কনুইয়েও ছিলো আঘাতের দাগ। রাতে নেশার ঘোরে কখন যে সে টুয়োমিকে খুন করেছে তা সে কোনোদিনই মনে করতে পারে নি। এরপর সেই মৃতদেহটিকে একটি বড় স্যুটকেসে ভরে ডাহ্‌মার সোজা রওনা দেয় নিজের দাদীবাড়ির উদ্দেশ্যে। এক সপ্তাহ পর দেহ থেকে হাত, পা আর মাথা আলাদা করে মাংসগুলোকে ছোট ছোট করে কেটে ব্যাগে ভরে সে। এরপর হাড়গুলোকে ভারি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে সে। তারপর মাথা বাদে টুয়োমির শরীরের বাকি অংশগুলোর জায়গা হয় আস্তাকুড়ে। দু’সপ্তাহ পর সয়লেক্স (এক ধরনের উচ্চ মাত্রার ক্ষারধর্মী পরিষ্কারক) ও ব্লিচের মিশ্রণে মাথাটিকে সিদ্ধ করে খুলিটি নিজের সংগ্রহে নিয়ে নেয় ডাহ্‌মার!

অনিচ্ছাকৃতভাবে টুয়োমিকে হত্যার পর ডাহ্‌মারের খুনের স্পৃহা যেন আরো বেড়ে যায়। এরপর থেকে নিয়মিতভাবেই শিকারের খোঁজে বের হতে থাকে সে।

দু’মাস পরের কথা। জেমস ডক্সটাটর নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর প্রস্টিটিউটের সাথে দেখা হয় ডাহ্‌মারের। কিছু নগ্ন ছবি তোলার জন্য ৫০ ডলারের লোভ দেখিয়ে ওয়েস্ট অ্যালিসে তাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে ডাহ্‌মার। মিলিত হবার পর ডক্সটাটরকে ওষুধ দিয়ে অচেতন করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সে। তারপর মৃতদেহটি ১ সপ্তাহের জন্য ভূগর্ভস্থ ঘরেই রেখে দেয় সে। তারপর টুয়োমির মতো করেই ডক্সটাটরের দেহটির ব্যবস্থা করে সে।

১৯৮৮ সালের ২৪ মার্চ দ্য ফিনিক্স নামে সমকামীদের এক পানশালায় রিচার্ড গেরেরো নামে ২২ বছর বয়সী এক উভকামী ছেলের সাথে পরিচয় হয় ডাহ্‌মারের। রাতের বাকি সময়টুকু ৫০ ডলারের বিনিময়ে তার সাথে কাটানোর আশ্বাসে ডাহ্‌মারের সাথে তার দাদীর বাড়িতে যায় গেরেরো। সেখানে আগের মতোই তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ডাহ্‌মার। তারপর সেই মৃতদেহের সাথে সে মেতে ওঠে বিকৃত যৌনকর্মে। ২৪ ঘন্টা পর মাথা বাদে গেরেরোর দেহের বাকি অংশও হারিয়ে যায় কোনো এক আস্তাকুড়ে, মাসখানেক পর গুড়ো গুড়ো করে ফেলা হয় মাথাটিকেও!

ডাহ্‌মারের আচরণ কিছুটা সন্দেহজনক লাগতো তার দাদীর কাছে। বিশেষ করে গভীর রাতে অপরিচিত তরুণদের ঘরে নিয়ে আসা এবং বেজমেন্ট ও গ্যারেজ থেকে আসা দুর্গন্ধ তার নজর কাড়ে। তাই ডাহ্‌মারকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেন তিনি। ফলে ২৫ সেপ্টেম্বর নর্থ টোয়েন্টি ফাইভ স্ট্রিটের এক বেডরুমের ছোট এক বাসায় উঠে যায় ডাহ্‌মার।

১৯৮৯ সালের ২৫ মার্চ ডাহ্‌মারের পরবর্তী শিকারে পরিণত হয় অ্যান্থনি সিয়ার্স নামের এক মডেল। তবে সিয়ার্সকে বেশ ভালো লেগেছিলো ডাহ্‌মারের। তাই খুনের পর তার মাথা ও জননাঙ্গ নিজের লকারে সযত্নে সংরক্ষণ করে সে! এর কিছুদিন পর সেই খুলিটিকে রঙও করে ডাহ্‌মার। ১৯৯০ সালের মে মাসে নিজের কর্মস্থলের কাছাকাছি অক্সফোর্ড এপার্টমেন্টসে একটি বাসা ভাড়া নেয় ডাহ্‌মার। এ মাসেরই ২০ তারিখে ৩২ বছর বয়সী রেমন্ড স্মিথ ডাহ্‌মারের ষষ্ঠ শিকারে পরিণত হন। তাকে আগের মতোই খুন করে বিভিন্ন অবস্থান থেকে তার ছবি তুলে নেয় ডাহ্‌মার। এগুলো সংগ্রহ করা ছিলো তার নেশা। তারপর শরীর ভ্যানিশের ব্যবস্থা করে মাথাটিকে সে রঙ করে রেখে দেয় সিয়ার্সের মাথার পাশেই। এর ১ সপ্তাহ পর ডাহ্‌মার আরেক যুবককে নিজের বাসায় আনে। তবে এবার ভুল করে ওষুধ মিশ্রিত মদ সে নিজেই পান করে ফেলে! ফলে ছেলেটি তার কিছু কাপড়, ৩০০ ডলার আর একটি ঘড়ি নিয়ে চম্পট দেয়!

একই বছরের জুনে ২৭ বছর বয়সী এডওয়ার্ড স্মিথও অকালে মারা যান ডাহ্‌মারের হাতে। তবে এবার আর আগের মতো মৃতদেহের সৎকার না করে সেটি ফ্রিজে সংরক্ষণ করে সে। এর তিন মাসেরও কম সময়ের মাথায় আর্নেস্ট মিলার নামে শিকাগোর ২২ বছর বয়সী এক তরুণকে প্রাণ হারাতে হয় ডাহ্‌মারের হাতে। মিলারের হৃদপিণ্ড, বাইসেপ্‌স ও পায়ের কিছু মাংস সে রেখে ফ্রিজে দিয়েছিলো পরবর্তীতে খাওয়ার জন্য! সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে এ তালিকায় যোগ হয় ডেভিড থমাস নামে আরো এক অভাগার নাম। দেখতে দেখতে ১৯৯০ সালটি শেষ হয়ে যায়, শুধু শেষ হয় না জেফ্‌রি ডাহ্‌মারের খুনের নেশা আর অসুস্থ যৌনাকাঙ্ক্ষা।

১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৭ বছর বয়সী কার্টিস স্ট্রটার এবং ৭ এপ্রিলে ১৯ বছর বয়সী এরল লিন্ডসেকে খুন করে ডাহ্‌মার।

অক্সফোর্ড অ্যাপার্টমেন্টসের ২১৩ নাম্বার অ্যাপার্টমেন্টটিতে থাকতো ডাহ্‌মার। ১৯৯১ সালেই তার প্রতিবেশীরা তার বাসা থেকে বিশ্রী গন্ধ আসার এবং মাঝে মাঝে করাতের শব্দ পাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করেন। তখন ম্যানেজার এ বিষয়ে খোঁজ নিতে আসলে একবার নিজের ফ্রিজ নষ্ট হবার এবং আরেকবার নিজের একুরিয়ামের মাছ মারা যাবার অজুহাত দিয়ে রক্ষা পায় সে।

২৬ মে ১৪ বছর বয়সী কোনেরাক সিন্থাসোম্ফোন নামে এক ছেলেকে পেয়ে যায় ডাহ্‌মার। তাকেও আগের মতো অজ্ঞান করে নিজের কু-উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে সে। এরপর কোনেরাককে না মেরে তার মাথায় ফ্রন্টাল লোবের ওখানে ছোট এক ছিদ্র করে সেখানে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ঢেলে দেয় সে! কিছুক্ষণ পরই অজ্ঞান হয়ে যায় ছেলেটি। তার পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ অ্যালকোহল গিলে আরো অ্যালকোহল আনতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ডাহ্‌মার। পরদিন সকালে বাসায় আসার পথে রাস্তায় তার মাথা খারাপ হবার দশা হয়। কারণ সে দেখে যে, কোনেরাক রাস্তায় উলঙ্গ বসে তিনজন মহিলার সাথে কথা বলছে। তবে ওষুধের প্রভাবে সে ছিলো অপ্রকৃতিস্থ। তারা আবার পুলিশকে ফোন করে দিয়েছিলো! কিছুক্ষণের মাঝেই পুলিশ এসে উপস্থিত হলে ডাহ্‌মার পড়ে যায় মহা বিপদে। সে তাদেরকে কোনোমতে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, তার এবং কোনেরাকের মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক আছে! তারপরও পুলিশরা নিশ্চিত হতে তার বাসা পর্যন্ত যেতে চায়। তবে ভাগ্য সেদিন ডাহ্‌মারের পক্ষে ছিলো। কারণ তারা তার বাসাটি সেভাবে চেক করে নি। আর অজ্ঞান অবস্থায় তোলা কোনেরাকের কিছু অর্ধ-উলঙ্গ ছবি দেখিয়ে ডাহ্‌মারও তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে পুলিশদের নিশ্চিত করাতে সক্ষম হয়। এরপর পুলিশ চলে গেলে কোনেরাকও আর বেশিক্ষণ পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার সুযোগ পায় নি।

কোনেরাক সিন্থাসোম্ফোনের ঘটনার পর খুনোখুনির নেশা যেন আরো জেঁকে বসে ডাহ্‌মারের মনে। ৩০ জুন ম্যাট টার্নার (২০), ৫ জুলাই জেরেমিয়াহ ওয়েইনবার্গার (২৩), ১৫ জুলাই অলিভার ল্যাসি (২৪) এবং ১৯ জুলাই জোসেফ ব্রেডহফ্‌ট (২৫) একে একে তার শিকারের খাতায় নাম লিখিয়ে বসে।

আজকের লেখার শুরুতেই বলেছিলাম যে, “দুনিয়াতে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী না।” তাহলে জেফ্‌রি ডাহ্‌মারের এ সিরিয়াল কিলিংই বা কেন ক্রমাগত চলতেই থাকবে। একদিন তাই ডাহ্‌মারও ধরা পড়েছিলো। এখন শোনাচ্ছি সেই গল্পই।

১৯৯১ সালের ২২ জুলাইয়ের কথা। কিছু নগ্ন ছবি তোলা, একসাথে বিয়ার পান করা ও কিছুটা অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর পরিবর্তে ডাহ্‌মারের দেয়া ১০০ ডলারের প্রস্তাবে রাজি হয় এডওয়ার্ড ট্রেসি (৩২)। ডাহ্‌মারের বাসায় ঢুকেই অন্য রকম এক গন্ধ নাকে আসে ট্রেসির। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই ট্রেসির হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয় ডাহ্‌মার। তারপর তাকে বাধ্য করে তার বেডরুমের দিকে যেতে। সেই রুমে ট্রেসি পুরুষদের নগ্ন পোস্টার ও একদিকে একটি সিনেমা চলতে দেখে। রুমের এক কোণায় রাখা ছিলো ৫৭ গ্যালন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নীল রঙের একটি ড্রাম, যা থেকে তীব্র কটু গন্ধ বের হচ্ছিলো। হাতে একটি ছুরি দোলাতে দোলাতে ট্রেসিকে কাপড় খুলতে বলে সে। এরপর তার বুকে কান পেতে হৃদস্পন্দন শুনে তাকে জানায় যে, সে আজকে ট্রেসির হৃৎপিণ্ড খেতে যাচ্ছে!

এমন ভয়াবহ অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা রাখে এডওয়ার্ড ট্রেসি। একের পর এক কৌশল অবলম্বন করে ডাহ্‌মারের হাত থেকে ছাড়া পেতে চায় সে। কিন্তু কিছুতেই ফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সে ডাহ্‌মারের কাছে বাথরুমে যাবার অনুমতি চায়। সেখানে গিয়ে সে তার মাথায় পরিকল্পনা সাজিয়ে নেয়। বের হয়ে আসার পর সে এমন একটি মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলো যখন ডাহ্‌মার কিছুটা অমনোযোগী হয়ে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে এমন একটি মুহূর্ত সে পেয়েও যায়। এ সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগায় ট্রেসি। আচমকা নিজের হাত ছাড়িয়ে সজোরে ডাহ্‌মারের মুখে ঘুষি চালিয়ে বসে সে হাতকড়া পরা অবস্থায়ই। এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত না থাকায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ডাহ্‌মার। আর ততক্ষণে দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে যায় ট্রেসি।

সময় তখন রাত সাড়ে এগারোটা। রাস্তার মোড়েই দুজন পুলিশ অফিসারের সাথে দেখা হয় ট্রেসির। তার কথা শুনে ডাহ্‌মারের ২১৩ নাম্বার অ্যাপার্টমেন্টে তাকে নিয়েই তল্লাশী চালাতে যায় তারা। ডাহ্‌মার তাদের সাথে বেশ ভদ্র ব্যবহারই করে। রল্‌ফ মুয়েলার নামক এক পুলিশ অফিসার ডাহ্‌মারের বেডরুমে বড় একটি ছুরি দেখতে পান। সেখানে একটি ড্রয়ার খোলা দেখতে পেয়ে সেটির তল্লাশী শুরু করেন তিনি। এতেই আক্কেলগুড়ুম হবার দশা হয় তার। কারণ সেখানেই ছিলো এতদিন ধরে তার হাতে খুন হওয়া ব্যক্তিদের নানা ভঙ্গিমায় তোলা সব ছবি। এটা দেখেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাহ্‌মার। তবে দুজন পুলিশ অফিসারের সাথে একা একা লড়বার শক্তি তার ছিলো না। অল্পক্ষণের মাঝেই তাকে কাবু করে ফেলে তারা। এরপর হাত পেছনে নিয়ে সেখানে হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হয়, ফোন দিয়ে আনানো হয় ব্যাকআপ টিমকে।

dahmer-1991

১৯৯১ সালে গ্রেফতারের পর

dahmer-1991-2

১৯৯১ সালেই তোলা আরেকটি ছবি

dahmer-1992

১৯৯২ সালে ডাহ্‌মার

inetrview-feb-1994-bbc

১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তোলা ছবি

এরপর ডাহ্‌মারের পুরো বাসায় তল্লাশী চালানো শুরু হয়। তল্লাশী চলতে থাকে, আর বেরোতে থাকে তার একের পর এক শিকারদের স্মৃতিচিহ্ন। রান্নাঘরে পাওয়া গিয়েছিলো ৪টি ছিন্ন মস্তক, ৭টি খুলি পাওয়া যায় তার বেডরুম ও ক্লোজেটে। এছাড়া তদন্তকারী দল তার রেফ্রিজারেটরে একটি ট্রেতে মানুষের রক্ত, দুটো হৃৎপিণ্ড এবং হাতের পেশীর কিছু অংশ পায়। এছাড়া সেখানে হাত-পা-মাথাবিহীন একজনের দেহ, এক ব্যাগ মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও বরফের সাথে আটকে থাকা মানুষের মাংসও খুঁজে পায় তারা। সেই সাথে দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল, এক জোড়া কাঁটা হাত, সংরক্ষিত এক জোড়া পুং জননাঙ্গ, মমি বানানো একটি মাথার চামড়া এবং পূর্বে উল্লেখ করা ৫৭ গ্যালনের ড্রামে এসিড দ্রবণে ডুবানো আরো ৩টি হাত-পা-মাথাবিহীন দেহ খুঁজে পাওয়া যায়। ডাহ্‌মারের অ্যাপার্টমেন্টে মোট ৭৪টি ছবি পাওয়া গিয়েছিলো যেখানে ফুটে উঠেছিলো তার শিকারদের দুরবস্থা।

২১৩ নাম্বার অ্যাপার্টমেন্ট

২১৩ নাম্বার অ্যাপার্টমেন্ট

inside-apartment

ফ্ল্যাটের ভেতরের দৃশ্য

gallon

উদ্ধার করা ৫৭ গ্যালনের সেই ড্রাম

gallon-abd-bath-tub

এই ড্রাম আর ফ্রিজেই রাখা হতো মৃতদেহ

jars-with-human-remains

এসব জারেই থাকতো মানবদেহের অবশিষ্টাংশ

skulls

সাজিয়ে রাখা খুলি

skulls-and-other-bones

ফ্রিজে থাকা খুলি ও অন্যান্য হাড়

human-hand-to-cook

রান্না করার উদ্দেশ্যে রাখা মানুষের হাত

bag-with-human-remains

ব্যাগে থাকা মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

again-body-parts

আরো কিছু ছিন্ন দেহাবশেষ

এরপর শুরু হয় দুর্ধর্ষ এ সিরিয়াল কিলারকে জিজ্ঞাসাবাদ। সেসব জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছিলো রোমহর্ষক এসব হত্যার বর্ণনা। তার বিরুদ্ধে মোট ১৬টি হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিলো। তাই মোট ১৬ বার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা দেয়া হয় ডাহ্‌মারকে।

victims2

ডাহ্‌মারের হাতে নিহত ব্যক্তিরা। প্রথম সারি (বাম থেকে)- হিক্স, টুয়োমি, ডক্সটাটর, গেরেরো, সিয়ার্স, রেমন্ড স্মিথ, এডি স্মিথ, মিলার দ্বিতীয় সারি (বাম থেকে)- থমাস, স্ট্রটার, লিন্‌সে, হিউস, সিন্থাসম্ফোন, টার্নার, ওয়েনবার্গার, ল্যাসি তৃতীয় সারি- ব্রেডহফ্‌ট

christopher-scarver

ক্রিস্টোফার স্কার্ভার

ধরা পড়ার পর অবশ্য খুব বেশি দিন বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হয় নি ডাহ্‌মারের। ১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বরের কথা। ডাহ্‌মার তখন থাকতো কলাম্বিয়া কারেকশনাল ইন্সটিটিউটে। সেখানেরই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আরেক আসামী, নাম ক্রিস্টোফার স্কার্ভার, ২০ ইঞ্চি লম্বা এক ধাতব দন্ড দিয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এরই সাথে শেষ হয় জেফ্‌রি ডাহ্‌মার নামক মানব ইতিহাসের ভয়াবহ নরখাদক, মৃতদেহের সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়া এক সিরিয়াল কিলারের।

 

This article is in Bangla language. It's about the life of the cannibal and necrophile Jeffrey Dahmer.

References:

1. biography.com/people/jeffrey-dahmer-9264755#synopsis

2. photobucket.com/images/jeffrey%20dahmer 3. moviepilot.com/posts/2945582 4. disturbinghorror.com/Serial-Killers/Crime-Scene/Crime-scene.html

5. angelfire.com/fl5/headsinmyfridge/Victims.htm

Featured Image: biography.com

Related Articles