Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিও: মধ্যযুগের এক মৃত্যুদ্বীপের কাহিনী

১৩৪৬-১৩৫৩, মাঝখানে মাত্র সাতটি বছর, কিন্তু এই সাতটি বছরই মানবজাতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ভয়াবহ এক রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে। সে সময় ইউরোপ ও ইউরেশিয়া অঞ্চলের জনগণের ভয়ের নাম ছিলো ব্ল্যাক ডেথYersinia pestis নামক ব্যাকটেরিয়ামের প্রভাবে সৃষ্ট এ রোগে প্রাণ হারায় সাড়ে ৭ থেকে ২০ কোটির মতো মানুষ।

মাছি, বডি ফ্লুইড ও হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়তো। মধ্যযুগে ইউরোপের সাধারণ জনগণ ঘনবসতিপূর্ণ নোংরা এলাকাতেই বেশি বসবাস করতো। ফলে সেসব জায়গা থেকে সহজেই ছড়িয়ে পড়তো এ রোগটি। শহর-বন্দরগুলোতে ব্যবসার উদ্দেশে দূর-দূরান্ত থেকে আসতো বণিকগণ। হয় তারা আসার সময় প্রাণঘাতী এ রোগকে নিয়ে আসতো, কিংবা যাওয়ার সময় আক্রান্ত অঞ্চলে থাকার সুবাদে নিজেও আক্রান্ত হয়ে ফিরে যেত।

Source: Herbology Manchester

তখনকার দিনের চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই আজকের দিনের মতো এত উন্নত ছিলো না, বরঞ্চ তা ছিলো নানা কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। ফলে কেন এমন ভয়াবহ রোগে তারা আক্রান্ত হচ্ছে আর এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ই বা কী- সেই সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিলো না তৎকালীন ইউরোপের অধিবাসীদের। কিন্তু এজন্য তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। এজন্য নিজেদের স্বল্প জ্ঞানে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করতো যেন রোগটি না ছড়ায়। কোনো বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হলে সেই বাড়িকে মোটামুটি সমাজ-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হতো, পশুপাখির মাধ্যমে রোগের বিস্তার প্রতিরোধে রাস্তাঘাটে কুকুর-বিড়ালের মতো অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়াও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, মৃতদেহগুলো একত্রিত করে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সেই সাথে নিষিদ্ধ করা হয় বিভিন্ন রকমের ব্যবসা-বাণিজ্যও। এককথায় বলতে গেলে, আক্রান্ত অঞ্চলগুলোর জনজীবন তখন একেবারেই স্থবির হয়ে গিয়েছিলো।

Source: history-world.org

১৩৪৮ সালে ইতালীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ভেনিসের অধিবাসীরা ব্ল্যাক ডেথের প্রতিরোধকল্পে চিন্তা করলো আরো এক ধাপ বেশি অগ্রসর হয়ে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানবসমাজ থেকে আলাদা করে দেয়া হবে, অর্থাৎ তারা বেছে নিয়েছিলো কোয়ারেন্টাইনকে।

১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এ শহরের দ্বীপগুলোকে আলাদা করে রেখেছে বিভিন্ন খাল, যেগুলোকে এখন যুক্ত করে রেখেছে প্রায় চারশ’র মতো ব্রিজ। ১৩৪৮ সালে এত ব্রিজ হয়তো ছিলো না, তবে অসংখ্য দ্বীপ তো ঠিকই ছিলো। ভেনিসবাসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, বাইরে থেকে কোনো নৌকা তাদের কোনো বন্দরে ভিড়তে চাইলে কমপক্ষে ৪০ দিন পানিতেই থাকতে হবে এটা প্রমাণ করতে যে, তারা ব্ল্যাক ডেথে আক্রান্ত না। এরপরই তারা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেত। নাহলে যত চেষ্টাই করা হতো না কেন, তাতে কোনোই ফায়দা হতো না। ১৪০৩ সালের দিকে তারা সিদ্ধান্ত নিলো, যদি কেউ এ মরণরোগে আক্রান্ত হয়, তবে তাকে ভেনেশিয়ান লেগুনে অবস্থিত ৬.৩ একরের লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিও দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে আক্রান্তদের জন্য বানানো হয়েছিলো বিশেষ ধরনের হাসপাতাল।

লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিওর এরিয়াল ভিউ; Source: Wikimedia Commons

এ দ্বীপের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে নিকটবর্তী লাজ্জারেত্তো নুওভা এবং পোভেগ্লিয়া দ্বীপকেও একইরকম কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রুপান্তরিত করা হয়েছিলো। বাইরে থেকে জলপথে কেউ আসলে তাদের তখন বলা হতো সেসব দ্বীপে গিয়ে থাকতে। তাদের নৌকাগুলো তখন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়ে যেতে হতো যাতে সেগুলোকে ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত করা যায়। জলপথ সবসময় পাহারা দিতো সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা। যদি কেউ এ নিয়ম ভঙ্গ করতে বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করতো, তবে সাথে সাথেই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হতো ফাঁসির মঞ্চে, ঝুলিয়ে দিতে হতো না কোনো বিলম্ব।

Source: Atlas Obscura

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এমন অভিনব পদ্ধতি গ্রহণের ফলে নিজেদের এলাকায় ব্ল্যাক ডেথের ক্ষয়ক্ষতিকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলো ভেনিসবাসী। তবে এর থেকেও নির্মম সত্য হলো, যাদেরকে সেসব দ্বীপে পাঠানো হয়েছিলো, মৃত্যুই হতো তাদের অধিকাংশের শেষ পরিণতি। এখন পর্যন্ত আনুমানিক ১,৫০০ কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে কেবলমাত্র লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিওর বুক থেকেই। ধারণা করা হয়, এমন আরো হাজার হাজার দুর্ভাগা শুয়ে আছে দ্বীপটির মাটির নিচে।

মধ্যযুগের মৃত্যুদ্বীপ লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিও নিয়েই এখন কিছু জেনে নেয়া যাক

১) গণকবর

ইউরোপজুড়ে যখন চলছে ব্ল্যাক ডেথের তাণ্ডবলীলা, তখন এখানে দিনে শতাধিক মানুষ মারা যেত। মৃতদেহের সৎকারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা কাজ করে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না। প্রতিদিনই মৃতদেহগুলো জড়ো করা হতো গণকবরগুলোতে। গুজব শোনা যায় যে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেককে নাকি জীবন্ত কবর পর্যন্ত দেয়া হয়েছে!

লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিওর একটি গণকবর; Source: Venice Water Authority – Consorzio Venezia Nuova Archive/Ministry for Cultural Heritage

কঙ্কালগুলোও এককালে জীবন্ত মানুষগুলোর আর্তনাদ যেন ফুটিয়ে তুলছে; Source: Venice Water Authority – Consorzio Venezia Nuova Archive/Ministry for Cultural Heritage

চলছে খনকার্য; Source: Venice Water Authority – Consorzio Venezia Nuova Archive/Ministry for Cultural Heritage

Source: Venice Water Authority – Consorzio Venezia Nuova Archive/Ministry for Cultural Heritage

২) বিশুদ্ধিকরণ

Source: Venice Water Authority – Consorzio Venezia Nuova Archive/Ministry for Cultural Heritage

সেই যুগের মানুষজন বিশ্বাস করতো, খারাপ বাতাসের প্রভাবেই তাদের সমাজে এমন মড়ক লেগেছে। এ বাতাসকে দূর করতে তাই জুনিপার, রোজমেরি ও অন্যান্য আরো ঔষধি গাছগাছড়া জড়ো করে সেগুলো পোড়াতো তারা, বিশ্বাস করতো এর ধোঁয়াই ব্ল্যাক ডেথের অভিশপ্ত বাতাসকে দূরে ঠেলে দেবে, বয়ে আনবে সুস্থ-নিরোগ জীবন। ময়লা কাপড়চোপড় পরিষ্কার করতে গরম পানি ব্যবহার করা হতো কিংবা কাজে লাগানো হতো ভিনেগার। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসা নৌকাগুলোকে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হতো যেন সেগুলোর জীবাণু চলে যায়। কোয়ারেন্টাইন শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘কোয়ারেন্টিনা জিওর্নি’ থেকে, যার অর্থ ‘চল্লিশ দিন’। মূল পোতাশ্রয়ে প্রবেশের পূর্বে বাইরের নৌকাগুলোর চল্লিশ দিন অপেক্ষা করার রীতি থেকে হয়েছে এ শব্দটির উদ্ভব।

৩) অভিজাতদের থাকার ব্যবস্থা

অভিজাতদের হাসপাতাল; Source: Wikimedia Commons

দ্বীপে যে পরিমাণ বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছিলো, তাতে সর্বসাকুল্যে দু’শজন মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিলো। তবে আলাদা সুবিধা ছিলো বিত্তবানদের জন্য। জীবনের শেষ দিনগুলো তারা যেন আরাম-আয়েশে কাটাতে পারেন, তাই তাদের জন্য বানানো হয়েছিলো বিশেষ কোয়ার্টার। তবে মৃত্যু তো আর ধনী-গরীব বোঝে না, তাই মরার পরে সেসব বিত্তবানদের জায়গাও হতো গরীবদের সাথে, সেই একই গণকবরে। অবশ্য অনেক ধনী ব্যক্তির কবরে মূল্যবান গয়না, মুদ্রা ও চিরুণির মতো জিনিসও পাওয়া গিয়েছে।

৪) হাসপাতাল

মূল প্রবেশপথ; Source: Wikimedia Commons

স্টাফ কোয়ার্টার; Source: Wikimedia Commons

বিউবোনিক, সেপ্টিসেমিক ও নিউমোনিক- এ তিন প্রকারের প্লেগে আক্রান্ত হতো জনসাধারণ। এগুলোর নামকরণ করা হয়েছিলো মূলত শরীরের কোন অংশ আক্রান্ত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে। বিউবোনিক প্লেগে শরীরের নানা অংশে পুঁজের মতো হতো। সেপ্টিসেমিক প্লেগে ব্লাড পয়জনিংয়ের পাশাপাশি টিস্যু মৃত ও কালো হয়ে যেত। নিউমোনিক প্লেগে কাশির সাথে রক্ত ঝরতো। ১৪২৩ সালে লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিওতে বানানো হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসুবিধা ছিলো শূন্যের কোঠায়, থাকার জায়গাও ছিলো অপ্রতুল। এজন্য একটি বিছানায় তিন-চারজন করে পর্যন্ত রাখা হতো।

৫) বেল টাওয়ার

লোকজন মনে করতো, ঈশ্বরের অভিশাপে তাদের শরীরে ভয়াবহ এ রোগটি বাসা বেধেছে। রোগমুক্তির আশায় তারা যেন প্রার্থনা করতে পারে, সেজন্য দ্বীপটিতে বানানো হয়েছিলো গির্জা। পাশাপাশি বেল টাওয়ারে দাঁড়িয়ে জলপথে কেউ আসছে কিনা সেই পর্যবেক্ষণটিও সারা যেত। চার্চটির দায়িত্বে ছিলেন সেইন্ট মেরি অফ নাযারেথ। কালক্রমে এখান থেকেই দ্বীপটি নাযারেটাম বা লাজ্জারেত্তো নাম পায়। ‘লাজারেট’ শব্দের অর্থ আলাদা হাসপাতাল।

৬) সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের স্থানান্তর

ব্ল্যাক ডেথে অগণিত মানুষ মারা গেলেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়া মানেই যে মৃত্যু সে কথা বলার জো নেই। কারণ তৎকালীন অনগ্রসর চিকিৎসাপদ্ধতির সাহায্যেও কিছু কিছু মানুষ ঠিকই ফিরে আসতে পেরেছিলো এ মরণব্যধির হাত থেকে। সৌভাগ্যবান এ লোকগুলোকে পরবর্তীতে লাজ্জারেত্তো ভেচ্চিও থেকে লাজ্জারেত্তো নুওভা দ্বীপে স্থানান্তর করা হতো। নৌকায় করে সশস্ত্র প্রহরার মাধ্যমে তাদেরকে পৌঁছে দেয়া হতো ভেনিস শহরে। এর ভেতর দিয়েই যেন শুরু হতো তাদের দ্বিতীয় জীবন।

ফিচার ইমেজ- The Submarine

Related Articles