Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেরি সিলাস্ট: জাহাজ থেকে ১০ ব্যক্তির অন্তর্ধান রহস্য

৫ ডিসেম্বর, ১৮৭২। ব্রিটিশ জাহাজ ‘ডাই গারিতা’র ক্যাপ্টেন ডেভিড রিড মোরহাউজ দূরবীনে চোখ রেখে চারপাশটা দেখে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, দূরে একটি জাহাজ ঠায় সাগরের বুকে ভাসছে, ডেকে কোনো জনপ্রাণীর টিকিটিও নেই। এজোরিস দ্বীপপুঞ্জের কাছে দিকভ্রান্ত হয়ে ভাসতে থাকা জাহাজটির যত কাছ দিয়ে তিনি অতিক্রম করছিলেন, ততই তার পরিচিত মনে হচ্ছিলো সেটিকে।

ক্যাপ্টেন মোরহাউজ খুঁজে পেলেন ‘মেরি সিলাস্টকে’; source: bp.blogspot.com

খুব ভালো করে লক্ষ করে ক্যাপ্টেন চিনতে পারলেন জাহাজটিকে। নিউইয়র্ক বন্দর থেকে তার জাহাজের ৮ দিন আগে ছেড়ে আসা ‘মেরি সিলাস্ট‘ ততদিনে তার পণ্য নিয়ে ইতালির জেনোয়া বন্দরে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু বিশাল সমুদ্রে জনমানবহীন এই মেরি সিলাস্টকে দেখে ক্যাপ্টেন রীতিমতো অবাক হলেন এবং সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে গেলেন। প্রথমে তার ধারণা ছিলো, হয়তো কোনো রোগে কিংবা মহামারীতে পড়ে জনশূন্য হয়ে পড়েছে জাহাজটি। কিন্তু জাহাজে পৌঁছে তো তার চক্ষু চড়কগাছ!

মেরি সিলাস্ট; source: smithsonianmag.com

জীবিত বা মৃত কোনো প্রাণীর দেহাবশেষ পর্যন্ত নেই পুরো জাহাজের কোথাও, এমনকি নেই কোনো রক্তের চিহ্নও। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা গেলো, পণ্য হিসেবে বহন করা শিল্পজাত অ্যালকোহলের সবকয়টি পিপা ঠিকঠাক আছে। তাই জলদস্যুর আক্রমণের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। অন্যদিকে খাবার পানীয় যা মজুদ আছে, তা দিয়ে ছয় মাস আয়েশেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাই খাবারের সংকটে পড়ে আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া কিংবা পালিয়ে যাবার ঘটনাটিও বাদ দিতে হচ্ছে মোটা দাগে। অক্ষুণ্ণ রয়েছে জাহাজের মূল্যবান দ্রব্যাদির সবকিছুই। তাই নাবিকদের একজন বাকিদের খুন করে পালিয়ে যাবার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। নাবিকদের জামাকাপড় থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় এবং ব্যক্তিগত সব জিনিস তখনও জাহাজেই পড়ে ছিলো। সব কিছু রেখে যেন তাড়াহুড়া করে উধাও হয়ে গেছে পণ্যবাহী সেই জাহাজের সাতজন নাবিক, জাহাজের ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিগস, ক্যাপ্টেনের স্ত্রী সারাহ এবং তার দু’বছর বয়সী কন্যাসন্তান সোফিয়া। সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের ইতিহাসে এমন অন্তর্ধানের ঘটনা বিরল।

জাহাজে সবকিছু রেখে দশজন মানুষ কোথায় উধাও হয়ে গেলেন? খুঁজে পাওয়া গিয়েছে কি তাদের কাউকে? সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের ইতিহাসের অমীমাংসিত এই রহস্যের আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের লেখা।

মেরি সিলাস্টের যাত্রা শুরু

‘মেরি সিলাস্ট’ নভেম্বরের ৭ তারিখের এক সুন্দর সকালে নিউইয়র্ক বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১,৭০১ ব্যারেল শিল্পজাত অ্যালকোহল নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ইতালির জেনোয়া বন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করে জাহাজটি।

যাত্রা শুরু নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকে; source: commons.wikimedia.org

তৎকালীন হিসেব অনুযায়ী ১,৭০১ ব্যারেল অ্যালকোহলের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ হাজার ডলার। পাশাপাশি ‘মেরি সিলাস্ট’ জাহাজের মূল্যই ছিলো ১৪ হাজার ডলার। ১৮৬০ সালে কানাডার নোভা স্কটিয়াতে নির্মিত এই জাহাজের নির্মাণকালীন নাম ছিলো ‘আমাজন’। পরে ১৮৬৮ সালে মালিক পরিবর্তিত হয় জাহাজের। নতুন মালিক রিচার্ড হেইনেস ‘মেরি সিলাস্ট’ নামে জাহাজটিকে নথিভুক্ত করেন। এরপরেও বেশ কয়েকবার মালিকানা বদলায় জাহাজটির, তবে এর নাম অপরিবর্তিতই থাকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিগস ছিলেন সাদামাটা একজন ধার্মিক মানুষ। জাহাজের মালিক জেমস হেনরি উইনচেস্টারের মতে, অন্য সবাই যখন মদের আসরে যোগ দিতো, ধার্মিক ব্রিগস সেই সময়টা বাইবেল পড়েই অতিবাহিত করতেন।

মেরি সিলাস্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আলবার্ট রিচার্ডসন ছিলেন ব্রিগসের যোগ্য সহচর। সাতজন নাবিকের বেশিরভাগই ছিলেন রিচার্ডসন আর ব্রিগসের পরিচিত এবং জাহাজ চালনায় দক্ষ। সে সময় জাহাজ চালনায় ক্যাপ্টেন তার অবস্থান আর জাহাজের ঘটনাবলির দিনলিপিগুলো ‘লগবুক’ নামে একটি খাতায় লিখে রাখতেন, বেঞ্জামিন ব্রিগসও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ৭ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি দিনের অবস্থান আর উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ ছিলো তার লগবুকে। ২৫ নভেম্বর সকাল ৮টায় ক্যাপ্টেন তার স্বাক্ষরসহ শেষ অবস্থানটি লিখেছিলেন। কিন্তু এরপরেই ঘটে সেই রহস্যময় অন্তর্ধান!

ডাই গারিতার যাত্রা শুরু

অন্যদিকে ৮ দিন পরে নিউইয়র্ক বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে ‘ডাই গারিতা’। ১,৭৩৫ ব্যারেল পেট্রোলিয়ামের কার্গো নিয়ে জাহাজটি রওনা হয়।

ডাই গারিতা; source: thechronicleherald.ca

৫ ডিসেম্বর ডাই গারিতার ক্যাপ্টেনের চোখে পড়ে ‘মেরি সিলাস্ট’ দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এজোরিস দ্বীপপুঞ্জের কাছে। ক্যাপ্টেন মোরহাউজ যেদিন মেরি সিলাস্টকে আবিষ্কার করেন, তার ১০ দিন আগে বেঞ্জামিন ব্রিগস তার লগবুকের শেষ এন্ট্রিটি করেছিলেন। এন্ট্রিটি করা হয়েছিলো এজোরিস দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ৪০০ ন্যটিকাল মাইল দূরে (37°01’N, 25°01’W)। অর্থাৎ শেষ এন্ট্রিটি করার পরে জাহাজটি সাগরে প্রায় ৪০০ নটিকাল মাইল পাড়ি দিয়েছে। মাঝ সাগরে মেরি সিলাস্টকে আবিস্কারের পরেই ডাই গারিতার ক্যাপ্টেন আর নাবিকেরা মিলে জাহাজ এবং তার আশেপাশে খোঁজা শুরু করেন। জাহাজের সবকিছু ফেলে রেখে এর ১০ দিন আগেই উধাও হয়ে যাওয়া সেই ১০ জন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কোথাও!

কোথাও কেউ নেই!

ভূতুড়ে সেই জাহাজে কাউকে খুঁজে না পেয়ে ক্যাপ্টেন মোরহাউজ প্রথমে ধারণা করেছিলেন অনেক কিছুই, কোনো আক্রমণ কিংবা মহামারীর কারণেই হয়তো জাহাজটির এই পরিণতি বলে ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু দেখা গেল, জাহাজে রক্তের কোনো দাগ নেই কিংবা খোয়া যায়নি কোনো মালামাল। এমনকি নাবিকদের ধূমপান করার পাইপগুলোও রয়ে গেছে অক্ষত। তবে দেখা গেল, সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় দুই যন্ত্র ‘সেক্সট্যান্ট’ আর ‘ক্রনোমিটার’ উধাও। জাহাজে থাকা একমাত্র লাইফবোটটিও নেই। তাহলে কি এই লাইফবোটে করেই অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন ১০ জন?

কৌতূহলের কেন্দ্রে ‘মেরি সিলাস্ট’

জাহাজ অন্তর্ধানের এই ঘটনা ইউরোপ আর আমেরিকাতে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। কোথায়-কীভাবে এই জাহাজের মানুষগুলো হারিয়ে গেলো, এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছিলো। তরুণ ডাক্তার আর্থার কোনান ডয়েলও এই রহস্য নিয়ে লিখেছিলেন ছোটগল্প। জাহাজের আসল ইংরেজি নাম ‘Mary Celeste’ হলেও তিনি তার গল্পে জাহাজের নাম একটু পরিবর্তন করে  দিয়েছিলেন ‘Marie Celeste’ । অনুসন্ধানমূলক এই গল্পটি মানুষকে যেন আরো বেশি তাড়িত করেছিলো আসলে কী ঘটেছিলো তা জানার জন্য। কিন্তু আদৌ কি কোনো কূলকিনারা করা যাবে এই রহস্যের?

আর্থার কোনান ডয়েল; source: commons.wikimedia.org

শুনানি এবং রায়

মেরি সিলাস্টকে আবিস্কারের পরে ডাই গারিতার ক্যাপ্টেন আর নাবিকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, জাহাজটিকে ৮০০ মাইল দূরবর্তী জিব্রাল্টারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরে জিব্রাল্টার আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ডাই গারিতার প্রত্যেক সদস্যের বিবৃতিও নেওয়া হয়। বিবৃতিতে উঠে আসে, পুরো জাহাজের কোথাও কোনো মদ কিংবা বিয়ারের বোতল পাওয়া যায়নি। কিংবা মদ্যপ অবস্থায় খুনোখুনির পর্যায়ে কিছু ঘটেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। জাহাজে বহন করা অ্যালকোহলের পুরোটাই ছিলো অপরিশোধিত শিল্পজাত অ্যালকোহল, যা পানের অযোগ্য। পরবর্তীতে এই অন্তর্ধানের সাথে আরো অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্বও জড়িয়ে পড়ে।

জিব্রাল্টার আদালতেই জাহাজটির অন্তর্ধান নিয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়; source: maryceleste.net

এমনকি জিব্রাল্টার আদালতের বিচারকদের অনেকেরই ধারণা ছিলো, ডাই গারিতার সদস্যরা হয়তো মেরি সিলাস্টের নাবিক আর ক্যাপ্টেনকে হত্যা কিংবা গুমের ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। কারণ নৌ আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি পরিত্যক্ত জাহাজ আর তাতে থাকা কার্গো উদ্ধার কিংবা সঠিক সন্ধান দিতে সমর্থ হয়, তবে জাহাজের মালিক অথবা ইনস্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ তাকে আর্থিকভাবে মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু জিব্রাল্টার আদালতে ডাই গারিতার সদস্যদের জবানবন্দী নিয়ে এবং আদালতের নিজের স্বাধীন তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কোনো দোষ প্রমাণিত হয়নি। মেরি সিলাস্ট রহস্য নিয়ে ৩ মাস তদন্ত শেষে জিব্রাল্টার আদালত রায় দেয়। রায় অনুযায়ী, জাহাজ আর কার্গোর জন্য করা ইনস্যুরেন্সের ৪৬ হাজার ডলারের ছয় ভাগের একভাগ অর্থাৎ ৭,৬০০ ডলার ডাই গারিতার ক্যাপ্টেনসহ পুরো দলকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

অমীমাংসিত রয়ে গেছে যে রহস্য

মেরি সিলাস্টের সেই ১০ আরোহীকে পরে আর কেউ কোথাও দেখেছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। রহস্যজনক এই ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্র, লেখা হয়েছে শত শত ছোটগল্প আর গোয়েন্দাকাহিনী, কেউ লিখেছেন বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ। অনেকেই এই ঘটনার জন্যে দায়ী করেছেন ভিনগ্রহের প্রাণীদের কিংবা সমুদ্রে লুকিয়ে থাকা অতৃপ্ত কোনো আত্মাকে। কিন্তু তাতে রহস্যের কূলকিনারা তো দূরে থাক, হেঁয়ালি আর কৌতূহলের পুরো আস্তরণ জমা হয়েছে এই ঘটনার গায়ে। অক্ষত একটি জাহাজকে সমুদ্রের বুকে ভাসমান রেখে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন এর আরোহীরা? মেরি সিলাস্টের এই রহস্য মানবজাতির জন্যে হয়ে থাকলো এক মুখরোচক কাহিনী। হয়তো একটি লাইফবোট, ক্রনোমিটার আর সেক্সট্যান্ট মেশিন নিয়ে সেই ১০ অভিযাত্রী চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছেন কোনো নির্জনতায়।

ফিচার ইমেজ- wowamazing.com

Related Articles