Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এলিয়েনের আধুনিক উপকথা

পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মহাবিশ্বের কোনো গ্রহে কি আমাদের মতো প্রাণের অস্তিত্ব আছে? এই প্রশ্নটি বেশ আধুনিক। প্রাচীনকালের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি পৃথিবীর বাইরে প্রাণ থাকতে পারে। তখন বিজ্ঞানের উন্মেষ ঘটেনি তেমন। কিন্তু আশেপাশে রহস্যময় ঘটনা ঠিকই ঘটতো। সেসব ঘটনাকে তারা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যাও দিতো। সেই ব্যাখ্যাগুলো পরবর্তীতে ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে উপকথা বা পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল মানুষের মাঝে। যতদূর জানা যায়, বহির্বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রাচীন উপকথা বা পুরাণ নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ পৃথিবীর বাইরেও যে পৃথিবীর চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি বড় একটি জগত আছে এটি সম্বন্ধে জানতোই না মানুষ। ভাবনাতেই আসেনি পৃথিবীর সমান বা তার চেয়ে বড় কোনো গ্রহের অস্তিত্ব আছে আকাশে।

আকাশকে তারা শুধুমাত্র তারা দিয়ে আঁকা বর্ণীল চাদর বলেই মনে করেছে। যেহেতু তাদের কল্পনা কিংবা বাস্তবতায় পৃথিবী ব্যতীত কোনো গ্রহের অস্তিত্ব ছিল না, তাই সেসব গ্রহে বিদ্যমান প্রাণ নিয়ে কোনো উপকথা বা পৌরাণিক গল্পও তৈরি হয়নি।

পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে এমনটা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না একসময়। ছবি: এইচডি ওয়াল

১৫০০ সালের পরে মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছিল পৃথিবীকে আমরা যেভাবে দেখি এটি আসলে তা না। আমরা হয়তো চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সূর্য পৃথিবীর পূর্ব দিক থেকে উঠছে আর পশ্চিম দিকে অস্ত যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবী নিজে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। যার অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর চেয়েও বড় জিনিসের অস্তিত্ব আছে। বড় ও ভারী জিনিসকে কেন্দ্র করেই ছোট ও হালকা জিনিসগুলো আবর্তন করে। সূর্য যেহেতু তার শক্তি দিয়ে পৃথিবীকে ঘোরাচ্ছে, তার মানে অবশ্যই সূর্যের ভর পৃথিবীর চেয়ে বড়। সীমাহীন এলাকাব্যাপী একটি গ্রহের চেয়েও বড় কিছুর অস্তিত্ব আছে এমনটা ভাবা তখনকার সময়ের জন্য আসলেই বৈপ্লবিক ছিল।

তখন পর্যন্ত সূর্য ও সূর্যের পরিবারের কিছু গ্রহ সম্বন্ধে জানা গিয়েছিল। কিন্তু সৌরজগতের বাইরেও যে অনেক অনেক নক্ষত্র আছে এবং কল্পনাতীত বিশাল গ্যালাক্সি আছে তা জানতে জানতে মানবজাতিকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

খুব বেশি দিন হয়নি, মানুষ তখনো বিশ্বাস করতো উপরের দিক সবসময়ই উপরে। পরবর্তীতে আবিষ্কার হলো পৃথিবী গোল। পৃথিবীর যে অংশটা আমাদের জন্য উপরে, একই অংশ হতে পারে অন্য কারো জন্য নীচে। আমরা বাংলাদেশীরা যদি নীচের দিক থেকে কোনো কিছু নির্দেশ করি সেটা হয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপরের দিক।

মানুষ মনে করতো উপরের আকাশলোকে দেবতারা বসবাস করে, কিন্তু আদতে উপর বলতে কিছু নেই। আকাশ বলতে যে গম্বুজের মতো তারায় শোভিত দেয়াল দেখি, সেটাও আসলে কোনো দেয়াল নয়। দেখে মনে হয় তারাগুলো খুবই কাছাকাছি ঘেঁষে ঘেঁষে লেগে আছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এক তারা থেকে আরেক তারার মাঝে বিলিয়ন বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব বিদ্যমান।

গম্বুজসদৃশ তারকাখচিত আকাশটি আসলে কোনো ‘আকাশ’ নয়। ছবি: ম্যাকডোনাল্ড অবজারভেটরি

পৃথিবীর স্বাভাবিক প্রাণের বাইরে বায়ুতে বা শূন্যে ভেসে বেড়ানো অদ্ভুত ধরনের সৃষ্টি বা অবাস্তব প্রাণ নিয়ে অনেক বিশ্বাস ও উপকথা আছে। যেমন- প্রেত, পিশাচ, অপদেবতা, মৃত আত্মা, ভূত ইত্যাদি। কিন্তু এসবের কোনোটিই বহির্জাগতিক কোনো গ্রহের প্রাণ নয়। উপকথা ও বিশ্বাস অনুসারে এরা আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ানো সত্তা। কিন্তু এই লেখার প্রসঙ্গ সেগুলো থেকে ভিন্ন।

আদিম মানুষ বা বিচ্ছিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে বহির্বিশ্বের প্রাণ নিয়ে কোনো উপকথা নেই। তবে উপকথা তো কোনো না কোনো কালের মানুষেরাই বানায়। আমাদের আজকের যুগের কোনো অন্ধবিশ্বাসও তো হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হাস্যকর উপকথা।

এলিয়েন বা ইউএফও সম্বন্ধে মানুষ যখন জানলো, তখন তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে নানা কাহিনীর জন্ম দিয়ে দিল। যারা এসব কাহিনীর জন্ম দিয়েছে, তারা শিক্ষিত ও শহুরে নাগরিক। (বহির্বিশ্বের বুদ্ধিমান প্রাণকে ‘এলিয়েন’ বলা হয় এবং এসব এলিয়েন যেসব মহাকাশযানে করে ঘুরে বেড়ায় তাদেরক পৃথিবীবাসী ‘ইউএফও’ বলে থাকে।) মনগড়া ব্যাখ্যার পাশাপাশি তাদেরকে ঘিরে নানা ধরনের কাহিনীরও জন্ম দিয়ে দেয় পৃথিবীবাসীরা। এসব অবৈজ্ঞানিক নাটকীয় কাহিনীকে আমরা বলতে পারি ‘আধুনিক উপকথা’।

আধুনিক উপকথা বা আধুনিক পুরাণগুলো একটি দিক থেকে আগ্রহোদ্দীপক। প্রাচীনকালের উপকথাগুলো কোন প্রেক্ষিতে কীভাবে জন্ম লাভ করেছিল তা আমরা জনতে পারি না। কিন্তু আধুনিক উপকথাগুলো সম্বন্ধে অনেক তথ্যই আমরা জানতে পারি। কারণ এসব ঘটনা ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিত, কারণ, পূর্বে এরকম ধারণার রূপ কেমন ছিল তার সবই আমাদের জানা আছে।

এমনকি এসব গল্পের জন্ম দিয়েছে যেসব লোকেরা আমরা চাইলে তাদের সাথে কথাও বলতে পারি। তারা এখনো জীবিত আছে। তারা তখন ঘোরের মধ্যে এসব করেছিল, নাকি কোনো বিশ্বাস থেকে করেছিল, নাকি নিজের অজান্তেই করেছিল তা-ও আমরা জানতে পারি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে। এমনকি তারা তখন যে অবস্থায় ছিল তার চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন মেডিকেল রিপোর্টও জানতে পারি।

১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ঘটনা। ‘হেভেন্‌স গেইট’ নামে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ৩৯ জন সদস্য স্বেচ্ছায় বিষ খেয়ে বসলো। তারা বিশ্বাস করেছিল বহির্বিশ্বের কোনো এক UFO তাদের সকলের আত্মা অন্য একটি গ্রহে নিয়ে যাবে। তাই তারা আত্মহত্যা করে পৃথিবীর জীবন সাঙ্গ করে ঐ গ্রহে রওনা দেয়। ঐ সময়ে পৃথিবী থেকে একটি ধূমকেতুকে দেখা যাচ্ছিল এবং এটি বেশ প্রকট ও উজ্জ্বল ছিল। ধর্মীয় ঐ গোষ্ঠীটি মনে করেছিল এর পাশে কোনো UFO আছে বলে এমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে একে। এমন ধারণায় তারা সকলে বিশ্বাস করেছিল, কারণ তাদের আধ্যাত্মিক নেতা এমন কথা বলেছিল।

আত্ম হন্তারকদের দুটি দেহ। ছবি: মাইক নেলসন/এএফপি/গেটি ইমেজেস

হ্যাভেনস গেটের গণ আত্মহত্যা (গাড়ির ভেতর সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশগুলো দ্রষ্টব্য)। ছবি: এ বি কিউ জার্নাল

ধূমকেতুটিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি টেলিস্কোপও কিনে এনেছিল তারা। কিন্তু পরবর্তীতে তা দোকানে ফেরত দিয়ে দেয়। ফেরত দিতে গিয়ে অভিযোগ দেয় টেলিস্কোপটি ভালো না, ঠিকমতো কাজ করে না। তারা কীভাবে জানলো যে টেলিস্কোপটি নষ্ট? তারা এর মধ্য দিয়ে কোনো UFO’র দেখা পায়নি। যেহেতু তারা এলিয়েনদের মহাকাশযান UFO দেখতে পায়নি, তাই গায়ের জোরে ধরে নিয়েছিল যে টেলিস্কোপটি নষ্ট!

আধ্যাত্মিক নেতাও কি এরকম ধারণায় বিশ্বাস করেছিল? এ ধরনের ধর্মীয় ঘটনাগুলোয় নেতারা সবসময় অক্ষত থাকে। ভোগান্তিগুলো ভোগে অনুসারীগুলো। কিন্তু এখানে সম্ববত আধ্যাত্মিক নেতাটি বহির্জাগতিক স্বর্গীয় প্রাণের ধারণায় বিশ্বাস করেছিল। কারণ তিনি নিজেও আত্মহত্যার জন্য বিষ গ্রহণ করেছিলেন।

আধ্যাত্মিক নেতা মার্শাল অ্যাপলহোয়াইট অন্য কয়েকজন অনুসারীর সাথে নিজের পুরুষাঙ্গ কেটে খোজা হয়ে গিয়েছিল। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললে নারীর সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া রোধ হয়ে যায় এবং তারও অপর নারীর প্রতি কোনো যৌন আকর্ষণ থাকে না। ফলে মন কলুষিত হয় না। মন যত পরিষ্কার থাকবে তাদের অর্চনা করা স্রষ্টার সান্নিধ্য তত বেশি পাবে!

এ থেকে বোঝা যায় তার ও তার কিছু অনুসারীর চিন্তাভাবনা কতটা অন্ধ ছিল। এমন অন্ধ বিশ্বাসের উপস্থিতিতে তারা যে সবাই একত্রে বিষ নিয়ে অন্য কোনো স্বর্গীয় গ্রহে চলে যেতে চাইবে, তা আর অবাক করার মতো কী?

মার্শাল আপলহোয়াইট, যার প্রেরণায় আত্মহত্যা করেছিল ৩৯ জন। এমন কর্মের জন্য তিনি টাইম, নিউজউইক সহ অন্যান্য ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান করে নিয়েছিলেন। ছবি: পিন্টারেস্ট

যারা এলিয়েন সংক্রান্ত কোনো দাবী বা অদ্ভুত কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে, তাদের সবার মধ্যে একটি জিনিসে মিল পাওয়া যায়। এলিয়েন সংক্রান্ত উদ্ভট দাবী যারা করে, তাদের প্রায় সকলেই সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত। হয় সেটি কোনো সায়েন্স ফিকশন বই, নাহয় সেটি কোনো সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র। হেভেন্‌স গেইট নামের ধর্মীয় গোষ্ঠীটির সদস্যরা স্টার ট্রেক সিরিজের প্রতি আচ্ছন্ন ছিল।

হ্যাঁ, এটা সত্য যে, ভিন গ্রহের প্রাণী নিয়ে এই পৃথিবীতে সায়েন্স ফিকশনের কোনো অভাব নেই। মূল কথা হচ্ছে অনেক অনেক সায়েন্স ফিকশনের অস্তিত্ব থাকলেই যে এ সংক্রান্ত দাবী সত্য হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। সকল ধরনের সায়েন্স ফিকশনই কাল্পনিক। যারা এগুলো পড়ে, তারাও জানে; যারা এগুলো লেখে, তারাও জানে। সবগুলোই মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর তৈরি করা গল্পের প্লটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এদের কোনোটিই বাস্তবে ঘটেনি। তারা শুধুই গল্প। অনেকটা আমাদের বাংলা ছড়ার হাট্টিমাটিম টিমের মতো কাল্পনিক প্রাণী।

এলিয়েনে আচ্ছন্ন ব্যক্তিরা স্টার ট্রেক জাতীয় সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত। ছবি: QuotesGram

এরপরেও অনেকে ধারণা করে এবং মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, এলিয়েনদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে তাদের দেখা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ দাবী করে এলিয়েনরা তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। অনেকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তাদের বিশ্বাসে তারা একদম অনড় থাকে। তাদের দাবীকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুক্তিহীন তথ্য বা সাক্ষ্য উপস্থাপন করে।

একজন লোকের নাক দিয়ে রক্ত ঝরতো। লোকটি দাবী করেছিল তার এই সমস্যার জন্য দায়ী কোনো এলিয়েন প্রাণী। এর সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য মনগড়ামতো ব্যাখ্যাও দিয়েছিল। তার দেয়া ব্যাখ্যা অনুসারে এলিয়েনরা তার নাকের ভেতর একটি রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়ে দিয়েছে, যার কারণে রক্ত ঝরছে। রেডিও ট্রান্সমিটার বসানোর কারণ, এর সাহায্যে এলিয়েনরা তার উপর গোয়েন্দাগিরি তথা বৈজ্ঞানিক নজরদারি করতে পারবে। উল্লেখ্য রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তার ছাড়াই তথ্য আদান প্রদান করা যায়। মোবাইল এরকমই একটি যন্ত্র।

লোকটির এমন ধারণাও ছিল, সে নিজেও একজন এলিয়েন! কীভাবে জানলো এই কথা? তার বাবা-মা ছিল ফর্সা, কিন্তু সে কিছুটা কালো। বাবা-মা ফর্সা হলে তো সে নিজেও ফর্সা হবার কথা ছিল। যেহেতু লোকটি তার বাবা-মায়ের মতো না, সেহেতু সে একজন এলিয়েন বা এলিয়েনের বংশধর! উদ্ভট যুক্তি।

আমেরিকায় এমন ঘটনার দিকে তাকালে অনেকটা অবাকই হতে হবে। আমেরিকানদের অনেকেই বিশ্বাস করে উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী এলিয়েনরা তাদেরকে ধরে UFO-তে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেখানে তার উপর ভয়ানক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিল। অর্থাৎ তারা এলিয়েনদের পৈশাচিক সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টের ভুক্তভোগী বা ভিক্টিম। যে এলিয়েনরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তারা দেখতে কেমন ছিল তার বর্ণনাও পাওয়া যায় তাদের কাছে। বেশিরভাগ মানুষই দাবী করে অপহরণকারী এলিয়েনদের গায়ের রঙ নীল, মস্তিষ্ক (মাথা) বেশ বড়, চোখগুলো বেশ বিস্তৃত। এলিয়েন নিয়ে এ ধরনের কাহিনীগুলো যদি একত্র করা হয়, তাহলে তা অনেক রংচঙে ও রসালো আকার ধারণ করবে। এই কাহিনীগুলো এমনকি সকল গ্রিক পুরাণ, মিশরীয় পুরাণ, নর্স পুরাণকেও হারিয়ে দেবে।

তাদের দাবী, এলিয়েনরা ধরে নিয়ে তাদের উপর এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। ছবি: প্রুফ অব এলিয়েন ডট কম

তবে আশার কথা হচ্ছে এলিয়েনের উপকথাগুলো সাম্প্রতিক। কেউ এই ব্যাপারে আগ্রহী হলে তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করতে পারে এবং অনুসন্ধান করে দেখতে পারে আসলেই এর পেছনের কারণ কী ছিল। কেউ চাইলে এসব ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে তাদের অপহরণ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জেনেও নিতে পারবে।

কেউ যদি এই কাজটি করতে যায় তাহলে দেখতে পাবে, একদমই সুস্থ ও সস্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ এরকম দাবীগুলো করছে। তারা নিখুঁতভাবে বর্ণনা দেবে UFO-র ভেতরে কীভাবে তাদেরকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল, কীভাবে তাদের শরীর কেটে-ছিড়ে ফেলা হয়েছিল, কীভাবে এলিয়েনরা নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলছিল তার সবই। তাদের সকল মানুষের বেলাতেই এলিয়েনরা ইংরেজিতে কথা বলে!

যেহেতু আমেরিকানরা ইংরেজিভাষী, তাই এরা ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বুঝতে পারবে না। অন্য কোনো ভাষাতেও যে এলিয়েনরা কথা বলতে পারে কিংবা এলিয়েনদের নিজস্ব ভাষাতেও যে কথা বলতে পারে এই ধারণা তাদের কল্পনায় তখন ছিল না।

সুসান ক্ল্যানসি নামে একজন মনোবিজ্ঞানী এরকম মানুষদের নিয়ে অনেক গবেষণা করেছিলেন। এলিয়েন তাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, এরকম দাবীদার মানুষের অনেকেরই ধরে নিয়ে যাবার ঘটনা সম্পর্কে পরিষ্কার স্মৃতি মনে নেই। কারো কারো বেলায় অল্প স্বল্প আছে, আর কারো কারো বেলায় একদমই নেই। সুসান ক্ল্যানসি দেখেছেন এলিয়েন কর্তৃক অপহরণের স্মৃতি যাদের তেমন মনে নেই তারা প্রায় সকলেই দাবী করছে, এলিয়েনরা তাদের কোনো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার দেহে করা এক্সপেরিমেন্ট সংক্রান্ত সকল স্মৃতি মুছে দিয়েছে।

মাঝে মাঝে এরকম রোগীদের সম্মোহনবিদ বা সাইকোথেরাপিস্টের কাছেও যেতে দেখা যায়। তাদের ধারণা উপযুক্ত থেরাপি বা সম্মোহনের মাধ্যমে তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারবে।

The 3 Sins of Memory শিরোনামে টেড টকে বক্তব্যরত মনোবিজ্ঞানী সুসান ক্ল্যানসি। ক্রেডিট: টেড টক

হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারটি একদমই ভিন্ন তল্লাটের গল্প। স্নায়ুবিজ্ঞানের এই প্রক্রিয়াটি বেশ চমকপ্রদ। তবে চমকপ্রদ হলেও এলিয়েনদের দ্বারা স্মৃতি হারিয়ে ফেলা ও উদ্ধার করার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি কোনো একটি কাল্পনিক বিষয় নিয়ে খুব বেশি মগ্ন থাকে, তাহলে মাঝে মাঝে মনে হতে পারে কাল্পনিক কোনো কিছু বুঝি আসলেই তার জীবনে হয়েছিল। তেমনই সায়েন্স ফিকশন নিয়ে কেউ যদি রাত-দিন মত্ত থাকে, তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে মনে হতে পারে সায়েন্স ফিকশনের কোনো কোনো ঘটনা তার জীবনেও ঘটেছে। এক্ষেত্রে এগুলোকে বলা যায় মিথ্যা স্মৃতি বা False memories।

এখনকার চিকিৎসা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাইরে থেকে এ ধরনের মিথ্যা স্মৃতি মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো সম্ভব। জীবনে সত্যি সত্যি ঘটে যাওয়া স্মৃতি থেকে এটি একদমই ভিন্ন। তাই কেউ যদি সম্মোহনবিদ বা সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যায় স্মৃতি উদ্ধারের জন্য, তাহলে তারা বড়জোর মিথ্যা স্মৃতি দিতে পারবে, সত্যিকার ঘটে যাওয়া স্মৃতি উদ্ধার করতে পারবে না।

কিছু কিছু মানুষ কেন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তাদেরকে এলিয়েন অপহরণ করেছিল, তা মিথ্যা স্মৃতি সিনড্রোমের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ ধরনের ব্যক্তিরা স্টার ট্রেক বা স্টার ওয়ার্স ধাঁচের সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রে অনেক বেশি মত্ত থাকে। তাদের সমসাময়িক সায়েন্স ফিকশনে যে যে ঘটনা ঘটে, তারাও সেরকম অভিজ্ঞতাই পায় এলিয়েনদের কাছ থেকে। তারা যে যে ঘটনার দাবী করে, সেগুলোর অধিকাংশই টেলিভিশনে প্রচারিত কোনো নাটক বা চলচ্চিত্রের সাথে মিলে যায়।

কাল্পনিক ব্যাপারকে বাস্তব স্মৃতি বলে বিশ্বাস করে কেউ কেউ। ছবি: ExP films

ঘুম জড়তা বা Sleep paralysis নামে আরো একটি ব্যাপার আছে। কেউ ঘুম জড়তায় পড়লে দেহের কোনো অঙ্গ নড়াচড়া করতে পারে না। কেউ যখন স্বপ্ন দেখে বা ঘুমায় তখন ক্ষণস্থায়ীভাবে তার দেহ স্থবির হয়ে যায়। স্বপ্নে বা ঘুমে প্রয়োজন পড়লে অনেক কষ্ট করেও হাত-পা নাড়ানো যায় না কিংবা চিৎকারও দেয়া যায় না।

অনেকেরই এমন হয়। ঘুম যখন ভাঙে, তখন জড়তা চলে যায় এবং দেহ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেহ স্বাভাবিক হতে সামান্য সময় লাগে। এমতাবস্থায় সে জাগ্রত আছে এবং আশেপাশের সকল কিছু দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু তার কোনো অঙ্গ নাড়াতে পারছে না। ব্যাপারটা এক দিক থেকে ভয়ানক, কারণ এই সময়টাতে অনেকে কাল্পনিক ভ্রান্তি বা হ্যালুসিনেশনে ভোগে।

সায়েন্স ফিকশনে আচ্ছন্ন কোনো লোক যদি এই পরিস্থিতিতে পড়ে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সায়েন্স ফিকশন সংক্রান্ত কোনো হ্যালুসিনেশনে সে পড়ে যাবে। ভাববে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী তাকে হাতে পায়ে বেঁধে রেখেছে যেন নড়াচড়া করতে না পারে। এবং আরো ভাববে তাকে নিয়ে বুঝি ভয়ঙ্কর সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

এটা বেশ খারাপ ভ্রান্তি। কল্পনা বা স্বপ্ন হলেও তা কোনো কারণে মনে গেঁথে যায়। এক পর্যায়ে তারা এটাকে বাস্তব বলে ধরে নেয় এবং এর স্মৃতিকে সত্যিকার স্মৃতি বলে মনে করে।

ঘুম জড়তায় পড়লে নড়াচড়া করা যায় না। চিত্রকর: Henry Fuseli (দ্য নাইটমেয়ার)।

একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখযোগ্য, সায়েন্স ফিকশনের গল্পগুলো জনপ্রিয় হবার আগেও এ ধরনের সমস্যা বিদ্যমান ছিল। তখনকার সময়ে যারা এরকম সমস্যায় পড়তো তারাও মিথ্যা স্মৃতিকে সত্য বলে মনে করতো। তবে সেগুলো এলিয়েনকে নিয়ে নয়, ভূত-প্রেত-পিশাচ বা অশুভ মৃত আত্মাকে নিয়ে। আজকালকার যুগের হরর সিনেমাগুলো যেমন হয় অনেকটা তেমন। তারা মানুষের কাছে বর্ণনা করতো, একটি মায়া নেকড়ে বা একজন রক্তচোষা মানুষ এসে তাদের ঘাড়ে কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খেয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার দাবী করতো ডানাওয়ালা অত্যন্ত সুন্দর পরী এসে তাদেরকে সঙ্গ দিয়ে গেছে।

কেউ যদি ভ্যাম্পায়ার বা মায়া নেকড়ের গল্পকাহিনীতে বুদ হয়ে থাকে এবং তার যদি ঘুম জড়তা বা স্লিপ প্যারালাইসিস হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সে ঘুম থেকে উঠে মনে করবে রাতে কোনো রক্তচোষা মনে হয় তাকে আক্রমণ করেছিল। কেউ যদি এলিয়েন, স্পেস শিপ, নাক্ষত্রিক ভ্রমণ নিয়ে মগ্ন থাকে, তাহলে সে সেই সংক্রান্ত বিষয় দেখতে পাবে এবং তা-ই সত্য বলে বিশ্বাস করবে।

এক্ষেত্রে আরো একটি ক্ষতিকর ব্যাপার হচ্ছে ভুক্তভোগীর পরিবার ও বন্ধুবান্ধব। কেউ যখন ভাসাভাসা স্মৃতি নিয়ে এলিয়েনদের কথা উপস্থাপন করে, তখন পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধবরা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। এলিয়েনের উচ্চতা কেমন ছিল, গায়ের রঙ কেমন ছিল, চোখ কয়টা ছিল, নাক আছে কিনা, মাথায় চুল আছে কিনা, এরা কি দেখতে মুভি-সিনেমার এলিয়েনের মতো ইত্যাদি ইত্যাদি। কৌতূহলের কোনো শেষ নেই। এমন প্রশ্নের বানে পড়ে তারা তাদের বিশ্বাসের সাথে কল্পনা মিশিয়ে ব্যাপারটাকে আরো ঘোলাটে করে ফেলে। এরকম উল্টাপাল্টা প্রশ্নের কারণেও ব্যক্তির মস্তিষ্কে মিথ্যা স্মৃতি প্রবেশ করতে পারে এবং তা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।

চোখ কয়টা, নাক কেমন, মাথায় চুল আছে কিনা, পেছনে লেজ আছে কিনা! ছবি: Behance

এই প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে এটা জানলে মনে হয় খুব বেশি অবাক লাগবে না যে, ১৯৯২ সালে আমেরিকার এক জরিপ থেকে দেখা যায়, আমেরিকার প্রায় চার মিলিয়ন মানুষ মনে করে বহির্জাগতিক কোনো বুদ্ধিমান এলিয়েন তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে এরকম হাইটেক-ফ্যান্টাসিগুলো খুব একটা জনপ্রিয় নয় বলে আমেরিকার মতো এরকম ঘটনা খুব বেশি দেখা যায় না। তারপরেও খোঁজ করলে অল্প বিস্তর ঠিকই পাওয়া যায়। ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ তার কোনো একটি স্মৃতিকথায় এরকম একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদের লেখা কোনো একটি সায়েন্স ফিকশন পড়ে এক মেয়ে দাবী করছে সে একই সাথে দুই জগতে বসবাস করছে।

মনোবিজ্ঞানী সু ব্ল্যাকমোরের মতে ঘুম জড়তায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মূলত মস্তিষ্কে কোনোকিছু নিয়ে পূর্ব থেকে স্থায়ী হয়ে থাকা ভয় বা শংকা থেকে হয়। এলিয়েনদের ধারণা জনপ্রিয় হবার আগে মধ্যযুগে এই ভয়গুলো ছিল ভ্যাম্পায়ার বা অশুভ আত্মা কেন্দ্রীক। মধ্যযুগে অনেক নারী অভিযোগ করেছিল একজন পুরুষ পিশাচ রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে তাদের সাথে যৌনকর্ম করেছে। আবার অনেক পুরুষও অভিযোগ করেছে রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় একজন নারী পিশাচ তাদের সাথে যৌনকর্ম করেছে। এরকম মুহূর্তে মনে হয় কোনো এক অশুভ পিশাচ বুকের উপরে এমনভাবে চেপে বসেছে যে কোনোভাবেই নড়াচড়া করা সম্ভব হয় না।

নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকথায় আছে ‘ওল্ড হ্যাগ’ নামে একটি সত্তা রাতের বেলায় মানুষের ঘরে আসে এবং তাদের বুকের উপর ভর করে বসে থাকে, ফলে নড়াচড়া করা সম্ভব হয় না। ইন্দোচীন এলাকার উপকথায় ‘ধূসর ভূত’ নামে একটি সত্তা আছে। এটি রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষের উপর চেপে বসে থাকে এবং তাদেরকে নড়াচড়ায় অক্ষম করে দেয়। বাংলাদেশেও এরকম সত্তা আছে। বাংলাদেশীরা একে ‘বোবায় ধরা’ নামে ডাকে। এখানের সবগুলোই ঘুমের জড়তার কারণে হয়। কোনোটিতেই কেউ বুকের উপর এসে শ্বাস চেপে বসে থাকে না।

বোবায় ধরা’তে কেউ বুকের উপর চেপে বসে না। ছবি: Carl Meadows

আশা করি আলোচনা থেকে আমরা পরিষ্কার হতে পেরেছি, কেন মানুষ ভুলভাবে মনে করে তাদেরকে এলিয়েনরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল কিংবা কেন মানুষ মনে করতো ভ্যাম্পায়াররা তাদের ঘাড় থেকে রক্ত চুষে খেয়ে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য বা প্রমাণ নেই যে পৃথিবীতে এলিয়েন এসেছিল কিংবা পৃথিবীর বাইরে এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে। এলিয়েনের পাশাপাশি ভূত বা অশুভ আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই।

কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়। পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিতে অনেক অনেক বাসযোগ্য গ্রহ রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা একদমই উড়িয়ে দেয়া যায় না। তারা এখনো পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি কিংবা তাদেরকে আমরা এখনো দেখিনি বলে তার মানে এই নয় যে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনও হতে পারে যে, তারা ঠিকই আছে, কিন্তু আমাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা তাদেরকে দেখতে বা শনাক্ত করতে পারছি না।

তবে তাদেরকে শনাক্ত করতে পারছি না বলে ইচ্ছে মতো কাল্পনিক গল্প ফেঁদেও বসা উচিৎ নয়। কোনোকিছু প্রমাণিত হলে তবেই তাকে নিয়ে খবর প্রচার করা উচিৎ এবং সত্যতার পক্ষে দাবী করা যায়। ঘুমের মধ্যে ধরে নিয়ে গেছে, বেহুশ করে নিয়ে গেছে, সুন্দর পিতামাতার কালো সন্তান প্রভৃতি অনুমান দিয়ে এলিয়েনের প্রমাণ হয় না। এখন বিজ্ঞানের যুগ, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানই জ্ঞানের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পন্থা। এলিয়েন সম্পর্কে যা করার বিজ্ঞানের সাহায্যেই করতে হবে, যা সিদ্ধান্ত নেবার বিজ্ঞানের সাহায্যেই নিতে হবে। মিথ্যা ও উদ্ভট গল্প ফেঁদে বসার কোনো সুযোগই নেই এখন আর।

তথ্যসূত্র: দ্য ম্যাজিক অব রিয়্যালিটি
ফিচার ছবি: প্রুফ অব এলিয়েন ডট কম

Related Articles