Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সঞ্জয় দত্ত: মুম্বাই নগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে জড়িয়ে পড়া বলিউডের খলনায়ক (১ম পর্ব)

ঘটনার পটভূমি

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) লৌহপুরুষ, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পোস্টারবয় এল কে আদভানী নব্বই দশকের শুরুতে বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের জন্য আন্দোলন শুরু করলেন দেশব্যাপী। ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে ১০ হাজার কিলোমিটার রথযাত্রা এসে থামলো উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে বিশ্ব হিন্দুু পরিষদ, আরএসএস, বিজেপির স্বেচ্ছাসেবকরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। সেই মসজিদ ভাঙার ঢেউ এসে লাগে মায়ানগরী মুম্বাইয়ে। শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মারাঠি হিন্দুদের সাথে পেরে উঠেনি সংখ্যালঘু মুসলমানেরা। প্রায় ১ হাজারের মতো লোক নিহত হয়, যার মধ্যে ৭৫০ জনের বেশিই ছিল মুসলমান।

বাবরি মসজিদ ভাঙার কারণেই শুরু হয় মুম্বাইয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা; source: nitinrai.com

আরেক উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনার প্রধান বাল থ্যাকারে তার সমর্থকদের এই বলে লেলিয়ে দিলেন যে, মুসলমানদেরকে আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দাও। এই দাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে দাউদ ইব্রাহীমের প্রত্যক্ষ মদদে মুম্বাই নগরীতে সিরিজ বোমা হামলার পরিকল্পনা করে টাইগার মেমন। সিরিজ বোমা হামলায় মুম্বাই নগরী যখন বিপর্যস্ত, ২৫৭ জন লোক নিহত ও দেড় হাজারের বেশি লোক আহত হয়, ঠিক তখনই মুম্বাই পুলিশ টের পেয়ে যায় বলিউড অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের সাথে মাফিয়াদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু তা-ই নয়, মুম্বাইয়ের মাফিয়াচক্রের অন্যতম প্রধান সদস্য আবু সালেম সঞ্জয় দত্তের বাসায় গিয়ে নিজে বেআইনী অস্ত্র দিয়ে আসে, গ্রেপ্তার হন এই নায়ক। তারপর থেকে কয়েক দফা জেলের গ্লানি টেনে সঞ্জয় দত্ত পুরোপুরি মুক্ত হয়েছেন এই কয়েকদিন আগে।

শিবসেনা প্রধান বাল থ্যাকারে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার লোকজনদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন; source: NewsRead.in

মুম্বাই পুলিশের চিরুনি অভিযান ও সঞ্জয় দত্তের সংশ্লিষ্টতা

১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ সিরিজ বোমার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে মুম্বাই। একটি পরিত্যাক্ত স্কুটারের সূত্র ধরে মুম্বাই পুলিশ দু’দিনের মধ্যে টের পেয়ে যায়, এই বোমা হামলার মাস্টারমাইন্ড হচ্ছেন টাইগার মেমন। শুরু হয়ে যায় ধরপাকড়। টাইগার মেমনের ব্যক্তিগত ম্যানেজার আসগার মুকাদ্দাম প্রথম ধরা পড়ে। তারপর একে একে ধরা পড়ে টাইগার মেমন ও দাউদ ইব্রাহীমের সকল শিষ্য।

আদভানীর উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতকে বিভাজিত করেছে; source: lkadvani1.blogspot.com

মুম্বাই নগরীর মাহিম থানার লকআপ ভরে উঠলো শত শত সন্দেহভাজনের গ্রেফতারের পর। মুম্বাই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রধান রাকেশ মারিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে অনেক তথ্য। এমনই এক সন্দেহভাজন ইব্রাহীম চৌহানকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রথমবারের মতো তথ্য পেয়ে যায় পুলিশ, বলিউডের প্রযোজক জুটি সামির-হানিফ দাউদ ইব্রাহীমের ছোট ভাই আনিস ইব্রাহীমের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সঞ্জয় দত্ত-মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত সনম মুভির প্রযোজক হচ্ছেন সামির-হানিফ। যেহেতু মুম্বাইয়ের সিরিজ বোমা হামলায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্যরা জড়িত, তাই পুলিশ মাফিয়াদের সমস্ত নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে এবার কোমর কষে মাঠে নেমে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে দাউদ ইব্রাহীম দুবাই থেকে পাকিস্তান পালিয়ে যান। সামান্যতম সন্দেহভাজনকেও পুলিশ ছাড় দেয়নি। ইব্রাহীম চৌহানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পুলিশ পরদিনই গ্রেফতার করে প্রযোজক সামির-হানিফ জুটির হানিফকে।

রাকেশ মারিয়ার পরামর্শে মাহিম থানার ওসি বীরেন্দ্র বাণী জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করলেন হানিফকে। প্রথমে হানিফ তার সাথে দাউদ ইব্রাহীমের ভাই আনিস ইব্রাহীমের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করে। জেরার এক পর্যায়ে হানিফ ভেঙে পড়ে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠে,

“আপনারা পুলিশের লোকজন আমাদের মতো চুনোপুঁটিকেই শায়েস্তা করতে জানেন। সাহস থাকলে সঞ্জয়কে ধরেন।”

“সঞ্জয়, কোন সঞ্জয়?” প্রশ্ন করলেন বাণী।

“আরে সাহাব, সঞ্জয় দত্তকে চিনেন না? অভিনেতা ও এমপি সুনীল দত্তের ছেলে সঞ্জয় দত্ত।” হানিফের উত্তর।

থ হয়ে গেলেন বীরেন্দ্র বাণী। রাকেশ মারিয়ার কাছে তড়িঘড়ি রিপোর্ট পাঠাতে হবে সঞ্জয় দত্তের ব্যাপারে। এদিকে রাকেশ মারিয়া সরাসরি ইব্রাহীম চৌহানকে ঘায়েল করে ফেললেন। ইব্রাহীম চৌহান সব বলে দিলেন রাকেশ মারিয়াকে।

“সাহাব, সামির-হানিফ আমার সামনেই আনিস ইব্রাহীমকে ফোন করেছে। আনিস ইব্রাহীম আমাকে ও আবু সালেমকে নির্দেশ দিয়েছে সঞ্জু বাবার বাসায় গিটার ও টেনিস বল পৌঁছে দিতে।”

“গিটার ও টেনিস বল মানে?” জিজ্ঞেস করলেন মারিয়া।

ইব্রাহীম চৌহান বলতে লাগলো, “সাহাব, গিটার হচ্ছে একে-৫৬ রাইফেল, আর টেনিস বল হচ্ছে অল্প কয়েকটা হ্যান্ড গ্রেনেড।”

মারিয়া এবার হাসতে লাগলেন, “তোমার সঞ্জু বাবাই কি অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত?”

ইব্রাহীম চৌহানের কাছ থেকে হ্যাঁ-সূচক সাড়া পেয়ে মারিয়া এবার বলতে লাগলেন, “দেখো ইব্রাহীম, তুমি নিজে বাঁচার জন্য উল্টাপাল্টা গল্প করো না। দাউদ ইব্রাহীমের ভাই আনিস ইব্রাহীম কেন তোমাকে ও আবু সালেমকে ফোন করবে সঞ্জয় দত্তের বাসায় অস্ত্র দিয়ে আসার জন্য। এর কারণটা কী?”

“সাহাব, সঞ্জয় দত্তের বাবা সুনীল দত্ত বান্দ্রা এলাকার এমপি। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সুনীল দত্ত। সঞ্জয় দত্তও এ ব্যাপারে বাবার কর্মকাণ্ডে শরিক ছিলেন। মুসলিম বিদ্বেষী শিবসেনার দল এতে ক্ষেপে গেছে। সঞ্জয় দত্তের দুই বোনকে প্রকাশ্যে গণধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছে শিবসেনা। মৃত্যুর হুমকি দিয়েছে সুনীল দত্তকে। ভীতসন্ত্রস্ত সঞ্জয় তাই আনিস ইব্রাহীমের কাছে নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র চেয়েছে।”

মারিয়া ভাবতে লাগলেন, শিবসেনার গুণ্ডা-পাণ্ডারা যদি সঞ্জয়কে হুমকি দিয়েই থাকে, তাহলে নিরাপত্তার জন্য মাফিয়াদের কাছ থেকে অস্ত্র আনতে হবে কেন? সঞ্জয় দত্ত কি আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন না?

সঞ্জয় দত্ত কি আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন না?; India West

ইত্যবসরে মাহিম থানার ওসি বীরেন্দ্র বাণী পুলিশের প্রিজন ভ্যানসহ রাকেশ মারিয়ার দফতরে হাজির।

“স্যার, প্রযোজক হানিফকে আপনার সামনেই নিয়ে এসেছি। সে বলেছে, সঞ্জয় দত্তের কাছে নাকি বেআইনী অস্ত্র আছে, যা আনিস ইব্রাহীম দিয়েছে।” বাণী বললেন রাকেশ মারিয়ার উদ্দেশ্যে।

হানিফের সহযোগী সামিরকে গ্রেফতার করে মারিয়ার কার্যালয়ে নিয়ে এসেছে পুলিশের আরেকটি দল। সামির-হানিফ ও ইব্রাহীম চৌহান এই তিনজনকে একত্র করে এবার জেরা শুরু করলেন রাকেশ মারিয়া। তাদের কাছ থেকে মারিয়া যা জানলেন তা হলো,

১৯৯২ সালের ডিসেম্বর ও তার পরের মাস জানুয়ারি, এই দুই মাসে মুম্বাই নগরী যখন দাঙ্গায় জেরবার, তখন সঞ্জয় দত্তের বাবা সুনীল দত্তের বাসা পালি হিলসের অজন্তায় প্রতিদিনই বলিউডের লোকজন মিলিত হতো। ত্রাণ কার্যক্রমও চলতো। ঠিক সেই সময় কোনো একদিন সঞ্জয় দত্ত আনিস ইব্রাহীমকে ফোন করে অস্ত্র চেয়েছেন। ১৬ জানুয়ারি তারিখে আবু সালেম, ইব্রাহীম চৌহান ও সামির- এই তিনজন সরাসরি সঞ্জয় দত্তের বাসায় অস্ত্র নিয়ে হাজির হলেন। দুজন কনস্টেবল বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলো। সঞ্জয় দু’জনকে ইশারা দিলেন একটু সরে যেতে। আবু সালেম সরাসরি সঞ্জয় দত্তের কাছে গিয়ে বললো-

“আপনি কয়টা অস্ত্র চেয়েছিলেন?”

“কয়টা অস্ত্র তোমরা নিয়ে এসেছ?”

“নয়টি একে-৫৬ ও ৮০টি হ্যান্ড গ্রেনেড আছে।”

“আমাকে তিনটি একে-৫৬ ও ২৫টি হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে যাও।”

সব জেনে রাকেশ মারিয়া তার উর্ধ্বতন বস মি. সামরাকে ফোন করে সব জানালেন। মি. সামরা তাকে সঞ্জয় দত্তকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিতে বললেন।

সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অ্যাকশন

মরিশাসের নয়নাভিরাম বিচে সঞ্জয় দত্ত তখন ‘আতিশ’ মুভির শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত। মুম্বাই নগরীর পুলিশ কমিশনার মি. সামরা প্রেস কনফারেন্সে বলে দিলেন, “আমরা তথ্য পেয়েছি, বলিউডের বেশ কিছু লোকজন মাফিয়াদের সাথে জড়িত। অচিরেই আমরা এদের পাকড়াও করবো।” সাংবাদিকরা পত্রিকায় গসিপ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কেউ কেউ লিখেই ফেললেন, সঞ্জয় দত্তও সিরিজ বোমা হামলার সাথে জড়িত। পুরো ভারত জুড়ে রব উঠলো, সঞ্জয়কে গ্রেফতার করো। মরিশাসে বসে সঞ্জয় এসব টের পেলেন। সাথে সাথে ফোন করলেন পুলিশ কমিশনার সামরাকে। সঞ্জয় দাবি করলেন, তিনি কোনোভাবেই সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত নন। পুলিশ চাইলে তিনি এখনই মুম্বাই ফিরে আসবেন। সামরা তাকে বললেন, “এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

এদিকে পুলিশ ভেতরে ভেতরে প্রস্তুুতি নিচ্ছিল সঞ্জয় দত্তকে গ্রেফতার করার জন্য। পুলিশ গোপনে খবর পেল, এয়ার মরিশাসের ফ্লাইটে করে ১৯ এপ্রিল ভোরবেলা সঞ্জয় দত্ত মুম্বাই আসছেন। ২০০ পুলিশ ও কমান্ডো বাহিনী বিমানবন্দর ঘিরে রাখল সঞ্জয় দত্তকে গ্রেফতারের জন্য।

এক পুলিশ অফিসার সঞ্জয়কে দেখে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “মি. সঞ্জয় দত্ত, আপনাকে আমাদের সাথে আসতে হবে।”

“কেন, আমি কী করেছি?” সঞ্জয় দত্তের বিনম্র প্রতিবাদ।

“এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারব না। আপনাকে আমাদের সাথে পুলিশের হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে।” বললেন অফিসার।

নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হলেন অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত; source: IBTimes India

আর কোনো কথা বলেননি সঞ্জয় দত্ত। বাধ্য ছেলের মতো পুলিশের গাড়িতে উঠলেন। এভাবেই নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হলেন অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত। সঞ্জয় দত্তের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ও তার গ্রেফতার পরবতী ঘটনাবলী নিয়ে সিরিজের শেষ পর্ব পড়ুন এখানে, সঞ্জয় দত্ত: মুম্বাই নগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে জড়িয়ে পড়া বলিউডের খলনায়ক (শেষ পর্ব)।

তথ্যসূত্র: Zaidi, S. Hussain. 2002. Black Friday. Page no- 172 -195. Penguin Books India.

ফিচার ইমেজ- images.dawn.com

Related Articles