Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্টোনহেঞ্জ: চিরন্তন এক রহস্য

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদগণ স্টোনহেঞ্জের রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কী করে তৈরি করা হয়েছিল এই বিশালাকৃতির পাথুরে স্তম্ভ? কেনই বা তৈরি করা হয়েছিল? এরকম আরও হাজারো প্রশ্ন স্টোনহেঞ্জকে ঘিরে তৈরি হয়েছে, যার উত্তর কেউই সঠিকভাবে দিতে পারেনি। তবে অনেক যুক্তি তর্কের ভিত্তিতে যেমন রয়েছে নানান তত্ত্ব, তেমনি রয়েছে অনেক মুখরোচক রহস্যময় গল্প।

ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের উইল্টশায়ারে অবস্থিত স্টোনহেঞ্জ নব্যপ্রস্তরযুগে তৈরি বলেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা। তৈরি করতেও সম্ভবত পৃথিবীর যেকোনো স্থাপনার চেয়ে অধিক সময় লেগেছে স্টোনহেঞ্জের ক্ষেত্রে। প্রায় ১৫০০ বছর! ছোট-বড় প্রায় ১০০টি পাথর নিয়ে তৈরি এই স্তম্ভের বড় পাথরগুলোর ওজন সর্বোচ্চ ২৫ টন! প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানুষের কাছে ছিল না কোনো প্রযুক্তি, যখন চাকাও আবিষ্কৃত হয়নি, তখন মানুষ কী করে এসব পাথর এ স্থানে বহন করে এনেছিল এবং এই স্তম্ভটি বানিয়েছিল তা আজও রহস্য হয়ে আছে। তবে ইতিহাসবিদদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্টোনহেঞ্জ তৈরি করা হয়েছিল তিনটি ধাপে। চলুন সংক্ষেপে দেখে আসি ধাপগুলো।

প্রথম ধাপ

স্টোনহেঞ্জের প্রাথমিক ধাপের কাজ (কল্পিত); image source: unknownworld.co.uk

কেউ সঠিক বলতে পারবে না একেবারে ঠিক কখন স্টোনহেঞ্জের কাজ শুরু হয়েছিল। এ নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক। তবে অধিকাংশের মতে এর প্রথমভাগের কাজ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে। প্রথম ধাপে এর বাইরের দিকের ৩৬০ ফুট ব্যাসের একটি বৃত্তাকার পরিখা খননের কাজ শুরু হয় যার গভীরতা ছয় ফুট। পরিখার উত্তর-পূর্বে একটি বড় প্রবেশপথ এবং দক্ষিণ দিকে একটি ছোট প্রবেশ পথ আছে। এই পরিখা এবং এর ঢালু কিনারাকে একত্রে ‘হেঞ্জ’ বলা হয়। পুরো হেঞ্জজুড়ে রয়েছে ৫৬টি ছোট ছোট খাদ যার প্রতিটির ব্যাস ৩ ফুটের মতো। ১৭ শতকে জন অব্রে নামক এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এই খাদ বা গর্ত আবিষ্কার করেন। তার নামেই এগুলোর নামকরণ করা ‘অব্রে হোল’। ধারণা করা হয় এই গর্তগুলোকে ‘ব্লুস্টোন’ অথবা কাঠের তক্তা দিয়ে ভরাট করা হয়েছিল। ব্লুস্টোন হচ্ছে স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে ছোট আকারের পাথর যেগুলো ভেজা অবস্থায় কিছুটা নীলাভ দেখায়। এই পাথরগুলোর ওজন ২ থেকে ৪ টনের মধ্যে, যেগুলো প্রায় ২৫০ মাইল দূরের প্রেসেলি পাহাড় থেকে আনা হয়েছিল!

দ্বিতীয় ধাপ

এই ধাপে ঠিক কী কাজ হয়েছিল তার খুব একটা প্রমাণ দৃশ্যমান নয়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে আগের ধাপের কাজ শেষ হবার ১০০ থেকে ২০০ বছর পর শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এ সময় থেকে স্টোনহেঞ্জকে সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। তখন কেন্দ্রে ছাদ সদৃশ কাঠের তৈরি গঠন বানানো হয়। তাছাড়া দুটি প্রবেশপথেও অনেকগুলো কাঠের তক্তা উল্লম্বভাবে স্থাপন করা হয়। বৃত্তাকার পরিখাটিতে নতুন করে আরো ৩০টি গর্ত খনন করা হয় শবদাহের জন্য।

তৃতীয় ধাপ

কাজ শেষ হবার পর পূর্ণ স্টোনহেঞ্জের চিত্র (কল্পিত); image source: reddit.com

দ্বিতীয় ধাপের প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর পর তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়। প্রধান কাজ মূলত এই ধাপেই হয় এবং এটিই সবচেয়ে দীর্ঘ ধাপ। এই সময় অব্রে হোলগুলোতে থাকা ব্লুস্টোন তুলে ফেলা হয় এবং সে স্থলে ৩০টি বিশালাকার ‘সারসেন’ বসানো হয়। স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে বড় পাথরগুলোকে সারসেন বলা হয়। এই সারসেনগুলো ২৫ মাইল দূরবর্তী মার্লবোরো নামক স্থান থেকে নেয়া হয়।

সারসেন এর সামনে ব্লুস্টোনের অবস্থান; image source: stone-circles.org.uk

প্রতিটি সারসেন উচ্চতায় ১৩ ফুট এবং প্রায় ৭ ফুট চওড়া। এদের ওজন প্রায় ২৫ টন! প্রতি দুটি সারসেনের উপর একটি করে চৌকাঠের মতো পাথর বসিয়ে দেয়া হয়। এরূপ একজোড়া সারসেনকে বলা হয় ট্রিলিথন। ব্লুস্টোনগুলোকে এদের সামনে বৃত্তাকারে বসিয়ে দেয়া হয়।

পরিবহন

সারসেনগুলো ২৫ মাইল দূরের মার্লবোরো থেকে কিভাবে স্টোনহেঞ্জে আনা হলো তা যেমন বিস্ময় সৃষ্টি করে, তারচেয়েও বেশি বিস্ময় সৃষ্টি করে ২৫০ মাইল দূরে অবস্থিত প্রেসিলি পাহাড় থেকে ব্লুস্টোনগুলোকে স্টোনহেঞ্জে বহন করার ব্যাপারটি। অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন মানুষই কোনোভাবে এগুলো সমুদ্রতীর ঘেঁষে স্টোনহেঞ্জে নিয়ে গেছে। তবে কেউ কেউ বলছেন হিমবাহের সাথে এই পাথরগুলো পরিবাহিত হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই! তবে কোনোটির ক্ষেত্রেই উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ মেলে না।

স্টোনহেঞ্জে পাথর গুলো পরিবহনের সম্ভাব্য পথ; image source: english-heritage.org.uk

আকৃতি প্রদান

স্টোনহেঞ্জের উত্তরদিকে অনেকগুলো ভাঙা ব্লুস্টোন এবং সারসেন পাওয়া গেছে যা থেকে ধারণা করা হয় সেখানেই পাথরগুলোকে এনে প্রথমে রাখা হয় এবং যথাযথ আকৃতি প্রদান করা হয়। সেখানে ছোট-বড় অনেকগুলো ‘হ্যামারস্টোন’ (পাথরকে আকৃতি দেবার জন্য হাতুড়ি হিসেবে ব্যবহৃত পাথর)-ও পাওয়া যায়। আধুনিক লেজারে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে কিছু পাথরকে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের প্রবেশপথের নিকটের পাথরগুলোকে বিশেষভাবে মসৃণ এবং আকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া খাড়া সারসেনগুলোর উপর অনুভূমিকভাবে পাথরগুলো স্থাপনের জন্য এগুলোর মধ্যে মসৃণ ছিদ্র এবং খাঁজ সৃষ্টি করা হয়।

বহিঃস্থ সারসেনগুলোর সংযোগস্থলের ডায়াগ্রাম; image source: english-heritage.org.uk

স্টোনহেঞ্জ কেন বানানো হয়েছিল

স্টোনহেঞ্জ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়েও যথারীতি রয়েছে অনেকগুলো তত্ত্ব এবং বিতর্ক। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি তত্ত্ব এক ঝলক দেখে নিই,

১) পবিত্র সমাধিক্ষেত্র

স্টোনহেঞ্জ একটি সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো- এমন দাবির পক্ষেই সবচেয়ে বেশি প্রমাণ পাওয়া যায়। স্টোনহেঞ্জে ঘুরতে গেলে আপনি নিজেও এর মাঝে গর্তগুলো দেখে একে সমাধিক্ষেত্র ভাববেন। তবে কিছু প্রত্মতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় এই স্থানটিতে কেবল সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষদেরই সমাধিস্থ করা হতো। সম্প্রতি এখানে পাওয়া গিয়েছে ব্রোঞ্জ যুগের ৬৩ জন মানুষের অস্থি। স্টোনহেঞ্জের বিশেষ আকৃতি এবং এতে প্রবেশের পথ নির্দেশ করে যে স্থানটিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনেই করা হতো।

২) মানমন্দির

স্টোনহেঞ্জের পাথরগুলো যেভাবে সাজানো, তাতে জোতির্বিদগণ বহু আগেই নিশ্চিত করেছেন স্টোনহেঞ্জের সাথে জোতির্বিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিলো। অনেকের ধারণা স্টোনহেঞ্জের সাহায্যে ব্রোঞ্জ যুগেের আশেপাশের মানুষ আবহাওয়া ও ঋতুর খোঁজ রাখতো এবং ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত সময় নির্ণয় করতো।

৩) আরোগ্য লাভের স্থান স্টোনহেঞ্জ

এই তত্ত্বটিকেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা স্টোনহেঞ্জে খুঁজে পাওয়া মানুষের কঙ্কালগুলোর মধ্যে এমন স্থানের মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে যা বর্তমানে সুইজারল্যান্ড। এতে সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত না হলেও অন্তত ধারণা করা যায় এই স্থানে মানুষ আরোগ্যলাভের জন্য অনেক দূর থেকেও ভ্রমণ করতো। তাছাড়া অনেক ইতিহাসবিদের মতে স্টোনহেঞ্জ একটি তীর্থস্থান ছিল যেখানে ভ্রমণ করলে অলৌকিভাবে আরোগ্যলাভ করা সম্ভব বলে মানুষ বিশ্বাস করতো!

কারা তৈরি করেছিল এই অদ্ভুত স্তম্ভ

স্টোনহেঞ্জে পাথর স্থাপন করছেন যাদুকর মার্লিন (কাল্পনিক ছবি); image source: fineartamerica.com

দ্বাদশ শতকের লেখক জিওফ্রের তত্ত্বে যদি আপনি বিশ্বাস করতে চান, তাহলে আপনাকে জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী হতে হবে। তার মতে কোনো এক মার্লিন নামক যাদুকরের জাদুতেই তৈরি হয় স্টোনহেঞ্জ। গল্পটা হচ্ছে এরকম।

রাজা অরেওলেস-এর রাজ্যের শত শত নাগরিককে বর্বর স্যাক্সনরা হত্যা করে এবং স্যালিসবুরি সমতল ভূমিতে নিয়ে গণকবর দেয় (যে স্থানে স্টোনহেঞ্জ রয়েছে)। স্টোনহেঞ্জের সারসেনগুলো তখন আয়ারল্যান্ডে একটি বৃত্তাকার স্তম্ভের মধ্যে ছিল, যা কিনা প্রাচীনকালে দৈত্যরা তৈরি করেছিল বলে ধারণা করতো মানুষ। রাজা অরেওলেস গণকবরের উপর মৃতদের স্মরণে একটি সমাধি নির্মাণের উদ্দেশ্যে আয়ারল্যান্ড থেকে সারসেনগুলো আনতে তার সৈন্যদেরকে প্রেরণ করেন। সৈন্যরা আইরিশদেরকে সহজেই পরাজিত করলেও পাথরগুলোকে কিছুতেই বহন করতে পারছিলো না। তখন রাজার আদেশে মার্লিন তার কালো জাদুর সাহায্যে ২৫০ মাইল দূরে ওয়াইল্ট শায়ারে পাথরগুলো পৌঁছে দেন!

১৭ শতকে প্রত্নতাত্ত্বিক জন অব্রে বলেন যে, স্টোনহেঞ্জ তৈরি করেন সেল্টিক ধর্মযাজকগণ, যাদেরকে ‘ড্রুইড’ বা ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ বলা হতো। তবে বিশ শতকে আধুনিক রেডিওকার্বন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় স্টোনহেঞ্জ ইংল্যান্ডে সেল্টিকদের বসবাসের প্রায় ১০০০ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বর্তমানে এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে স্টোনহেঞ্জ কোনো একটি সম্প্রদায়ের নয়, বরং একাধিক সম্প্রদায় এবং জাতির কাজের ফসল।

স্টোনহেঞ্জের বর্তমান অবস্থা

স্টোনহেঞ্জ; ছবিসূত্রঃ drdudsdicta.com

১৯৮৬ সালে স্টোনহেঞ্জকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর একটি হচ্ছে এই স্টোনহেঞ্জ। প্রতি বছর আট লক্ষাধিক দর্শনার্থী এই স্থানটিতে এসে ঘুরে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার স্টোনহেঞ্জের সংস্কার করা হয়েছে। সারসেনগুলোকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এদেরকে কংক্রিট দ্বারা মজবুত করা হয়েছে। তাছাড়া ক্রমাগত বাড়তে থাকা দর্শনার্থীদের সুবিধা করে দেয়ার জন্য বেশ কিছু ব্লুস্টোনকেও পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।

ইতিহাসবিদ আর প্রত্নতত্ত্ববিদগণ যে তত্ত্বই দিক না কেন, স্টোনহেঞ্জের রহস্য পুরোপুরি অনাবৃত করা আদৌ সম্ভব নয়। হাজার বছরের পুরনো এই স্তম্ভটি কী উদ্দেশ্যে কারা বানিয়েছিল এসব কিছুই নিশ্চিত করে হয়তো জানা যাবে না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, স্টোনহেঞ্জ যতদিন অক্ষত থাকবে, ততদিনই মানুষের নিকট এটি একটি রহস্য হয়ে থাকবে।

ফিচার ছবিঃ xinature.com

Related Articles