Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের বীরত্বগাথা

১৯৭১ সাল, পশ্চিম পাকিস্তানের সীমাহীন শোষণ-নিপীড়নের নাগপাশ থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। দীর্ঘ নয় মাস জুড়ে চলা সশস্ত্র সেই সংগ্রামে কিশোর, শ্রমিক, মজুর, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও ত্যাগ দিয়ে একটি মহান ইতিহাস গড়ল তারা। একটি বিজয়ের ইতিহাস, একটি গৌরবের ইতিহাস। জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের, লাল-সবুজে আঁকা পতাকা উড়ল মুক্ত বাংলার সুনীল আকাশে।

স্বাধীন বাংলার আকাশে উড়ছে বিজয়নিশান; Source: londoni

আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে ছিলেন জাতির যেসব সূর্যসন্তান, তাদের মধ্যে চিকিৎসকেরা অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে যেখানে পাকবাহিনীর হাতে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল মানবতা, সেখানে চিকিৎসকরা সেই বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে। তারা যেমন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি রণাঙ্গণের বাইরে আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদেরকে অবিরত চিকিৎসাসেবা দান করে গেছেন।

পাকবাহিনীর বর্বরতা; Source: hindustantimes.com

যুদ্ধ মানেই রক্তপাত আর মৃত্যু। মৃত্যুর দুয়ার থেকে আহত সেনাদের ফিরিয়ে এনে আবারও রণক্ষেত্রে দাঁপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে শত্রুর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়া বা নিরীহ কোনো মানুষের দুঃসহ ক্ষত সারিয়ে তাকে আবারো হাস্যোজ্জ্বল জীবন দান করতে পারেন চিকিৎসকেরাই। পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধেই চিকিৎসকেরা বৈরী পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত মানুষকে সুস্থ করার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের সেই ভীষণ সংকটকালে সাহসী কিছু বাঙালী চিকিৎসক গণমানুষের সেবায় মহৎ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। আজ বলব মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসাব্যবস্থা এবং সেসব মহান চিকিৎসকদের কথাই।

বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল

১৯৭১ সালের মার্চ মাস, পূর্ব পাকিস্তান তখন ঘোর সংকটে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালি চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এ. এইচ. সাঈদুর রহমানকে সভাপতি এবং ভাস্কুলার সার্জন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (BMA-UK)। মে মাসের শুরুর দিকে বিএমএ ডা. জাফরুল্লাহ এবং আরেকজন তরুণ চিকিৎসক ডা. এম. এ. মবিনকে ভারতের ত্রিপুরায় পাঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য। তারা দুজন প্রথমে মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেন এবং পরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও ত্রিপুরায় উদ্বাস্তু বাঙালীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে শুরু করেন। পরে তারা মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর আখতার আহমেদকে সহযোগিতা করেন একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে।

বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল; Source: londoni

যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হলে অগণিত দেশপ্রেমী, বাঙালী তরুণ প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার বাহিনীর থাবা থেকে মুক্ত করার সংকল্প নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করেন। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু এবং পাকিস্তানী পশুদের নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নারীর জন্য জরুরি চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনীয়তা চিকিৎসা সংকটকে ঘনীভূত করে।

এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ভারতের জি. বি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের কাছে সাহায্য চান যেন ত্রিপুরা রাজ্যে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করা হয় এবং এর দায়িত্ব মুক্তিবাহিনীর হাতে অর্পণ করা হয়। এই উদ্যোগ আগরতলার অন্যান্য হাসপাতালের উপর ব্যাপক চাপ হ্রাস করতে পারবে। ডা. দত্ত ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের সাথে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। অবশেষে মেজর খালেদ মোশাররফের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং আগরতলা শহরের দক্ষিণে অবস্থিত বিশ্রামগঞ্জের কাছে মেলাঘর নামক স্থানে ‘হাবুল ব্যানার্জির লিচু বাগান’ এ একটি উদ্বাস্তু শিবির স্থাপন করা হয়। এই জায়গাটাই পরে একটু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে একটি হাসপাতালের রূপ দেয়া হয়।

মেজর খালেদ মোশাররফ; Source: wikia.com

আগস্ট মাসে মেজর খালেদ মোশাররফ হাসপাতালের নির্মাণের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন এবং মেজর আখতার আহমেদকে হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করেন। মেজর আহমেদ বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি করেন বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল।

মেজর আখতার আহমেদ; Source: bdnews24.com

হাসপাতালটি ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’, ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস হসপিটাল’ বা শুধু ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। ত্রিপুরার সীমান্ত দেশের কুমিল্লা জেলার খুবই কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা আর উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি এই এলাকার বাঙালী রোগীরাও সহজেই চিকিৎসা নিতে পারতেন। যুদ্ধের সময় অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে হাসপাতালটি।

বীরপ্রতীক পদকপ্রাপ্ত ডা. সিতারা বেগম; Source: wikimedia commons

এরপর ডা. সিতারা বেগম হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পান। আরো পাঁচজন বাঙালি ডাক্তার এবং মহিলা স্বেচ্ছাসেবীর সহযোগীতায় ডা. সিতারা বেগম হাসপাতাল চালাতে থাকেন। সেসময় যেহেতু কোনো নার্স ছিল না, ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বেচ্ছাসেবী মহিলাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন।

যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে অনেক মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ মেয়েরা হাসপাতালে যোগ দিতে থাকেন। অল্প কিছু শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা হাসপাতালটি ডিসেম্বরের শেষের দিকে চারশোরও বেশি শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পরিণত হয়।

এটা তো গেল দেশের সীমান্তের বাইরে যুদ্ধাহত বাঙালিদের সেবায় দেশের চিকিৎসকদের অবদান আর ত্যাগের কথা। দেশের অভ্যন্তরে এমনই আরো অসংখ্য চিকিৎসক দেশমাতৃকার স্বাধীনতা পাগল ছেলেদের গুলিবিদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত শরীরকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে, মুমূর্ষু মুক্তিযোদ্ধার শিয়রে বসে রাতদিন তাদের সেবা করে তাদেরকে সুস্থ হতে রাতের ঘুমকে বিসর্জন দিয়েছেন। সবার কথা হয়তো জানা সম্ভব হয়নি এখনো। তবে আমরা যাদের কথা জানি, তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবদানের কথা আজ জানানোর চেষ্টা করবো।

ডা. মুহম্মদ ফজলে রাব্বি

ডা. ফজলে রাব্বি; Source: wikipedia

ডা.ফজলে রাব্বি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত প্রফেসর এবং কার্ডিওলজিস্ট। ভীষণ মেধাবী এই মানুষটি সেই সময়ে দুবার পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশন করে রেকর্ড গড়েছিলেন।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি স্বাধীনতা আন্দোলনেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মানবতাবাদী এই চিকিৎসক এবং তার পরিবার পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা করেন এবং তাদের পরিবারকে দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচান। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদেরকে তিনি অর্থ, আশ্রয়, চিকিৎসা প্রভৃতি প্রদান করেন। পাকবাহিনী আর তাদের সহযোগীদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে মেরুদন্ডহীন করে দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হন দেশের খ্যাতনামা অনেক পন্ডিতদের মতো ডা. ফজলে রাব্বিও। তাঁকে বাড়ি থেকে প্রথমে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ১৫ ডিসেম্বর রায়েরবাজারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

ডা. আলিম চৌধুরী

ডা. আলিম চৌধুরী; Source: ganijan.com

ডা. আলিম চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় তার মেধা এবং শ্রমকে নিয়োজিত করেন। কুচক্রী পাকিস্তানী সেনারা যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, তাদের তালিকায় তার নামও আছে। ডা. আলিমকে আল বদর বাহিনী তার পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে।

ডা. আজহারুল হক

ডা. আজহারুল হক; Source: wikimedia commons

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা তরুণ এই চিকিৎসক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। যুদ্ধের সময় তার প্রাইভেট চেম্বার ছিল ঢাকার হাতিরপুলে সায়্যিদা ফার্মেসীর সাথেই। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে এখানে নিয়ে আসতেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। রাতের আঁধারে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরেও তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। রাজাকাররা ১৫ ডিসেম্বর তাকে মেরে ফেলে। ১৬ ডিসেম্বর তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়।

মুক্তিযু্দ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং শহীদ হওয়া অনেক চিকিৎসকই ছিলেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। তারা একইসাথে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং আহতদের সেবা করেছেন।

জাতিকে স্বপ্ন দেখাতেন যারা, যারা অন্ধকারে আলোর পথ দেখাতেন সেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বর্বর পাকবাহিনী আমাদের জাতিকে অন্ধকারে নিপতিত করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল জাতি যেন অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে মেধাশূন্য। তাদের এই ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করতে গিয়ে দেশের প্রতিটি পেশার সেরা মেধাবীদের হত্যা করে তারা। চিকিৎসকরাও তাদের বর্বরতা থেকে মুক্তি পাননি। উল্লেখিত তিনজন ছাড়াও অসংখ্য মেধাবী চিকিৎসককে তাদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডা. আবুল ফজল জিয়াউর রহমান, ডা. এবিএম নুরুল ইসলাম, ডা. জিকরুল হক, ডা. সামসাদ আলী, ডা. রাখাল চন্দ্র দাস প্রমুখ।

এই বিজয়ের মাসে সেসব শহীদ চিকিৎসককে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, তাদের প্রতি নিবেদন করছি সশ্রদ্ধ সালাম।

ফিচার ইমেজ- Londoni

Related Articles