Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সম্রাট শাহজাহানের অনন্য সব স্থাপত্যকীর্তি

ভারতবর্ষের ইতিহাসে, বিশেষ করে মুঘল ইতিহাসে সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ যুগে ভারতবর্ষের সম্যক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো স্থাপত্যশিল্প। নিজের শিল্পচিন্তাকে কাজে লাগিয়ে সম্রাট শাহজাহান তার জীবদ্দশায় এমন কারুকার্যময় সব স্থাপনা নির্মাণ করিয়ে যান, যা আজও সমগ্র পৃথিবীর পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তার বিনির্মিত তাজমহল বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের একটি তা তো সবারই জানা। স্থাপত্যকলায় এই বিরল অবদানের কারণে সম্রাট শাহজাহানকে ‘The prince of builders’ নামে অভিহিত করা হয়। চলুন তার অনন্য স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে কিছু জানা যাক।

সম্রাট জাহাঙ্গীর যেমন চিত্রকলায় পারদর্শী ও সুবিখ্যাত ছিলেন, তার পুত্র শাহজাহান তেমনি পারদর্শী ছিলেন স্থাপনাশিল্পে। পূর্ববর্তী মুঘল সম্রাটদের নির্মাণশৈলী থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন শাহজাহান। তার স্থাপনায় রঙ আর আড়ম্বরের প্রাচুর্য ছিল লক্ষণীয়, অবকাঠামোগত দিক দিয়েও ছিল এসব স্থাপনা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি উন্নত। বিদেশী স্থাপত্যরীতির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় তার নির্মাণে। শাহজাহানের পূর্বে স্থাপত্যশিল্পে লাল পাথরের ব্যবহার ছিল বেশি। এর সাথে সম্রাট বহুমূল্য শ্বেত মর্মর পাথরের ব্যবহার শুরু করেন। কোনো কোনো শিল্প সমালোচকের মতে এই ধারা ভারতীয় প্রচলিত প্রথা থেকে সরে আসা হলেও সৌন্দর্যের বিচারে তা ছিল তুলনাহীন।

আগ্রার দুর্গ; source: indiatours.net

ইতিহাসবিদ ব্লেয়ার ও ব্লুমের মতে, ১৬২৭ সালে সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসন গ্রহণের পর আগ্রা দুর্গ নতুন করে সংস্কার করা হয় এবং একে তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা হয়। এগুলো হলো অতিথি ও সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য দিউয়ান-ই-আম, সম্পদ গচ্ছিত রাখার জন্য ও একান্ত ব্যক্তিগত অতিথিদের জন্য মাচ্ছি ভবন এবং আঙুরি বাগ নামে একটি আবাসিক এলাকা। প্রথম অংশ দিউয়ান-ই-আম হলো প্রবেশপথের সাথে লাগোয়া অংশ। সম্রাট শাহজাহান মর্মর পাথরের ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব দিলেও, বেলে পাথর ব্যবহার পুরোপুরি বাদ দেননি। দিউয়ান-ই-আম নির্মিত হয়েছিল লাল বেলে পাথরে। দিউয়ান-ই-আমের পেছনেই রয়েছে অনন্য শিল্পশৈলীসম্পন্ন দিউয়ান-ই-খাস। তবে শিল্পশৈলীর বিচারে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক ছিল ‘মতি মসজিদ’। আগ্রা দুর্গের ভেতরেই এই মতি মসজিদ নির্মিত হয় লাল বেলে পাথরের উপর স্বচ্ছ সাদা মর্মর পাথরের আস্তরণ দিয়ে। শিল্প সমালোচক ফার্গুসন এই মসজিদের অনন্য উৎকর্ষতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ২৩৪ ফুট লম্বা ও ১৮৭ ফুট চওড়া এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৪৮ সালে ও শেষ হয় ১৬৬২ সালে। জানা যায়, মতি মসজিদ নির্মাণে সে যুগে খরচ হয়েছিল ত্রিশ লক্ষ টাকা।

শালিমার উদ্যান, লাহোর; source: sfari.com

উল্লিখিত স্থাপত্য ছাড়াও শাহজাহানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত লাহোর দুর্গের শীষ মহল, মুসাম্মান বার্জ, হীরা মহল, মতি মহল, রঙ্গ মহল, নওলাখ পটমন্ডপ, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিক্ষেত্র ও লাহোরের শালিমার উদ্যান উল্লেখযোগ্য।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিক্ষেত্র : trekearth.com

১৬৩৮ সালে শাহজাহান দিল্লীর অদূরে শাহজাহানাবাদ নামে এক নতুন নগরীর পত্তন করেন এবং রাজধানী আগ্রা থেকে সরিয়ে এখানে স্থাপন করেন। এই বিশাল প্রকল্পের নকশাকার ছিলেন আহমেদ লহরী, হামিদ গায়রত খান ও মাকরামত খান। এরা প্রত্যেকেই তাজমহল নির্মাণ প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রাচীর দ্বারা সুবেষ্টিত এই নগরীতে ছিল প্রশস্ত রাস্তাঘাট, পানির নহর, মসজিদ, বাজার, বাগ-বাগিচা, অভিজাতদের বাসস্থান, হারেম ও ‘লাল কেল্লা’ নামক সুরক্ষিত এক দুর্গ।

ঐতিহাসিক লাল কেল্লা : pinterest.com

আয়তনে এই লাল কেল্লা ছিল আগ্রার দুর্গের দ্বিগুণ। এখানেও লাল বেলে পাথরের উপরে সাদা মর্মরের আস্তরণের নির্মাণশৈলী লক্ষ্য করা যায়। দুর্গ সহ এই নগরীর নির্মাণ ১৬৩৮ সালে শুরু হয়ে ১৬৮৪ সালে শেষ হয়। শাহজাহান থেকে নিয়ে মুঘল বংশের শেষ ধারা পর্যন্ত এই শাহজাহানাবাদ মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এটি পরবর্তী সম্রাটদেরও প্রধান বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ঐতিহাসিকদের মতে শুধু সম্রাটদের বাসস্থান হিসেবেই নয়, এই ইতিহাস বিখ্যাত লাল কেল্লা সৈন্য সংরক্ষণশালা, অস্ত্রাগার, শাহী করশালা ও বিভিন্ন বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন স্থানসহ আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হতো।

লাল কেল্লার অভ্যন্তরের একটি অংশ; source: whc.unesco.org

শাহজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধির উপর নির্মিত জগদ্বিখ্যাত ‘তাজমহল’। ১৬৩১ সালের জুন মাসে দাক্ষিণাত্যের বুরহানপুরে সম্রাটের ১৪তম সন্তানকে প্রসবকালে মমতাজ মৃত্যুবরণ করেন। আগ্রায় যমুনার তীরে সম্রাজ্ঞীকে সমাহিত করা হয়। এই সমাধির উপরে শাহজাহান নির্মাণ করেন তার স্বপ্নের সৌধ তাজমহল। ২০ হাজার দক্ষ কারিগর দীর্ঘ ২২ বছর নিরলস পরিশ্রম করে ১৬৫৩ সালে তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তাজমহলের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সম্রাট নিজে। মূল পরিকল্পনা করেছিলেন শিল্পী ইসফানদিয়ার রুমী এবং প্রধান স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ ঈসা সিরাজী। বলা হয় তরুণ বাঙালি শিল্পী বলদেও দাস ছিলেন তাজমহলের অন্যতম রূপকার। বাগদাদের এক তরুণ শিল্পী মর্মর পাথরের গায়ে অপূর্ব দক্ষতায় আরবী অক্ষরে কুরআনের আয়াত ফুটিয়ে তোলেন। অতি মূল্যবান স্ফটিক, নীলকান্তমণি, ফিরোজা ও জামীরা পাথরের ব্যবহার রয়েছে এখানে। তাজমহলের কারিগরদের বেশিরভাগই এসেছিলেন কনৌজ থেকে। এছাড়া বাইরে থেকেও কারিগরদের আনা হয়। বলা হয়ে থাকে, তাজমহলে নির্মাণে সে যুগের হিসাবে ১৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।

শ্বেত মর্মরের স্বপ্ন তাজমহল; source: naturetrekth.com

তাজমহলের কেন্দ্রীয় গম্বুজটি ২৪০ ফুট উঁচু। এটি চারপাশে চারটি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ ও চারকোণায় চারটি সরু মিনার দ্বারা পরিবেষ্টিত। এর প্রধান ফটকটি লাল বেলেপাথরে নির্মিত। সংলগ্ন বর্গাকার বাগানটি লম্বা লম্বা জলের নহর দিয়ে বিভক্ত। সমাধিক্ষেত্রের ভেতর মূল্যবান পাথর খচিত ও মার্বেল পাথরে তৈরি একটি অষ্টকোণা কুঠুরী রয়েছে। এখানে সম্রাজ্ঞী মমতাজের একটি প্রতীকি কবর রয়েছে। সম্রাজ্ঞীর দেহাবশেষ রক্ষিত শিলালিপি সমন্বিত মূল শবাধার নিচে বাগানের সমতলে অবস্থিত।

চাঁদের আলোয় রহস্যময়ী তাজমহল; source: askideas.com

সম্রাট শাহজাহানের আরেকটি অনুপম শিল্পকীর্তি পৃথিবীবিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন। শিল্পী বেবাদল খান ৭ বছর (১৬২৮-১৬৩৫) পরিশ্রম করে এই সিংহাসন তৈরির কাজ শেষ করেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ট্যাভার্নিয়ে নামে এক ফরাসী ব্যবসায়ীর ময়ূর সিংহাসন দেখার সুযোগ হয়েছিল। এটি সে সময় দিল্লীর লাল কেল্লায় স্থাপিত ছিল। ট্যাভার্নিয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, দৈর্ঘ্যে ৯ ফুট, প্রস্থে ৬ ফুট ও উচ্চতায় ১৫ ফুট এই সিংহাসন ভিত্তিস্থান হতে চারটি খিলান দ্বারা দাঁড় করানো ছিল। এই চারটি খিলানের উপর ছিল বারটি স্তম্ভ, যা তিনদিক দিয়ে উপরের কারুকার্যমন্ডিত চাঁদোয়া ধরে রাখতো। চাঁদোয়ার অভ্যন্তরভাগ হীরা ও মণিমুক্তা খচিত ছিল। চাঁদোয়ার উপরিভাগে ছিল একটি চতুর্ভুজাকার গম্বুজ। এখানে ছিল একটি লেজ উঁচু করা ময়ূরের প্রতিকৃতি। এর লেজটি ছিল নীলকান্তমণি ও অন্যান্য নানা রঙের পাথরে নির্মিত। ময়ূরটির বুকের মাঝখানে একটি বিশাল রুবি পাথর বসানো ছিল। ময়ূরের উভয় পাশে এর সমান উচ্চতাবিশিষ্ট দু’টি সোনার কাজ করা ফুলের তোড়া ছিল। আরেক ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ারের মতে, এতে এক জোড়া ময়ূরের পেরিকৃতি ছিল। সিংহাসনটিতে ওঠার জন্য চার ধাপবিশিষ্ট একটি সিঁড়ি ছিল। এই সিঁড়িতেও অনেক মূল্যবান মণিমুক্তা বসানো ছিল। রাজকীয় রত্নাগারের প্রধান খান জামান সম্রাটের আদেশে ৮৬ লক্ষ টাকার মণিমুক্তা রত্নাগার থেকে দিয়েছিলেন এই সিংহাসন নির্মাণ করার জন্য। সিংহাসনের যে হাতলে সম্রাটের বাহু থাকতো শুধু তাতেই দশ লক্ষ টাকার মণিমুক্তা বসানো ছিল। ময়ূরের বুকে বসানো এক লক্ষ টাকা মূল্যমানের বিশেষ রুবি পাথরটি পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাস সম্রাট জাহাঙ্গীরকে উপহার দিয়েছিলেন। পুরো ময়ূর সিংহাসনে ব্যবহৃত মণিমাণিক্যের হিসেব করে এক ফরাসী রত্নকার এর এর মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন ১১ কোটি টাকা।

শিল্পীর চোখে ময়ূর সিংহাসন; source: it.pinterest.com

১৭৩৯ সালে পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ দিল্লী লুন্ঠনকালে এই অনন্য ময়ূর সিংহাসন পারস্যে নিয়ে যান। তিনি কুর্দি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হবার পরে এই সিংহাসন আগা মুহাম্মদ শাহ ভাঙাচোরা অবস্থায় উদ্ধার করেন। সাধারণ বিদ্রোহী কর্তৃক এই সিংহাসন তছনছ ও এর বেশিরভাগ সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছিল। আগা মুহাম্মদ শাহ একে কোনোরকমে মেরামত করে বর্তমান রূপ দান করেন। বর্তমানে এটি ইরানের তেহরান জাদুঘরে রয়েছে।

অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের মতোই ভালো-খারাপের সংমিশ্রণ ছিলেন শাহজাহান। তবে তার পরিচয় বেশি ফুটে ওঠে তার অসাধারণ সব স্থাপনাকর্মের মধ্যে দিয়ে। স্থাপনাশিল্পে অনন্য অবদানের জন্য শুধু মুঘল বংশে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে, তথা পৃথিবোজোড়া চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সম্রাট শাহজাহান। যতদিন তার স্থাপনা থাকবে, ততদিন নিশ্চিতভাবে তিনিও থাকবেন মানুষের বিস্ময়মাখা অনুভূতিতে।

তথ্যসূত্র:  ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস- মধ্যযুগঃ মোগল পর্ব – এ কে এম শাহনাওয়াজ (pub-2015, Page 158-160)

ফিচার ইমেজ- tryvel.pt

Related Articles