Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টিপু সুলতান ও তার অনন্য রকেট ক্ষেপণাস্ত্র

১৯৬৩ সালের দিকে ভারতীয় প্রখ্যাত রকেট বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন NASA’র ‘ওয়ালপস ফ্লাইট ফ্যাসিলিটিতে’। রিসেপশন লবিতে হাঁটার সময় একদিন তার চোখ আঁটকে গেল একটি চিত্রকর্মে। ছবিটি ছিল একটি যুদ্ধক্ষেত্রের, তাতে দেখা যাচ্ছে পেছন দিকে কয়েকটি রকেট ধেয়ে আসছে আর সামনে রকেট হামলায় বিধ্বস্ত একটি সৈন্যবাহিনীর ছবি।

একটি রকেট ফ্লাইট কেন্দ্রে এমন পেইন্টিং থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আব্দুল কালাম অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, রকেট নিক্ষেপকারী সৈন্যদের ঠিক ইউরোপিয়ান বা শ্বেতাঙ্গ মনে হচ্ছেনা। বরং তাদের মুখাবয়বে মিল আছে উপমহাদেশের লোকদের সাথেই। কৌতূহল চাপতে না পেরে পেইন্টিংটির কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।

এটি ছিল মহীশুরের বীর টিপু সুলতানের বাহিনীর সাথে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধের ছবি। মহীশুরের সেনাবাহিনীর বিধ্বংসী সব রকেট ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় নাকাল ব্রিটিশ সৈন্যদের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল সেখানে। আবদুল কালাম একই সাথে বেদনা ও গর্বের অনুভূতি বোধ করলেন।

মহীশুর সেনাবাহিনীর হামলায় নাকাল বৃটিশ সৈন্যদল; Image Source: Daily Star

রকেট প্রযুক্তিতে টিপু সুলতানের সেই অবিস্মরণীয় অবদানের কথা আজ তার নিজ দেশ ভারতবর্ষ বিস্মৃত হয়ে গেছে। কিন্তু তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাত ভোলেনি বিশ্বের অপর প্রান্তের প্রতিষ্ঠানটি। বস্তুত টিপু সুলতানকে আধুনিক রকেটের স্থপতি বলা যায়। সেসময়ের পৃথিবীতে রকেট ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ইউরোপে নয়, ছিল আমাদের ভারতবর্ষে, দক্ষিণ ভারতের মহীশুরে। আমাদের আজকের লেখাটি টিপু সুলতান বাহিনীর এ অসাধারণ রকেট ক্ষেপণাস্ত্র নিয়েই।

গানপাউডার ব্যবহার করে রকেট ওড়ানোর প্রযুক্তি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করে চাইনিজরা। বলা হয়ে থাকে অমরত্বের সন্ধানে “জীবনের পরশমণি” খুঁজতে গিয়েই তারা আবিষ্কার করে ফেলেন গানপাউডার। তারা তখন বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে এ গানপাউডার ব্যবহার করতেন। একটি বাঁশের খোলসে গানপাউডার ভর্তি করে সেটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে উৎসবের জৌলুশ বাড়ানো হতো।

ধারণা করা হয় এমনি কোনো উৎসবে দুর্ঘটনাবশত আবিষ্কৃত হয়ে যায় রকেট। কোনো গানপাউডার ভর্তি টিউব একেবারে বিস্ফোরিত না হয়ে বেরিয়ে আসে অগ্নিকুণ্ড থেকে। এরপর গানপাউডার থেকে উৎপন্ন গ্যাস এবং স্ফুলিঙ্গ দ্বারা চালিত হয়ে ছিটকে যায় আকাশে। এ ঘটনার পর চাইনিজরা এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা শুরু করে এবং গানপাউডার চালিত রকেট আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোলীয়দের সাথে যুদ্ধে সর্বপ্রথম চাইনিজরা রকেট ব্যবহার করে। এর বিধ্বংসী ক্ষমতা তখন তত বেশী না হলেও এই নতুন প্রযুক্তি মঙ্গোলীয়দের মানসিকভাবে অনেক দুর্বল করে দেয়। এর পরে মঙ্গোলীয়রা নিজেদের রকেট প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আর তাদের হাত ধরেই রকেট ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে।

মহীশুরে রকেটের আগমন কীভাবে হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে হায়দার আলী এবং পরবর্তীতে তার পুত্র টিপু সুলতানের হাত ধরে রকেট প্রযুক্তি এক অন্য মাত্রা পেয়েছিল। হায়দার আলীর সময় থেকেই মহীশুরের সেনাবাহিনীতে প্রায় বারোশজন রকেট-সৈনিক থাকত। ১৭৮০ সালের পল্লীলুরের যুদ্ধে হায়দার আলীর সেনাবাহিনীর কাছে ব্রিটিশদের শোচনীয় পরাজয়ের পেছনেও ছিল রকেটের অবদান। এ যুদ্ধে রকেট হামলার ফলে ইংরেজদের অস্ত্র গুদামে আগুন ধরে যায়। আর এটিই ডেকে আনে তাদের পরাজয়।

টিপু সুলতান; Image Source: christies.net

টিপু সুলতানের আমলে মহীশুরকে মুখোমুখি হতে হয় আরো শক্তিশালী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে। প্রজ্ঞাবান টিপু বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের সাথে টিকে থাকতে নতুন কিছু উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। এ তাড়না থেকেই রকেট উন্নয়ন নিয়ে তাদের গবেষণায় জোর দেন তিনি। মহীশুরে রকেট প্রযুক্তিতে সবচেয়ে বড় যেই পরিবর্তনটি আনা হয় তা হলো রকেটের জ্বালানী কক্ষ হিসেবে লোহার তৈরি বাক্স ব্যবহার। আগে এর জন্য বাঁশ  বা অন্যান্য দুর্বল পদার্থের কাঠামো ব্যবহার হতো।

এ বিষয়টিই মূলত মহীশুরীয়ান রকেটকে ইউরোপের রকেট থেকে আলাদা করে তোলে। ধাতব কাঠামোর জন্য রকেটের জ্বালানী অর্থাৎ ব্ল্যাক পাউডারের বিস্ফোরণ অধিকতর প্রকট হতো। এর ফলে সৃষ্টি হতো অধিক গতিবেগ, রকেট পাড়ি দিতে পারতো আরো বেশী পাল্লার দূরত্ব (সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটার পর্যন্ত)। সে সময়ের ইউরোপের রকেটগুলোর দূরত্বের পাল্লা বা গতিবেগ এর কাছাকাছিও ছিল না।

এছাড়াও টিপু সুলতান রকেটের সাথে তরবারি সংযুক্ত করে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের ধারণা দেন। রকেট এটি নির্দিষ্ট দূরত্ব উড়ে শত্রুর কাছাকাছি যাওয়ার পর যেন ঠিকভাবে ঘুরে গিয়ে তরবারির অগ্রভাগ দিয়েই আঘাত হানতে পারে। তবে মহীশুরের রকেটে আঘাতের জন্যে সাধারণত চার ফুট লম্বা বাঁশের ফলা ব্যবহার করা হতো। এটি খাঁজের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতো লোহার তৈরি জ্বালানি প্রকোষ্ঠের সাথে।

এ জ্বালানি কক্ষ হিসেবে সাধারণত আট ইঞ্চি লম্বা এবং দেড় থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের লোহার টিউব ব্যবহার করা হতো। এ টিউবের ব্যাস ও লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব হিসেব করে একটি নির্দিষ্ট কৌণিক দিকে রকেট নিক্ষেপ করতে হতো। এজন্য রকেট সৈনিকরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতেন। এছাড়াও ছিল বিশেষভাবে নির্মিত রকেট লঞ্চার, যার থেকে একসাথে পাঁচ থেকে দশটি রকেট নিক্ষেপ করা যেত।

শিল্পীর তুলিতে মহীশুরের রকেট; Image Source: cloudfront.net

ব্রিটিশ-মহীশুর যুদ্ধে টিপু সুলতানের রকেট বাহিনী ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল। আকাশে নীলাভ আলোর ছটা দেখলেই ব্রিটিশরা বুঝতে পারত আসছে রকেটের ঝাঁক। আচমকা এগুলো আঘাত হানত ব্রিটিশদের ডেরায়, কখনো সামনে থেকে কখনো পেছন থেকে। রকেট এর সাথে সংযুক্ত বাঁশের ফলা ক্ষত বিক্ষত করে যেতো ব্রিটিশ সৈন্যদের। রকেটের আঘাতে মৃত্যুও ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

তৃতীয় অ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে রকেট হামলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার একটি ছিল কর্নেল নক্স এর উপর হামলা। ১৭৯২ সালের ছয় ফেব্রুয়ারি কর্নেল নক্স তার দলবল নিয়ে উত্তর থেকে কাবেরী নদীর দিকে এগোচ্ছিলেন। সেরিঙ্গাপটমের কাছে এসে তিনি রকেট হামলার শিকার হন।

সেসময় টিপু সুলতানের রকেট-সৈনিকদের ১২০ জন এবং ১৩১ জন সদস্য সম্বলিত দুটি দল ছিল মাত্র। কিন্তু এ যুদ্ধের সময়ই রকেট সৈনিকদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৫,০০০ জনে। সেসময় দুধরনের রকেট ছিল, কিছু রকেট শূন্যেই বিস্ফোরিত হতো। আর কিছু ছিল গ্রাউন্ড রকেট, যেগুলো একবার মাটিতে আঘাত করে আবার উপরে উঠে যেতো এভাবে সর্পিলাকার গতিতে এগোতে থাকত যতক্ষণ না এর শক্তি নিঃশেষ হয়।

এ যুদ্ধের পরবর্তীতে টিপু সুলতান তার অসামান্য রণকুশলতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্তটি স্থাপন করেছিলেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। তার সমর্থনে ফ্রান্সের রিপাবলিকান অফিসাররা মিলে গঠন করেন জ্যাকোবিয়ান ক্লাব, মহীশুর। জানা যায় জ্যাকোবিয়ান ক্লাব যখন টিপু সুলতানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলো সেসময় গান স্যালুটের অংশ হিসেবে ওড়ানো হয় পাঁচশ রকেট। এ থেকে বোঝা যায় উৎসব উপলক্ষে রকেট ওড়ানোর প্রচলন ছিল মহীশুরেও।

মহীশুর-ফ্রান্সের মৈত্রী; Image Source: readoo.in

তবে চতুর্থ অ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে এ সকল রকেট তার চূড়ান্ত বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে। এসময়ে ব্রিটিশ কর্নেল ওয়েলসলীও একবার রকেট হামলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওয়েলসলী পরবর্তীতে ওয়াটারলু যুদ্ধের নায়ক ও লর্ড অফ ওয়েলিংটন হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সেসময় সুলতানাপুত গ্রামের কাছে একটি উঁচু টিলা ছিল যার আড়াল নিয়ে রকেট-সৈনিকরা তাদের হামলা চালাত। তাদের শায়েস্তা করার জন্য কর্নেল ওয়েলসলীকে নিযুক্ত করা হয়।

১৭৯৯ সালের ৫ই এপ্রিল রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনী নিয়ে টিলার দিকে এগোতে শুরু করেন কর্নেল ওয়েলসলী। আচমকা রাতের আঁধারের বুক চিরে আকাশে দেখা দেয় নীলাভ আলো, চারদিক থেকে গর্জে উঠে মহীশুর বাহিনীর রকেট লঞ্চার ও বন্দুক। শক্ত প্রতিরোধের সামনে টিকতে পারেনি ব্রিটিশ সৈন্যদল। বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় তারা, অনেকে সৈন্য হতাহত হয় এবং গ্রেফতারও হয় অনেকে। কর্নেল ওয়েলসলী বাধ্য হন পিছু হটতে। এ ঘটনা ওয়েলসলীর উপর অনেক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তী জীবনেও তিনি সেরিঙ্গাপটমের এ ঘটনার উল্লেখ করতেন বারবার।

অ্যাংলো-মহীশুর গোটা যুদ্ধেই টিপুর রকেট বাহিনী জন্ম দিয়েছে এমন আরো অনেক বীরত্বগাঁথার। কিন্তু ভাগ্য সাথে না থাকায় এবং প্রতিবেশী রাজ্যের অসহযোগিতায় হারতে হয় সুলতানকে। ১৭৯৯ সালে তুরুখানাল্লির যুদ্ধে নিহত হন টিপু সুলতান। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি লড়ে গেছেন সত্যিকারের বীরের মতো। আত্মসমর্পণ না করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদি মৃত্যুকেই। সার্থক করেছেন তার সেই বিখ্যাত উক্তিকে

“শিয়ালের মতো শত বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের ন্যায় একদিনের জীবন উত্তম”

Image Source: Quotefancy

এ যুদ্ধে মহীশুরের হারের পর ব্রিটিশরা হাতে পেয়ে যায় প্রায় ৭০০ রকেট এবং ৯০০ রকেটের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ। টিপুর এ রকেট নিয়ে ইংরেজদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না। এ রকেটগুলোকে উইলিয়াম কনগ্রেভ ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাধ্যমে এর কৌশল আয়ত্ত করে তারা। পরবর্তীতে আরো গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করেন কনগ্রেভ রকেট। যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের আধুনিকতম রকেট এবং কৃত্রিম উপগ্রহ নিক্ষেপণ ব্যবস্থা।

আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! টিপু সুলতানের কৌশল আয়ত্ত করে তৈরি করা এসব রকেট সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিল তার ফরাসি মিত্র নেপোলিয়নের বিরুদ্ধেই। তবে সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় এখানে যে, ভারতবর্ষের উন্নত রকেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইউরোপ সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের, অথচ খোদ ভারতেই এর অন্তত দেড়শ বছর পর পর্যন্ত রকেট-বিদ্যা আর আলোর মুখ দেখেনি।

This article is in Bangla language. It's about rockets of Indian warrior king tipu sultan.

References:

1. grc.nasa.gov/www/k-12/TRC/Rockets/history_of_rockets.html

2.  Wings of Fire: An Autobiographyby A.P.J. Abdul Kalam, Arun Tiwari (Contributor)

3. https://www.theguardian.com/world/2018/jul/27/indian-warrior-king-tipu-sultan-rocket-cache-unearthed-in-abandoned-well

For more references check hyperlinks inside the article.

Featured Image: picoku.net

Related Articles