Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হিটলারের জন্য অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছিলো যে নারীরা

গত শতকের ত্রিশের দশকের ঘটনা। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তখন ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া শুরু করেছে। এ সময় দেশে তাদের অগণিত সমর্থকের মাঝে একজন ছিলেন হিল্ডেজার্ড ট্রুট্‌জ। হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর এক অন্ধ সমর্থক ছিলেন তিনি। অন্ধ সমর্থন যে কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে তার নমুনা তুলে ধরতেই আজকের এ লেখা

হিটলায় ইয়ুথের পতাকা; সোর্সঃ Wikimedia Commons

হিটলার ইয়ুথের সদস্যরা; সোর্সঃ Wikimedia Commons

তরুণ-তরুণীদের মাঝে নাৎসি বাহিনীর মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে যে সংগঠনটি কাজ করতো, তার নাম ‘হিটলার ইয়ুথ’। এই হিটলার ইয়ুথেরই নারী শাখার নাম ছিলো Bund Deutscher Mädel (BDM), বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘জার্মান নারীদের সংগঠন’। নাৎসি বাহিনীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৩৩ সালে সংগঠনটিতে যোগ দেন ট্রুট্‌জ। নিয়মিতই এর সাপ্তাহিক মিটিংগুলোতে অংশ নিতেন তিনি, স্বপ্ন দেখতেন নতুন এক জার্মানির। তার ভাষ্যমতে, “হিটলার এবং আরো উন্নত জার্মানির জন্য আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা তরুণ-তরুণীরা জার্মানির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম।”

বিডিএম এর সদস্যারা; সোর্সঃ Wikimedia Commons

অল্প কিছুদিনের ভেতরেই ট্রুট্‌জ তাদের এলাকার বিডিএম-এর এক পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন। জার্মান বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন তার সোনালী চুল এবং আকাশের বিশালতা মাখানো নীল চোখও যেন এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। অনেকেই তাকে নর্ডিক নারীদের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতো। এর পেছনে শারীরিক উচ্চতার পাশাপাশি প্রশস্ত হিপ ও পেলভিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো বলে মনে করেন তিনি।

১৯৩৬ সালের কথা। ট্রুট্‌জ সেই বছর আঠারোতে পা রাখলেন। মনে তার হাজারো রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। একই বছর তার স্কুল জীবনও শেষ হলো। এরপর তিনি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করবেন। তার মনের প্রজাপতিগুলো যেন ঠিক ফুলের সন্ধান করে উঠতে পারছিলো না। এমন বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে তাই তিনি ছুটে গেলেন বিডিএম-এর এক নেতার কাছে, জানালেন তার মনের বিস্তারিত খবরাখবর। সেই নেতা সেদিন তাকে এমন কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন যা ট্রুট্‌জের সারা জীবনের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো। তিনি তাকে সেসব পরামর্শ না দিলে সম্ভবত আজকে ট্রুট্‌জকে নিয়ে আমিও লিখতে বসতাম না!

তিনি তাকে বললেন, “তুমি যদি ঠিক করতে না-ই পার যে এখন কী করবে, তাহলে ফুয়েরারকে (অ্যাডলফ হিটলার) একটা বাচ্চা দিচ্ছ না কেন? এখন জার্মানির জন্য অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে দরকার হলো জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ শিশু।”

নেতার কাছ থেকে এই কথা শোনার পরই ট্রুট্‌জ প্রথমবারের মতো নাৎসি বাহিনীর ‘লেবেন্সবর্ন’ প্রোগ্রামের কথা জানতে পারেন। ‘বিশুদ্ধ’ জার্মানদের নিজেদের মাঝে মিলনের মাধ্যমে সোনালী রঙের চুল ও নীল চোখ সম্পন্ন ‘আর্য’ শিশুদের জন্মহার বাড়ানোই ছিলো সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এ প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য। এজন্য বাছাইকৃত ‘বিশুদ্ধ’ জার্মান নারীরা শয্যাসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতেন কোনো শ্যুত্‌জস্টাফেল অফিসারকে (যিনি নিজেও তথাকথিত ‘বিশুদ্ধ’)। এরপর সেই নারীর গর্ভে আসা সন্তানকেও তাই ‘বিশুদ্ধ’ বলেই মনে করা হতো। উল্লেখ্য, নাৎসি জার্মানিতে কালো ইউনিফর্ম পরিহিত শ্যুত্‌জস্টাফেল কিংবা সংক্ষেপে ‘এসএস’ ছিলো হিটলার বাহিনীর সবচেয়ে বড় প্যারামিলিটারি সংগঠন।

এসএস বাহিনী; সোর্সঃ Wikimedia Commons

মূল আলাপে ফিরে আসা যাক। সেই বিডিএম নেতা এরপর ট্রুট্‌জকে পুরো প্রক্রিয়া খুলে বললেন। লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রামে সিলেক্ট হতে প্রথমেই তাকে একগাদা মেডিকেল টেস্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সেই সাথে তার জীবনের অতীত ইতিহাস সম্পর্কেও বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানো হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো প্রার্থীর শরীরে কোনোভাবেই ইহুদীদের রক্ত থাকা চলবে না। এতসব অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার গন্ডি পার হতে পারলে তখনই কেবল সেই নারী প্রার্থী একদল এসএস অফিসার থেকে তার পছন্দের শয্যাসঙ্গী বেছে নিতে পারবে।

এতক্ষণ যেন তন্ময় হয়ে নেতার কথা শুনে যাচ্ছিলেন ট্রুট্‌জ। নিজের গর্ভে দশ মাস দশ দিন একটি সন্তানকে ধারণ করে তাকে নাৎসি বাহিনীর জন্য দিয়ে দেয়ার মতো দেশপ্রেম তার মনকে মারাত্মকভাবে আলোড়িত করে তুললো। অ্যাডলফ হিটলারের জন্য, তার নাৎসি বাহিনীর জন্য, সর্বোপরি দেশের জন্য এমন কিছু একটাই তো করতে চাচ্ছিলেন তিনি! তাই আর দেরি করলেন না ট্রুট্‌জ। শীঘ্রই লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রামের টেস্টের জন্য নিজের নামটি রেজিস্ট্রেশন করালেন তিনি। তবে বাসায় বাবা-মাকে কিছুই জানান নি ট্রুট্‌জ, কারণ তারা তার সেই সিদ্ধান্তকে মেনে নেবে না। প্রোগ্রামের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এজন্য তিনি বাসায় জানালেন ন্যাশনাল সোশ্যালিজম নিয়ে পড়াশোনা করতে একটি আবাসিক কোর্সে তিনি ভর্তি হয়েছেন।

এরপর এলো সেই নির্ধারিত দিনটি। ট্রুট্‌জকে নিয়ে যাওয়া হলো জার্মানির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বাভারিয়া প্রদেশের একটি পুরনো দুর্গে। এটি ছিলো টেগের্নসী লেকের কাছাকাছি একটি জায়গা, চমৎকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। সেখানে গিয়ে নিজের মতো আরো চল্লিশ জন নারীকে দেখতে পেলেন ট্রুট্‌জ। সবার উদ্দেশ্যই এক, গর্ভে সন্তান ধারণ করে তাকে নাৎসি বাহিনীতে দিয়ে দেয়া। সেই নারীদের কেউ কারো আসল নাম জানতো না, সবাইকে দেয়া হয়েছিলো ছদ্মনাম। আর সেখানে আসতে কেবল একটি সার্টিফিকেটই লাগতো- ‘জাতিগত বিশুদ্ধতা’। এজন্য একজন নারীর প্রপিতামহ পর্যন্ত বংশ ইতিহাস অনুসন্ধান করা হতো।

লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রামে আসার আগে পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এক তরুণী; সোর্সঃ pinterest.com

দুর্গ পুরনো হলে কী হবে! সেখানে ভোগ-বিলাসের উপকরণের কোনো কমতি ছিলো না। লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রামে নির্বাচিত সেই তরুণীদের জন্য সেখানে খেলাধুলা, লাইব্রেরি, মিউজিক রুম, এমনকি সিনেমা হল পর্যন্ত ছিলো। ট্রুট্‌জের মতে, “সেখানে আমি যে খাবার খেয়েছিলাম, তা আমার জীবনে খাওয়া সেরা খাবার। সেখানে আমাদের কোনো কাজ করতে হতো না, অনেক চাকরবাকরই ছিলো সেখানে।” এভাবে রাজকন্যার মতোই কাটছিলো তাদের দিনগুলো। অপেক্ষা শুধু একজন এসএস রাজপুত্রের!

পুরো প্রোগ্রামটি নিয়ন্ত্রণ করতেন একজন উচ্চপদস্থ এসএস ডাক্তার। মেয়েরা সেখানে আসার পরপরই তিনি তাদেরকে ভালোমতো পরীক্ষা করেছিলেন। তাদেরকে জানাতে হয়েছিলো বংশগতভাবে তারা কোনো রোগ পেয়েছে কিনা, তাদের পরিবারে কেউ মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্ত কিনা এবং পরিবারে কখনো কোনো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিয়েছে কিনা। তিনি তাদেরকে এটা বলেও সতর্ক করে দেন যে, তাদের গর্ভে আসা সন্তানকে কোনোভাবেই নিজের কাছে রাখা যাবে না। কিছুদিন পরই সেই সন্তানকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হবে। তাকে বড় করা হবে আলাদা পরিচর্যা কেন্দ্রে। তাকে নাৎসি পরিবেশে, নাৎসি আদর্শ শিখিয়ে একজন নাৎসি সদস্য হিসেবেই গড়ে তোলা হবে।

এরপর আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অর্থাৎ সঙ্গী বাছাইয়ের বিষয়টি। প্রাথমিক বিষয়াদি জানানোর পর সেই নারীদের সামনে হাজির করা হলো একদল এসএস অফিসারকে। সুঠাম দেহের অধিকারী, লম্বা সেই অফিসাররা সহজেই নারীদের মন কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্পর্ক বিছানা পর্যন্ত গড়ানোর আগে একে অপরকে চিনে নেয়ার ব্যবস্থাও ছিলো। এজন্য তাদেরকে একসাথে খেলাধুলা করা, সিনেমা দেখা, সন্ধ্যায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে একসাথে গল্পগুজব করার মতো বিষয়ের মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছিলো।

শয্যাসঙ্গী বেছে নেয়ার জন্য ট্রুট্‌জদের দেয়া হয়েছিলো সাতদিন সময়। তাদের বিশেষভাবে বলে দেয়া হয়েছিলো যেন তাদের চুল ও চোখের রঙের সাথে শয্যাসঙ্গীর চুল ও চোখের রঙ সর্বোচ্চ পরিমাণে মিলে যায়। বলাবাহুল্য, সেই অফিসারদের কারো নামই তাদেরকে জানানো হয় নি। সবই ছিলো কঠোর গোপনীয়তার অংশ।

একসময় সঙ্গী পছন্দ করা হয়ে গেলে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হয় তাদের। তখন সেই নারীদের আরো কিছু মেডিকেল টেস্টের ভেতর দিয়ে যাওয়া লাগে। এরপরই একদিন জানিয়ে দেয়া হয় সেদিনই তাদেরকে শয্যাসঙ্গীর সাথে রাত কাটাতে হবে। ট্রুট্‌জের ভাষ্যমতে, সেদিন তিনি এতটাই উত্তেজিত ও আনন্দিত ছিলেন যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এতে একদিকে যেমন শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি ছিলো, তেমনি অ্যাডলফ হিটলারের জন্য কিছু করতে পারার গর্বও মিশে ছিলো! তাদের সেই সঙ্গমকে তারা দেশের জন্য, ভালোবাসার ফুয়েরারের জন্যই মনে করেছিলেন। এজন্য তাদের মাঝে কোনো লজ্জাবোধ কিংবা অনুশোচনাও কাজ করে নি। প্রথম সপ্তাহে সেই লোকটি তিন রাতে ট্রুট্‌জের শয্যাসঙ্গী হয়েছিলো। পরের সপ্তাহে তাকে অন্যান্য নারীদের সাথে ডিউটি পালন করতে হয়েছিলো!

মিলনের পর অল্প কিছুদিনের মাঝেই গর্ভধারণ করেন ট্রুট্‌জ। এরপরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা এক মাতৃসেবা কেন্দ্রে। বাচ্চা জন্মানোর আগপর্যন্ত নয়টি মাস তিনি সেখানেই কাটান। এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ট্রুট্‌জ। তবে মাত্র দু’সপ্তাহই জীবনের প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করতে পেরেছিলেন তিনি। এরপরই বাচ্চাটিকে আলাদা আরেকটি এসএস হোমে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাকে পুরোপুরি নাৎসি পরিবেশে বড় করা হবে। এরপর আর কোনোদিনই নিজের গর্ভের সন্তান দেখতে পান নি তিনি, খোঁজ পান নি তার সেই শয্যাসঙ্গীরও।

পরবর্তী বছরগুলোতে আরো সন্তান নেয়ার জন্য বলা হয়েছিলো ট্রুট্‌জকে। কিন্তু ততদিনে তিনি আরেকজন অফিসারের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই আর ওদিকের কথা ভাবেন নি তিনি। একসময় তাদের বিয়েও হয়ে যায়। বিয়ের পরে একদিন আনন্দে গদগদ হয়ে ট্রুট্‌জ তার স্বামীকে লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রামে নিজের সংযুক্তি এবং বাচ্চা জন্মদানের কথাটি জানিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, হিটলারের প্রতি এমন ভালোবাসা ও আনুগত্য দেখে নাৎসি বাহিনীতে চাকরিরত তার স্বামী বোধহয় খুশি হবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো ঠিক তার উল্টোটা! অমন প্রোগ্রামে ট্রুট্‌জের জড়ানোর বিষয়টি একেবারেই স্বাভাবিকভাবে নেন নি তার স্বামী। তবে স্ত্রী কাজটি হিটলারের জন্য করেছে দেখে তিনি তাকে কিছু বলতেও পারছিলেন না!

লেবেন্সবর্ন থেকে জন্ম নেয়া শিশুদের একাংশ; সোর্সঃ vbstudio.net

ট্রুট্‌জের কাহিনীর ইতি টানছি এখানেই। মানুষের মাঝে বর্ণপ্রথার বীজ ছড়িয়ে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রাম থেকে আনুমানিক ২০,০০০ শিশুর জন্ম হয়েছিলো। বারো বছর ধরে চলা এ প্রোগ্রামের অধিকাংশ শিশুর জন্মই হয় জার্মানি আর নরওয়েতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের অনেককেই দত্তক নেয়া হয়েছিলো, ধ্বংস করে ফেলা হয় তাদের যাবতীয় জন্মপরিচয়।

পরবর্তী পর্ব: লেবেন্সবর্ন – শ্রেষ্ঠ মানবজাতির সন্ধানে নাৎসি বাহিনীর গোপন প্রোগ্রাম

ফিচার ইমেজ: historie.stoplusjednicka.cz

Related Articles