Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিজয় দেখা হয়নি শহীদুল্লা কায়সারের

“প্রিয়তমা সুপান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবো না।”

এটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টোপাশে লেখা এক পিতা আর স্বামী শহীদুল্লা কায়সারের চিরকুট। তিনি উর্দ্ধে উঠেছিলেন সবরকম মোহের। তিনি পেরিয়ে গিয়েছিলেন কালের সীমা। তিনি ছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, একজন বুদ্ধিজীবী, একজন গোপন যোদ্ধা। স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রয়োজনে তাই মৃত্যুকে বরণ করতেও সদা প্রস্তুত ছিলেন।

১৯২৭ সালে ফেনীর মজুপুরে মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ আর সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তার পিতা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ আরবি, ফারসি, উর্দু সাহিত্যের পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। নিজের সব ছেলেমেয়েকে তাই শিক্ষিত করে তুলেছিলেন আধুনিক জ্ঞানে। তার মা ছিলেন জমিদারের মেয়ে। কিন্তু মানবহিতৈষী কাজে তার আগ্রহ ছিল উল্লেখযোগ্য। ওই সময়েই নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে তার মা দেশী কাপড় তৈরিতে কাজ করেছেন বেগম রোকেয়ার সাথে। বলা যায়, তাদের পরিবারে রাজনৈতিক সচেতনতার বীজ আগেই বপন করা ছিল।

শহীদুল্লা কায়সার; source: THeStartBio.com

শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। তারপর যথাক্রমে নাফিসা কবীর, মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ্ (জহির রায়হান), জাকারিয়া হাবিব, সুরাইয়া বেগম, সাহানা বেগম, মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ্ এবং মোহাম্মদ সাইফুল্লাহকে নিয়ে মোট আট ভাইবোন।

১৯৪২ সালে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। মেধাবী শহীদুল্লার ভালো লাগত অর্থনীতি। প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পাশের পর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করতে এলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব্যসাচীর মতো একইসাথে চালিয়ে গেছেন রিপন কলেজে আইনের পড়াশোনা। দেশবিভাগের পর তাকে ঢাকায় আসতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ শেষ করতে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।

এই মানুষটি যুক্ত ছিলেন সমসাময়িক রাজনীতির সাথে। সাম্যবাদী রাজনীতি করার সুবাদে জেল খাটতে হয়েছে বহুবার। ১৯৫৬ সালে জেল থেকে বের হয়ে আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ দিয়ে সাংবাদিক জীবন শুরু করলেন। এরপর ১৯৫৮ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ এর সহকারী সম্পাদক হয়ে যোগদান করেন। আমৃত্যু তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’ কে ভালোবেসেছেন। যুদ্ধ চলাকালেও ‘দৈনিক সংবাদ’ এর জন্য হেডলাইন লিখেছেন। স্ত্রী পান্না কায়সার অবাক হয়ে যেতেন। সংবাদের অফিস পাকিস্তানিরা পুড়িয়ে দিয়ে গেছে সেই কবে, এখন কেন তার জন্য হেডলাইন লেখা? শহীদুল্লা কায়সার হেসে বলতেন, “কী যে বল না! আমাদের দেশ স্বাধীন হবে না? তখন তো আবার আমার সংবাদ চালু হবে! জাগো, বাঙালি জাগো!

১৯৫৮ সালেই আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করার সাত দিনের মাথায় আবারো গ্রেফতার হন শহীদুল্লা কায়সার। ১৯৬২ সালে ছাড়া পেয়েই ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদান করেন। সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় অন্যান্য লেখার পাশাপাশি ‘বিশ্বকর্মা’ ও ‘দেশপ্রেমিক’ ছদ্মনামেও লিখেছেন বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক দুর্দশার কথা, মানুষের হতাশার কথা। ছদ্মনামের এসব লেখা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মানুষের মাঝে।

১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কারাগারে থাকা তার জন্য একপ্রকার শাপে-বর হয়েছিল। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন ‘সারেং বউ’। কালজয়ী এই উপন্যাস দিয়েই বাঙালির কাছে তিনি পরিচিত হয়েছেন। বইটি তাকে এনে দিয়েছিল ‘আদমজী পুরষ্কার’। এ কারণেই হয়ত শহীদুল্লা কায়সার বলেছিলেন, “আইয়ুব খান যদি আমাকে জেলে না পাঠাতেন, আমি হয়তো সাহিত্যিক হতাম না!

পান্না কায়সারের সাথে; source: Channel i Online

শহীদুল্লা কায়সার মূলত একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। নিষিদ্ধ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পরিচয়েই পরিচিত ছিলেন তিনি। আমৃত্যু কমিউনিস্ট হয়েই থেকেছেন। যার ফলাফল ছিল দফায় দফায় জীবনের মোট আটটি বছর জেলে কাটানো। কমিউনিস্ট পার্টি করলেও তার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদুল্লা কায়সার বিয়ে করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য জোহরা বেগমকে। কিন্তু জেলে যাওয়ার পর স্বামীর মুক্তি অনিশ্চিত জেনে জোহরা কলকাতায় ফিরে যান ও আইনিভাবে দুজনের তালাক সম্পন্ন হয়। এই ঘটনার পর মুষড়ে পড়েছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। এরপর মা সুফিয়া খাতুন বার বার বিয়ে করতে অনুরোধ করলেও ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যেতেন তিনি। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পান্না কায়সারকে বিয়ে করলেন। পান্না ততদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক, স্নাতকোত্তর পাস করে ফেলেছেন। তাদের দুজনের সংসারে জন্ম নেন অমিতাভ কায়সার ও শমী কায়সার।

জেলে বসেই তার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। ছোটগল্প, রম্য, কবিতা, চিঠিপত্র অনেক কিছুই লিখেছেন। ‘সারেং বউ’ আর ‘সংশপ্তক’ তো আছেই। জীবনের শেষ উপন্যাস ‘কবে পোহাবে বিভাবরী’ তার যুদ্ধ চলাকালে লেখা। সারা দেশ যখন যুদ্ধে উত্তাল, তখনও তিনি ঘরে বসে ‘দৈনিক সংবাদ’ এর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন উপন্যাস লেখা। প্রতিদিন লেখা শেষ হলে মাটিতে গর্ত করে পাণ্ডুলিপি চাপা দিয়ে রাখতেন। এই উপন্যাসে দেখা যায় যুদ্ধের আসল পরিস্থিতি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি তার এই সৃষ্টিকে শেষ করতে পারেননি। চার খণ্ডে উপন্যাস শেষ করতে চাইলেও ‘কবে পোহাবে বিভাবরী’ টিকে আছে তার দুই খণ্ডের কলেবরেই। তাছাড়া এই দুই খণ্ডও খুব বেশি মানুষের হাতে আসেনি।

কালজয়ী লেখা সারেং বউ; source: তিমির-বিদারী-পাঠাগার

তাহলে দেশে যখন যুদ্ধ চলছে, তখন কি শুধু এই লেখালেখিতেই সময় কাটিয়েছেন শহীদুল্লা কায়সার? উত্তর হলো, একদম তা নয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রচুর মানুষ ভারতে চলে গিয়েছেন। তার মতো কমিউনিস্ট, বিপ্লবী লেখক ও সাংবাদিকের বিপদ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল জেনেও দেশের বাইরে যাননি তিনি। তার কারণে তার পরিবারকে নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। অনেকেই দেশের বাইরে যাওয়ার আগে নিজেদের রেশন কার্ড সুফিয়া কামালের হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। সুফিয়া কামাল সেগুলো দিয়ে রেশন সংগ্রহ করে রাখতেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন শহীদুল্লা কায়সার। তার দুই বাচ্চাই তখন ছোট শিশু। তাদের জন্য দুধ কম কিনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার কিনতেন তিনি। স্ত্রীকে বলতেন, বাচ্চাদের দুধের বদলে চাল বেঁটে খাওয়াতে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাকে বারবার ভারত চলে যেতে বলা হচ্ছিল। রাশিয়ার দূতাবাসও তাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কমরেড মণি সিংহ এক চিঠিতে তাকে লিখে পাঠান যে, এখানে থাকা আর সঙ্গত নয়, এই কথাগুলো তিনি লালকালি দিয়ে দাগ দিয়ে দেন।

শহীদুল্লা কায়সার হয়ত নিজেও বুঝতে পারছিলেন তার বিপদের কথা। সবাইকে নিয়ে পুরান ঢাকার কায়েতটুলির বাড়িতে চলে আসেন তিনি। বারবার তাকে বাড়ি ছাড়তে বলার পর ১৩ ডিসেম্বর বাড়ির লোকের জোরাজুরিতে অল্পকিছু কাপড় নিয়ে বের হলেন। কিন্তু সেদিনই আবার ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরে বলেন, ওখানে সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পরদিন ১৪ ডিসেম্বর সবাইকে নিয়ে সেখানে যাবেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাস হোক কিংবা রাও ফরমান আলীর ষড়যন্ত্র, ১৪ তারিখ কারফিউ উঠল না, আর সবাইকে নিয়ে বেরুনোও হল না তার। সেদিন রাতে চিরকুট ধরিয়ে দিলেন স্ত্রীকে। যেন তিনি বুঝে ফেলেছেন যে, সময় এসে গিয়েছে। শমীকে খাওয়াচ্ছিলেন পান্না। হঠাৎ কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো দরজায়। জহির রায়হান জানতে চাইলেন, “বড়দা, দরজা খুলে দেব?”। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ! মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে, দরজা খুলে দাও”। এটা বলেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকা বের করতে লাগলেন। দরজা খুলে দিতেই প্রবেশ করল একদল মুখে কাপড় বাঁধা মানুষ। এসেই জিজ্ঞাসা করল, “শহীদুল্লা কায়সার কে?” সারাজীবন বিপ্লবী রাজনীতি করা, জেল খাটা তুখোড় এই সাংবাদিক সামনে বিপদ দেখেও দমে যাননি। এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তিনিই শহীদুল্লা কায়সার। বাড়ির সবার বাধা উপেক্ষা করে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। যাওয়ার সময় একটু হেসে স্ত্রীকে বলেছিলেন, “ভালো থেকো।”

১৫ ডিসেম্বর থেকে সারা ঢাকাতে শুরু হয়ে গেল বিজয়ের গান। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য দেখতে যাচ্ছে তখন। স্বস্তি পেলেন পান্না কায়সার। দেবর জহির রায়হান কথা দিলেন, পরের দিন সকালেই বড়দাকে খুঁজতে বের হবেন। ছোট্ট শমীকে কোলে নিয়ে মা তাকে শোনাচ্ছিলেন, তার বাবা ফিরে আসবে।

রায়েরবাজার বধ্যভূমি; source: Dhakatimes24.com

১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের দিন। তাদের খোঁজের পালা পুরান ঢাকা থেকে রায়ের বাজার গিয়ে ঠেকল। লাশের গন্ধে চারদিকে নিঃশ্বাস নেওয়াই দায়। রায়ের বাজার এসে লাশের পর লাশ দেখে পান্নার সারা পৃথিবী ভেঙে পড়ল। মাত্র তিন বছরের বিয়ের মাথায় লাশের স্তূপে লাশ উল্টেপাল্টে পাগলের মতো তিনি খুঁজছিলেন স্বামীকে, তবুও সেদিন তিনি খুঁজে পাননি তাকে। আলোকিত শহীদুল্লা কায়সার চিরতরে হারিয়ে গেছেন অন্ধকারে। এই নিঃস্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র, কিন্তু হাতে হাত রেখে সোনার বাংলা গেয়ে বিজয় দেখা হয়নি পান্না আর শহীদুল্লা কায়সারের।

ফিচার ইমেজ: প্রথম আলো

Related Articles