Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঢাকার যানজট নিরসনে সাইক্লিং

ঢাকা, পৃথিবীর ব্যস্ততম শহরগুলোর মধ্যে একটি। প্রায় এক কোটি আশি লাখ লোকের বসতি এই শহরে। সংখ্যাটি এখানেই থেমে নেই, প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চলাচলের জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ যানবাহনের। আর এই বিপুল পরিমাণ যানবাহন চলাচলের জন্য সমানুপাতিক হারে রাস্তারও প্রয়োজন। যদি তা না থাকে তাহলেই পড়তে হয় যানজটের কবলে, অপচয় হয় মূল্যবান সময়। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শহরে যানবাহন চলাচলের জন্য ২৫-৩০ শতাংশ রাস্তা থাকা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে ঢাকার চিত্র আমাদেরকে হতাশ করে। কেননা ঢাকায় যানবাহন চলাচলের জন্যে রাস্তা রয়েছে মাত্র সাত শতাংশ!

এবার দেখা যাক ঢাকায় কত শতাংশ মানুষ কোন ধরনের যানবাহনের প্রতি বেশি নির্ভরশীল। ২০১২ সালে ঢাকার যানজটের ওপর ‘ঢাকা শহরে যানজটের অর্থনৈতিক প্রভাব এবং এর কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান’ নামে একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। গবেষণা অনুসারে ঢাকার ৪১% জনগণ যাতায়াতের জন্য নির্ভর করেন বাসের ওপর। ৩৮% মানুষ রিকশা, ১১% ট্যাক্সি, ২% মোটর সাইকেল এবং বাকি ৮% ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত গাড়ি।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঢাকার রাস্তায় তাকালে অন্যান্য গাড়ির তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। অবশ্য না পড়েও উপায় নেই। এ বছরের জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী,  দেশে নিবন্ধিত মোট ব্যক্তিগত গাড়ির ৭৮% চলে ঢাকার রাজপথে। মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩০৩টি গাড়ি নিবন্ধিত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ঢাকার রাস্তায় গাড়ি নামছে ১২-১৩টি!

ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের চাপ; source: mutuallyhurtingstalemates.wordpress.com

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের করা এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র সাত কিলোমিটার! সময়ের বিবেচনায় প্রতিদিন যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা এবং এই কর্মঘণ্টার অপচয়ের ফলে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গবেষকরা বলছেন জনসংখ্যা এবং যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সে অনুপাতে রাস্তা না বাড়ানো হয় তাহলে ২০২৫ নাগাদ ঢাকার যানবাহনের গড় গতি হবে ঘণ্টায় মাত্র চার কিলোমিটার। মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষের হাঁটার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার!

হতাশার মাঝে এক চিলতে আশার আলো

সাইকেল বা দ্বি-চক্রযান, প্যাডেল মার্চ করতে করতে দু’চাকার উপর ভর করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ছোট এবং ওজনে হালকা হওয়ায় খুব সহজেই বহন করা যায়। নেই কোনো তেল-গ্যাসের ঝামেলা, তাই সর্বদাই এটি পরিবেশবান্ধব। যেখানে বাস, সিএনজি, মোটর সাইকেল ঢাকার যানজটের সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যায়, সেখানে ঢাকার রাস্তায় খুব নির্ভার ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যায় সাইকেল। খুব অল্প জায়গার মধ্যে দিয়েও খুব সহজে বেরিয়ে যেতে পারে এই বাহন। এ কারণে ঢাকায় স্বল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রশ্নে অন্তত এই মুহূর্তে সাইকেলের বিকল্প কিছুই নেই।

সহজেই পার্ক করা যায় সাইকেল বা দ্বি-চক্রযান; source: bdproducts24.com

ঢাকায় যেখানে যানবাহনের ঘণ্টায় গড় গতি সাত কিলোমিটার, সেখানে সাইকেলের গতি ঘণ্টায় প্রায় ১২-১৫ কিলোমিটার। রাজধানীতে ৫ কিলোমিটারের পথে যেতে যানবাহন খুঁজতেই চলে যায় ৩০ মিনিট আর সাইকেলে ৩০ মিনিটেরও কম সময়ে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছানো নিতান্তই একটি সাধারণ ব্যাপার। সময়ের অপচয় রোধ ছাড়াও সাইকেলের আরও কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন-

  • সাইকেল চালানোর মাধ্যমে প্রত্যেকের শরীরচর্চা হয় যা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়ক। যারা অতি বা অল্প-স্বল্প স্বাস্থ্যবান তাদের জন্য সাইকেল বেশ উপকারী।
  • কম পরিশ্রম হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বিশেষজ্ঞের মতে, সপ্তাহে ১৫০ মিনিট সাইকেল চালালে সে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়।
  • সাইকেল চালনার মাধ্যমে শরীরের মাংসপেশির শক্তিমত্তা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
  • সাইকেল চালানোর মাধ্যমে মানুষ নিজের ক্ষুধাকে আয়ত্তে আনতে পারে। অর্থাৎ অল্প ক্ষুধা কিংবা কম খাবার খেয়েও মানুষ অনেকটা পথ সাইকেলে আরোহণ করে যেতে পারে।
  • অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন চিত্তাকর্ষণের জন্য সাইকেল চালনা একটি অন্যতম মাধ্যম। কেননা গতি মানুষকে উৎফুল্ল করে।

শরীরচর্চায় সাইকেল; source: standard.co.uk

ঢাকায় বসবাসরত জনগণের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয় করে তার খরচ চালিয়ে নেয়া দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। অনেকের জন্যে সেটা আকাশ কুসুম স্বপ্নও বটে। তবে এক্ষেত্রে সাইকেল তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামের সাইকেল বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।

বর্তমানে ঢাকার রাস্তায় মাউন্টেন বাইক অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এসব সাইকেলের দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশি হলেও পূর্বে ব্যবহৃত (সেকেন্ড হ্যান্ড) সাইকেল প্রায় অর্ধেক দামে কেনা যায় একটু খুঁজে দেখলেই। ভালো মানের নতুন একটি সাইকেল কিনতে চাইলে গুণতে হবে ১০-১২ হাজার টাকা। বর্তমানে বাজারে সাইকেলের বেশ কিছু ব্র্যান্ডও চোখে পড়ে যার মধ্যে কোর, নেকরো, ট্রেক, ভেলোস বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিশেষ করে তরুণ ছেলেমেয়েদের মাঝে এসব সাইকেলের ব্যবহার বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়।

রাজধানীর বংশালে সাইকেলের সবচেয়ে বড় বাজার রয়েছে। সেখানেই সাইকেল বেশি পরিমাণে কেনা-বেচা হয়। এছাড়া গুলশান, ধানমণ্ডি, মিরপুরসহ প্রায় সব স্থানেই সাইকেলের শো-রুম রয়েছে। পুরনো সাইকেলের জন্য রয়েছে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেস।

সাইকেলের শো-রুম; source: youtube.com

ঢাকার বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। এসব ধোঁয়া ঢাকার বাতাসে ছড়িয়ে দেয় কার্বন-মনোক্সাইডের মতো বিষাক্ত প্রাণনাশকারী গ্যাস। এদিক থেকে সাইকেল অত্যন্ত নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব একটি বাহন হিসেবে পরিচিত।

সাইকেলের শহর অ্যামস্টারডাম

নেদারল্যান্ডের ছোট্ট শহর অ্যামস্টারডামের জনসংখ্যা মাত্র আট লাখ। তবে এর চাইতেও মজার ব্যাপার শহরে বাই-সাইকেলের পরিমাণ আট লাখ আশি হাজার। সাইকেল আর জনসংখ্যার পরিমাণ দেখে এটা সহজেই অনুমেয় যে, অ্যামস্টারডামের প্রধান বাহনই হচ্ছে সাইকেল। এ কারণে শহরে বর্তমানে বায়ু দূষণ নেই বললেই চলে। যেখানে নিউইয়র্ক চেষ্টা করছে তাদের নাগরিকদের সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহী করে তুলতে, সেখানে অ্যামস্টারডামের প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে এতো বেশি বাই-সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতে!

সাইকেলের শহর অ্যামস্টারডাম; source: nytimes.com

গত দুই দশক ধরে অ্যামস্টারডামে সাইকেলে ভ্রমণ প্রায় ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরের প্রায় ৩২% যাত্রা হয় সাইকেলে যেখানে গাড়িতে যাত্রার সংখ্যা ২২%। এত পরিমাণে বাই-সাইকেল চলার কারণে অনেক সময় অ্যামস্টারডামের রাস্তায় জ্যাম বেঁধে যায়। এ ব্যাপারে শহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, সাইকেলের জায়গায় ওগুলো যদি গাড়ি হতো, তাহলে যানযটের  পরিমাণ সম্পর্কে কল্পনা করাও দুরূহ হয়ে পড়তো।

আজকাল ঢাকার রাস্তায় সাইকেল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তরুণ-বয়স্ক-নারীসহ সকলেই নির্ভর করছেন সাইকেলের ওপর। ভরসা না করবে-ই বা কেন? ১০ কিলোমিটার দূরত্বের গন্তব্যে বাসে যেতে যদি সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা, তাহলে সাইকেলে চেপে যেতে সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট। সাথে নেই বাসের জন্য অপেক্ষা কিংবা সিট পাওয়া না পাওয়ার আশংকা।

কল্পনা করুন তো, ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর জায়গায় চলছে হাজার হাজার সাইকেল। মানুষ দলবদ্ধ হয়ে সাইকেলে করে অফিসে যাচ্ছে আবার কাজ শেষে বাসায় ফিরছে। দৃশ্যটা কেমন হবে দেখতে? মন্দ হবে না নিশ্চয়ই। কেননা তখন ঢাকার রাস্তায় কালো-ধোঁয়ায় তৈরি কৃত্রিম কুয়াশার মেঘ থাকবে না, থাকবে টুং-টাং শব্দের ঝঙ্কারে তৈরি দলীয় কোনো সঙ্গীত। ঢাকাকে তখন আর কেউ যানজটের  শহর বলবে না; বলবে সাইকেলের নগরী, দু’চাকার নগরী ঢাকা!

স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার রাস্তায় সাইক্লিস্টরা; source: youtube.com

ফিচার ইমেজ- gezengenc.com

Related Articles