Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বার্ডিং: শখ যখন পাখি দেখা

প্রাণিকূলের সুন্দর সৃষ্টিগুলোর ভেতর অন্যতম হলো পাখি। পাখি দেখতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু এখনকার দিনে পাখির দেখা মেলাই মুশকিল। এক কাক, শালিক আর চড়ুই বাদে আশেপাশে আর আছেটাই বা কী? এর মধ্যে কাককে তো আবার পাখি বলেই স্বীকার করে না অনেকে। শালিক, চড়ুই না হয় বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে নগর জীবন; কিন্তু বাকীরা? নগরায়ন, উন্নয়ন আর প্রগতির গুঁতোয় সরতে সরতে টিকে থাকা অবশিষ্ট ছিটেফোঁটা জঙ্গলেও ঠাঁই মিলছে না। ফলাফল বিলুপ্তি, শত শত পাখির ঠিকানা এখন বিলুপ্তির খাতায়।

কিন্তু এখনো অনেক পাখিই টিকে রয়েছে, যাদের নামও হয়তো আমরা জানি না। সেগুলোর দেখা পাওয়া কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। আর যদি দেখতে চান, তবে নেমে পড়তে হবে বার্ডিংয়ে! বার্ডিং এখনকার দিনে জনপ্রিয় ‘হবি’ বা শখগুলোর ভেতর অন্যতম। তবে বার্ডিং বলতে সবাই যেন চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে পাখি দেখাকেই শুধু ভেবে না বসেন। বার্ডিং এর চেয়েও অনেক বেশী কিছু, ওয়াইল্ড লাইভ প্রিজারভেশন, অচেনা ও বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের ডকুমেন্টেশনও এর সাথে জড়িত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বার্ডারদের থাকে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা এবং তারা পাখিদের বিলুপ্তি থেকে টিকের থাকার পথে সহযোগীর ন্যায়। বার্ডারদের কল্যাণেই আজ মানুষ পাখি সংরক্ষণে সচেতন হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বার্ডিংয়ে ব্যস্ত একজন শৌখিন বার্ডার; Source: লেখক

বার্ডিং করা বলতে মূলত বোঝায় পাখি দেখা, পাখিদের জীবনাচরণ নিয়ে গবেষণা করা, তা লিপিবদ্ধ করা, পাখিদের ছবি তোলা ইত্যাদি। এটা পেশাদারি আকারেও করা যেতে পারে কিংবা শখের বশেও হতে পারে। যারা এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, তারাই হলো বার্ডার। তবে ‘Bird Watcher’ বলেও একটা টার্ম রয়েছে, যেটা বলতে বোঝায় শুধু মনোরঞ্জন বা অবসর কাটানোর জন্যে যারা পাখি দেখে। তবে এই শ্রেণীকরণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

বার্ডিংয়ের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় এর শুরুটা হয়েছিলো পাখির উপযোগীতার দিক থেকে, মূলত খাদ্য হিসেবেই। এছাড়াও ডিম সংগ্রহ ও পাখি শিকার করে সেটা নিদর্শনের বস্তু হিসেবে তৈরী হতো। এই প্রয়োজনীয়তার কারণে পাখি নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানীরা বার্ডিং করতেন, অর্থাৎ এক্ষেত্রে বার্ডিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল পাখির প্রাপ্তিস্থান, শারীরবৃত্তীয় গঠন গবেষণা করা, যে তথ্য পরে শিকারে ব্যবহৃত হবে। মূলত উনিশ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানী ও সচেতন সমাজ পাখি সংরক্ষণ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ উদ্দেশ্যে ১৮৮৯ সালে রয়েল সোসাইটি ফর দ্য প্রটেকশন অব বার্ড গঠিত হয়। এ ধরনের সচেতনতামূলক কর্মকান্ড পাখি দর্শনের জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এরপর সারা বিশ্বে বার্ডিংয়ের জন্যে অনেক সংঘ গঠিত হয়েছে। আমেরিকাতে রয়েছে আমেরিকান বার্ডিং এসোসিয়েশন। আমাদের দেশেও রয়েছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব।

কী কী নিয়ে মাঠে নামব?

বার্ডিং শুরু করতে পারেন একটি দূরবীন ও গাইডবই নিয়েই; Source: axelfoto

কী রসদ নিয়ে মাঠে নামবেন সেটা অবশ্য নির্ভর করবে আপনি কী কী করতে চান বা আপনার আগ্রহ কতটা তার উপর। যেমন: আপনার যদি অবসরে প্রকৃতির মাঝে দু’দন্ড সময় কাটানোই উদ্দেশ্য হয়, তবে বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। একটি বাইনোকুলার এবং পাখি চেনার একটি ফিল্ড গাইড হলেই যথেষ্ট। ব্যাকপ্যাকে কী কী নেবেন সেটা অবশ্য নির্ভর করবে আপনি কত দূরে এবং কতদিনের জন্য যাচ্ছেন তার উপর। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে নতুন নতুন পাখি দেখাও যে একটি অ্যাডভেঞ্চার সেটা বার্ডিংয়ে না নামলে বুঝবেন না! আর হ্যাঁ, একা না গিয়ে দল বেঁধে গেলে মজাটা জমবে আরো বেশী।

সিলেটের সাতছড়ি অভয়ারণ্যে বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের সদস্যরা; Source: বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব

শুধু পাখি দেখেই মন ভরছে না? ছবি তোলা, পাখির ডাক রেকর্ড করতে চান? সেক্ষেত্রে কিছু উপকরণ নিয়ে নামতে হবে। ডিএসএলআর ক্যামেরা এবং সেই সাথে টেলিফটো লেন্স লাগবে। পাখির খুব নিকটে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় টেলিলেন্স ছাড়া ছবি তোলা মুশকিল। পাখির ডাক রেকর্ড করার জন্যে ডিজিটাল অডিও রেকর্ডার ব্যবহার করতে পারেন, কিংবা স্মার্টফোনের অডিও রেকর্ডারও ব্যবহার করা যায়। বিস্তারিত টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন জানার জন্য ফেসবুকে রয়েছে বার্ডারদের অনেক গ্রুপ। বার্ডারদের তোলা এসব ছবি ও অডিও পাখির জীবনাচরণ নিয়ে গবেষণা, পক্ষিবিদ্যা এবং পাখি সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত হতে পারে। সেদিক থেকে আপনি একজন বার্ডার হিসেবে পাখি সংরক্ষণেই অবদান রাখছেন।

শুরুতে কিছুটা তাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে নামাও জরুরি। যেমন: খুব কমন পাখি কোনগুলো, কোন পাখি কোথায় কোন ধরনের জায়গায় পাওয়া যেতে পারে, কোন ঋতুতে কোন পাখি কোথায় থাকে, কোন পাখিগুলো বিলুপ্তির পথে, কোনগুলো অতিথি পাখি আর কোনগুলোই বা দেশি পাখি ইত্যাদি। এসব জানার জন্য রয়েছে অনেক বই ও বার্ডারদের ব্লগ। এসব তথ্য জেনে মাঠে নামলে পাখির দেখা মিলবে সহজে। বার্ডারদের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় অভ্যাস হলো ‘লাইফ লিষ্ট’ তৈরি করা। এটি এখন পর্যন্ত কী কী পাখি দেখা হলো তার একটি তালিকা। সাথে থাকতে পারে আরো বিস্তারিত; যেমন: স্থান, সময়, বৈজ্ঞানিক নাম ইত্যাদি। লাইফ লিষ্টকে বার্ডাররা শুধু দেখা পাখির তালিকা হিসেবেই দেখেন না, এটা বার্ডিংয়ের সাথে জড়ানো অনেক হাসি-ঠাট্টা আর অ্যাডভেঞ্চারের স্মৃতি। তবে তালিকা নিয়ে বেশি চিন্তা না করাই ভালো, কারণ এতে পাখি দেখার আনন্দে মনোযোগ থাকবে না।

এখনো পর্যন্ত দেখা পাখির তালিকা নিয়ে বানিয়ে ফেলুন Life list; Source: Pinterest, Ken

বার্ডারদের মধ্যে অনেকেই যে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন তা হলো যেসব পাখিগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে সেগুলো খুঁজে বের করে ছবি তোলা। এই কাজের জন্যে প্রায় ঘাঘু গোয়েন্দার মতো লেগে থেকে এসব পাখি খুঁজে বের করতে হয়। এসব ছবি থেকেই পরবর্তীতে বিলুপ্তপ্রায় পাখির তালিকা তৈরী, তথ্যভান্ডার গড়ে ওঠে। পাখির ছবি তোলার সময়ে শুধু স্থির অবস্থায় গাছের ডালে বসে থাকা পাখির ছবি না তুলে, চলমান কোনো ছবি, যেমন- উড়ন্ত অবস্থায় পাখির শিকারের দৃশ্য, বাসা তৈরীর দৃশ্য ইত্যাদি ছবি তোলাও জরুরি। কেননা এ জাতীয় ছবি থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

শীতকালে খেজুররসের হাড়িঁর উপর দুটি Purple Sunbird; Photo courtesy: Sazid Rezwan

বার্ডিংয়ের নীতি-নৈতিকতা

সব কাজেই কিছু নীতিমালা ও নৈতিকতার ব্যাপার থাকে, বার্ডিংয়েও তার ব্যতিক্রম নেই। বার্ডিংয়ে নামার আগে এর নৈতিক বিষয়গুলো জেনে নেয়া দরকার। বার্ডারের মূল উদ্দেশ্য হবে পাখি তথা জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করা। ছবি তোলা, রেকর্ডিং ইত্যাদি করতে গিয়ে পাখির যাতে কোনো ক্ষতি বা অসুবিধা না হয় সেটার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। পাখিরা নিরিবিলি এবং মানুষ অধ্যুষিত নয় এমন জায়গায় থাকে। ছবি তুলতে গিয়ে যদি আপনি পাখির এলাকার ভেতর ঢুকে পড়েন, তবে পাখি ওখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। সেক্ষেত্রে আপনি পাখি সংরক্ষণের বদলে উল্টো ক্ষতির কারণ হলেন!

কোথাও কোনো দুষ্প্রাপ্য পাখির সন্ধান পেলে ঐ স্থানটিকে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে জনপ্রিয় করার আগে এটা ভেবে দেখুন এতে ঐ স্থানটি শৌখিন বার্ডারদের ভিড়ে জনবহুল হয়ে পড়বে কিনা। তেমনটা হলে উপকারের বদলে ক্ষতিই হবে। পাখিকে আকর্ষণ করতে কোনো ধরনের খাবার, ফাঁদ ইত্যাদি কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না।

পাখির সন্ধান করতে গিয়ে কোনো নিষিদ্ধ অঞ্চল, যেমন: সামরিক ঘাঁটি, সরকারি কোনো প্রবেশ নিষিদ্ধ জায়গা, কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ইত্যাদি জায়গায় যেন ঢুকে পড়া না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দলনেতার ভূমিকা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। দলনেতা যদি নিয়মকানুন ও নৈতিকতা রক্ষায় রোলমডেল হতে পারেন, তবে দলের বাকীরাও সেভাবেই চলবে।

বার্ডিংয়ের জন্যে জনপ্রিয় কিছু জায়গা

যেকোনো গাছাগাছালি অধ্যুষিত জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাতেই বার্ডিং করা যায়। এসব জায়গাতেই পাখি বেশি থাকে। ঢাকার আশেপাশে বার্ডিংয়ের দুটি জনপ্রিয় জায়গা হলো বোটানিকাল গার্ডেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তবে পরিযায়ী পাখি সহ অন্যান্য দেশীয় বিরল পাখি দেখতে যেতে পারেন কক্সবাজারের সোনাদিয়া, সুন্দরবন, মৌলভিবাজারের বাইক্কার বিল, রাঙামাটির কাট্টলী বিল, রাজশাহীর পদ্মার চর, সিলেটের সাতছড়ি অভয়ারণ্য, চট্টগ্রামের শেখ রাসেল এভিয়ারী ইত্যাদি জায়গায়।

নাগরিক জীবন থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাল সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে বার্ডিংয়ের মতো দারুণ আর কিছুই হতে পারে না। বন্য পরিবেশও যে আপনার চাপ কমাতে পারে, তা জঙ্গলে না গিয়ে বুঝবেনই না। সুতরাং তল্পিতল্পা গুছিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে নেমে পড়ুন বার্ডিংয়ে!

ফিচার ছবি- লেখক

 

Related Articles