Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: দ্রোহ এবং প্রেমের কবি

“ভালো আছি, ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো”

আকাশের ঠিকানায় কি কেউ সত্যি ভালো থাকে? কত শত খোলা চিঠি অবিরত লিখে যাচ্ছি খোলা আকাশের ঠিকানায়, ইচ্ছে একটাই, চিঠিটা পৌঁছে যাক তার প্রাপকের কাছে। আসলে হয়তো খুঁজছি চিঠিটার একটি ঠিকানা।

“একটা ঠিকানা চাই।
যেই ঠিকানায় সপ্তাহশেষে একটি করে চিঠি দিব…
প্রেম-প্রেম, আবেগে ঠাসা, ভালোবাসায় টইটুম্বুর!
হবে একটা ঠিকানা?
কারণে অকারণে চিঠি দিব”

ভালোবাসার তীব্রতাকে প্রতিবাদের রূপ দিয়ে আশির দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন প্রয়াত কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের দ্রোহ এবং প্রেমের কবি। কবি মহলে ‘প্রতিবাদী রোমান্টিক’ শিরোনামেও পরিচিত এই কবি। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের একজন সফল গীতিকার। তার লেখা গান শুধু বাংলাদেশে নয়, ওপার বাংলাতেও বেশ জনপ্রিয়। কবিতাপ্রেমী ও দ্রোহ অনুরাগীদের কাছে রুদ্রের কবিতা নিঃসঙ্গ রাতের এক অপার স্বস্তি।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কবিতাংশ; Courtesy: অনিরুদ্ধ কিরণ

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর তার পিতার কর্মস্থল বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। কবির স্মরণে মিঠেখালিতে আছে ‘রুদ্র স্মৃতি সংসদ’।

কবি রুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাশ করেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় সক্রিয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে বাউন্ডুলে এ কবির বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন রুদ্র। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশে সবগুলো আন্দোলনে কবি রুদ্র’র সশরীর অংশগ্রহণ ছিল এবং হয়তো এসব থেকেই তিনি বেশ কিছু দ্রোহের কাব্য রচনা করেন।

“আর কী অবাক! ইতিহাসে দেখি সব
লুটেরা দস্যুর জয়গানে ঠাঁসা,
প্রশস্তি, বহিরাগত তস্করের নামে নানা রঙ পতাকা ওড়ায়।
কথা ছিলো, ‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন,
আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।
অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু
অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।
জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি,
আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন “

১৯৮১ সালে বহুল আলোচিত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন রুদ্র। ১৯৮৬ সালে তাদের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে।

কবি রুদ্র ও তসলিমা নাসরিন; Image Source: Bagerhatinfo.com

নব্বইয়ের শেষের দিকে আবারো শুরু হয়েছিল রুদ্র ও তসলিমার প্রেম। কিন্তু সেটা ছিলো তসলিমার দ্বিতীয় বিবাহ থেকে তৃতীয় বিবাহে উত্তরণের মধ্যবর্তী সময়ে। ফলে সেই প্রেমও বেশিদিন টেকেনি।

বিয়ের পরে পারিবারিক অনুষ্ঠানে রুদ্র ও তসলিমা নাসরিন; Image Source: youtube

ব্যক্তিজীবনে চরম মাত্রায় খামখেয়ালী ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন এ কবি। তার বাবাকে লেখা একটি চিঠিতে তার ব্যক্তিত্ব বেশ সুস্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিলো। বিয়ের পরপরই তিনি তার বাবাকে এই চিঠিটি লিখেন

আব্বা,

পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। নাসরিনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকায় ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে করে বৌ বাড়ি নিয়ে যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কখনই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়,স্পষ্টতই তা দুটো বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি,আমি জানি না আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন। এ তো চরম সত্য যে, একটি জেনারেশনের সাথে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার সাথে আপনার আব্বার অমিল ছিলো, আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানদের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসঙ্গত করতে পারি; পারি কিছুটা মসৃণ করতে। সংঘাত রোধ করতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না। তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।

আমার মনে পড়ে না। এই ছাব্বিশ বছরে একদিনও পিতা হিসাবে আপনার সন্তানদের আদর করে কাছে টেনে নেননি। আশেপাশে অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্য আদর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করিনি। ছেলেবেলায় আমার খেলতে ভালো লাগতো। খেললে আমি ভালো খেলোয়াড় হতাম। আপনি খেলতে দিতেন না। ভাবতাম, না খেললেই বোধ হয় ভালো। ভালো মানুষেরা বোধ হয় খেলে না। আবার প্রশ্ন জাগতো, তাহলে আমার খেলতে ভালো লাগে কেনো? আমি কি তবে খারাপ মানুষ? আজ বুঝি, খেলা না খেলার মধ্যে মানুষের ভালো-মন্দ নিহিত নয়। কষ্ট লাগে। আমিও স্বপ্ন দেখতাম, আমি ডাক্তার হবো। আপনার চেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আপনাকে ও নিজেকে গৌরব দেবো। সন্তান বড় হলে পিতারই তো সুখ। আমি সেভাবে তৈরীও হচ্ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কি যে এক বিরাট পরিবর্তন এলো ! একটি দেশ, একটি নতুন দেশের জন্ম হলো, নতুন চিন্তার সব হতে লাগলো। নতুন স্বপ্ন এলো মানুষের মনে। সবাই অন্যরকম ভাবতে শুরু করলো। আমিও আমার আগের স্বপ্নকে ধরে রাখতে পারিনি। তার চেয়ে বড় এক স্বপ্ন, তার চেয়ে তাজা এক স্বপ্ন, তার চেয়ে বেগবান এক স্বপ্নকে আমি কাছে টেনে নিলাম। আমি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। আগেও একটু আধটু লিখতাম, এবার পুরোপুরি। আমি আমার আগের সব চিন্তা-ভাবনার প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে লাগলাম। চিন্তা থেকে, জীবন থেকে, বিশ্বাস-আদর্শ থেকে, অনেক কিছুর সঙ্গেই সংঘর্ষ হতে লাগলো। অনেক কিছুর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির শুরু হলো। কখনো ক্ষোভে আমি অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলতে লাগলাম। আপনার সাথে আমার সাথে বিশ্বাসের সাথে মিল এমন মানুষের দেখা পেলাম। তাদের সাথে সংঘাতও হলো। একি! সবার সাথে সংঘর্ষ হয় কেন? মনে মনে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম। তাহলে কি এ পথ ভুল পথ? আমি কি ভুল পথে চলেছি? কখনো মনে হয়েছে, আমিই ঠিক, এই প্রকৃত পথ। মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে তবে সবচেয়ে সুন্দর হবে। নিজেকে ভালোবাসতে গেলে সে তার পরিবারকে ভালোবাসবে। আর পরিবারকে ভালোবাসা মানেই একটি গ্রামকে ভালোবাসা। একটি গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসবে। আর একটি গ্রাম মানেই তো সারা পৃথিবী। পৃথিবীর সব মানুষ – সব মানুষ সুন্দর হয়ে বাঁচবে। পৃথিবীতে কত বড় বড় কাজ করেছে মানুষ। একটা ছো্‌ট্ট পরিবারকে সুন্দর করা যাবে না? অবশ্যই যাবে। একটু যৌক্তিক হলে, একটু খোলামেলা হলে কত সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। সম্পর্ক সহজ হলে কাজ সহজ হয়। আমরা চাইলেই তা করতে পারি। জানিনা এ চিঠিখানায় আপনি ভুল বুঝবেন কিনা। ঈদের আগে আগে বাড়ি আসবো। আম্মাকে বলবেন, যেন বড় মামার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমাকে পাঠায়। বাসায় রান্নার কিছুই কেনা হয়নি। বাইরের খাওয়ায় খরচ বেশী এবং অস্বাস্থ্যকর। আম্মার তদারকিতে দেওয়া সম্পত্তির এটুকুই তো রিটার্ন মাত্র। আপনার সেন্টিমেন্টে লাগতে পারে। লাগাটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনার শ্বশুড়বাড়ি। আমাদের কিসের সেন্টিমেন্ট? শিমু মংলায় পড়বে, বাবু স্কুলে। আপনারা না চাইলেও এসব করা হবে। দোয়া করবেন।

– শহীদুল্লাহ

পারিবারিক স্বচ্ছলতা থাকা স্বত্ত্বেও সেই পথ বেছে না নিয়ে বরং নিজের কয়েকটা রিক্সা ছিল, তা থেকে যা আয় হতো, তাতেই বেশ চলতেন। এছাড়া ঠিকাদারী ও চিংড়ির খামার করেছেন আর দু’হাতে টাকা উড়িয়েছেন।

পাঞ্জাবী আর জিন্সের যুগলবন্দী পোষাক তার নিজস্ব স্টাইল ছিলো। পরে জেমস এটা জনপ্রিয় করেন। রুদ্র’র মদ্যপ্রীতি ছিলো বলিহারী! হুইস্কির তিনি বাংলা নামকরণ করেছিলেন ‘সোনালী শিশির

তসলিমার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্যামা তরুণী শিমুলের সঙ্গে রুদ্র’র প্রেম হয়েছিলো। কিন্তু শিমুলের অভিভাবক রাজী না হওয়ায় সে সম্পর্কও চুকে যায়। সেই থেকে রুদ্র আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যান। ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যেতে থাকেন। কবির ভাষায়,

“এতোটা নিঃশব্দে জেগে থাকা যায় না, তবু জেগে আছি…
আরো কতো শব্দহীন হাঁটবে তুমি, আরো কতো নিভৃত চরণে
আমি কি কিছুই শুনবো না- আমি কি কিছুই জানবো না!”

অতিরিক্ত অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার ফলাফল যা হয়, শেষমেষ আলসারে পেয়ে বসেছিল রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। পায়ের আঙ্গুলে রোগ বাসা বেঁধেছিল। ডাক্তার বলেছিলো পা বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। তিনি পা ছেড়ে দিয়ে সিগারেট নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যার ফলে রুদ্রর নতুন ঠিকানা হলো হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ২৩১ নম্বর কেবিন। ১৯৯১ সালের ২০ জুন ভালো হয়ে পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়িতে ফিরে যান রুদ্র। কিন্তু ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কাছে পঁয়ত্রিশ বছরের স্বেচ্ছাচারী জীবনের সমর্পণ করে আঁধারপুরের বাসিন্দা হন বাংলা সাহিত্যের এ নক্ষত্র।

মাত্র ৩৫ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো ’ সহ অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।

১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই ‘উপদ্রুত উপকূলে’। প্রথম বইয়ের ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা সকলের মনোযোগ কেড়ে নেয় ও পাঠক সমাজে সাড়া জাগায়। রুদ্র’র দ্বিতীয় বই ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘মানুষের মানচিত্র‘ (১৯৮৪), ‘ছোবল’ (১৯৮৬), ‘গল্প’ (১৯৮৭), ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ (১৯৮৮) ও ‘মৌলিক মুখোশ’ (১৯৯০)। এছাড়া প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘সোনালি শিশির’। আর তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’

২১ জুন রুদ্রের ছাব্বিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ছাব্বিশ বছর পরও হয়ত রুদ্র জানেন না তার প্রিয়জনদের ভুল ভেঙ্গেছে কিনা, ভুল ভাঙলে হয়ত হৃদয়ের নীল বন্দর থেকে লিখে দিবেন প্রিয় নাম ভালোবাসা, আর নিজে থাকবেন একা থাকার ভালো লাগায়, নিঃসঙ্গতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

“ভুল ভেঙ্গে গেলে ডাক দিও,
আমি মৃত্যুর আলিঙ্গন ফেলে আত্মমগ্ন আগুন
ললাটের সৌমতায় তোমার লিখে দেবো একখানা প্রিয়নাম – ভালোবাসা”

Related Articles