Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্রেট মস্ক অব জেনি: বিশ্বের বৃহত্তম মাটির মসজিদ

পশ্চিম আফ্রিকার একটি অনুন্নত কৃষিভিত্তিক দেশ মালি। খরা, মহামারি, অনাহার লেগেই আছে দেশটিতে। উল্লেখ করার মতো তেমন বিশেষ কিছু নেই এ দেশটিতে। তবে বিশেষ এক স্থাপনার কারণে দেশটি পুরো বিশ্বে পরিচিত। স্থাপনাটি হাজার বছরের পুরনো, কাদামাটির তৈরি একটি বিশাল আকৃতির মসজিদ। মালির অন্তর্বর্তী ছোট একটি গ্রাম জেনিতে এটি অবস্থিত। সকলের কাছে ‘গ্রেট মস্ক অব জেনি‘ নামেই এটি অধিক পরিচিত।

মালিতে অবস্থিত কাদা মাটির মসজিদ ‘গ্রেট মস্ক অফ জেনি’; Source: pinterest.co.uk

মসজিদটি কবে, কখন এবং কীভাবে নির্মিত হয়েছিল সে সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ৮০০ – ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। জেনির ২৬ তম শাসক কোনবোরোর হাতে এই মসজিদের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়। কোনবোরো যখন রাজা হন তখন ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। জেনির সাধারণ মানুষ তখন ব্যাপক উৎসাহে গ্রহণ করে নেন তাদের প্রথম মুসলমান শাসককে।

তখন নতুন রাজা চিন্তা করেন তার প্রজাদের প্রার্থনার জন্যে একটি উপযুক্ত স্থান দরকার। যেখানে সৃষ্টিকর্তার জন্যে স্থান নেই সেখানে তিনি কী করে প্রাসাদে বাস করবেন? তিনি ঠিক করলেন তার প্রাসাদ ভেঙ্গে সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে ডেকে আনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো মসজিদ তৈরিতে গতানুগতিক কাদামাটি এবং গ্রামের সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করা হবে।

মসজিদের দেয়াল অনেক উঁচু হবে বলে সেখানে তালগাছের কাঠ দিয়ে নকশা করা হলো যা স্থানীয়ভাবে টরল নামে পরিচিত। মাটির দেয়াল যাতে সহজে ধ্বসে না পড়ে সেজন্যই এই কাঠ ব্যবহার করা হতো। মসজিদের পূর্ব দিকে রাজার জন্যে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এটি ছিল মসজিদের তুলনায় আকারে ছোট। পরবর্তীতে রাজার উত্তরাধিকারীরা এই মসজিদের সাথে আরো দুটি মিনার নির্মাণ করেন এবং মসজিদের চারপাশে উঁচু করে দেয়াল তোলেন।

আয়তনে বৃহত্তম কাদা মাটির মসজিদ; Source: pinterest.com

১৮২৭ সাল পর্যন্ত এই মসজিদ সম্পর্কে কোনো প্রকার লিখিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। ফরাসি পর্যটক রেনে কেইলি ১৮২৭ সালে মালি ভ্রমণের সময় এই মসজিদটি আবিষ্কার করেন এবং এই মসজিদের বিস্তারিত বর্ণনা জার্নাল অব দ্য ভয়েজ টু টিম্বাকটু এন্ড জেনিতে উল্লেখ করেন। তিনিই প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি মসজিদটি ধ্বংস হওয়ার পূর্বে নিজের চোখে দেখেছিলেন। তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন মসজিদের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত কাদা মাটির প্রলেপ দেওয়ার প্রয়োজন হতো। তিনি ধারণা করেন, অনেক বছর অবহেলায় পড়ে থেকে মসজিদটির স্থায়ীত্ব কমে এসেছিল।

গবেষকদের মতে, ১৮৩৪-১৮৩৬ সালের দিকে প্রথম মসজিদের ভগ্নাবশেষের উপর দ্বিতীয় মসজিদটি তৈরি করা হয়। এর প্রমাণ হিসেবে ১৮৯৬ সালে ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবইস মসজিদটির ভগ্নাবশেষের উপর একটি হাতে আঁকা ছবি প্রকাশ করেন। সেখানে দেখানো হয় আকার ও আকৃতিতে দ্বিতীয় মসজিদের স্থাপনা প্রথম মসজিদের চাইতে অনেক বড়। পাশাপাশি দ্বিতীয়বার নির্মিত মসজিদটির মিনারের পাশাপাশি স্তম্ভের ব্যবহার করা হয়েছিল।

ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবইস সম্পাদিত পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিটি; Source: khanacademy.org

বর্তমানে মসজিদটির যে রূপ দেখা যায় তা মূলত এর তৃতীয় সংস্করণ। ১৯০৭ সালের দিকে এর কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, মালি যখন ফরাসি উপনিবেশের অধীনে ছিল তখন ফরাসিরা এই মসজিদ পুনরায় নির্মাণ করে। তবে এর পক্ষে কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, স্থানীয় রাজমিস্ত্রীরা সংগঠিত হয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের সাহায্যে মসজিদটি পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়।

গ্রামের মানুষ আর রাজমিস্ত্রীদের যৌথ প্রচেষ্টায় পুনরায় নির্মিত হয় মাটির মসজিদ; Source: archnet.org

কাদা মাটির মসজিদটির বাইরের অংশ; Source: wonderfulltourism.blogspot.com

বর্তমানে যে মসজিদটি দেখতে পাওয়া যায় তার মাঝে বেশ পরিকল্পিত স্থাপত্যশৈলীর ছাপ পাওয়া যায়। মসজিদটির চারপাশ উঁচু মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মসজিদটির মাঝখানের চূড়াটি একটি উঁচু স্তম্ভের মতো দেখা যায়।

মসজিদের ভেতরকার একাংশ; Source: khanacademy.org

এর দেয়ালে এবং ছাদে অনেকগুলো ছিদ্র রাখা হয়েছে যেন গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট আলো-বাতাস পাওয়া যায়। এর বাইরের অংশের ৩টি উঁচু মিনার মসজিদটিকে অসম্ভব সুন্দর ছন্দময় দৃশ্য উপহার দেয়। এতে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বর্তমানে মসজিদটির সাথে একটি শৌচাগার সংযুক্ত রয়েছে। আরো আছে মহিলাদের জন্য নামাজের আলাদা স্থান। এছাড়াও মসজিদের বাইরের অংশে দুজন ধর্মীয় নেতার সমাধি রয়েছে।

উপর হতে মসজিদের পুরো অংশের ছবি; Souce: mustseeplaces.eu

মসজিদটিকে ঘিরে জেনি গ্রামের সচেয়ে বড় উৎসব ‘ক্রেপিসেজ দি লা গ্র্যান্ড মস্ক’ পালন করা হয়। বার্ষিক এই অনুষ্ঠানের জন্যে গ্রামের মানুষ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে। গ্রামের সকলেই এতে আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ করে। তখন রাজমিস্ত্রীর সংগঠন গ্রামের লোকদের একত্রিত করে নাইজার এবং বানি নদী থেকে মাটি আহরণ করা শুরু করেন। সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটি সংগ্রহের কাজে। এদিকে গান বাজনার দল গান গেয়ে সকলকে বিনোদন দিতে থাকে। আর গৃহস্থ মেয়েদের কাজ হলো মাটির মিশ্রণ তৈরিতে পানি সরবরাহ করা। এভাবে কাদামাটির মিশ্রণ তৈরি করার পর মসজিদের দেয়াল জুড়ে প্রলেপ লাগানোর কাজ শুরু হয়।

মসজিদের দেয়ালে মাটির প্রলেপ লাগাতে ব্যস্ত একদল শ্রমিক; Source: en.yesurdu.com

গ্রামের বাসিন্দারা তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী মাটির মসজিদকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করে। উৎসবের সময়ে বাইরের কিছু পর্যটক সবসময় চেয়েছে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব খাটাতে। আবার অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী মসজিদটিকে কংক্রিটের মসজিদ করে দেয়ারও প্রস্তাব করেছে। কিন্তু জেনি সম্প্রদায়বাসী তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী। তারা কোনোপ্রকার প্রলোভনের কাছে মাথা নত না করে এখনো সমুন্নত রেখেছে বিশ্বের বৃহত্তম মাটির মসজিদটিকে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদ এবং মসজিদের চারপাশের গ্রামটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

জেনি গ্রামের একাংশ যার অধিকাংশই মাটির বাড়ি; Source: travelomali.com

মধ্যযুগে আফ্রিকার এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিক পথ এবং এর বিস্তৃত সংস্কৃতির জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে গ্রামটিতে দেড় লাখের মতো মানুষ বাস করে, যাদের অধিকাংশই মুসলমান। অনেক কাল আগে থেকেই এ অঞ্চলটি ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মসজিদটি। অসংখ্য শিক্ষার্থী কুরআন শেখার জন্যে এই মসজিদে ভিড় করতো। এখনো এই মসজিদে নিয়মিত কুরআন পাঠদান হয়।

মসজিদের ছাদ; Source: khanacademy.org

কাদামাটির এ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ মোটেও সহজসাধ্য নয়। জেনি গ্রামে রাজমিস্ত্রীদের সংগঠনটি পুরো গ্রামের মাটির ঘরবাড়ি তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন। এই সংগঠনই মূলত মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে কর্মরত থাকেন। কিন্তু খুব বড় আকৃতির স্থাপনা হওয়ায় প্রায় সময় কিছু না কিছু মেরামত হতেই হয়। উপযুক্ত লোক এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এই কাজ দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে জেনিবাসীদের জন্য। স্বাভাবিকভাবে এর সাথে খরচের ব্যাপারটিও জড়িয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামবাসীর অদম্য ভালোবাসা এবং ধর্মীয় অনুভব মসজিদটিকে এখনো বিশ্বদরবারে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে।

ফিচার ইমেজ- wonderfulltourism.blogspot.com

Related Articles