সময়ের পরিক্রমায় আর স্থাপত্য বিজ্ঞানের উৎকর্ষে বাড়ি নির্মাণ পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। স্থাপত্যশিল্পীদের ধ্যান-ধারণাও ক্রমশ বদলে গিয়েছে। বর্তমানে ঘরবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁ নির্মাণের বৈচিত্র্য দেখলে তাজ্জ্বব বনে যেতে হয়। এসব বাড়ি তৈরির পেছনে যেসব স্থপতি জড়িত ছিলেন, তাদের প্রতিভাবান ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! তাদের এই ক্ষ্যাপামির মধ্যে অবশ্য বিজ্ঞান রয়েছে। বিজ্ঞানের সব নিয়ম মেনে অনেক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ও শিল্পমণ্ডিত বাড়ি নির্মিত হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এমন কয়েকজন প্রতিভাবান স্থপতির পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে নির্মিত বৈচিত্র্যময় কয়েকটি বাড়ি নিয়ে আজকের এই লেখা।
ক্রেজি হাউজ, ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের এই বাড়িটিতে প্রকৃতি আর রূপকথা মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গিয়েছে। ১৯৯০ সালে ভিয়েতনামের দ্য লাত শহরে এই অদ্ভুত দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি নির্মিত হয়। তবে এটি কোনো বসতবাড়ি নয়। এটি একটি হোটেল। দাং ভিয়েত না নামের একজন পেশাদার স্থপতি এই বাড়ির নকশা করেন। নির্মাণশৈলীতে বরাবরই বৈচিত্র্য পছন্দ করেন এই শিল্পী। এজন্য চালান নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই স্থপতি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। দাং কাঠ আর কংক্রিটে তৈরি এই বাড়ির নাম দেন ‘ক্রেজি হাউজ’। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, এটি যেন এক ক্ষ্যাপাটে স্থপতির এক ক্ষ্যাপাটে বাড়ি।
দূর থেকে বাড়িটির দিকে তাকালে হোটেল বলে মনেই হবে না। মনে হবে, একটি গাছ ডালপালা মেলেছে। আর তার ডালপালায় ছড়িয়ে রয়েছে হোটেলটির ঘরদোরে। হোটেলটিতে খোলা জায়গাই বেশি। এই প্রসঙ্গে স্থপতি দাংয়ের অভিমত হচ্ছে, প্রকৃতিকে আগে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে, তারপর নির্মাণ। হোটেলের দরজা-জানালা নির্দিষ্ট কোনো আকারের নয়। ঘরের আকারও তেমন। এবড়ো থেবড়ো। ছাদের আকৃতিও সমান নয়। সেখান দিয়ে গাছের ডালপালা আর শিকড় নেমে এসেছে। পুরো হোটেলের চারদিকে কাঠের তৈরি নানা ভাস্কর্য। বড় বড় গাছের মোটা মোটা গুঁড়ি কেটে সিঁড়ি তৈরি হয়েছে।
হোটেলের প্রতিটি ঘর একেকটি প্রাণীকে থিম করে বানানো হয়েছে। পিঁপড়া, বাঘ, সিংহ, হরিণ এমন সব প্রাণীর ভাবনা দেখা যায় একেকটি রুমে। যেমন- বাঘের ঘরে ঢুকলেই মনে হবে রক্তিম চোখ করে বিছানার দিকে থাবা বাড়িয়ে আছে সেই বাঘ। বিছানায় কেউ এসে বসলেই তার ওপর হামলে পড়তে প্রস্তুত সে। এমন ভাবনা বাকি ঘরগুলোতেও রয়েছে।
প্রথমদিকে মানুষজনকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি এই ক্রেজি হাউজ। ক্ষ্যাপাটে স্থপতির এমন পাগলামিকে অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দাংয়ের এই হোটেল। হয়ে ওঠে ভিয়েতনামের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসতে শুরু করে এই বাড়িটি দেখতে। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা থেকে এই নকশা বেশ কয়েকবার পুরস্কৃতও হয়েছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, স্থপতি দাং মনে করেন, এই বাড়ির নির্মাণকাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি। নতুন কোনো চিন্তাভাবনা তার মাথায় এলেই সেটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য নেমে পড়েন সত্তরোর্ধ্ব দাং ভিয়েত না।
আপসাইড ডাউন হাউজ, পোল্যান্ড
উত্তর পোল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রাম শিমবার্ক। ছোট্ট এই গ্রামটি দিনে দিনে হয়ে উঠেছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এই গ্রামের মাউন্ট ভিয়েজিতা পাহাড়ের নিচে নির্মিত হয়েছে আপসাইড-ডাউন হাউজ নামের এক উল্টো বাড়ি। ছাদ মাটিতে আর মেঝে আকাশের দিকে। অনেকটা যাকে বলে পা উপরে আর মাথা নিচে।
ড্যানিয়েল ফ্লাপিয়েস্কি নামে এক পোলিশ স্থপতির নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কাঠ আর কংক্রিটের এই বাড়িটি। এই বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে বেশ বিপদেই পড়তে হয়েছে ড্যানিয়েলকে। একবার বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে দেখা গেল পুরো বাড়ির অর্ধেকের বেশি কাঁচামাল ভিত তৈরি করতেই চলে গেছে। তার উপর নির্মাণ শ্রমিকদেরকে নিয়ে প্রায় সময় নানা বিপত্তি লেগেই থাকতো।
বাড়ির প্রতিটি দেয়াল, মেঝে আর ছাদের মধ্যকার সূক্ষ্ম কোণ, মাপ জোক করতে গিয়ে নির্মাণকর্মীদের প্রায়শ মাথা খারাপের জোগাড় হতো। ফলে কিছুদিন পর পরই অনেক নির্মাণকর্মী কাজ বন্ধ করে চলে যেতেন। পরে আবার তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ধরে এনে কাজ শুরু করানো হতো। ২০০৭ সালে এই বাড়ির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। দুই কক্ষবিশিষ্ট বাড়িটির মোট আয়তন ২০০ বর্গমিটার। একসাথে বিশজন মানুষ বাড়িটিতে প্রবেশ করতে পারেন।
বাড়ির ছাদের দরজা দিয়ে দর্শকদের বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। বাড়ির ভেতরটা সাজানো হয়েছে পঞ্চাশ বছরের পুরনো পোল্যান্ডের বাড়ি-ঘরের আদলে। ছাদ দিয়ে হেঁটে চলে বেড়াতে হয়। মাথার ওপর মেঝে হওয়ায় সেখানে সাজানো রয়েছে টেবিল-চেয়ার, সোফা, খাট। এসব দেখতে দেখতে অনেক দর্শনার্থীর নাকি মাথা ঘুরতে থাকে। ফলে বেশি সময় বাড়ির ভেতরে থাকতে না পেরে অনেকেই বের হয়ে আসেন।
হবিট হাউজ, ওয়েলস
রূপকথার গল্পের হবিটদের বাড়ির আদলে পেমব্রোকসার, ওয়েলসে এক পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হয়েছে এই হবিট হাউজ। প্রকৃতির মাঝে নির্মিত বাড়িটি এককথায় অনন্য। বাড়ির নকশা এবং নির্মাণকাজের সাথে জড়িত ছিলেন স্বয়ং বাড়ির মালিক সাইমন ডালে। একটি পরিবেশবান্ধব বাড়ি নির্মাণ করার ইচ্ছা থেকেই তিনি এই বাড়িটি নির্মাণ করেন।
ঘাসের ছাদ, পাথর আর মাটির দেয়ালের তৈরি বাড়িটির সূক্ষ্ম নকশা আর ঘরের ভেতরের দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো এককথায় অতুলনীয়। বাড়ির কাছেই কয়েকটি ঝর্ণা থাকায় বাড়ির চারপাশের পরিবেশকে করে তুলেছে আরও দর্শনীয়। বাড়ির ভিতরে কোনো কৃত্রিম বা বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
বাড়িটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে দিনের বেলায় সূর্যের আলো বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। আর রাতের বেলায় সোলার প্যানেলের সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব বাড়ি হিসেবে বিশ্বে এই বাড়িটি বেশ পরিচিতি পেয়েছে।
ড্যান্সিং হাউজ, চেক প্রজাতন্ত্র
চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে নির্মিত হয়েছে এমন একটি বাড়ি যা গোটা পৃথিবীর বাড়ি তৈরির নকশায় এক বিস্ময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমার আঘাতে প্রাগ শহরের ভোলতাভা নদীর ধারে থাকা অনেক পুরনো বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বাড়ির মালিক ও স্থাপত্যশিল্পীরা সেসব বাড়িগুলো ভেঙে তার স্থলে ভিন্ন ধরনের কিছু নির্মাণের পরিকল্পনা করতে লাগলেন।
নিত্য চেনা কাঠামো থেকে বের হয়ে এসে নতুন কিছু করার ভাবনা থেকে কাজ শুরু হলো। ১৯৯২ সালে বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তবে কাজ শুরু হতেই এর নির্মাণ নিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত চেক প্রেসিডেন্টের ইচ্ছায় ১৯৯৬ সালে এই বাড়ির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। মোট নয় তলা বাড়ির পুরোটাই হোটেল আর রেস্তোরাঁ। দুটো তলা মাটির নিচে। মোট ৯৯টি কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই বাড়ি।
প্রথমদিকে চেক প্রজাতন্ত্রের দুই জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পীর নামানুসারে বাড়ির নামকরণ করা হয় ‘ফ্রেড অ্যান্ড জিঞ্জার’। পরবর্তীকালে বিশ্বের মানুষের কাছে এই সুন্দর অদ্ভুত বাড়িটি ‘ড্যান্সিং হাউজ’ নামেই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে। দেশটির মুদ্রায়ও এই বাড়ির প্রতিচ্ছবি ব্যবহার করেছে সে দেশের জাতীয় ব্যাংক।
This article is a bengali article. This is story about some interesting crazy housesaround the world built by some crazy architects. All the sources are hyperlinked into the article.
Feature Image: Business Insider