উজ্জ্বল নীল আকাশে মনোমুগ্ধকর মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে, গ্ল্যাডিওলাসের ডাঁট রূপ নিয়েছে জাহাজের মাস্তুলে, গাছপালার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে মানুষের অবয়ব কিংবা হাতির শুঁড় বদলে গেছে ভেঁপুতে। বিস্ময়কর সব উপাদান ও রূপকের সম্মিলনে আঁকা ভ্লাদিমির কুশের প্রতিটি ছবিই যেন একেকটি নতুন জগতের হাতছানি, একেকটি মায়াবী রূপকথা।
চোখধাঁধানো রঙের মিশেলে দারুণ সূক্ষ্মতায় আঁকা ছবিগুলো আপনার অবচেতন মনে নাড়া দেবেই। কুশের উদ্দেশ্যও তা-ই। দর্শকের অবচেতন মনকে আন্দোলিত করে কল্পনার দরজা খুলে দেওয়া এবং তার শিল্প চেতনার উন্মেষ ঘটানো। সমালোচকেরা কুশের ছবিগুলোকে স্যুরিয়ালিজম ধারায় ফেললেও কুশের আছে একান্ত নিজস্ব শিল্পশৈলী যাকে তিনি বলেন 'মেটাফোরিক্যাল রিয়েলিজম'। আজকের লেখা ভ্লাদিমির কুশের জীবন এবং তার রূপকের বিস্ময়কর জগত নিয়ে।
জন্ম ও শৈশব
ভ্লাদিমির কুশের জন্ম রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে, ১৯৬৫ সালে। শিশু কুশ বাবার কোলে বসে খেলতেন রঙ-পেন্সিল নিয়ে। কুশের পরিবার বেশ সংস্কৃতিমনা ছিল। তাদের বাসায় ছিল তাক ভর্তি বই। ছোট্ট কুশ সেই বইয়ের জগতে ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতেন কল্পনার স্বপ্নিল ভুবনে। কল্পনার ডানায় চড়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন দেশ-বিদেশ। কুশের বয়স যখন সাত বছর তখন তিনি ভর্তি হন আর্ট স্কুলে। কুশ খুবই ভাগ্যবান ছিলেন, কারণ তার প্রথম আর্ট শিক্ষক তার বাধাহীন কল্পনাকে কখনো অবদমিত করতে চাননি। বরং তিনি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে, সৃজনশীল শিল্প সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। শিক্ষকের বলা বিখ্যাত শিল্পীদের গল্প কুশের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
বারো বছর বয়সে কুশ বাবার সাথে সুদীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে তৎকালীন রাশিয়ান প্রগতিশীল শিল্পীদের আন্ডারগ্রাউন্ড প্রদর্শনী দেখেন। রাশিয়ার সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেরকম প্রদর্শনী ছিল বদ্ধ জায়গায় খোলা হাওয়ার প্রবাহের মতো। এই ঘটনা কুশের পরবর্তী জীবনে নতুন কিছু সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল। কুশ আর্ট স্কুলেই রেনেসাঁ, ইম্প্রেশনিজম ও মডার্ন আর্টের সেরা শিল্পীদের সাথে পরিচিত হন। হিয়েরোনিমাস বস, ক্যাসপার ডেভিড ফ্রেড্রেরিখ, ডালি প্রমুখ শিল্পীদের প্রভাব পড়েছিল তার পরবর্তী কাজগুলোতে। সতের বছর বয়সে কুশকে দেশের নিয়মানুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। সেখানে মূলত তার কাজ ছিল বড় বড় দেয়ালচিত্র ও জেনারেলদের পোর্ট্রেট আঁকা। সেনাবাহিনীর চাকরি শেষে তিনি আবার তার পুরনো আর্ট স্কুলে ফিরে আসেন এবং গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করেন।
রাশিয়া থেকে আমেরিকা: পৃথিবীর পথে
কুশ মস্কোর রাস্তায় রোজগারের জন্য পোর্ট্রেট আঁকতেন। ১৯৮৭ সালে তিনি আর্টিস্ট ইউনিয়নের উদ্যোগে আয়োজিত প্রদর্শনীগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেন। ১৯৯০ সালে জার্মানিতে তার একটি প্রদর্শনী হয়, যা তার কপাল খুলে দেয়। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। লস এঞ্জেলসে আরেকটি প্রদর্শনী হয় তার। এভাবে তার আমেরিকান জীবন শুরু হয়। কুশের লস এঞ্জেলসের দিনগুলো খুব কঠিন ছিল। ছবি আঁকতে হতো ছোট্ট একটা গ্যারেজে আর রোজগারের জন্য তিনি সান্তামনিকা পিয়ারে পোর্ট্রেট আঁকতেন।
অবশেষে তিনি তার স্বপ্নের গন্তব্য হাওয়াই পাড়ি জমান। ১৯৯৩ সালে কুশের সাথে এক ফরাসি আর্ট ডিলারের সাক্ষাৎ হয়, যিনি হংকংয়ে কুশের ছবির একটি প্রদর্শনী আয়োজন করে দেন। কল্পনাতীত সফলতা লাভ করে সেই প্রদর্শনী। তারপর কুশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি মূলত ক্যানভাসে তেলরঙ ব্যবহার করে ছবি আঁকেন। তার মূল ছবিগুলো তার ব্যক্তিগত গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে। তিনি প্রিন্টেড কপি বেশি বিক্রি করেন।
চিত্রশিল্পের বাইরে ভাস্কর্যের জগতেও তিনি রেখে যাচ্ছে তার সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর। তার নির্মিত ভাস্কর্যগুলো অবশ্য ছোট আকারের। সেগুলো মূলত তার ছবি থেকে নেয়া। যেমন- "প্রস এন্ড কনস", " ওয়ালনাট অব ইডেন" ইত্যাদি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কুশের চারটি গ্যালারি আছে- ক্যালিফোর্নিয়ার ল্যাগুনা বীচে, হাওয়াই দ্বীপে, সিয়াটলে এবং লাস ভেগাসে।
কুশের শিল্পভাবনা ও রূপকের জগত
স্যুরিয়ালিজমের প্রসঙ্গ আসলেই অনেকে ডালির কথা বলেন। কিন্তু ডালির বেশিরভাগ ছবির বিষয়বস্তুই ছিল বিকৃতভাবে উপস্থাপিত। সেই যুদ্ধ ও সহিংসতার সময়টা তৎকালীন স্যুরিয়ালিস্টদের একটা মলিনতার চাদের আবৃত করে রেখেছিল। কুশই প্রথম স্যুরিয়ালিজমকে সতেজ ও ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করেন, যা প্রকৃতির সাথে গভীরভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। স্যুরিয়ালিজমের বিকৃতির পরিবর্তে কুশ বাস্তব জগতের জিনিসগুলোকে অস্বাভাবিকভাবে সংযুক্ত করে একটি গুঢ় অর্থ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কুশ তার এই আঁকার ধরনকে বলেন 'মেটাফোরিক্যাল রিয়েলিজম'।
তার নিজস্ব চিত্রকলার এই ধারায় পার্থিব জগতকে বাস্তবের মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে সত্য ও সুন্দরের উপমায়। এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে তার ব্যক্তিগত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং পৌরাণিক উপাদান। কুশ রূপক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন,
পৃথিবীকে রূপকের আয়নায় দেখা- এটাই আমার লক্ষ্য। রূপকের উপস্থিতি শুধু ভাষাগত যোগাযোগের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে রূপক গভীরভাবে জড়িত। রূপক মূলত দর্শকের অনুভূতি ও অবচেতন সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দেয়। এটি কল্পনার দরজা খুলে দেয়। এভাবে দর্শক দুটি আপাত ভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কার করে। দুটি জিনিস যত দূরবর্তী হবে, তাদের মধ্যকার সাদৃশ্য তত প্রবল হবে। রূপকের মাধ্যমে প্রকাশিত দুটি বিষয়ের সাদৃশ্যের হঠাৎ উপলব্ধি সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর। শিল্পীর সার্থকতা এখানেই।
একেবারে বাস্তবের মতো দেখতে কোনো চিত্রশিল্প দেখে আমরা নির্বাক প্রশংসায় মগ্ন হই কিংবা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের সিম্বল নির্মিত কুহেলিকায় মুগ্ধ হই। মেটাফোরিক্যাল আর্ট আমাদের অবচেতন মনকে একপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, যেন সে রূপকগুলোর অর্থ কল্পনায় খুঁজে নিতে পারে।
প্রত্যেকটি রূপকের বলার মতো আলাদা গল্প থাকে। রূপক হাজার বছরের পুরনো সভ্যতাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করে, পৃথিবীর নতুন রূপ উন্মোচন করে। আধুনিক জীবনের অনিশ্চয়তা ও অসঙ্গতি মিশ্রিত জটিলতাকেও রূপক তুলে ধরতে পারে। কুশের ছবির প্রতীকগুলো পুরাণ ও ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত, সেজন্যই এগুলো সার্বজনীন। যেমন- ডিম ভেঙে কুসুম বের হয়ে আসা পৃথিবীর জন্মকে বোঝায় যা প্রাচীন ভারতীয়, চীনা, এমনকি পলিনেশিয় পুরাণেও খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বলেন,
আমার কাজ হচ্ছে এই মিথগুলোকে নতুনভাবে গড়া; আমার কল্পনায়, রূপকের ভাষায়। এভাবে বলা যায়, আমি পুরাণকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে ভাঙি এবং আমার ল্যাবরেটরিতে পুনর্নির্মাণ করি। যদিও তা হয় পূর্বের স্ক্রিপ্ট অনুসারেই।
কুশের কাছে শিল্প মানে ছুটে চলা- সকালে এক কাপ কফি, কখনো অত্যাচার, কখনো আনন্দ, কঠোর পরিশ্রম এবং একটি আসক্তি। কুশের ধারণা- গত শতাব্দীগুলোর মতো বর্তমানে সক্রিয় ভূমিকায় নেই। তিনি তার নতুন ধারায় কাজ দিয়ে এর পুনর্জাগরণের ব্যাপারে আশাবাদী।
নির্বাচিত চিত্রকর্ম
আফ্রিকান সোনাটা
এই ছবিতে দেখা যায়, হাতির শুঁড় রূপান্তরিত হয়েছে ভেঁপুতে। ভেঁপু রূপকের মাধ্যমে হাতি যে শব্দ করছে সেটা বোঝানো হয়েছে। হাতির শব্দকে আনন্দঘন গানের উৎসব হিসেবে দেখিয়েছেন শিল্পী। হাতিরা প্রাণী হিসেবে একইসাথে শক্তিশালী ও নম্র প্রকৃতির। তাই প্রাণীদের এই সঙ্গীত শোভাযাত্রায় হাতিদেরকে নেতা বানানো হয়েছে।
ব্রেকফাস্ট অন দ্য লেক
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অনিন্দ্যসুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যের দর্শন মনের জন্য সেরা নাস্তা। এই ছবিটি শরীর ও মনের জন্য সেরা প্রাতরাশের জোগানকে বুঝিয়েছে।
বর্ন টু ফ্লাই
এই ছবিতে নিশ্চিত গন্তব্যের হাতছানি প্রকাশিত হয়েছে। প্রজাপতির যে রূপান্তর হয় এটা তো আমরা সবাই জানি। এই ছবিটিতে প্রজাপতির ভবিষ্যৎ ইতিবাচকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ইভনিং ফ্লাইটস
পেঁচারা নৈঃশব্দ্য, শান্তি ও জ্ঞানের প্রতীক। বেলা শেষের আলো এবং আকাশে এক ফালি চাঁদের উপস্থিতি রাতের প্রারম্ভকে বোঝায়। রাতের নিঃশব্দ পরিবেশ পেঁচার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
ডিপারচার অব উয়িংড শিপ
এটি কুশের খুব জনপ্রিয় একটি ছবি। বিশাল তিনটি মাস্তুলের জাহাজের পালের জায়গা দখল করেছে প্রজাপতির ডানা। প্রজাপতি এখানে স্বাধীনতা ও অ্যাডভেঞ্চারের প্রতীক।
রেডউড কাটিং
আজকের পৃথিবীতে মরুকরণের নির্দয় উৎসব চলছে। এভাবে যে আমরা পরিবেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছি, এই অপ্রিয় সত্যটাই এই ছবিতে ফুটে উঠেছে।
মেটামরফোসিস
উদাস কোনো দুপুরে আকাশে উড়ে বেড়ানো মেঘের সাথে পরিচিত কিছুর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন কখনো? এই ছবিতে মেঘের বেলুনে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে মেঘের রূপান্তরকে বোঝানো হয়েছে।
কুশ নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের সেরা স্যুরিয়ালিস্ট চিত্রশিল্পী, যিনি স্যুরিয়ালিজমকে নিয়ে গেছেন এক একটি ভিন্ন মাত্রায়, প্রকাশ করেছেন আরো সৃষ্টিশীলভাবে। তার জন্য নিরন্তর শুভকামনা।
This is a Bangla article on Russian painter Vladimir Kush. Life and style of painting of this prolific artist have been discussed in the article. All the informations are hyperlinked inside the article.
Feature Image - Mescado Libre Argentina