১৭ শতকে বাণিজ্য, শিল্প, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে নেদারল্যান্ডস উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে। এই সময়টি ইতিহাসে ‘ডাচ গোল্ডেন এজ’ বা ‘ওলন্দাজ সোনালী যুগ’ নামে খ্যাত। এই উজ্জ্বল সময়কালে নেদারল্যান্ডস শিল্পকলায় অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করে। বহু চিত্রকর এই যুগে তাদের কৃতিত্বের চিহ্ন রেখে যান। এদের মধ্যে জোহান্নেস ভারমিয়ার, ফ্রাঞ্জ হ্যালস ট্রোনি, পলুস পটার, রেমব্রান্ত, জ্যাকব ভ্যান লু তাদের কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।
এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে রেমব্রান্ত (১৬০৬-১৬৬৯) নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। তার আঁকা ছবিতে প্রকৃতির বিশাল ঐশ্বর্য, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যের ঘটনা, রাজপরিবার ও অভিজাত ব্যক্তিবর্গ এবং সমকালীন বিভিন্ন বিষয় বেশ ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুটে উঠেছে। এজন্য বলা হয়- শুধু ডাচ গোল্ডেন এজ নয়, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে রেমব্রান্ত অন্যতম।
এই অমর শিল্পীর আঁকা অসংখ্য ছবি আজও অনুরাগীদের বিস্মিত করে থাকে। কালজয়ী এসব ছবির মধ্যে ১৬৪২ সালে আঁকা ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ ছবিটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রেমব্রান্তের এই ছবিটি বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। সাধারণভাবে ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ নামে পরিচিত হলেও এর মূল নাম কিন্তু বিশাল! ‘মিলিশিয়া কোম্পানি অব ডিস্ট্রিক্ট টু আন্ডার দ্য কমান্ড অব ক্যাপ্টেন ফ্রানজ ব্যান্নিংক কক’ ছবিটিই ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ নামে খ্যাত!
ছবিটিতে ক্যাপ্টেন ফ্রানজ ব্যান্নিংক কক ও তার সাথে ১৭ জন সিভিক মিলিশিয়া গার্ড সদস্যকে দেখা যায়। এছাড়া একজন বাদক ও একজন মেয়ের দৃশ্যও চোখে পড়ে। ছবিতে ফুটে ওঠা চরিত্রগুলোর শারীরিক গতি বেশ সাবলীল ও নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। সমকালীন ছবিতে রাজপরিবার বা অভিজাত সামরিক ব্যক্তিগণের ছবিতে গতির উপস্থিতি তেমন একটা চোখে পড়ে না। শুধু রেমব্রান্তের মতো একজন অমিত প্রতিভাবান শিল্পীর পক্ষেই এমন দৃশ্য কৌশলের সাথে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।
এই ছবিটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছবিটির আকার। আজ থেকে প্রায় পৌনে চারশ বছর আগে আঁকা এই ছবিটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ১১.৯১ ও ১৪.৩৪ ফুট। অর্থাৎ ছবিতে আঁকা মানুষগুলো প্রায় প্রমাণ আকারের! বড় কোনো শিল্পীর আঁকা এত বড় মাস্টারপিস ইতিহাসে কমই পাওয়া যায়। ছবিটিতে আলোর ব্যবহার রীতিমতো বিস্ময় তৈরি করার মতো। ডাচ গোল্ডেন এজের শিল্পীরা ছবিতে আলো আঁধারি তৈরির যে কৌশল ব্যবহার করতেন, ইতালিয়ান ভাষায় তা ‘তেনেব্রোসো’ নামে প্রচলিত, যাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘ড্রামাটিক ইল্যুমিনেশন’। ছবিতে রহস্যের আবহ তৈরির জন্য দৃশ্যের পেছনে অন্ধকারের উপস্থিতি দেখিয়ে আলোর আভাস বোঝানো হতো। ফলে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক ধাঁচের ছবিতে দৃশ্যের প্রয়োজনে অলৌকিকতা বা আকস্মিকতা বোঝানো সহজ হতো।
মজার ঘটনা হচ্ছে, ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও এই ছবিটি কিন্তু রাতের দৃশ্য নিয়ে তৈরি নয়! কালো বার্নিশ দিয়ে দীর্ঘদিন কোটিং থাকার কারণে ভুলভাবে ছবিটিতে রাতের দৃশ্য তৈরি হয়েছে। রেমব্রান্ত ছবিটিতে দিনের দৃশ্যই দেখাতে চেয়েছেন, রাতের নয়। দীর্ঘদিন ছবিটিতে বার্নিশের কোটিং ছিলো। ১৯৪০ এর দশকে এই কোটিং মুছে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়।
অনেকে বলে থাকেন, এই ছবিতে রেমব্রান্তের নিজের প্রতিকৃতির কিছুটা আভাস আছে। ছবিটির একেবারে মাঝখানে সবুজ পোশাক পরা ও লোহার হেলমেট পরা চরিত্রের পেছনে একজন মানুষের অস্পষ্ট আভাস চোখে পড়ে। প্রথম দৃষ্টিতে শুধু এর চোখ ও বেরেট নজরে পড়ে। এই দাবি সত্য হলে বলতে হবে, সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোচিত ছবিতে কৌশলে আত্মপ্রতিকৃতি বা তার আবহ তৈরি করা এত বড় শিল্পীর ছাড়া অন্য কারো পক্ষে অসম্ভব।
ছবিটিতে সোনালী চুলের একটি মেয়ের দৃশ্য আছে। তার কোমরে একটি সাদা রঙের মোরগ বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে দেখা যায়। এছাড়া ‘ক্লোভার’ নামে একধরনের পিস্তলও তার সাথে দেখা যায়। মিলিশিয়া দলের সাথে তাকে দেখা গেলেও মেয়েটি সম্ভবত এর সদস্য ছিলো না। উল্লেখ্য, মিলিশিয়ার ‘ক্লোভার’ পিস্তল বহনকারী দল ‘ক্লোভেনিয়ারস’ নামে পরিচিত ছিলো।
মজার ঘটনা হচ্ছে- ডাচ মিলিশিয়ার এই ‘ক্লোভেনিয়ার’ এর দল তাদের গ্রুপ পোট্রেট তৈরি করতে ৬ জন শিল্পীকে নিযুক্ত করেছিলো। তারা ছিলেন রেমব্রান্ত, বিকেনয়, বেকার, ভ্যান ডার হেলস্ট, ভ্যান স্যান্ড্রার্ট ও ফ্লিংক। প্রত্যেকের দায়িত্ব ছিলো ৬টি আলাদা আলাদা বড় কাঠের প্যানেলে একসারি সিক্যুয়াল ছবি তৈরি করা। প্রতিটি ছবি বিষয়বস্তুর প্রকৃতি হিসেবে একটি আরেকটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে। আসলে ক্লোভেনিয়ার দল চেয়েছিলো তাদের কার্যালয়ের জন্য বেশ ভালো কিছু গ্রুপ পোট্রেট করিয়ে রাখতে। কিন্তু ছবিতে রেমব্রান্তের স্টাইল ও বিষয়বস্তু ধরার কৌশল অন্য সবার থেকে আলাদা ও প্রাণবন্ত ছিলো।
‘নাইট ওয়াচ’ ছবিটি শেষ করার পর রেমব্রান্ত দীর্ঘদিনের জন্য এক বিরতি নেন। আগে ধারণা করা হতো, সিভিক মিলিশিয়া সদস্যদের ছবি আঁকার মূল উদ্যোক্তাদের সাথে রেমব্রান্ত ও অন্য শিল্পীদের বিভিন্ন কারণে মতভেদ হয়ে থাকতে পারে। ফলে তারা ছবির খরচে তাদের দেওয়া অংশ দিতে গড়িমসি করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় দেখা যায়, ক্লোভেনিয়ার সদস্যরা রেমব্রান্তের অভিনব ও অতুলনীয় কাজের জন্য প্রশংসা করেছিলেন। বিরতি নেবার একটি কারণ এটা হতে পারে যে, ক্রমাগত একক ও গ্রুপ পোট্রেট আঁকা থেকে এই শিল্পী কিছুদিনের জন্য একটু দূরে থাকতে চেয়েছিলেন।
ছবিটি আঁকার ৭৩ বছর পর ১৭১৫ সালে এটি আমস্টারডামের টাউন হলে সরিয়ে নেওয়া হয়। দেয়ালে টাঙানোর সময় যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিলো। কেননা, ছবিটি আকারে দেয়ালের চেয়ে বড় হওয়ায় জায়গার অভাব দেখা দিচ্ছিলো! ফলে জায়গা সংকুলানের জন্য ছবিটির ক্যানভাস বেশ কয়েক জায়গায় কেটে ফেলে তবেই স্থান দিতে হয়েছিলো। এর ফলে ছবিটির আকার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেলো। এর উপরের কিছু অংশ, দুই পাশ ও নিচের বেশ কিছু অংশ বাদ গেলো। এমনকি ছবির বামপাশের দুটি চরিত্রও রেহাই পায়নি। পরে গেরিট লুন্ডেনস নামে অন্য একজন শিল্পী এই ছবির একটি অনুলিপি তৈরি করেছিলেন। এতে রেমব্রান্তের আঁকা মূল ছবির পুরো আভাস অল্প করে হলেও পাওয়া যায়।
আমস্টারডামসের আর্ট মিউজিয়ামগুলোর জন্য একসময় অন্যতম ভয়ের বিষয় ছিলো অগ্নিকাণ্ড। দুর্ঘটনার ফলে আগুন লাগায় প্রায়ই এসব মিউজিয়ামে রক্ষিত অমূল্য সব ছবি ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতো। ‘নাইট ওয়াচ’ ছবিটি আমস্টারডামসের ‘রিজকসমিউজিয়াম’ এ আনার পর এর নিরাপত্তার জন্য এক অভিনব পদ্ধতি নেওয়া হয়। ১৯৩৪ সালে মিউজিয়ামে ছবিটির নির্ধারিত স্থানে চোরা দরজার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে আগুন লাগা বা অন্য কোনো রকম দুর্ঘটনার আভাস পাওয়া মাত্রই একে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া যায়।
‘রিজকসমিউজিয়াম’ ১৮৮৫ সালে আমস্টারডামে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম আকর্ষণ ছিলো ‘নাইট ওয়াচ’ ছবিটির প্রদর্শনী। প্রায় ১২০ বছর পর ২০১৩ সালে এই মিউজিয়ামের ডিরেক্টর ঘোষণা করেন, “সব কিছু বদলে গেছে, কিন্তু রেমব্রান্তের ‘নাইট ওয়াচ’ একদম বদলায়নি। রিজকসমিউজিয়ামের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এই ‘নাইট ওয়াচ’, বাকি সব আকর্ষণও একে কেন্দ্র করেই চলছে ও চলবে।”
দুঃখের ঘটনা হচ্ছে, এই কালজয়ী চিত্রকর্মও আক্রান্ত হওয়া থেকে রেহাই পায়নি। ১৯১১ সালের ১৩ জানুয়ারি বেকারত্বের ফলে জন্মানো ক্ষোভ থেকে নৌবাহিনীর একজন চাকরি হারানো সদস্য ছুরি হাতে ছবিটির উপর হামলা চালায়। ১৯৭৫ সালে আরো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। এই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর জনৈক স্কুলশিক্ষক একইভাবে ছুরি হাতে ছবিটি বিধ্বস্ত করে। তার দাবি ছিলো, এই ছবিটি নষ্ট করলে অনেক পুণ্যের কাজ করা হবে! ১৯৯০ সালের ৬ এপ্রিল আরেকজন হামলাকারী ছবিটির উপর এসিড নিক্ষেপ করে! এসব ঘটনার পর ছবিটি রক্ষা করার জন্য সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।
শিল্পরসিকরা বলেন, যিনি দক্ষতা ও উৎসুক মননের সাহায্যে কোন বিশেষ শিল্পকর্ম তৈরি করেন, তিনি আসলে চিরকালের জন্যই তেমন একটি স্বাক্ষর রেখে যান। রেমব্রান্ত ছিলেন এমনই একজন শিল্পী। তার আঁকা অমর চিত্রকর্ম ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ শিল্পের জগতের শ্রেষ্ঠ বিস্ময়ের মধ্যে অন্যতম।
This Bangla article is about 'The Night Watch' which is the ageless artwork of Dutch artist Rembradnt.
References:
01. The Night Watch - Totally History
02. 15 Things You Might Not Know About Rembrandt’s The Night Watch - Mentalfloss
03. Interesting facts about The Night Watch - Just Fun Facts
04. The Night Watch – Rembrandt | [High Res] Painting & Interesting Facts - zzzclan.com