Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আইয়ুব বাচ্চু: গিটার ও গানের নক্ষত্র

শীতকালের ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া। ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি হয়তো। পাটিগণিত এর জটিল সমস্যা নিয়ে আটকে আছি। রাত জেগে অংক করার অভ্যাস। রাতের শুনশান নীরবতায় অংক করার আনন্দ ছিল অন্যরকম। হঠাৎ রাতের নীরবতা ভেঙে একটা গানের সুর কানে এসে বিঁধল। চুপচাপ হয়ে শুনছি, খাতায় কলম আটকে গেল, চিন্তা হয়ে গেল স্থির। সকল মনোযোগ আঁটকে গেল ঐ গানে। শুনছি ‘বুকেরি সব কষ্ট দু’হাতে সরিয়ে…’ অসম্ভব এক ভাল লাগায় মন প্রাণ এক গভীর আচ্ছাদনে ঢেকে গেল। সেই সময়টা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। জানি এই গান শুনে আমার মতো অনুভব আরও অনেকের জীবনে হয়েছে।

আইয়ুব বাচ্চু। Image Source: alchetron.com/Ayub-Bachchu

কিন্তু গানটা তো পেতে হবে যে করেই হোক। কিন্তু গানের গায়কের নাম তো জানিনা। তখন তো এখনকার মতো ইন্টারনেটের এতো সুব্যবস্থা ছিল না যে ‘চাহিবা মাত্র দিতে বাধিত থাকিব’ টাইপের গুগল মামা সদা হাজির। তাই গানের কথা টুকে রেখে দোকানে দোকানে খোঁজা ছাড়া উপায় কি? আর তখন একটা নতুন গান, একটা নতুন অ্যালবাম মানে নতুন উন্মাদনা। সেই প্রশান্তি আজকের দিনে আর কোথায়? গায়কের সাথে শ্রোতার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হতো। গানের কথা শুনে মনে হতো, আরে আমাকে ভেবেই তো এই গান।

খুব সহজেই মিলল অ্যালবাম। আমার কাছে অজানা হলেও গানটি তখন বেশ জনপ্রিয়। সবার মুখে মুখে। গানের দোকানগুলোতেও বাজতে শোনা যাচ্ছে এই গান। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে বাকি নেই, বলছিলাম বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী, যিনি একাধারে গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, প্লেব্যাক শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং আরও অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত ‘আইয়ুব বাচ্চু’র কথা।

আইয়ুব বাচ্চু। Image Source: twitter.com/ababayub

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শহরের এক বনেদী হাজী পরিবারে জন্ম রবিনের (আইয়ুব বাচ্চুর ডাক নাম)। সঙ্গীত চর্চার জন্য খুব একটা অনুকূল পরিবেশ যে তিনি পেয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই সংসারে থেকেও বোহেমিয়ান রবিন। বাউন্ডুলে স্বভাবের জন্য সংসারের কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারছিল না তাকে।

ঘরের সকলেই খুব ভালভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিন্তু রবিনের মন বলে অন্য কথা। তার মনে বাজে যেন অন্য সুর। নয়টা-পাঁচটা চাকরি করার পেছনে ছোটার জন্য যেন জন্ম হয়নি রবিনের। অন্যকিছু যেন অপেক্ষা করছে তার জন্যে। কিন্তু এতো সহজ ছিল না সেই পথ চলা। জোয়ারের বিপরীতে দ্বার টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহস এবং সামর্থ্য সকলের থাকে না। কিন্তু রবিন থেমে থাকার পাত্র নয়। তাকে যে জীবনের দুর্গম পথটিই বেছে নিতে হবে। সংসারের সবার কাছে ছেলে গোল্লায় গেছে শুনতে শুনতে প্রায় অতিষ্ট রবিন। এমন সময় একদিন টিভিতে গানের একটি প্রোগ্রামে দেখলেন পপ সম্রাট আজম খানকে।

পপ সম্রাট আজম খান। Image Source: beherenow.com.bd/article/artist-bio-azam-khan-the-legend

অনেক আগে থেকেই আজম খানের ভক্ত রবিন। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন পপ সম্রাটের গান। পাশে ঝাঁকড়া চুলে বোতাম খোলা শার্টে একজন গিটার বাজাচ্ছেন অসাধারণ দক্ষতায়। সেই প্রথম পরিচয় গিটারে দক্ষ হাতের খেলা। হবেই না বা কেন? বাজাচ্ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী গিটারিস্ট ‘নয়ন মুন্সি’। এই লোকটি বাংলাদেশের গিটার জগতে এক অনন্য নাম। সে সময়কার অনেক পরিচিত গান, যেমন- এই নীল মনিহার, মন শুধু মন ছুঁয়েছে, মেলায় যাই রে, আবার এলো যে সন্ধ্যা প্রভৃতি কালজয়ী গানের গিটারিস্ট তিনি। তার এই অনবদ্য বাজনা শুনে রবিন ঠিক করে ফেললেন, জীবনে আর কিছু চান না, শুধু এমন অসাধারণভাবে গিটার বাজাতে চান। সেই থেকেই গিটারের পিছে ছোটা, যা আজও শেষ হয়নি।

নয়ন মুন্সি। Image Source: amarblog.com

শুরুটা ছিল সেই সময়কার আরেকজন গুণী গীটারিস্ট রুডি থমাসের হাত ধরে, যদিও গুরুমুখী বিদ্যার চাইতে স্ব-শিক্ষার্থীই ছিলেন বেশি। তবুও হাতে খড়িটা বেশ পোক্ত হাতেই হয়েছিল বলা চলে। কারণ রুডি থমাস ছিলেন তখন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’-এর অন্যতম সদস্য, আবার ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা। তার হাত ধরে ১৯৭৮ সালে ফিলিংসে যোগ দেন আইয়ুব বাচ্চু। ইংরেজি গানের কভার করার প্রবণতায় সেই সময় বেশি ছিল। প্রায় দু’বছরের মতো কাজ করার পর ১৯৮০ সালের দিকে পারস্পরিক মনোমালিন্যে ভেঙে যায় ফিলিংস। বেকার হয়ে পড়লেও কখনো মনোবল হারাননি তিনি। জানতেন একদিন ঠিকই তার গুণের কদর হবে। খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। ডাক পেয়ে গেলেন রুডি থমাসের কাছ থেকেই সোলসে যোগ দেয়ার জন্যে।

সোলসের প্রথম দিকের সদস্যরা। Image Source: soulsbd.com/

সোলস সেই সময় বাংলাদেশের সঙ্গীত জগত কাঁপানো ব্যান্ড দল। ‘না’ বলার তো প্রশ্নই আসে না।  সাজেদ, নেওয়ামজ, লুলু, নকিব খান, পিলু সকলেই খুব সহজেই কাছের করে নিয়েছিল চট্টগ্রামের এই গুণী গিটারিস্টকে। প্রায় দশটি বছর পার করেছিলেন এই শক্তিশালী ব্যান্ড দলটির সাথে। এই দশটি বছর আইয়ুব বাচ্চুর জীবনেও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ১৯৮৬ সালের দিকে আইয়ুব বাচ্চু ‘রক্তগোলাপ’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেন। এর ঠিক দুই বছর পর ১৯৮৮-১৯৮৯ এর দিকে ‘ময়না’ নামে আরেকটি অ্যালবাম বের করেন যেটি অডিও জগতে খুব সাড়া ফেলে। শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা ‘হারানো বিকেলের গল্প’ গানটিতে আইয়ুব বাচ্চু প্রথম কণ্ঠ দেন। এই লোকটির কাছ থেকেই পরবর্তীতে ‘একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘সময় যেন কাটে না’, ‘ভালোবাসি ঐ সবুজের মেলা’, ‘হৃদয় কাঁদামাটির কোনো মূর্তি নয়’, ‘চায়ের কাপে পরিচয়’, ‘দখিনা হাওয়ায় ঐ তোমার চুলে’ ‘যতিন স্যারের ক্লাসে’র মতো অসাধারণ সব গানের কথা আমরা পাই।

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। Image Source: kalerkantho.com

সোলসের সাথে দশ বছর কাটানোর পর মনে হঠাৎ যেন কিছু না পাওয়ার আকুতি। সঙ্গীত জগতে নিজের কাজের কিছু ছাপ রেখে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা। সোলস তখন মেলোডি ধাচের গান তৈরিতে অনেক বেশি অভ্যস্ত। কিন্তু দুরন্ত ছেলেটির মনে বাজছে রক, পাওয়ার আর নতুন কিছু করার নিরন্তর প্রচেষ্টা। তাই সোলস ত্যাগ করে ১৯৯০ সালের ৫ই এপ্রিল নিজের ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করলেন আইয়ুব বাচ্চু, যার নাম রাখলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘লাভ রান্‌স ব্লাইন্ড’। সেই বছরই এল.আর.বি. তাদের যাত্রা শুরু করে একটি ডাবল এলবাম দিয়ে যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ডাবল এলবাম। এল.আর.বি’র প্রথম এই ডাবলসটি বের হয়েছিল মাধবী এবং হকার নামে। এই অ্যালবাম দুটোর বেশ কিছু গান খুব জনপ্রিয় হয় যা আজও আমাদের কানে বাজে।

এল.আর.বি’র বর্তমান লাইনআপ। Image Source: archive.dhakatribune.com

১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অবিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়, বিশেষ করে কষ্ট কাকে বলে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, অবাক হৃদয়, আমিও মানুষ। তিনি অনেক বাংলা ছবিতে প্লে ব্যাক করেছেন। ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তাঁর গাওয়া প্রথম সিনেমার গান। ব্যাচেলর মুভিতে ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’ গানটিও শ্রোতা মনে বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।

গীটার হাতে আইয়ুব বাচ্চু। Image Source: alchetron.com

একবার কলকাতার যাদবপুরে বাজাতে গিয়ে এক মজার ঘটনার সম্মুখীন হন আইয়ুব বাচ্চু। একটা পোস্টারে দেখতে পান যে, দেশের অনেক নবাগত ব্যান্ডদলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতা হচ্ছে। খেলার ছলে নিজেদের নাম দিয়ে বসলেন আইয়ুব বাচ্চু। পরে প্রতিযোগিতার কর্ণধারেরা যাদবপুরে তাদের কনসার্ট শুনতে গেল। শুনে তাদের বাজনায় এতোই মুগ্ধ হলেন যে প্রতিযোগীর আসন থেকে সরিয়ে বিচারকের আসনে তুলে দিলেন।

গিটারের কথা আসলে আইয়ুব বাচ্চু এক অনন্য নাম। আমাদের পাশের দেশ ভারতের অনেক খ্যাতনামা গায়ক এবং সুরকার তাকে  এক বাক্যে আইডল মানেন। জিমি হেন্ড্রিক্স, জিম্মি পেজ, রিচি ব্ল্যাকমোর এবং জো স্যাট্রিয়ানীর বাজনায় তিনি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত। আইয়ুব বাচ্চুর নিজের একটি স্টুডিও আছে। ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম এবি কিচেন। সঙ্গীতে আরও নতুন নতুন শিল্পী গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার এই পদক্ষেপ।

AB Kitchen Image Source: ablrb.net

বাংলাদেশের আরেকজন বিখ্যাত গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ তার ছোটবেলার বন্ধু। জীবনে চলার পথে গান নিয়ে অনেক কিছু শেয়ার করে আসছেন। আমাদের আরেক সুপরিচিত মুখ পার্থ বড়ুয়া, আইয়ুব বাচ্চুর সরাসরি ছাত্র। তিনিই প্রথম পার্থকে সোলসে নিয়ে আসেন।তপন চৌধুরীর অনেক গানে তিনি কাজ করেছেন। হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, নাসিম আলি খান, আলাম আরা মিনু সহ আরো অনেক সুপরিচিত শিল্পীর সাথে সুরকার, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

আইয়ুব বাচ্চুর সাথে জুয়েল। Image Source: thedailynewnation.com

আইয়ুব বাচ্চু মিউজিককে বরাবরই পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। টানা ৩০ মিনিট গিটার বাজিয়ে ৩০ টাকা প্রথম আয়ের কথাও তাই কখনো ভুলতে পারেন না। আজকের দিনের হিসেবে হয়তো কিছু নয়, কিন্তু প্রথম আয়ের আনন্দ কিছু তো অন্যরকম বটেই। এখন পর্যন্ত দেশে বিদেশে অনেকগুলো কনসার্ট করেছেন তিনি। দেশের বাইরেও সমানভাবে সম্মানিত হয়ে আসছেন এই অনবদ্য গিটারিস্ট। ছেলে আহানাফের সাথে একই স্টেজে বাজানোকে জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে দেখেন এই লিজেন্ড।

তথ্যসূত্র

  1. bn.wikipedia.org/আইয়ুব বাচ্চু
  2. en.wikipedia.org/wiki/Ayub_Bachchu
  3. biographybd.com/ayub-bachchu/
  4. youtube.com/watch?v=UKm0sxCZF4M

Related Articles