Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়: তরুণ সিদ্ধার্থ আপোস করেনি বয়সকালেও

ধৃতিমান চ্যাটার্জী নামে তাকে বেশি চেনা গেলেও তার প্রকৃত নাম সুন্দর চ্যাটার্জী। বয়স যত বাড়ছে, তার অভিনয়ে দৃঢ়তার প্রকাশ আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার দক্ষতা দিন দিন বেড়েই গেছে, কমেনি এতটুকুও জৌলুশ। শুরুটা হয়েছিলো ১৯৭০ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ থেকে। চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো এক তরুণ যুবা, হতাশার সাথে সে নিত্য অভ্যস্ত। তবু চাকরির ভাইভা বোর্ডে গিয়ে সে নিজের চিন্তা-ভাবনা বা মতাদর্শের সাথে আপোস করতে পারে না। ভেতরে ভেতরে কিছুটা চাপা আগুনের দেখা মিললেও তার কখনো বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। তার চোখেমুখে চাপা ক্ষোভ সবসময়ই লক্ষ্য করা যায়। ধৃতিমানের মুখাবয়বের যে প্রয়োজনীয় কাঠিন্য, তা যেন চরিত্রটির জন্য পুরোপুরি মানানসই ছিল। প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একটা সময় এমন আসে, যখন ব্যক্তি আর অবাক হয় না, সেই অভ্যস্ততাটি তিনি অনেক সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার চেহারায় ও চলনে। এই সিনেমার চাকরির সাক্ষাৎকারের দৃশ্যটি অনেক বিখ্যাত।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দিয়েই শুরুটা হয়েছিল; Source: jabberwock.com

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থিয়েটারের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং তার পরবর্তী অভিনয়জীবনের জন্যও তিনি সেই নির্দিষ্ট সময়ের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। সেসময় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছেন ধৃতিমান। তার পিতার ছবি তোলার শখ ছিল এবং তার বেশ কিছু ক্যামেরাও ছিল। সে থেকেই যেন ক্যামেরার প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ কাজ করতো ধৃতিমানের।

৪/৫ বছর বয়সের সময় একবার এক পূর্ণিমায় বাবার সাথে তাজমহলের ছবি তোলার সময় তিনিও ছিলেন, পিতামাতা দুজনেই ছিলেন ফিল্ম সোসাইটির সদস্য। তার মতে, তখন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের সংস্কৃতির সাথে সিনেমার সম্পর্ক ঠিক সাহিত্যের মতোই ছিল। তাই সিনেমার সাথে জড়িয়ে পড়া খুব একটা কাকতালীয় ছিল না তার জন্য। কলকাতায় এমন একটা পরিবেশের মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠেছেন, যার মধ্য থেকে তার মধ্যে সিনেমা খুব শক্তিশালী অস্তিত্বের ভূমিকা পালন করেছে।

তার মতে, একজন অভিনেতার একটি সিনেমায় শুধু পরিচালকের মতে হুবহু চলাই নয়, নিজস্বও অনেক সৃজনশীল অবদান থাকে। সিনেমার স্ক্রিপ্টের পরও অনেক কিছু থেকে যায়, যাতে শুধুই অভিনেতাকে ভূমিকা নিতে হয়।

রাজনীতি নিয়ে তার ভাবনায় নেই কোনো সীমাবদ্ধতা। রাজনীতি তার মতে কোনো গোষ্ঠীবিশেষের সম্পত্তি কিংবা সীমানা নয়, বরং আমাদের সমগ্র জীবনই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত- এই বিশ্বাসই রাখেন তিনি। বাংলা থেকে শুরু করে হিন্দি, ইংরেজি, সিংহলি ভাষাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

সত্যজিৎ রায় ও শর্মিলা ঠাকুরের সাথে ধৃতিমান (মাঝখানে); Source: jabberwock.com

তিনি অভিনয় করেছেন হলিউডের সিনেমাতেও। ‘হলি স্মোক’ সিনেমায় তাকে দেখা যায় অভিনেত্রী কেট উইন্সলেটের সাথে। এদিকে টালিউডের সাথে বলিউডে তার দৃপ্ত পদচারণা তো রয়েছেই। বলিউডে করা তার প্রথম সিনেমা ‘ব্ল্যাক’, এতে মিশেলের পিতার চরিত্রে তার দৃঢ় অভিনয় সিনেমাটিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। এছাড়াও বলিউডে তাকে দেখা গিয়েছে ‘কাহানি’, ‘এজেন্ট বিনোদ’, ‘পিংক’ সিনেমায়। কমেডি সিনেমায় অভিনয়ের ইচ্ছা থাকলেও হয়ে ওঠেনি, এজন্য মুন্সিয়ানার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কাজের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতাই তার প্রথম পছন্দ ও স্বভাব। কখনো নিজেকে একটি ক্ষেত্রে আটকে রাখেননি তিনি। বিজ্ঞাপন, অভিনয়, চলচ্চিত্র নির্মাণ, শখের ফটোগ্রাফি- সবকিছুতেই মেতে থাকতে ভালোবাসেন ধৃতিমান। তার স্ত্রী চেন্নাইয়ের মেয়ে, ধৃতিমানের সবচেয়ে বড় সমালোচক তিনিই।

সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রেই তার দৃপ্ত পদচারণা; Source: gramunion.com

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি কলকাতার অল ইন্ডিয়া রেডিওর খণ্ডকালীন ঘোষক হিসেবে কাজ করেন। পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের সাথে যুক্ত হন ধৃতিমান। বর্তমানে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জুরির একজন সদস্য তিনি।

ব্যক্তিজীবনে তাকে দেখা যায় বিদ্যমান ব্যবস্থার একজন কঠোর সমালোচক হিসেবে। তিনি কখনো বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার প্রতি ঝোঁকেননি, বাণিজ্যিক সিনেমার জগতে তার স্থান কখনোই হবে না বলেই তিনি মনে করেছেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সবসময় নিজের পছন্দকে স্থান দিয়েছেন তিনি, প্রয়োজনকে নয়। তাই সমান্তরাল ধারার সিনেমাতেই তার দৃপ্ত পদচারণা লক্ষ্য করা যায়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে অভিনয় করবার কিছুদিন পর মৃণাল সেন তাকে তার ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমায় নেবেন কিনা ভেবেছিলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থের চরিত্রের পর নিম্ন মধ্যবিত্ত একটি চরিত্রে তাকে দর্শক সেভাবে গ্রহণ করতে পারবে না বলেই পরিচালক শেষমেশ তাকে নিলেন না, কিন্তু পরে তার জন্য মানানসই কোনো চরিত্র এলে তাকে নেবেন বলে ঠিক করলেন।

পদাতিক সিনেমার পরিকল্পনা হাতে নেবার পর মৃণাল সেন মূল চরিত্রে ধৃতিমানকে নিলেন। বেশ কয়েক বছর পর শুরু হলো ‘আকালের সন্ধানে’ সিনেমার কাজ। ধৃতিমানের মতে, এটিই তার এত বছরের ক্যারিয়ারে একমাত্র সিনেমা, যার মূল চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য তিনি নিজে পরিচালককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এই সিনেমার মূল চরিত্র অর্থাৎ পরিচালকের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন, সাথে ছিলেন স্মিতা পাতিল।

এবার সত্যজিতের শঙ্কু হতে যাচ্ছেন ধৃতিমান; Source: ebela.com

অভিনয়ের চেয়ে সিনেমা বানানোর প্রতি তার ঝোঁক অনেক বেশি ছিল সবসময়ই। এমনকি সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের সাথে তিনি কাজ করতেন অভিনয়ের জন্য নয়, তাদের পরিচালনার কাজ কাছ থেকে দেখবার জন্য। ধৃতিমান নিজেকে ক্যামেরার পেছনের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন, সেইসাথে ডকুমেন্টারি ফিল্মও। মূল আয়টা তার অভিনয় থেকে নয়, বিজ্ঞাপন থেকেই এসেছে, তাই তার প্রথম পেশা সবসময় বিজ্ঞাপনের কাজটাই মনে করেন তিনি। অভিনয়ে অসামান্য পারদর্শিতা তাকে দিয়েছে দক্ষ অভিনেতার তকমা। এবং এখনও তিনি থেমে নেই। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘নকশাল’ সিনেমায় তাকে দেখা যায় বেশ নেতিবাচক ও শক্তিশালী একটি চরিত্রে।

অপর্ণা সেনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব, একসাথে পড়াশোনাও করেছেন। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ এও ধৃতিমান অভিনয় করেন। নিজের চেয়ে অনেক কমবয়সী অভিনেত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ দৃশ্যে অভিনয় করতে প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও দক্ষতার জোরে তিনি সে যাত্রাও ভালোমতেই উতরে যান।

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ধৃতিমান অভিনীত ‘চিত্রকর’। চিত্রশিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জীবনকাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে তার সাথে অভিনয় করেছেন অর্পিতা চ্যাটার্জী। এখানে শিল্পের আধুনিকতা ও প্রাচীনত্বের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব উঠে আসবে। এরকম চরিত্রে আগে কখনো অভিনয় করা হয়নি তার।

অর্পিতা চ্যাটার্জীর সাথে ‘চিত্রকর’ সিনেমার একটি দৃশ্যে; Source: iffk.in

সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে অভিনয়ের বদৌলতেই বেশ ঘনিষ্ঠতা তার। সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ধৃতিমানকে দেখা যাবে প্রফেসর শঙ্কুর চরিত্রে। সত্যজিতের সৃষ্টি করা অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র এটি। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৮ সালের শেষের দিকে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের প্রযোজনায় ‘প্রফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো’ সিনেমাটি মুক্তি পেতে যাচ্ছে। সন্দীপের ভাষ্যমতে,

‘‘প্রফেসর শঙ্কু আমার বরাবরের ফেভারিট চরিত্র। এই সায়েন্স ফিকশনটা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ করতে চেয়েছি। অবশেষে সেটা সম্ভব হল। এই মুহূর্তে এটা তৈরি করা কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ। আর শঙ্কুর চরিত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ছাড়া কারও কথা ভাবিনি।’’

‘সরীসৃপ’ সিনেমায় তার চরিত্র ছড়িয়েছিল রহস্য ও অন্ধকারের বেড়াজাল, ‘পদাতিক’ এ এসে দলছুট হবার ভয়, ‘চিত্রকর’ এ অন্ধ শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টির মোহগ্রস্ততা, সবসময় ঝুঁকি নিতেই পছন্দ করেন ধৃতিমান, চ্যালেঞ্জিং কিছু না হলে কাজ করার আনন্দ পান না তেমন করে। এজন্য তার কমফোর্ট জোন বলতে কিছু নেই। বরং কতটা নিজেকে ভেঙে গড়া যায়, সে ভাবনাই তার মধ্যে প্রবল।

ফিচার ইমেজ: fragmenteyes.blogpspot.com

Related Articles