Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফাহমো উৎসব: যেখানে পাথর ডিঙিয়ে প্রমাণ করতে হয় বিয়ের বয়স

প্রায় ১৮,০০০ দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি দেশ ইন্দোনেশিয়া, তার মধ্যে ছোট্ট একটি দ্বীপের নাম ‘নিয়াস’। এই নিয়াস দ্বীপের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। মূলত এটি একটি আদিবাসী দ্বীপ। এখানে তারা যুগের পর যুগ বসবাস করে আসছে। তবে এখনো তারা ধরে রেখেছে তাদের বিভিন্ন আদিম প্রথা ও সংস্কৃতি। সময়ের প্রেক্ষাপটে তাদের সেসব প্রথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে রহস্যময় ও চমকপ্রদ। আর তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ফাহমো উৎসব’।

দ্বীপের নামানুসারে এখানকার অধিবাসীদের নামও ‘নিয়াস’। নিয়াস জনগোষ্ঠীর আদি উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না। তবে প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে এখানে ‘নিহা’ নামক জনগোষ্ঠীর বসবাস শুরু হয়, অনেকের ধারণা তখন থেকেই এখানে মানুষের স্থায়ী বসবাস শুরু হয়। আবার অনেকের ধারণা যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্ব থেকেই এই দ্বীপে মানুষ বসবাস করে আসছে। তাদের মতে, প্রায় ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হোভিন্ড অঞ্চল থেকে অস্টোমেল্যান্সড নামক একটি জাতি নিয়াস দ্বীপে এসে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে তাদের সাথে তাইওয়ান, চীন সহ আরও বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এসে বসবাস শুরু করে। একপর্যায়ে তারা সবাই নিয়াস জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় ধারণ করে এক জাতিতে পরিণত হয়।

নিয়াস দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া; image source: Wikimedia Commons

১৯৯৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব আরিলাংগা এবং স্থানীয় নিয়াস জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে একটি সুপ্রাচীন গুহায় গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় দেখা যায়, নিয়াসের অস্তিত্ব প্রায় ১২,০০০ বছরের পুরাতন। এই গবেষণার আলামতে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ আরও দেখতে পান যে, প্রায় ৭০০ বছর আগে নিয়াস দ্বীপের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুটি পরস্পরবিরোধী মতামত তৈরি হয়। একদল মনে করে প্রায় ১২,০০০ বছর পূর্বে নিয়াস দ্বীপের উৎপত্তি ঘটেছে, আরেকদল তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, মাত্র ৭০০ বছর পূর্বে নিয়াস দ্বীপের উৎপত্তি ঘটেছে। তবে এর সমন্বয় করতে গিয়ে অন্য একদল গবেষক বলেন, নিয়াস দ্বীপ প্রায় ১২,০০০ বছর পূর্বে উৎপত্তি হলেও প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে তা একবার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর তা পুনর্গঠিত হলে বর্তমান নিয়াস জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে।

দ্বীপের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে স্থাপিত নিয়াস জাদুঘর; image source : museum-nias.org

নিয়াস দ্বীপটি সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৫,১২১ বর্গ কিলোমিটার। প্রধান দ্বীপের সাথে আরও কিছু ছোট ছোট দ্বীপ সংযুক্ত রয়েছে। নিয়াসের বেশিরভাগই নিম্নভূমি এলাকা, যা প্রায় ৮০০ মিটার পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালের আদমশুমারির রিপোর্ট অনুসারে দ্বীপটিতে প্রায় ৭৫৬,৩৩৮ জন বাসিন্দা রয়েছে।

দ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় নিয়াস জনগোষ্ঠীর প্রধান সম্পদ সমুদ্র। সমুদ্রকে ঘিরে প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছে তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি। বাণিজ্যের সূত্র ধরে বিভিন্ন সময়ে নিয়াস দ্বীপে আগমন ঘটেছে বিভিন্ন পরাশক্তির বণিকদের। তাদের মাধ্যমে নিয়াসবাসী প্রভাবিতও হয়েছে নানাভাবে। বিশেষত নিয়াসে চীন ও আরব বণিকদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি ছিল।

নিয়াসের লাগুন্দ্রি সমুদ্র সৈকত; image source : indonesia-tourism.com

দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে সমুদ্র সৈকত। প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে নিয়াস দ্বীপে সমুদ্র উদযাপন করতে বিপুল সংখ্যক ভ্রমণ পিপাসু মানুষের আগমন ঘটে। কিন্তু সমুদ্র সৈকত তো বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আছে; ফলে অনেকেই নিয়াসে এমন কিছুর অনুসন্ধান করেন যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। আর তা হচ্ছে নিয়াস জনগোষ্ঠীর নিজস্ব প্রথা ও ঐতিহ্য। নিয়াসদের পোশাক, খাদ্য, প্রার্থনাসহ নানা কিছুই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী উপাদান হচ্ছে ‘ফাহমো উৎসব’।

ফাহমো উৎসবের একটি দৃশ্য; image source : Wikimedia Commons

‘ফাহমো’ মূলত একটি ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের নাম। এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে নিজের সাবালকত্ব তথা বিয়ের বয়স প্রমাণ করতে হয়। যারা এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পারেন তারা জীবনের সকল ঝড়-বাধা অতিক্রম করতে পারবেন বলে মনে করা হয়।

প্রতিবছরের মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অলিম্পিক গেমস বা এশিয়া গেমসের মতো প্রতিযোগিতায় আমরা যেমন দেখে থাকি একজন অ্যাথলেটকে ছোট সময় থেকে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে জটিল জটিল প্রতিযোগিতার জন্য উপযোগী করে তোলা হয়, ঠিক তেমনি নিয়াস আদিবাসীরা তাদের ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘ফাহমো’ প্রতিযোগিতার জন্য যোগ্য করে তুলতে থাকেন। যখন পরিবার পরিজন বা গুরু তার সন্তান বা শিষ্যকে উপযুক্ত মনে করেন, তখন তাকে বীরত্ব প্রদর্শনের লড়াইয়ে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন।

পাথর অতিক্রমের একটি দৃশ্য; image source : babadjawa.com

মজার ব্যাপার হলো, প্রতিবছর কোন কোন যুবক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারলো আর কোন কোন যুবক প্রতিযোগিতায় নিজেকে উৎরে নিতে পারল তা নিয়ে সারা বছর দ্বীপব্যাপী ব্যাপক গুঞ্জন চলতে থাকে, কারণ যারা উৎরে গেল তারাই শুধুমাত্র সাবালক; তারা বিয়ে করার উপযুক্ত। ফলে উৎসবের পর সবার নজর থাকে প্রমাণিত সাবালকদের বিয়ের দিকে। কন্যাদের পরিবারগুলো নতুন বীরদের বরণ করে নিতে চান নিজেদের কন্যা দানের মাধ্যমে। আবার কোনো কন্যা যদি কোনো যুবকের প্রেমে পড়েন আর তিনি ‘ফাহমো’ উৎসবে নিজের বীরত্ব প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে উভয়ের জন্য নেমে আসে গভীর শোক ও অপেক্ষা।

নিয়াস উপজাতীরা তাদের এই ঐতিহাসিক প্রথা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চান না। তারা মনে করেন, এটা তাদের বীরত্বের প্রমাণ বহন করে। জানা যায়, সমুদ্র উপকূলে বাস করার কারণে প্রাচীনকাল থেকেই তারা নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন বাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। এমন বাস্তবতায় তারা এমন অভিনব প্রতিযোগিতার প্রথা গড়ে তুলেছে।

পাথর অতিক্রম করছেন একজন প্রতিযোগী;  image source : Pinterest

প্রতিযোগিতার জন্য প্রায় ২ ফুট উঁচু একটি পাথরের স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়; অবস্থাভেদে এটির উচ্চতা সর্বনিম্ন ১.৮ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ২.২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকেন তার প্রশিক্ষক এবং উৎসবের বিচারক। বিচারকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়া হয়। প্রতিযোগিতা উপভোগের জন্য ভিড় জমান প্রচুর সংখ্যক মানুষ। প্রতিযোগিতাটি ‘উচ্চ লম্ফে’র সদৃশ হলেও এই লাফের বিশেষ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। লাফ দিতে হয় তলোয়ার চালানোর মতো ভঙ্গি করে, অর্থাৎ কোনো যোদ্ধা যখন যুদ্ধরত থাকেন তখন তার এক হাতে ঢাল থাকে এবং অপর হাতে তলোয়ার থাকে। ঢাল দিয়ে প্রতিপক্ষের হামলা নিবারণ করে তিনি লাফ দিয়ে উপর দিক থেকে প্রতিপক্ষের উপরে তলোয়ার পরিচালনা করেন। এ সময়ে তার দেহের একটি বিশেষ ভঙ্গি তৈরি হয় (ছবিতে দ্রষ্টব্য)। এই পদ্ধতি আমাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষদের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

১৯১৫ সালে নিয়াস দ্বীপের একটি মেগালিথ পাথর সংরক্ষণ করছে সেখানকার অধিবাসীরা; image source : Wikimedia Commons
উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ধরণের পোশাক;  image source : suaranusantara.com

পাথরের ঠিক পূর্বে অর্থাৎ লাফ দেয়ার জন্য সর্বশেষ যেখানে পা ফেলে দম নিয়ে উঁচুতে উঠতে হয়, সেখানে একটি ছোট পাথর বসানো থাকে এবং পাথর ডিঙিয়ে যেখানে প্রতিযোগী আছড়ে পড়েন সে জায়গাটি বালু দিয়ে নিরাপদভাবে তৈরি করা হয়। প্রত্যেক প্রতিযোগী এ সময়ে বিশেষ ধরনের পোশাক পরেন। মাথায় একটি সোনালি রঙের ক্যাপ এবং গায়ে ফতুয়া সদৃশ একটি পোশাক পরিধান করতে হয়। এ সময়ে যুবতী মেয়েরাও বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করে প্রতিযোগিতা দেখতে আসেন। 

স্বভাবতই পাথরের উপর দিয়ে লাফ দেয়া অত্যন্ত বিপদজ্জনক কাজ। উৎরে না যেতে পারলে গুরুতর আহত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তবে এখানকার যুবকেরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, দুর্ঘটনা খুব কমই ঘটে। ১৮-২০ বছরের যুবকরা অনায়াসে এই উচ্চতা ডিঙিয়ে যেতে পারেন। 

শিশুদের পাথর ডিঙানোর অনুশীলন; image source : Getty Images

এই উৎসবের পরিচিতি আগেকার দিনে শুধু নিয়াস দ্বীপে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা সমগ্র ইন্দোনেশিয়ায় খুবই পরিচিত। এর কারণ হচ্ছে দেশটির ১,০০০ রুপিয়াহর নোটে এই উৎসবের একটি ছবি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এই উৎসব পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যও খুব কার্যকর। ফলে ফাহামো উৎসবের নির্দিষ্ট সময়ের পাশাপাশি বছরের অন্যান্য সময়েও দর্শনার্থীদের প্রদর্শনের জন্য এই প্রতিযোগিতার প্রতীকী আয়োজন করা হয়ে থাকে। এভাবেই নিয়াস জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে তা এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত করে তুলেছে। পাশাপাশি এটি একটি আয়ের উৎসেও পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক নিয়াস দ্বীপে ভ্রমণ করতে যান। আর তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ফাহমো উৎসব বা পাথর লম্ফ।

ইন্দোনেশিয়ার ১,০০০ টাকার নোটে ফাহমো উৎসবের দৃশ্য; image source : Wikimedia Commons

ফিচার ইমেজ: ONTripers

Related Articles